উম্মতের আলেমগণের আবশ্যিক কর্তব্য
হযরত মাওলানা মুফতী আবদুস সালাম চাটগামী দা.বা.
হযরত মাওলানা মুফতী আবদুস সালাম চাটগামী দা.বা.
ইসলামের গণ্ডি সংরক্ষণ এবং পাহারা দেওয়া এ উম্মতের শরীয়তপন্থী আলেমদের আবশ্যিক দায়িত্ব। যেমন- ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্র নায়কদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানা পাহারা দেওয়া। ঠিক এভাবেই এ উম্মতের শরীয়তের প্রাজ্ঞ আলেমদের জন্য জরুরী, তাঁরা ইসলামী আইন-কানুন এবং তাঁর সীমা বর্ণনা করবেন এবং বিধিবিধান প্রয়োগ করার দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে সমর্পণ করবেন। তারপর রাষ্ট্রে সামগ্রীকভাবে ইসলামী বিধিবিধান জারি করে এবং ব্যক্তিগত ইসলামী বিধিবিধানের ব্যপারে সাধারণ লোকজনকে আমলের উপর অটুট থাকার দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। উদ্দেশ্য হল, ইসলামী বিধিবিধানের সীমানা হিফাযত করা, আর এটা এ উম্মতের আলেমদের দায়িত্ব। যদি রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ সীমান্ত হিফাযত করা শাসকদের জন্য জরুরী হয়, তবে ইসলামী আইন-কানুন এবং ইসলামী বিধিবিধানের সংরক্ষণ এবং তার দেখাশোনা করা উম্মতের আলেমদের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ এবং আবশ্যিক কাজ।
সুতরাং যদি কোন দল নিজ দায়িত্বে ত্রুটি করে, টালবাহানার মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে, তবে তাঁরা আল্লাহর নিকট বড়ই অপরাধী হবে। যেমনভাবে ব্যক্তিগত বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রে অলসতা করা ফিসক এবং বড় ধরনের অপরাধ। আল্লাহর কোন বিধান অস্বীকার করা কুফর, দুনিয়ায় যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আর পরকালে চিরস্থায়ী জাহান্নাম। এমনিভাবে যেসব বিধান ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত তার বাস্তব প্রয়োগ না করা সবচেয়ে বড় ফিসক, অর্থাৎ বড় নাফরমানী ও কুফর। এর মধ্যে থেকে কোন শরয়ী বিধান প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করা আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করা এবং ইসলামী বিধিবিধানের বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল। যা অমার্জনীয় অপরাধ। আল্লাহ আমাদেরকে এবং সব মুসলমানকে এসব অপরাধ থেকে মুক্ত রাখুন।
কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াত নিয়ে গবেষণা করুন এবং নিজের দ্বীন ইসলাম এবং ঈমানের ব্যাপারে জরিপ চালান। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“সুতরাং তোমার প্রতিপালকের শপথ, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাঁদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায় বিচারক বলে মনে করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন প্রকার সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হ্রষ্টচিত্তে কবুল করে নিবে।”-(সূরা নিসা-৬৫)
উপরোক্ত আয়াত দ্বারা জ্ঞাত হওয়া গেল যে, কুরআন-হাদীস অনুযায়ী মীমাংসা করা এবং তা হ্রষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া ব্যতীত কোন ঈমানদারের ঈমান সঠিক হয় না। সুতরাং বিচারকদের কুরআন-হাদীস অনুযায়ী মীমাংসা করা ফরয অর্থাৎ জরুরী। আর মীমাংসা গ্রহণকারীদের ঐ মীমাংসা সন্তষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া ফরয তথা আবশ্যিক। অন্যথায় মুমিন হিসেবে বিবেচিত হবে না।আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
“নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি। যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হ্রদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না।”-(সূরা নিসা-১০৫)
