জামাত ও তানজীম গঠন কি বিদআত? মিম্বারুত তাওহিদ, প্রশ্ন নং ৪৭০১
প্রশ্ন:
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ! আল্লাহ তাআলা আমাদের শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে হিফাযত করুন। সমকালীন মাশায়েখদের কারো কারো থেকে – যেমন শায়খ আলবানী (আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করুন)- শুনছি যে, তারা ফতোয়া দিচ্ছেন, তানজীম এবং আন্দোলনী জামাত গঠন বিদআত। আমাদের ধর্মে তা জায়েয নয়।
কয়েকটি জালেম শাসনব্যবস্থার পতনের পর আমরা কিছুটা স্বাধীনতা পাচ্ছি- যেমনটা আপনারাও জানেন। তাই চাচ্ছি একটা তানজীম তলে একতাবদ্ধ হতে, যা এই জাহিলী সমাজে আমাদের সুরক্ষার উপকরণ হবে। আপনাদের কাছে আবেদন করছি, আপনারা ফতোয়া দিন, এটি জায়েয হবে কি হবে না। আল্লাহ তাআলা আপনাদের মাঝে বারাকাহ দান করুন।
নিবেদক
আবু ফারুক
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم الحمد لله رب العالمين وصلى الله على نبيه الكريم وعلى آله وصحبه أجمعين. وبعد:
সকলেরই জানা যে, আল্লাহ তাআলার শরীয়তের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলীল ব্যতীত যে কোন মাসআলাতেই হোক- হালাল বা হারামের দাবি করা জায়েয নয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ} [النحل: 116].
“তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে তোমাদের যবানা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।”- নাহল: ১১৬
দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহায়তামূলক জামাত ও তানজীম গঠন করা যারা হারাম বলেন, তাদের হাতে নির্ভরযোগ্য কোন শরয়ী দলীল নেই। আর যাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ না থাকবে, তাদের দাবি মিথ্যা।
বাস্তবতা হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং তানজীম গঠন করা প্রত্যাখানের দাওয়াত মূলত তবিয়ত ও সহজাত প্রকৃতি বিরোধী কাজ। সকল জ্ঞানীর নিকটই স্বীকৃত যে, ঐক্যবদ্ধতা ও ভ্রাতৃত্ব-নুসরতের মাধ্যমে যা করা সম্ভব, বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।
একক ব্যক্তি দুর্বল। কিন্তু তার সহযোগীদের নিয়ে শক্তিশালী। তার এমন কারো প্রয়োজন, যারা তাকে সহায়তা করবে ও শক্তি যোগাবে। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় বিষয়াদির বেলায়। যেমনটা মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَأَخِي هَرُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي إنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ (34) قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِيكَ وَنَجْعَلُ لَكُمَا سُلْطَانًا فَلا يَصِلُونَ إلَيْكُمَا بِآيَاتِنَا أَنتُمَا وَمَنِ اتَّبَعَكُمَا الْغَالِبُونَ} [القصص: 34 - 35].
“আমার ভাই হারুন, সে আমা অপেক্ষা প্রাঞ্জলভাষী। অতএব, তাকে আমার সাথে সাহায্যের জন্যে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন জানাবে। আমি আশংকা করি যে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে। আল্লাহ্ বললেন, আমি তোমার বাহু শক্তিশালী করব তোমার ভাই দ্বারা এবং তোমাদের প্রধান্য দান করব। ফলে, তারা তোমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। আমার নিদর্শনাবলীর জোরে তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীরা প্রবল থাকবে।”- কাসাস: ৩৪-৩৪
ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া যেমন গত্যন্তর নেই, এমন একজন আমীরেরও কোন বিকল্প নেই, যিনি তাদেরকে পরিচালিত করবেন এবং তার কথা শুনা হবে ও আনুগত্য করা হবে।
لا يصلح الناس فوضى لا سراة لهم .. ولا سراة إذا جهالهم سادوا
والبيت لا يبتنى إلا باعمدة .. ولا عماد إذا لم ترس أوتاد
فإن تجمع أوتاد وأعمدة .. وساكن بلغوا الأمر الذي رادوا
‘আমীর বিহীন অরাজকতার মাঝে শান্তি-শৃংখলা সম্ভব নয় .... আর জাহেলরা যদি আমীর হয়ে বসে থাকে, তাহলে এই নেতৃত্বেরও কোন মূল্য নেই।
খুঁটি বিহীন ঘর দাঁড়াতে পারে না .......................... আর পেরেক না গাড়লে খুঁটিও কাজ দেবে না।
গৃহকর্মী, পেরেক ও খুঁটি একত্র হলেই তখন .... যে বাসনা তারা স্থির করেছে, তাতে কামিয়াব হতে পারবে।’
