তিরমিযি শরীফের একটি হাদিস নিয়ে এক ভাই দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলেন। হাদিসের তরজমা তিনি এই উল্লেখ করেছিলেন,
“আবূদ দারদা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে কি তোমাদের অধিক উত্তম কাজ প্রসঙ্গে জানাব না, যা তোমাদের মনিবের নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের সম্মানের দিক হতে সবচেয়ে উঁচু, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান-খাইরাত করার চেয়েও বেশি ভাল এবং তোমাদের শক্রর মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদেরকে তোমাদের সংহার করা ও তোমাদেরকে তাদের সংহার করার চাইতেও ভাল? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা'আলার যিকর।
মু'আয ইবনু জাবাল (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহ তা'আলার শাস্তি হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলার যিকরের তুলনায় অগ্রগণ্য কোন জিনিস নেই।”
মূল হাদিসটি (সুনানে তিরমিযি: ৩৩৭৭) এই-
ভাইয়ের পেরেশানীর কারণ সম্ভবত এই যে, এ হাদিসে যিকিরকে জিহাদের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে, অথচ জিহাদের ফজিলত সীমাহীন। অধিকন্তু এ হাদিসকে কেন্দ্র করে যিকিরপন্থীরা জিহাদ তরকের বাহানা খোঁজবে। ইনশাআল্লাহ আমি হাদিসটির সহীহ ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
প্রথমে মনে রাখতে হবে, কোন আমলের ফজিলত বেশি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অন্য সকল ফরয-নফল বাদ দিয়ে এটাতেই লিপ্ত থাকতে হবে। এমনটা মনে করা সুস্পষ্টই গোমরাহি। যেমন ধরুন- নামাযের ফজিলত অনেক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সারাক্ষণ শুধু নামাযেই ব্যস্ত থাকবে; হজ্ব করবে না, যাকাত দেবে না, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে না... ইত্যাদি। বরং যার উপর যে যে বিষয় ফরয তাকে তা আদায় করতে হবে। ফরয দায়িত্ব আদায়ের পর বা পাশাপাশি অন্যান্য আমল করতে কোন অসুবিধা নেই। যে যত আমল করবে তার তত প্রতিদান মিলবে।
জিহাদ ও যিকিরের ক্ষেত্রেও একই কথা। যিকিরের ফজিলত যদি জিহাদের চেয়ে বেশিও হয়ে থাক, তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, ফরয জিহাদ ছেড়ে যিকিরে মশগুল থাকবে। এটা তখন ফরয নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত ছেড়ে যিকিরে মশগুল থাকার মতোই হবে। বরং যিকিরের ফজিলতের অর্থ: নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত-জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি ফরয আদায়ের পাশাপাশি যিকিরেরও পাবন্দি করবে। ফরয ছেড়ে যে যিকিরে লিপ্ত থাকবে সে গোমরাহ হওয়ার ব্যাপারে আশাকরি কারো দ্বিমত নেই। ফরয জিহাদ ছেড়ে খানকাহ ও যিকির মশগুল ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা।
দ্বিতীয়ত: আমলের সওয়াব তার কষ্টের ভিত্তিতে নয়, আমলের মর্যাদা হিসেবে। যে আমলের মর্যাদা বেশি তার সওয়াবও বেশি- যদিও তা সহজ হয় আর অন্যগুলো কঠিন হয়। যেমন- ঈমান আনা অনেক সহজ কাজ। কিন্তু এর প্রতিদান অন্য সকল আমলের চেয়ে বেশি। নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত-জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি সকল আমলের চেয়ে ঈমানের প্রতিদান বেশি, অথচ এসবগুলোর তুলনায় ঈমান সহজ। এ বিষয়টি ইজ্জুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালাম রহ. পরিষ্কার আলোচনা করেছেন তার [ক্বাওয়ায়িদুল আহকাম ফি মাসালিহিল আনাম] কিতাবে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন,
অতএব, কোন আমলের মর্যাদা বেশি হলে তার সওয়াবও বেশি- যদিও তা অন্যান্য আমলের চেয়ে অনেক সহজ হয়। আর কোন আমলের মর্যাদা কম হলে তার সওয়াবও কম- যদিও তা অন্যান্য মর্যাদাবান আমলের চেয়ে কষ্টসাধ্য হয়।
এবার আমরা আলোচ্য হাদিসে আসি। এ হাদিসে আল্লাহ তাআলার যিকিরকে ইনফাক তথা যাকাত, দান-খায়রাতসহ অন্য সকল আর্থিক ইবাদাতের চেয়ে এবং জিহাদের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। এখানে যিকির দ্বারা কি উদ্দেশ্য?