অর্থাৎ- আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা সঠিক এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আল্লাহর কিতাবের আলোকে নবী ও তাঁর প্রতিনিধিগণ এবং শাসকবর্গ মীমাংসা করবেন। আর কোন প্রতারক এবং প্রবঞ্চক মুনাফিকের কথার মারপ্যাচে পড়ে তাদের সাহায্যকারী হবেন না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
“আর আমি আদেশ করছি যে, আপনি তাঁদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তদানুযায়ী ফায়সালা করুন, তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন। যেন তারা আপনাকে এমন কোন নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। অনন্তর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে নিন, আল্লাহ তাঁদেরকে তাদের গুনাহের শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। মানুষের মধ্যে অনেকেই নাফরমান।”-(সূরা মায়েদাহ-৪৯)
অর্থাৎ-সমস্ত মুসলমানের এটাই সরল পথ যে সর্বদা কুরআন-হাদীস অনুযায়ী বিধিবিধান প্রয়োগ করে এবং তদানুযায়ী আমল করে, আর কারোর কোন রকম অভিলাষ কামনা-বাসনার খেয়াল না করা। মুসলমানদের শাসকবর্গ অথবা বিচারকমন্ডলী যারা এরুপ কাজকর্মের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা যদি এরকম করেন, তাহলে অমান্যকারীরা তাদের সঠিক রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে এবং পথভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে।সুতরাং মুসলিম শাসকবর্গ এবং তত্বাবধায়কদের সবসময় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরী যে, তারা কিতাব ও সুন্নাহ অনুসারে বিচার কার্য মীমাংসা করবেন এবং ইসলামের বিধিবিধান বাস্তবায়ন করবেন। যদি প্রজাসাধারণ বা অধীনস্তরা তাদের আদেশ না মানে, তবে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন। এজন্য মুসলিম শাসকবর্গ আল্লাহ কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হবেন না এবং কিয়ামতে দিবসে তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না। কিন্তু মুসলমান শাসকবর্গ ও বিচারকমণ্ডলী যদি কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে বিচার কার্য মীমাংসা না করেন, তবে তাদের কঠিন শাস্তি হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
“এবং যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফির।”-(সূরা মায়েদাহ-৪৪)
অর্থাৎ- যেসব ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহ অনুসারে বিধিবিধান জারি করে না অথবা এটাকে আমলযোগ্য বলে বিবেচনা করে না বা এটাকে অসম্পূর্ণ গণ্য করে, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তুলে, যে কারণেই হোক ইচ্ছাধীন থাকা অবস্থায় শরয়ী বিধান জারি করে না, এসব লোক কাফির। যদিও তারা মুসলিম নাম ধারণ করে। তাদের বিধান কাফিরের মত। কাফিরদের সাথে যেমন আচার-ব্যবহার করা হয়, তদ্রুপই তাদের সাথে আচরণ করা হবে।আল্লাহ বলেন,
“এবং যে সব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই জালিম”-(সূরা মায়েদাহ-৪৫)
কতল ও কিসাস(হত্যার পরিবর্তে হত্যা) এর বর্ণনা পরম্পরায় আল্লাহ তাআলা আহলে কিতাবদের উপর তিরস্কার করতে গিয়ে বলেন- তাদের কাছে কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ তাওরাতের মধ্যে কিসাস ও দিয়্যাত(রক্তঋন) এর বিধিবিধান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাহানা হিসেবে আপনার কাছে আসে এবং তাদের তাওরাতের বিধি অনুসারে মীমাংসা করে না, সে কিতাব অনুসারে বিচার করে না, তাঁরা বড় জালিম।আল্লাহ বলেনঃ
“এবং যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই পাপাচারী।”-(সূরা মায়েদাহ-৪৭)
উক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, নাসারা, ইহুদী বা মুসলমান যেই হোক, যখন দ্বীনি বিধান গোপন করে অথবা উক্ত বিধান বর্ণনা না করে অথবা এর উপর আমল না করে অথবা এটাকে আমলের যোগ্য বলে বিবেচনা না করে, তখন সে ব্যক্তি ফাসিক, জালিম এবং কাফির হয়ে যায়। তার পরিণতি কি হবে?