এটা যে শুধু মনুষ্য সমাজে তা-ই নয়, জন্তু-জানোয়ারের মাঝেও এমনটা দেখা যায়। সকল জন্তুকে আমরা দেখি, তারা দল বেঁধে চলাফেরা করে; একা একা না। প্রত্যেক দলের মাঝে দেখি একটা করে সর্দার থাকে, যেটি এদেরকে সামনে নিয়ে চলে।
(এ গেল যুক্তিভিত্তিক কথা।) আর জামাত ও তানজীম গঠনের পক্ষে (শরয়ী) দলীল যদি দিতে যাই, তাহলে দলীলের তো অভাব নেই। এখানে কয়েকটা উল্লেখ করছি-
এক.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ} [المائدة:2]
‘তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’- মায়েদা: ২
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং নেক ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহায়তা করতে আদেশ দিয়েছেন। আর নেক ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহায়তা করাই দাওয়াতি ও জিহাদি জামাত ও তানজীমসমূহের উদ্দেশ্য। অতএব, এসব জামাত ও তানজীম আয়াতের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ।
দুই.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا}
‘আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’- আলে ইমরান: ১০৩
আল্লাহ তাআলা আদেশ দিচ্ছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে। আর এসব জামাত ও তানজীম মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার জন্য নয়, যেমনটা কেউ কেউ মনে করে; বরং যতদিন একক জামাত গঠন করার সুযোগ না আসবে, ততদিন এগুলো মুসলমানদেরকে এসবের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ মাত্র। পূর্ণ ও একক ঐক্যের অপেক্ষার বাহানায় মুসলমানদেরকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন ছেড়ে রাখা কল্যাণকর কিছু নয়। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা অপেক্ষা আংশিক ঐক্যও শ্রেয়। যা পরিপূর্ণ অর্জন করা যায় না, তা সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়াও যায় না।
সকল ভূখণ্ড ও অঞ্চলের দাঈদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থন জরুরী। এই সমন্বিত আমলটিই তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন জামাত গঠন করতে তাগাদা দিচ্ছে। কেননা, ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল ও ভিন্ন ভিন্ন কর্মোপোকরণ- সবগুলোই এমন বিষয়, যেগুলো মুসলিম জামাতসমূহের পরস্পরের মাঝে স্বতন্ত্রবৈশিষ্টসম্পন্ন ভিন্নতা সৃষ্টির দাবিদার। যেমনটা জাতি, গোষ্ঠী ও জনপদের ভিন্নতার কারণে স্বাভাবিক হয়ে থাকে। এটা সকল মুসলিম এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার পরিপন্থী না। বরং ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ড, ভিন্ন ভিন্ন আমল ও ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যসম্বলিত দলসমূহের পরস্পরে নিজেদের মাঝেকার ঐক্য অনেক সময় মুসলমানদের সার্বজনীন একক ঐক্য গঠনে সহায়ক হয়।
তিন.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنْ الْمُنْكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ} [آل عمران: -104]
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি ‘উম্মাহ’ তথা দল থাকা চাই- যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। আর এরূপ লোকই সফলকাম।’- আলে ইমরান: ১০৪
আমাদের বিবাদমান বিষয়টিতে এ আয়াত সুস্পষ্ট সমাধান। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে ‘উম্মাহ’ তথা দলবদ্ধভাবে কল্যাণের দিকে আহ্বানের আদেশ দিয়েছেন। ‘উম্মাহ’ বলা হয় জামাতকে। যেমন আল্লাহর তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِنَ النَّاسِ يَسْقُونَ}
‘তিনি (মূসা আলাইহিস সালাম) কূপের কাছে এক উম্মাহ তথা একদল লোককে পেলেন, তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর কাজে রত।’- কাসাস: ২৩
{مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ}
‘আহলে কিতাবদের মধ্যে একটি উম্মাহ তথা একদল লোক ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা গভীর রাতে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সেজদা করে।’- আলে ইমরান: ১১৩
{مِنْهُمْ أُمَّةٌ مُقْتَصِدَةٌ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُونَ}
‘তাদের একটি উম্মাহ তথা কিছুসংখ্যক লোক সৎপথের অনুগামী। আর তাদের অনেকে মন্দ কাজ করে যাচ্ছে।’- মায়েদা: ৬৬
জামাত ও তানজীম গঠন (আয়াতে বর্ণিত) এই ‘উম্মাহ’ তথা জামাত সৃষ্টির বাস্তবিক প্রয়োগ বৈ কিছু নয়।
চার.