দু’টি উদ্দেশ্য নেয়া যায়:
১. কলবি যিকির। তথা সার্বক্ষণিক আল্লাহ তাআলার ইয়াদ ও নিয়তের পরিশুদ্ধি। যদি এমনটি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে স্পষ্ট যে, পরিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমলই সহীহ না। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি কোন কিছুই পরিশুদ্ধ ও খালেছ নিয়ত ছাড়া সহীহ না। খালেছ নিয়ত ছাড়া সওয়াব পাওয়া যায় না। তদ্রূপ, আল্লাহ তাআলার ইয়াদ ছাড়া শুধু ভাসা ভাসা আমলের দ্বারাও তেমন সওয়াব পাওয়া যায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ তাআলার যিকির অন্য সকল আমল হতে উত্তম হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণেই হাদিসে মু’মিনের নিয়তকে তার আমলের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। কাযি ইবনুল আরাবী রহ. এমনটিই বলেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন,
উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী নিছক মৌখিক যিকির জিহাদ ও অন্যান্য আমল থেকে উত্তম সাব্যস্ত হয় না। আর যিকির যদি বিদআতি যিকির হয, তাহলে তো উত্তম হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হানাফি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম ইবনুল মালাক রহ. (৮৫৪হি.) এ হাকিকতটিই তুলে ধরেছেন। তার যামানার জাহেল সুফিদের খণ্ডনকল্পে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,
২. দ্বিতীয়ত যিকির দ্বারা যেকোন যিকির উদ্দেশ্য নয়, বরং কামেল যিকির উদ্দেশ্য। আর তা হবে আল্লাহ তাআলার আযমত ও ইস্তিহজার সহ যিকরে লিসানি তথা মৌখিক যিকির ও কলবি যিকিরের সমন্বিত যিকির। তাহলে এ যিকিরের জন্য কয়েকটি বিষয় জরুরী:
ক. অন্তরে আল্লাহ তাআলার আযমত ও বড়ত্বের অনভূতি।
খ. ইস্তিহজার তথা আল্লাহ তাআলাকে হাজির নাযির মনে করে, তিনি আমাকে দেখছেন আমি তার সামনে আছি- এমন অনুভূতি নিয়ে যিকির করা।
গ. যিকিরের মা’না-মাফহুম তথা অর্থ ও মর্ম বুঝে যিকির করা।
ঘ. যিকির মাসনুন যিকির হওয়া বা শরীয়তসম্মত অন্য কোন যিকির হওয়া।
এ গেল যিকিরের কথা। আর যেসব আমলের তুলনায় এ যিকিরকে উত্তম বলা হয়েছে সেগুলোর অবস্থা হল- সেগুলোতে যথাযথ আল্লাহর ইয়াদ নেই, ইস্তিহযার এবং আযমত ও বড়ত্বের উপলব্ধি নেই। শুধু ভাসা ভাসা আমল। এমন ধরণের আমলের তুলনায় পূর্বোল্লিখিত যিকিরকে উত্তম বলা হয়েছে। অতএব, যে ব্যক্তি জিহাদ করছে কিন্তু জিহাদরত অবস্থায় তার মুখে আল্লাহর যিকির নেই, অন্তরে আল্লাহর ইয়াদ ও আযমতের উপলব্ধি নেই- তার এ জিহাদের তুলনায় পূর্বোক্ত কামেল যিকিরের সওয়াব বেশি। যদিও তার জিহাদে কষ্ট হচ্ছে বেশি, কিন্তু যথাযথ লিসানি ও কলবি যিকিরের সমন্বয় না থাকার কারণে তার জিহাদের সওয়াব কমে গেছে। আর কমবেই বা না কেন, জিহাদরত অবস্থায় তো অন্তরে আল্লাহ তাআলাকে অধিক পরিমাণে ইয়াদ করার এবং যবান আল্লাহ তাআলার যিকিরে মশগুল রাখার আদেশ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
ইমাম জাসসাস রহ. বলেন,
এক. মুখে আল্লাহ তাআলার যিকির করা।
দুই. অন্তরের যিকির।
অন্তরের যিকির আবার দুই ধরণের:
এক. আল্লাহর দুশমন মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে সুদৃঢ় ও অটল-অবিচল থাকার সওয়াব এবং যুদ্ধ হতে পলায়নের শাস্তির কথা স্বরণ করা।
দুই. আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলী, বান্দাদের উপর আল্লাহ তাআলার নেয়ামতরাজি এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদের যে ফরয দায়িত্ব তাদের উপর তার পাওনা রয়েছে- সেগুলো স্বরণ করা।
এই সব ধরণের যিকির অটল অবিচল থাকতে সহায়ক হবে। আল্লাহ তাআলার নুসরত লাভ এবং শত্রুর উপর দুঃসাহসিকতা দেখানো ও তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মাধ্যম হবে।