আল্লাহ বলেন,
“তারপর আমি অবতীর্ণ করেছি জালিমদের উপর আযাব আসমান থেকে নির্দেশ লঙ্ঘন করার কারণে।”–(সূরা বাকারাহ-৫৯)
“আর কতই না উত্তম হত যদি এ জালিমরা পার্থিব কোন আযাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর আযাবই সবচেয়ে কঠিনতম।”-(সূরা বাকারাহ-১৬৫)
“অতঃপর যখন তাঁরা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাঁদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গুনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুণ। তারপর যখন তাঁরা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্চিত বানর হয়ে যাও।”-(সূরা আ’রাফ-১৬৫,১৬৬)
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহ দ্বারা ইশারার জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলার আহকাম তথা বিধিবিধানের নাফমানীকারীদের জন্য রয়েছে দুনিয়ায় আযাবের ধমকি। আর আখেরাতে রয়েছে এর থেকে বেশি অপমান ও অসম্মানজনক আযাব। এ জন্য সমগ্র মুসলিম দুনিয়ার মুসলমানের উচিত, নতুন করে তাওবা করে এবং ভবিষ্যতের নাফরমানী এবং ফিসক-ফুজুর থেকে তাওবাকারী হয়ে যাওয়া। আর সমগ্র শরয়ী বিধানের উপর আমল করা এবং তাঁর উপর দৃঢ়পদ থাকা। অন্যথায় কষ্টদায়ক আযাবের জন্য প্রস্তুত থাকা ছাড়া উপায় নেই। “আর কতই না উত্তম হত যদি এ জালিমরা পার্থিব কোন আযাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর আযাবই সবচেয়ে কঠিনতম।”-(সূরা বাকারাহ-১৬৫)
“অতঃপর যখন তাঁরা সেসব বিষয় ভুলে গেল, যা তাঁদেরকে বোঝানো হয়েছিল, তখন আমি সেসব লোককে মুক্তি দান করলাম যারা মন্দ কাজ থেকে বারণ করত। আর পাকড়াও করলাম গুনাহগারদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের নাফরমানীর দরুণ। তারপর যখন তাঁরা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্চিত বানর হয়ে যাও।”-(সূরা আ’রাফ-১৬৫,১৬৬)
দু’টি বিষয়ের উপর দ্বীন-ইসলামের ভিত্তিঃ
দ্বীন ইসলাম ঐ জিনিসের নাম যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীকে প্রদান করা হয়েছে। আর এর ভিত্তি দু’টি বিষয়ের উপর। তার মধ্যে প্রথমটা হচ্ছে কিতাব অর্থাৎ পরিত্র কুরআন। দ্বিতীয়টি সুন্নাতে রাসুল। তারপর ইজমায়ে উম্মত অর্থাৎ উম্মতের ঐক্যমত এবং কিয়াস। এ দু’টো মূলনীতি প্রথম দু’টো মূলনীতির অধীন। সুতরাং প্রথম দু’প্রধান উৎস থেকে যে বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়, চাই সেটা আকাইদ(বিশ্বাসমূলক) ও চিন্তা গবেষণামূলক হোক বা ইবাদাত ও লেনদেন সম্পর্কীয় হোক, জীবিকা সম্পর্কীয় হোক, জীবন যাপন প্রণালী সম্পর্কীয় হোক, চারিত্রিক হোক, শিষ্টাচার সম্পর্কীয় হোক, রাজনৈতিক হোক, রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ক হোক, ইসলামী দণ্ডবিধান বা অন্যায় অপরাধের অন্য কোন শাস্তি সম্পর্কীয় হোক সব বিধিবিধানের সমষ্টির নাম দ্বীন ইসলাম।
এগুলোর উপর দৃঢ় বিশ্বাস ও ঈমান গ্রহণের পর তার উপর সন্তুষ্টি, আকর্ষণ এবং আমল দ্বারা সজ্জিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষ মুসলমান হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ততা লাভ করে অন্যথায় নয়। যে সব রাষ্ট্র উক্ত বিষয়গুলো জারি সেটিকেই ইসলামী হুকুমত বলে অন্যথায় নয়। অতএব, সব ইসলামী বিশ্বের মুসলমানদের উচিত আল্লাহর বিধানের উপর আমল করতঃ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আইন-কানুন শীঘ্র বাস্তবায়ন করা। কেননা, মুসলমানদের উন্নতি ও কল্যাণ উক্ত বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে, আর তাদের পথভ্রষ্টতা ইসলামী বিধান ত্যাগ করা এবং শাসকদের বেপরোয়া ভূমিকার কারণে হয়ে থাকে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এ দ’টো জিনিস আঁকড়ে থাকবে। সেগুলো হল, আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাত।”