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا خرج ثلاثة فى سفر فليؤمروا أحدهم
‘তিন ব্যক্তি সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেয়।’- আবু দাউদ।
ইমাম আহমাদ রহ. তার নিজ মুসনাদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لايحل لثلاثة يكونون بفلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم
‘যে কোন তিন ব্যক্তির জন্য কোন মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেয়।’
এ দুই হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সফরের হালতে এক আমীরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক- যদিও মুসাফিরের সংখ্যা তিন জনই হোক না কেন।
বক্তব্যের ভাষ্য ঈঙ্গিত করছে যে, এর চেয়ে বড় যে কোন বিষয়ে অবশ্যই এক আমীরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেমনটা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ দুই হাদিসের টীকায় বলেন,
‘সবচে’ কম সংখ্যাবিশিষ্ট জামাত ও সবচে’ ছোট্ট ইজতিমার বেলায়ও যখন একজনকে আমীর বানানো আবশ্যক করেছেন, তখন তা এর চেয়ে বড় জামাত ও ইজতিমার বেলায় আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ হচ্ছে।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৬৫
তিনি আরো বলেন,
‘সফরের হালতে সৃষ্টি হওয়া ছোট্ট একটি জামাআতের বেলায়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন একথা বুঝানোর জন্য যে, সব ধরণের জামাআতের ক্ষেত্রেই আমীর বানিয়ে নেয়া আবশ্যক।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
শাওকানি রহ. বলেন,
‘মরুময়দানে কিংবা সফরে থাকা তিন জনের বেলায়ই যখন এই বিধান; তখন গ্রাম ও শহরে বসবাসরত এর চেয়ে বেশি সংখ্যক, যারা পারস্পরিক জুলুম প্রতিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর প্রতি মুখাপেক্ষী, তাদের বেলায় তো এ বিধান এর আগেই প্রযোজ্য হবে।’- নাইলুল আওতার: ৯/১২৮
এই আদেশের হেকমত কি- সেদিকে ইশারা করে শাওকানি রহ. বলেন,
‘এটি দলীল যে, তিন বা ততোধিক সংখ্যার সকলের জন্য এই বিধান- তারা তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেবে। কেননা, এর মাধ্যমেই তারা পারস্পরিক মতবিরোধ থেকে মুক্তি পাবে, যে মতবিরোধ তাদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করবে। আমীর নির্ধারণ না করলে সকলেই নিজের বুঝ অনুযায়ী স্বেচ্ছাচারিতা দেখাবে। নিজ খাহেশাত মতো কাজ করবে। এভাবে তারা ধ্বংসে নিপতিত হবে। পক্ষান্তরে আমীর বানিয়ে নিলে মতবিরোধ কমে যাবে এবং একতা সৃষ্টি হবে।’- নাইলুল আওতার: ৯/১২৮
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ ব্যাপারে বলেন,
‘কেননা, পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত মানব জাতির মাসলাহাতসমূহের পরিপূর্ণতা সম্ভব নয়। কারণ, তারা একে অপরের মুখাপেক্ষী। আর ঐক্যবদ্ধ হতে গেলে তাদের একজন নেতা আবশ্যক।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
পাঁচ.