অধিকন্তু আয়াতের দ্বারা সব ধরণের যিকিরই উদ্দেশ্য হতে পারে। কেননা, যিকির শব্দ সব ধরণের যিকিরকেই বুঝায়।” (আহকামুল কুরআন: ৩/৮৬)
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইখলাসের সাথে, যথাযথ কলবি ও লিসানি যিকির সহ, আল্লাহ তাআলার আযমত ও ইস্তিহজার সহ, সওয়াবের আশা ও শাস্তির ভয় নিয়ে আল্লাহ তাআলার দ্বীনের বিজয়ের উদ্দেশ্যে জিহাদ করবে- তার এ জিহাদের প্রতিদান উপরোক্ত কামেল যিকিরের চেয়েও বেশি। কেননা, এখানে দু’টি আমলের সমন্বয় ঘটেছে:
ক. কামেল যিকির।
খ. জিহাদ।
অতএব, এমন মুজাহিদের জিহাদের সওয়াব ঐসব ব্যক্তির কামেল যিকিরের চেয়ে বেশি, যারা বাড়িতে বা মসজিদে বসে, পূর্ণ ধ্যান খেয়ালে, পূর্ণ আযমত ও ইস্তিহজারের সাথে, অর্থ ও মর্ম বুঝে বুঝে মাসনুন ও শরীয়তসম্মত যিকিরে লিপ্ত আছে। কেননা, এসকল ব্যক্তির আমল হল একটা। তা হচ্ছে- শুধু যিকির। পক্ষান্তরে মুজাহিদের আমল দু’টি: ক. যিকির। খ. জিহাদ। কাজেই তার সওয়াব বেশি।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন,
সারকথা দাঁড়াল-
ইস্তিহজারের সাথে কামেল যিকিরের সওয়াব, ইস্তিহজার বিহীন জিহাদ ও অন্যান্য আমলের চেয়ে বেশি।
ইস্তিহজার বিহীন জিহাদের সওয়াব, ইস্তিহজার বিহীন যিকিরের চেয়ে বেশি।
ইস্তিহজার বিশিষ্ট জিহাদ ও অন্যান্য আমলের সওয়াব, ইস্তিহজার বিশিষ্ট কামেল যিকিরের চেয়ে বেশি।
বি.দ্র.
ভুলে গেলে চলবে না যে, জিহাদ বর্তমানে ফরযে আইন। যিকির করা ফরয নয়, মুস্তাহাব। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জিহাদ ছেড়ে যিকিরে লিপ্ত আছেন, তারা- যদি সব ধরণের শিরিক বিদআত থেকে মুক্ত থাকেন- তাহলে অন্তত এতটুকু বলতে হবে যে, ফরযে আইন তরকের গুনাহে লিপ্ত আছেন। আর যেসব মুজাহিদ ইস্তিহজার ও কামেল যিকির ছাড়া শুধু জিহাদে লিপ্ত আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে, তারা নফল যিকিরের ফজিলত না পেলেও অন্তত কোন ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত নন। অতএব, এ হিসাবে জিহাদে লিপ্ত যেকোন মুজাহিদ- যদি তিনি অন্যান্য গুনাহ থেকে বিরত থাকেন, জিহাদ তরককারী- যদিও অন্য সকল ফরয আদায়কারী হয়ে থাকেন- যেকোন যিকিরকারীর চেয়ে উত্তম। কেননা, যিকিরকারী ফরযে আইন তরকের গুনাহে লিপ্ত, আর মুজাহিদ নফলে লিপ্ত না থাকলেও কোন ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত নন। আর স্পষ্ট যে, আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত ব্যক্তি কিছুতেই ঐ ব্যক্তির মতো নয়, যে আল্লাহর সবগুলো ফরয আদায়ে লিপ্ত আছেন এবং কোন ধরণের নাফরমানীতে লিপ্ত নন।
যাহোক, সর্বদিক থেকে সকল মুজাহিদকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এর হিসাব নিকাশ আল্লাহ তাআলার দায়িত্বে। আমার উদ্দেশ্য এতটুকু দেখানো যে, উপরোক্ত হাদিস জিহাদ ছেড়ে ঘরে বা খানকায় বসে থাকার বৈধতা দেয় না, মুজাহিদদের উপর খানকাহবাসীদের শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণ করে না।
“আবূদ দারদা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে কি তোমাদের অধিক উত্তম কাজ প্রসঙ্গে জানাব না, যা তোমাদের মনিবের নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের সম্মানের দিক হতে সবচেয়ে উঁচু, স্বর্ণ ও রৌপ্য দান-খাইরাত করার চেয়েও বেশি ভাল এবং তোমাদের শক্রর মুকাবিলায় অবতীর্ণ হয়ে তাদেরকে তোমাদের সংহার করা ও তোমাদেরকে তাদের সংহার করার চাইতেও ভাল? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা'আলার যিকর।
মু'আয ইবনু জাবাল (রাযিঃ) বলেন, আল্লাহ তা'আলার শাস্তি হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহ তা'আলার যিকরের তুলনায় অগ্রগণ্য কোন জিনিস নেই।”
মূল হাদিসটি (সুনানে তিরমিযি: ৩৩৭৭) এই-