দ্বীন ইসলামের নিয়মনীতি সব দৃষ্টিকোণ থেকেই পূর্নাঙ্গ। এর চেয়ে অধিক পূর্নাঙ্গ কোন বিধান আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেন নি। এরুপ কোন বিধিবিধান কল্পনাও করা যায় না। এ বিধানে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ঘরোয়া স্তর পর্যন্ত, ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন তথা সব কিছুর জন্য ব্যাপক মূলনীতি এবং শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান। আর এর মধ্যে প্রকাশ্য ও গোপনীয় বিষয়ের সংশোধনের সব মূলনীতি ও শাখাগত বিষয়ের বিধান পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। দ্বীন ইসলামের পরিপূর্ণ ভান্ডার সেসব মূল্যবান মণিমুক্তা দ্বারা পরিপূর্ণ, যা মানুষের উন্নতি ও শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রয়োজন। যখন সব প্রচলিত আইন-কানুনের আঁচল সেসব মণিমুক্তা থেকে মুক্ত।
দ্বীন ইসলামের সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষতর আদর্শের যেমন লেনিন, কার্লমার্কস, হেগেল এবং এঙ্গেলস প্রমুখ ব্যক্তিদের বাতিল নীতিমালা গ্রহণের কোন প্রয়োজন নেই। তেমনি বৃটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকা ইত্যাদি পশ্চিমাদেশের পথভ্রষ্টকারী এবং ধ্বংসাত্বক আদর্শ ভিক্ষা মাগার জন্য তাদের দ্বারে ধরণা দেওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। কেননা, দ্বীন ইসলাম হচ্ছে সমগ্র দুনিয়ার এবং মানুষের প্রতিপালকের বিধান, যিনি চিরঞ্জীবও চিরস্থায়ী, সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এমন প্রভুর নিকট থেকে যে বিধান পালনের জন্য দেওয়া হবে তাঁর মধ্যে কোন প্রকারের অসম্পূর্নতা, ত্রুটি এবং সন্দেহের অবকাশ নেই।
এ জন্য যে, যিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের সৃষ্টিকর্তা তিনি ইনসানিয়্যাত তথা মনুষ্য জাতিরও সৃষ্টিকর্তা, তিনি মানুষের জীবনের শুরু থেকে পরকাল পর্যন্ত যাবতীয় জীবনোপকরণের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত। আর তাঁর বিধান গোটা মানব গোষ্টীর জন্য সমানভাবে উপকারী।
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং উদ্দেশ্যঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সর্বদা তাঁর রাসুলগণকে প্রেরণের মাধ্যমে এই পূর্নাঙ্গতম বিধানকে বাস্তবায়ন করে মানুষের উন্নতি-কল্যাণের ব্যবস্থা করতে থাকেন। আর শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ কিতাব পবিত্র কুরআন প্রদান করে ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশ স্থানে তাঁরই বিধান বাস্তবায়ন করেন এবং এ কুরআন ও সুন্নাতের বিধান পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানে দীর্ঘকাল পর্যন্ত জারি ছিল, অধিকাংশ জায়গায় দ্বীন ইসলামের বিজয় এবং শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনা বিদ্যমান ছিল। অপরদিকে কাফির এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের আদর্শিক পতাকা ছিল অবনত।
আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন তা পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্য যে, আমাদের খারাপ আমলের কারণে ইসলামী রাষ্ট্র এবং ইসলামী বিধিবিধান ধ্বংস হয়ে গেছে। যার শাস্তি আমরা এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ ভোগ করছে। সুতরাং এখনো আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। শরয়ী আইন-কানুন জারি করে দেওয়া উচিত। কেননা, ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচয় হল, সে রাষ্ট্রে ইসলামী আইন-কানুন তথা কুরয়ান-হাদীসের বিধান প্রতিষ্ঠির থাকবে। রাষ্ট্রের শাসকবর্গ থেকে শুরু করে প্রজাবর্গ পর্যন্ত সবাই উক্ত আইনের পাবন্দী হবে। তারপর এ রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত এবং ওখানকার শাসকবর্গ মুসলমানদের শাসনকর্তা এবং ওখানকার প্রজা মুসলিম প্রজা হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত হবে।