ইমাম আহমাদ রহ. নিজ মুসনাদে আবু সালেহের বরাতে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এবং তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে,
(لا يزال لهذا الأمر أو على هذا الأمر عصابة على الحق ولا يضرهم خلاف من خالفهم حتى يأتيهم أمر الله)
‘এই দ্বীনের সংরক্ষণে সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দল থাকবে। বিরোদ্ধবাদিদের বিরোধীতা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলার ফায়সালা আসার পূর্ব পর্যন্তই তারা অটল থাকবে।’
ইবনে মাজাহ্ রহ. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেন,
(لا تزال طائفة من أمتي قوامة على أمر الله لا يضرها من خالفها تقاتل أعداء الله كلما ذهبت حرب نشبت حرب قوم آخرين حتى تأتيهم الساعة)
‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই আল্লাহ তাআলার আদেশর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তাদের বিরোদ্ধবাদিরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে। যখনই এক যুদ্ধ শেষ হবে, তখনই আরেক কওমের সাথে যুদ্ধের সূচনা হবে। কেয়ামত আসা অবধিই এভাবে চলবে।’ হাদিসটির সনদ হাসান।
এসকল হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, তায়েফায়ে মানসূরা, যারা কেয়ামত অবধি এ দ্বীনের হেফাজত করবে, তারা সংঘবদ্ধ দল হবে। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তি হবে না। তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত "الطائفة" ও "العصابة" বিশেষণ দু’টি থেকে এমনটিই বুঝা যায়।
ছয়.
হাওয়াযেন সম্প্রদায়ের বন্দীদের ঘটনায় ইমাম বুখারী রহ. হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের রহ. থেকে বর্ণনা করেন; মারওয়ান ও মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উভয়ে তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
(إنا لا ندري من أذن منكم في ذلك ممن لم يأذن فارجعوا حتى يرفعوا إلينا عرفاؤكم أمركم فرجع الناس فكلمهم عرفاؤهم ثم رجعوا إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فأخبروه أنهم قد طيبوا وأذنوا)
‘আমরা জানতে পারছি না যে, তোমাদের কে (বন্দীদের ফিরিয়ে দিতে) অনুমতি দিচ্ছে আর কে দিচ্ছে না। তোমরা ফিরে যাও। তোমাদের (সম্মতি-অসম্মতির) বিষয়টা তোমাদের সর্দারগণ আমাদের নিকট পেশ করা পর্যন্ত আমি কোন ফায়াসালা দিচ্ছি না। এতে লোকজন ফিরে যায়। অতঃপর তাদের সর্দারগণ তাদের সাথে কথা বলে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সংবাদ দেয় যে, তারা সন্তুষ্ট চিত্তে অনুমতি দিয়েছে।’
عرفاء হচ্ছে عريف এর বহুবচন। عريف বলে- যে ব্যক্তি نقيب এর মতো কওমের অবস্থাদি ও অন্যান্য বিষয়ের খবরাখবর রাখে। এ হাদিস এভাবে দলীল হচ্ছে যে, হাদিসে পাওয়া গেল, লোকজন বিভিন্ন জামাতে বিভক্ত ছিল, যাদের প্রত্যেক জামাতের একজন করে عريف ছিল। এটি দলীল যে, এমন দল গঠন বৈধ, যে দলের একজন প্রধান থাকবেন, যিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন। যেমন, কোন গোষ্ঠীর শায়খ, কোন জনপদের বড় ব্যক্তিটি এবং কওমের অগ্রগণ্য লোকটি নেতৃত্ব দেন। এবং এ রকম আরো অন্যান্য। মুসলমানদের মাঝে সর্বদাই এমনটি চলে আসছে। কেউ তাতে আপত্তি করেনি। কেউ তাতে প্রশ্ন তুলেনি। এর মাঝে এবং নিজেদেরই একজনকে আমীর নির্ধারণ করে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচারের জন্য কোন জামাত গঠনের মাঝে কোন তফাৎ নেই।
ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন,
‘عريف ও নিরীক্ষক নিযুক্ত করা ইমামের জন্য সুন্নত। কেননা, ইমামের জন্য সবকিছু সরাসরি নিজে দেখাশুনা করা সম্ভব নয়। কাজেই এমন কিছু লোক তার দরকার, যাদেরকে তিনি তার সহায়তার জন্য এবং এসব বিষয়ের কতক অংশ আঞ্জাম দেয়ার জন্য নির্বাচন করে নেবেন। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত করেছেন। যেন তারা পরস্পর পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন, সকল লোক যেন একশ্রেণীভুক্ত না হয়। কেননা, এমনটা হলে সুলতানের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।’- ইবনে বাত্তাল রহ. কৃত সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ: ৮/২৪৯
সাত.