عن أبي الدرداء رضي الله عنه قال قال النبي صلى الله عليه و سلم: ألا أنبئكم بخير أعمالكم وأزكاها عند مليككم وأرفعها في درجاتكم وخير لكم من إنفاق الذهب والورق وخير لكم من أن تلقوا عدوكم فتضربوا أعناقهم ويضربوا أعناقكم ؟ قالوا بلى، قال: ذكر الله تعالى. فقال معاذ بن جبل رضي الله عنه: ما شيء أنجى من عذاب الله من ذكر الله
ভাইয়ের পেরেশানীর কারণ সম্ভবত এই যে, এ হাদিসে যিকিরকে জিহাদের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে, অথচ জিহাদের ফজিলত সীমাহীন। অধিকন্তু এ হাদিসকে কেন্দ্র করে যিকিরপন্থীরা জিহাদ তরকের বাহানা খোঁজবে। ইনশাআল্লাহ আমি হাদিসটির সহীহ ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ।
প্রথমে মনে রাখতে হবে, কোন আমলের ফজিলত বেশি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অন্য সকল ফরয-নফল বাদ দিয়ে এটাতেই লিপ্ত থাকতে হবে। এমনটা মনে করা সুস্পষ্টই গোমরাহি। যেমন ধরুন- নামাযের ফজিলত অনেক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সারাক্ষণ শুধু নামাযেই ব্যস্ত থাকবে; হজ্ব করবে না, যাকাত দেবে না, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেবে না... ইত্যাদি। বরং যার উপর যে যে বিষয় ফরয তাকে তা আদায় করতে হবে। ফরয দায়িত্ব আদায়ের পর বা পাশাপাশি অন্যান্য আমল করতে কোন অসুবিধা নেই। যে যত আমল করবে তার তত প্রতিদান মিলবে।
জিহাদ ও যিকিরের ক্ষেত্রেও একই কথা। যিকিরের ফজিলত যদি জিহাদের চেয়ে বেশিও হয়ে থাক, তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, ফরয জিহাদ ছেড়ে যিকিরে মশগুল থাকবে। এটা তখন ফরয নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত ছেড়ে যিকিরে মশগুল থাকার মতোই হবে। বরং যিকিরের ফজিলতের অর্থ: নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত-জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি ফরয আদায়ের পাশাপাশি যিকিরেরও পাবন্দি করবে। ফরয ছেড়ে যে যিকিরে লিপ্ত থাকবে সে গোমরাহ হওয়ার ব্যাপারে আশাকরি কারো দ্বিমত নেই। ফরয জিহাদ ছেড়ে খানকাহ ও যিকির মশগুল ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা।
দ্বিতীয়ত: আমলের সওয়াব তার কষ্টের ভিত্তিতে নয়, আমলের মর্যাদা হিসেবে। যে আমলের মর্যাদা বেশি তার সওয়াবও বেশি- যদিও তা সহজ হয় আর অন্যগুলো কঠিন হয়। যেমন- ঈমান আনা অনেক সহজ কাজ। কিন্তু এর প্রতিদান অন্য সকল আমলের চেয়ে বেশি। নামায-রোযা-হজ্ব-যাকাত-জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি সকল আমলের চেয়ে ঈমানের প্রতিদান বেশি, অথচ এসবগুলোর তুলনায় ঈমান সহজ। এ বিষয়টি ইজ্জুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালাম রহ. পরিষ্কার আলোচনা করেছেন তার [ক্বাওয়ায়িদুল আহকাম ফি মাসালিহিল আনাম] কিতাবে। এক পর্যায়ে তিনি বলেন,
ومما يدل على أن الثواب لا يترتب على قدر النصب في جميع العبادات ... والحاصل بأن الثواب يترتب على تفاوت الرتب في الشرف. اهـ
“সকল ইবাদতে সওয়াবের পরিমাণ যে কষ্টের ভিত্তিতে নয় তার দলীল- এরপর তিনি উপরোক্ত হাদিসসহ যিকির সংক্রান্ত আরো হাদিস উল্লেখ করেন। তারপর বলেন- সারকথা: সওয়াব নির্ধারিত হয় আমলের মর্যাদার কম বেশ এর ভিত্তিতে।” (ক্বাওয়ায়িদুল আহকাম ফি মাসালিহিল আনাম: ১/৪৮) অতএব, কোন আমলের মর্যাদা বেশি হলে তার সওয়াবও বেশি- যদিও তা অন্যান্য আমলের চেয়ে অনেক সহজ হয়। আর কোন আমলের মর্যাদা কম হলে তার সওয়াবও কম- যদিও তা অন্যান্য মর্যাদাবান আমলের চেয়ে কষ্টসাধ্য হয়।
এবার আমরা আলোচ্য হাদিসে আসি। এ হাদিসে আল্লাহ তাআলার যিকিরকে ইনফাক তথা যাকাত, দান-খায়রাতসহ অন্য সকল আর্থিক ইবাদাতের চেয়ে এবং জিহাদের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। এখানে যিকির দ্বারা কি উদ্দেশ্য?