যদি মুসলিম শাসকদের তরফ থেকে মুসলিম দেশে ইসলামী আইন জারি না করা হয়, বরং কুফর ও খোদাদ্রোহী আইন প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং একে আরো উন্নতি প্রদান করা হয়। তখন ঐ দেশসমূহ ইসলামী দেশ হিসেবে কখনো গণ্য হওয়ার উপযুক্ত নয় বরং সেগুলোকে অমুসলিম দেশ হিসেবে সাব্যস্ত করা হবে। কেননা, ইসলামী দেশের পরিচয় ইসলামী আইন প্রয়োগের দ্বারা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, কাফিরদের দেশসমূহ দেখা যেতে পারে- যে দেশে সাম্যবাদ প্রচলিত সে দেশকে কমিউনিস্ট দেশ বলা হয়। কেননা, কমিউনিজম হল রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক নিয়ম প্রচলিত থাকে। এ কারণে সেটিকে গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়। যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিদ্যমান সেটিকে ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশ বলা হয়। সুতরাং কোন ইসলামী দেশের শাসকবর্গ যদি ইসলামী আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা না করেন তবে সে দেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করার উপযুক্ততা থাকে না। এভাবে কোন ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসীরা না ইসলামী আইন চায়, না সে আইনের প্রতি সন্তুষ্ঠ, বরং অনৈসলামিক আইনের বাস্তবায়ন চায় এবং সে আইনের প্রতি খুশী, তাহলে এদের মুসলমান বলে অভিহিত হওয়ার যোগ্যতা নেই। বরং এমন লোক কাফির উপাধী পাওয়ার উপযুক্ত।
পূর্বে যেসব কুরআনের আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর উপর চিন্তা গবেষণা করা প্রয়োজন। এটা বুঝা দরকার যে, কোন ইসলামের দাবীদার কলেমায়ে তায়্যিবাহ পড়ে, নামায পড়ে, রোযা রাখে, কিন্তু ইসলামের অন্যান্য বিধানের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে না, ইসলামী ইনসাফ এবং ইসলামী রাষ্ট্র অস্বীকার করে, এর দন্ডবিধানের উপর বিশ্বাস রাখে না, কিসাস ও দিয়্যাত অস্বীকার করে, ইসলামের উত্তরাধিকার আইন স্বীকার করে না, ইসলামী বিচার ব্যবস্থা ও সাক্ষ্য গ্রহণ নীতিকে মানে না, এমন ইসলামের দাবীদার কুরআন-হাদীস অনুসারে মুসলমান নয়। বরং এমন ব্যক্তি পাক্কা কাফির ও মুনাফিক। কেননা, দ্বীন ইসলামে সেই ব্যক্তি মুসলমান, যে ইসলামের সব জরুরী এবং অকাট্য বিধানকে মানে এবং স্বীকার করে, আর তাঁর উপর কোন অভিযোগ না করে। আল্লাহর নিকট আমলের ত্রুটি ক্ষমাযোগ্য। কিন্তু আকীদা ও বিশ্বাস সংক্রান্ত ইসলামের বিধান অস্বীকার করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুলাহ’ এই কালেমায়ে তাওহীদ ইসলামের সব বিধানকে বেস্টন করে আছে। এ কালেমায় দু’টো অংশ পরিদৃশ্যমান। কিন্তু শিরোনামে এর সব বিধান এসে যায়। পূর্বে এর বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। ন্যায় বিচারকদের জন্য এ সামান্য ইশারাই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা আমাকে, শাসক শ্রেণীকে এবং ইসলামী বিশ্বের সব মুসলমানকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুন। ইসলামী আইন তথা কুরয়ান-সুন্নাহর কানুন জারি করার এবং তাঁর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। সর্বপ্রকার আযাব ও শাস্তি থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আমীন।।
[উৎসঃ উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসার মুখপাত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম, এপ্রিল-২০১৭ সংখ্যা]
Comment