শরয়ী দলীল প্রমাণ দিয়ে প্রমাণিত যে, ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে থাকা শরীয়তের অন্যতম মাকসাদ। একতাবদ্ধতা, জামাতের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জামাতে সাথে জড়িত হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদায়ক এবং একাকী, বিচ্ছিন্ন ও পৃথক থাকা থেকে সতর্কীকরণমূলক অসংখ্য নস ও বিধি বিধান এটি বুঝাচ্ছে। এসব নসের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি:
১.
عن ابن عباس - رضي الله عنهما -: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «خير الصحابة: أربعة وخير السرايا: أربعمائة، وخير الجيوش: أربعة آلاف، ولن يغلب اثنا عشر ألفا من قلة». أخرجه الترمذي،وأبو داود.
‘হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সর্বোত্তম সাথী হল চার জন। ছোট বাহিনির মধ্যে সর্বোত্তম হল, চার শত জনের বাহিনি। বড় বাহিনির মধ্যে সর্বোত্তম হল, চার হাজারের বাহিনি। আর বার হাজারের বাহিনি কিছুতেই সংখ্যাস্বল্পতার কারণে পরাজিত হবে না।’- তিরমিযি, আবু দাউদ।
২.
عن أبي الدرداء - رضي الله عنه - قال: سمعت رسول الله -صلى الله عليه وسلم- يقول: «ما من ثلاثة في قرية ولا بدو لا تقام فيهم الصلاة، إلا قد استحوذ عليهم الشيطان، فعليك بالجماعة، فإنما يأكل الذئب من الغنم القاصية».أخرجه أبو داود والنسائي.
‘হযরত আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোন গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি তিন জন লোক থাকে আর তাদের মাঝে নামায কায়েম না করা হয়, তাহলে শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়ে যায়। *কাজেই, তুমি জামাতের সঙ্গে থাক। কেননা, দলবিচ্ছিন্ন বকরিকেই বাঘে খেয়ে থাকে।’- আবু দাউদ, নাসায়ী।
৩.
عن عبد الله بن عمر - رضي الله عنهما - قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «لو يعلم الناس ما في الوحدة ما أعلم ما سار راكب بليل وحده» أخرجه البخاري والترمذي.
‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একাকী থাকার মাঝে যে ক্ষতির কথা আমি জানি লোকজন যদি তা জানতো, তাহলে কোন আরোহী রাত্রি বেলায় একাকি আরোহণ করতো না।’- বুখারী, তিরমিযি।
৪.
عن سعيد بن المسيب - رحمه الله - أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال: «الشيطان يهم بالواحد وبالاثنين، فإذا كانوا ثلاثة ما يهم، بهم». أخرجه الموطأ.
‘সায়িদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, শয়তান এক জন ও দুই জনের প্রতি লোভ করে। তিন জন হয়ে গেলে আর করে না।’- মুআত্তা।
৫.
عن عمرو بن شعيب - رحمه الله - عن أبيه عن جده قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «الراكب شيطان، والراكبان شيطانان، والثلاثة ركب» أخرجه الموطأ وأبو داود والترمذي.
‘আমর ইবনে শুয়াইব রহ. তার পিতৃসূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একাকী আরোহী ব্যক্তি শয়তান। দুই জান আরোহীও শয়তান। তিন জন হল পূর্ণ আরোহী জামাত।’- *মুআত্তা, আবু দাউদ, তিরমিযি।
৬.
عن ابن عمر، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لن يجمع الله أمتي على ضلالة، ويد الله على الجماعة» هكذا - ورفع يديه - «فإنه من شذ شذ في النار» رواه الخطيب البغدادي في "الفقيه والمتفقه" وابن أبي عاصم في السنة. وقال علي بن أبي طالب - رضي الله عنه - كدر الجماعة خير من صفو الفرد.
‘হযরত ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহির ব্যাপারে একমত করবেন না। জামাতের উপর আল্লাহ তাআলার হাত আছে। - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উভয় হাত উঁচু করে দেখান- এভাবে। কাজেই যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হবে, সে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’
হাদিসটি খতীব বাগদাদি ‘আলফকিহ্ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ কিতাবে এবং ইবনে আবি আসেম ‘আসসুন্নাহ্’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘জামাতের ঘোলাটাও একক ব্যক্তির স্বচ্ছটা অপেক্ষা উত্তম।’
আট.