দু’টি উদ্দেশ্য নেয়া যায়:
১. কলবি যিকির। তথা সার্বক্ষণিক আল্লাহ তাআলার ইয়াদ ও নিয়তের পরিশুদ্ধি। যদি এমনটি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে স্পষ্ট যে, পরিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোন আমলই সহীহ না। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, জিহাদ-কিতাল ইত্যাদি কোন কিছুই পরিশুদ্ধ ও খালেছ নিয়ত ছাড়া সহীহ না। খালেছ নিয়ত ছাড়া সওয়াব পাওয়া যায় না। তদ্রূপ, আল্লাহ তাআলার ইয়াদ ছাড়া শুধু ভাসা ভাসা আমলের দ্বারাও তেমন সওয়াব পাওয়া যায় না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহ তাআলার যিকির অন্য সকল আমল হতে উত্তম হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণেই হাদিসে মু’মিনের নিয়তকে তার আমলের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। কাযি ইবনুল আরাবী রহ. এমনটিই বলেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন,
وأجاب القاضي أبو بكر بن العربي بأنه ما من عمل صالح الا والذكر مشترط في تصحيحه فمن لم يذكر الله بقلبه عند صدقته أو صيامه مثلا فليس عمله كاملا فصار الذكر أفضل الأعمال من هذه الحيثية ويشير إلى ذلك حديث نية المؤمن ابلغ من عمله اهـ
“কাযি আবু বকর ইবনুল আরাবী রহ. এ হাদিসের এই জওয়াব দিয়েছেন যে, প্রতিটি নেক কাজ সহীহ হওয়ার জন্য যিকির শর্ত। যে ব্যক্তি- উদাহরণস্বরূপ- তার সাদাকা বা তার রোযা আদায়ের সময় অন্তরে আল্লাহ তাআলাকে ইয়াদ না করবে, তার আমল কামেল নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে যিকির (তথা আল্লাহ তাআলার ইয়াদ) সর্বোত্তম আমল। হাদিস: ‘মু’মিনের নিয়ত তার আমল থেকে উত্তম’- এ দিকেই ঈঙ্গিত করে।” (ফাতহুল বারি: ১১/২১০) উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী নিছক মৌখিক যিকির জিহাদ ও অন্যান্য আমল থেকে উত্তম সাব্যস্ত হয় না। আর যিকির যদি বিদআতি যিকির হয, তাহলে তো উত্তম হওয়ার প্রশ্নই আসে না। হানাফি মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম ইবনুল মালাক রহ. (৮৫৪হি.) এ হাকিকতটিই তুলে ধরেছেন। তার যামানার জাহেল সুফিদের খণ্ডনকল্পে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন,
المراد من هذا: هو الذِّكر القلبي ... لا الذِّكر اللِّساني المشتمل على صياحٍ وانزجاعٍ، وشدةِ تحريكِ العنقِ واعوجاجٍ، كما يفعله بعض الناس زاعمين أن ذلك جالبٌ للحضور، وموجبٌ للسرور، حاشا لله، بل هو سبب للغَيبة والغرور. اهـ
“এখানে যিকির দ্বারা কলবি যিকির উদ্দেশ্য ... মৌখিক যিকির উদ্দেশ্য নয়, যে যিকিরে থাকে চিল্লা-ফাল্লা আর হৈ-হুল্লোর, জোরে জোরে ঘাড় নাড়ানো আর বক্র অঙ্গভঙ্গি। যেমনটা কতক লোক করে থাকে। মনে করে- এমন করলে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও অন্তরের প্রশান্তি অর্জন হবে। আল্লাহর পানা। কিছুতেই না। এসব বরং আল্লাহ তাআলা থেকে দূরে সরা ও প্রবঞ্চনার কারণ।” (শরহু ইবনিল মালাক আলাল মাসাবিহ: ৩/৯২)২. দ্বিতীয়ত যিকির দ্বারা যেকোন যিকির উদ্দেশ্য নয়, বরং কামেল যিকির উদ্দেশ্য। আর তা হবে আল্লাহ তাআলার আযমত ও ইস্তিহজার সহ যিকরে লিসানি তথা মৌখিক যিকির ও কলবি যিকিরের সমন্বিত যিকির। তাহলে এ যিকিরের জন্য কয়েকটি বিষয় জরুরী:
ক. অন্তরে আল্লাহ তাআলার আযমত ও বড়ত্বের অনভূতি।
খ. ইস্তিহজার তথা আল্লাহ তাআলাকে হাজির নাযির মনে করে, তিনি আমাকে দেখছেন আমি তার সামনে আছি- এমন অনুভূতি নিয়ে যিকির করা।
গ. যিকিরের মা’না-মাফহুম তথা অর্থ ও মর্ম বুঝে যিকির করা।
ঘ. যিকির মাসনুন যিকির হওয়া বা শরীয়তসম্মত অন্য কোন যিকির হওয়া।
এ গেল যিকিরের কথা। আর যেসব আমলের তুলনায় এ যিকিরকে উত্তম বলা হয়েছে সেগুলোর অবস্থা হল- সেগুলোতে যথাযথ আল্লাহর ইয়াদ নেই, ইস্তিহযার এবং আযমত ও বড়ত্বের উপলব্ধি নেই। শুধু ভাসা ভাসা আমল। এমন ধরণের আমলের তুলনায় পূর্বোল্লিখিত যিকিরকে উত্তম বলা হয়েছে। অতএব, যে ব্যক্তি জিহাদ করছে কিন্তু জিহাদরত অবস্থায় তার মুখে আল্লাহর যিকির নেই, অন্তরে আল্লাহর ইয়াদ ও আযমতের উপলব্ধি নেই- তার এ জিহাদের তুলনায় পূর্বোক্ত কামেল যিকিরের সওয়াব বেশি। যদিও তার জিহাদে কষ্ট হচ্ছে বেশি, কিন্তু যথাযথ লিসানি ও কলবি যিকিরের সমন্বয় না থাকার কারণে তার জিহাদের সওয়াব কমে গেছে। আর কমবেই বা না কেন, জিহাদরত অবস্থায় তো অন্তরে আল্লাহ তাআলাকে অধিক পরিমাণে ইয়াদ করার এবং যবান আল্লাহ তাআলার যিকিরে মশগুল রাখার আদেশ স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ}
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা কোন বাহিনির সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহ তাআলাকে অধিক পরিমাণে স্বরণ করতে থাক, যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হতে পার।” (আনফাল: ৪৫)ইমাম জাসসাস রহ. বলেন,
وقوله تعالى: {واذكروا الله كثيرا} يحتمل وجهين: أحدهما: ذكر الله تعالى باللسان، والآخر: الذكر بالقلب، وذلك على وجهين: أحدهما: ذكر ثواب الصبر على الثبات لجهاد أعداء الله المشركين وذكر عقاب الفرار؛ والثاني: ذكر دلائله ونعمه على عباده وما يستحقه عليهم من القيام بفرضه في جهاد أعدائه. وضروب هذه الأذكار كلها تعين على الصبر والثبات ويستدعى بها النصر من الله والجرأة على العدو والاستهانة بهم. وجائز أن يكون المراد بالآية جميع الأذكار لشمول الاسم لجميعها. اهـ
“আল্লাহ তাআলার বাণী- ‘এবং আল্লাহ তাআলাকে অধিক পরিমাণে স্বরণ করতে থাক’ এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে: এক. মুখে আল্লাহ তাআলার যিকির করা।
দুই. অন্তরের যিকির।
অন্তরের যিকির আবার দুই ধরণের:
এক. আল্লাহর দুশমন মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদে সুদৃঢ় ও অটল-অবিচল থাকার সওয়াব এবং যুদ্ধ হতে পলায়নের শাস্তির কথা স্বরণ করা।
দুই. আল্লাহ তাআলার নিদর্শনাবলী, বান্দাদের উপর আল্লাহ তাআলার নেয়ামতরাজি এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদের যে ফরয দায়িত্ব তাদের উপর তার পাওনা রয়েছে- সেগুলো স্বরণ করা।
এই সব ধরণের যিকির অটল অবিচল থাকতে সহায়ক হবে। আল্লাহ তাআলার নুসরত লাভ এবং শত্রুর উপর দুঃসাহসিকতা দেখানো ও তাদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মাধ্যম হবে।
অধিকন্তু আয়াতের দ্বারা সব ধরণের যিকিরই উদ্দেশ্য হতে পারে। কেননা, যিকির শব্দ সব ধরণের যিকিরকেই বুঝায়।” (আহকামুল কুরআন: ৩/৮৬)
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইখলাসের সাথে, যথাযথ কলবি ও লিসানি যিকির সহ, আল্লাহ তাআলার আযমত ও ইস্তিহজার সহ, সওয়াবের আশা ও শাস্তির ভয় নিয়ে আল্লাহ তাআলার দ্বীনের বিজয়ের উদ্দেশ্যে জিহাদ করবে- তার এ জিহাদের প্রতিদান উপরোক্ত কামেল যিকিরের চেয়েও বেশি। কেননা, এখানে দু’টি আমলের সমন্বয় ঘটেছে:
ক. কামেল যিকির।
খ. জিহাদ।
অতএব, এমন মুজাহিদের জিহাদের সওয়াব ঐসব ব্যক্তির কামেল যিকিরের চেয়ে বেশি, যারা বাড়িতে বা মসজিদে বসে, পূর্ণ ধ্যান খেয়ালে, পূর্ণ আযমত ও ইস্তিহজারের সাথে, অর্থ ও মর্ম বুঝে বুঝে মাসনুন ও শরীয়তসম্মত যিকিরে লিপ্ত আছে। কেননা, এসকল ব্যক্তির আমল হল একটা। তা হচ্ছে- শুধু যিকির। পক্ষান্তরে মুজাহিদের আমল দু’টি: ক. যিকির। খ. জিহাদ। কাজেই তার সওয়াব বেশি।
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন,
أشرت إليه مستشكلا في أوائل الجهاد مع ما ورد في فضل المجاهد انه كالصائم لا يفطر وكالقائم لا يفتر وغير ذلك مما يدل على افضليته على غيره من الأعمال الصالحة، وطريق الجمع والله اعلم ان المراد بذكر الله في حديث أبي الدرداء الذكر الكامل، وهو ما يجتمع فيه ذكر اللسان والقلب بالتفكر في المعنى واستحضار عظمة الله تعالى، وان الذي يحصل له ذلك يكون أفضل ممن يقاتل الكفار مثلا من غير استحضار لذلك، وان أفضلية الجهاد انما هي بالنسبة إلى ذكر اللسان المجرد، فمن اتفق له انه جمع ذلك كمن يذكر الله بلسانه وقلبه واستحضاره وكل ذلك حال صلاته أو في صيامه أو تصدقه أو قتاله الكفار مثلا فهو الذي بلغ الغاية القصوى. اهـ
“কিতাবুল জিহাদের শুরুতে এ হাদিসের দিকে ঈঙ্গিত করে এসেছি। মুজাহিদের যে ফজিলত বর্ণিত হয়েছে তার দাবি হল- জিহাদ অন্য সকল নেক কাজের চেয়ে উত্তম। যেমন- মুজাহিদ ঐ রোযাদারের মতো যে কখনোও রোযা ভাঙে না। ঐ ইবাদাত গুজারের মতো যে, কখনও বিরতি দেয় না। এছাড়াও অন্যান্য ফজিলত। এতদসত্ত্বেও এ হাদিসে যিকিরকে উত্তম বলাটা (বাহ্যত) মুশকিল মনে হয়। -ওয়াল্লাহু আ’লাম- উভয়ের সমন্বয় এভাবে হবে যে, আবুদদারদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে আল্লাহ তাআলার যিকির দ্বারা কামেল যিকির উদ্দেশ্য। আর কামেল যিকির হল ঐ যিকির, যে যিকিরে মৌখিক যিকির এবং অর্থ ও মর্মে ফিকির করে করে আল্লাহ তাআলার আযমতের খেয়াল রেখে অন্তরের যিকির- উভয়টার সমন্বয় ঘটবে। যার মাঝে এমন যিকির পাওয়া যাবে সে ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম- উদাহরণত- যে ব্যক্তি এই অবস্থা ব্যতিরেকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। আর (ইস্তিহজার বিহীন) জিহাদ উত্তম হল (ইস্তিহজার বিহীন) মৌখিক যিকিরের চেয়ে। অতএব, যে ব্যক্তি এ উভয়টির সমন্বয় ঘটাবে; যেমন- উদাহরণত- ঐ ব্যক্তি, যে তার নামাযে, তার রোযায়, তার সাদাকায় বা কাফেরের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের হালতে ইস্তিহজারের সাথে তার যবানে ও অন্তরে আল্লাহ তাআলার যিকির করবে- তাহলে সে-ই (ফজিলতের) চূড়ান্ত দরজায় উপনীত হতে সক্ষম হবে।” (ফাতহুল বারি: ১১/২১০)সারকথা দাঁড়াল-