যেসব দলীল উল্লেখ করেছি, সেগুলো যে শুধু জামাত ও তানজীমের বৈধতাই বুঝাচ্ছে তাই নয়; বরং বিষয়টি ফরয পর্যায়ে গড়াবে। কেননা, আজকের দুনিয়ায় দ্বীনি খেদমতের কোন কাজই সংঘবদ্ধভাবে হওয়া ব্যতীত ফলপ্রসূ হবে না। আর মূলনীতি হল,
"ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب"
‘যে জিনিস ব্যতীত ফরয যথাযথ আদায় সম্ভব নয়, সেটাও ফরয।’
যেমনটা মারাক্বিস সুউদ- এ বলা হয়েছে,
وما وجوب واجب قد أطلقا ... به وجوبه به تحققا
এই মূলনীতির স্বপক্ষে একটি দলীল হল, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস। তিনি বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের বৎসর রাসূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাররুজ জাহরান পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন আমাদের মাঝে ঘোষণা দিলেন, শত্রুর মুখোমুখী হতে হবে। ফলে তিনি আমাদেরকে রোযা ভেঙে ফেলতে আদেশ দেন। আমরা সবাই রোযা ভেঙে ফেলি।’ ইমাম তিরমিযি রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, হাদিসটি হাসান সহীহ।
লক্ষণীয়, রোযাদার মুসাফিরের জন্য রোযা ভেঙে ফেলা এমনিতেই জায়েয। কিন্তু যেহেতু রোযা ভাঙা ছাড়া জিহাদ যথাযথ সম্ভব নয়, তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছেন। যাতে মুজাহিদগণ জিহাদে এবং শত্রুর মোকাবেলায় শক্তি পায়। ফলে রোযা ভাঙা ফরয হয়ে গেছে। কেননা, ‘যে জিনিস ব্যতীত ফরয যথাযথ আদায় সম্ভব নয়, সেটাও ফরয।’
এমনই আরেকটি দলীল- আল্লাহ তাআলার এ বাণী,
{وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ} [الأنفال: 60]
‘আর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, যার দ্বারা তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের নিজেদের দুশমনদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখবে।’- আনফাল: ৬০
ই’দাদ ব্যতীত যখন জিহাদ সম্ভব নয়, তখন ই’দাদও ফরয হয়ে গেল।
***
তানজীম ও জামাতের বিরোধীরা জায়েয বাইয়াতকে কেবল মুসলমানদের সার্বজনীন একক খলিফার বাইয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেন। তাদের দাবি, এছাড়া অন্য সকল বাইয়াতের অর্থ দলাদলী ও বিচ্ছিন্নতার দিকে আহ্বান। আর এটা নব আবিষ্কৃত বিদআত।
বাইয়াতকে বিদআত দাবি করার ব্যাপারে আপত্তি আছে। কেনন, বিদআতের সংজ্ঞা হল, ‘বিদআত বলা হয় এমন বিষয়কে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় যেটি করার কারণ ও আবশ্যকতা দেখা দেওয়া সত্তেও এবং সেটি করার সুযোগ থাকা সত্তেও তিনি তা করেননি।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় এসব তানজীম ও জামাতের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। কাজেই, সে যামানায় এগুলো ছিল না বাহানা তুলে এগুলোকে বিদআত বলে দেয়া উচিৎ নয়। এসব তানজীমের অনুরূপ যেসব বিষয়ের আবশ্যকতা তখন দেখা দিয়েছে, সেগুলো সে যামানায়ও পাওয়া গেছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তা আমল করেছেনও। যেমন, عرفاء নির্বাচন।
আর তাদের দাবি, ‘খলিফা ছাড়া অন্য কারো বাইয়াত জায়েয নয়’- ইমাম ত্বহাবি রহ. একে প্রত্যাখান ও খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন,