ইস্তিহজারের সাথে কামেল যিকিরের সওয়াব, ইস্তিহজার বিহীন জিহাদ ও অন্যান্য আমলের চেয়ে বেশি।
ইস্তিহজার বিহীন জিহাদের সওয়াব, ইস্তিহজার বিহীন যিকিরের চেয়ে বেশি।
ইস্তিহজার বিশিষ্ট জিহাদ ও অন্যান্য আমলের সওয়াব, ইস্তিহজার বিশিষ্ট কামেল যিকিরের চেয়ে বেশি।
এ থেকে এই ফলাফল দাঁড়াচ্ছে যে, যেসকল মুজাহিদ পূর্ণ ইখলাস ও যিকিরের সাথে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত আছেন তাদের জিহাদ, ঐসব শিরিক ও বিদআতমুক্ত মুখলিস অলী, দরবেশ ও পীর মাশায়েখদের যিকিরের চেয়ে উত্তম, যারা ইস্তিহজার ও আযমতের সাথে, অর্থ ও মর্ম খেয়াল করে করে যিকিরে লিপ্ত আছেন। কেননা, তারা যে ধরণের যিকিরে লিপ্ত আছেন, মুজাহিদগণও এমনই- কিংবা তার চেয়ে উত্তম- যিকিরে লিপ্ত আছেন। অতিরিক্ত এই যে, মুজাহিদগণ আল্লাহর দ্বীনের জন্য নিজেদের জান-মাল ও সর্বস্ব ব্যয় করছেন আর তারা তা করছেন না। অতএব, যিকিরের দিক থেকে মুজাহিদগণ এবং মুখলিস ও শরীয়তের অনুগামী অলী দরবেশগণ সমানে সামান। আর মুজাহিদগণের শ্রেষ্টত্ব যে, তারা যিকিরের পাশাপাশি জিহাদেও লিপ্ত আছেন। অতএব, উক্ত হাদিস থেকে অলী দরবেশগণের উপর মুজাহিদগেণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
বি.দ্র.
ভুলে গেলে চলবে না যে, জিহাদ বর্তমানে ফরযে আইন। যিকির করা ফরয নয়, মুস্তাহাব। যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জিহাদ ছেড়ে যিকিরে লিপ্ত আছেন, তারা- যদি সব ধরণের শিরিক বিদআত থেকে মুক্ত থাকেন- তাহলে অন্তত এতটুকু বলতে হবে যে, ফরযে আইন তরকের গুনাহে লিপ্ত আছেন। আর যেসব মুজাহিদ ইস্তিহজার ও কামেল যিকির ছাড়া শুধু জিহাদে লিপ্ত আছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে, তারা নফল যিকিরের ফজিলত না পেলেও অন্তত কোন ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত নন। অতএব, এ হিসাবে জিহাদে লিপ্ত যেকোন মুজাহিদ- যদি তিনি অন্যান্য গুনাহ থেকে বিরত থাকেন, জিহাদ তরককারী- যদিও অন্য সকল ফরয আদায়কারী হয়ে থাকেন- যেকোন যিকিরকারীর চেয়ে উত্তম। কেননা, যিকিরকারী ফরযে আইন তরকের গুনাহে লিপ্ত, আর মুজাহিদ নফলে লিপ্ত না থাকলেও কোন ফরয তরকের গুনাহে লিপ্ত নন। আর স্পষ্ট যে, আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত ব্যক্তি কিছুতেই ঐ ব্যক্তির মতো নয়, যে আল্লাহর সবগুলো ফরয আদায়ে লিপ্ত আছেন এবং কোন ধরণের নাফরমানীতে লিপ্ত নন।
যাহোক, সর্বদিক থেকে সকল মুজাহিদকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এর হিসাব নিকাশ আল্লাহ তাআলার দায়িত্বে। আমার উদ্দেশ্য এতটুকু দেখানো যে, উপরোক্ত হাদিস জিহাদ ছেড়ে ঘরে বা খানকায় বসে থাকার বৈধতা দেয় না, মুজাহিদদের উপর খানকাহবাসীদের শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণ করে না।
والله سبحانه وتعالى أعلم، وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وصحبه أجمعين
Comment