“যায়েদ ইবনে ওয়াহব থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কোন তিন ব্যক্তি সফরে থাকলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়। এ-ই হল সে আমীর, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীর বানিয়ে গেছেন।’
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার গোলাম নাফে রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান এবং তিনি হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا كان ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم
‘তিন ব্যক্তি সফরে থাকলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।’
নাফে রহ. বলেন, তখন আমি আবু সালামাকে বললাম, তাহলে আপনি আমাদের আমীর।
আবু জা’ফর (তথা ত্বহাবি রহ.) বলেন, লোকজন তাদের আমীরদের থেকে দূরে অবস্থান কালে নিজেদের জন্য যে আমীর বানিয়ে নেবে, উক্ত দুই হাদিস বুঝাচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ আমীরকে মুকিম থাকাবস্থার আমীরদের সমস্তরের সাব্যস্ত করেছেন। তাদের মতো সে আমীরের আদশকেও অবশ্যশ্রবণীয় ও পালনীয় সাব্যস্ত করেছেন।”- বায়ানু মুশকিলিল আছার: ১১/২০৫
সায়্যিদ ইমাম তার মূল্যবান কিতাব ‘আলউমদাহ্ ফি ই’দাদিল উদ্দাহ্’ কিতাবে তাদের এ সংশয়ের অপনোদন করেছেন। সেখানে তিনি সালাফের অনেকগুলো বাইয়াত দেখিয়েছেন, যেগুলো তারা তাদের যামানার খলিফা ছাড়া অন্যদের হাতে দিয়েছেন। কিতাবটি দেখে নেয়া যেতে পারে।
***
তবে মনে রাখতে হবে, আমরা যখন জামাত ও তানজীম গঠনের বৈধতার কথা বলছি- তখন এর অর্থ এই নয় যে, বিদ্যমান প্রত্যেকটি জামাতে যোগ দেয়া বৈধ বলছি। বরং এটি নির্ধারণ হবে প্রত্যেক জামাতের মানহাজের ধরণের ভিত্তিতে। প্রত্যেক এমন জামাত, যার কুরআন সন্নাহ সমর্থিত মানহাজ রয়েছে এবং সেটি বিচ্যুতি ও বিদআত থেকে মুক্ত- তাতে যোগ দেয়া বৈধ। আর প্রত্যেক এমন জামাত, যা বিদআতি মানহাজের উপর চলে, কিংবা বিকৃত ফিকির লালন করে, তাতে যোগ দেয়া জায়েয নয়।
والله اعلم والحمد لله رب العالمين.
উত্তর প্রদানে:
শায়খ আবুল মুনযির আশশানকিতি
সদস্য, শরয়ী বিভাগ, মিম্বারুত তাওহিদ
প্রশ্ন:
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ! আল্লাহ তাআলা আমাদের শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে হিফাযত করুন। সমকালীন মাশায়েখদের কারো কারো থেকে – যেমন শায়খ আলবানী (আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করুন)- শুনছি যে, তারা ফতোয়া দিচ্ছেন, তানজীম এবং আন্দোলনী জামাত গঠন বিদআত। আমাদের ধর্মে তা জায়েয নয়।
কয়েকটি জালেম শাসনব্যবস্থার পতনের পর আমরা কিছুটা স্বাধীনতা পাচ্ছি- যেমনটা আপনারাও জানেন। তাই চাচ্ছি একটা তানজীম তলে একতাবদ্ধ হতে, যা এই জাহিলী সমাজে আমাদের সুরক্ষার উপকরণ হবে। আপনাদের কাছে আবেদন করছি, আপনারা ফতোয়া দিন, এটি জায়েয হবে কি হবে না। আল্লাহ তাআলা আপনাদের মাঝে বারাকাহ দান করুন।
নিবেদক
আবু ফারুক
উত্তর:
بسم الله الرحمن الرحيم الحمد لله رب العالمين وصلى الله على نبيه الكريم وعلى آله وصحبه أجمعين. وبعد:
সকলেরই জানা যে, আল্লাহ তাআলার শরীয়তের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট দলীল ব্যতীত যে কোন মাসআলাতেই হোক- হালাল বা হারামের দাবি করা জায়েয নয়।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ} [النحل: 116].
“তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে তোমাদের যবানা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।”- নাহল: ১১৬
দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহায়তামূলক জামাত ও তানজীম গঠন করা যারা হারাম বলেন, তাদের হাতে নির্ভরযোগ্য কোন শরয়ী দলীল নেই। আর যাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ না থাকবে, তাদের দাবি মিথ্যা।
বাস্তবতা হচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং তানজীম গঠন করা প্রত্যাখানের দাওয়াত মূলত তবিয়ত ও সহজাত প্রকৃতি বিরোধী কাজ। সকল জ্ঞানীর নিকটই স্বীকৃত যে, ঐক্যবদ্ধতা ও ভ্রাতৃত্ব-নুসরতের মাধ্যমে যা করা সম্ভব, বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে তা সম্ভব নয়।
একক ব্যক্তি দুর্বল। কিন্তু তার সহযোগীদের নিয়ে শক্তিশালী। তার এমন কারো প্রয়োজন, যারা তাকে সহায়তা করবে ও শক্তি যোগাবে। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ ও বড় বড় বিষয়াদির বেলায়। যেমনটা মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَأَخِي هَرُونُ هُوَ أَفْصَحُ مِنِّي لِسَانًا فَأَرْسِلْهُ مَعِيَ رِدْءًا يُصَدِّقُنِي إنِّي أَخَافُ أَن يُكَذِّبُونِ (34) قَالَ سَنَشُدُّ عَضُدَكَ بِأَخِيكَ وَنَجْعَلُ لَكُمَا سُلْطَانًا فَلا يَصِلُونَ إلَيْكُمَا بِآيَاتِنَا أَنتُمَا وَمَنِ اتَّبَعَكُمَا الْغَالِبُونَ} [القصص: 34 - 35].
“আমার ভাই হারুন, সে আমা অপেক্ষা প্রাঞ্জলভাষী। অতএব, তাকে আমার সাথে সাহায্যের জন্যে প্রেরণ করুন। সে আমাকে সমর্থন জানাবে। আমি আশংকা করি যে, তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে। আল্লাহ্ বললেন, আমি তোমার বাহু শক্তিশালী করব তোমার ভাই দ্বারা এবং তোমাদের প্রধান্য দান করব। ফলে, তারা তোমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। আমার নিদর্শনাবলীর জোরে তোমরা এবং তোমাদের অনুসারীরা প্রবল থাকবে।”- কাসাস: ৩৪-৩৪
ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া যেমন গত্যন্তর নেই, এমন একজন আমীরেরও কোন বিকল্প নেই, যিনি তাদেরকে পরিচালিত করবেন এবং তার কথা শুনা হবে ও আনুগত্য করা হবে।
لا يصلح الناس فوضى لا سراة لهم .. ولا سراة إذا جهالهم سادوا
والبيت لا يبتنى إلا باعمدة .. ولا عماد إذا لم ترس أوتاد
فإن تجمع أوتاد وأعمدة .. وساكن بلغوا الأمر الذي رادوا
‘আমীর বিহীন অরাজকতার মাঝে শান্তি-শৃংখলা সম্ভব নয় .... আর জাহেলরা যদি আমীর হয়ে বসে থাকে, তাহলে এই নেতৃত্বেরও কোন মূল্য নেই।
খুঁটি বিহীন ঘর দাঁড়াতে পারে না .......................... আর পেরেক না গাড়লে খুঁটিও কাজ দেবে না।
গৃহকর্মী, পেরেক ও খুঁটি একত্র হলেই তখন .... যে বাসনা তারা স্থির করেছে, তাতে কামিয়াব হতে পারবে।’
এটা যে শুধু মনুষ্য সমাজে তা-ই নয়, জন্তু-জানোয়ারের মাঝেও এমনটা দেখা যায়। সকল জন্তুকে আমরা দেখি, তারা দল বেঁধে চলাফেরা করে; একা একা না। প্রত্যেক দলের মাঝে দেখি একটা করে সর্দার থাকে, যেটি এদেরকে সামনে নিয়ে চলে।
(এ গেল যুক্তিভিত্তিক কথা।) আর জামাত ও তানজীম গঠনের পক্ষে (শরয়ী) দলীল যদি দিতে যাই, তাহলে দলীলের তো অভাব নেই। এখানে কয়েকটা উল্লেখ করছি-
এক.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلا تَعَاوَنُوا عَلَى الإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ} [المائدة:2]
‘তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’- মায়েদা: ২
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং নেক ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহায়তা করতে আদেশ দিয়েছেন। আর নেক ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহায়তা করাই দাওয়াতি ও জিহাদি জামাত ও তানজীমসমূহের উদ্দেশ্য। অতএব, এসব জামাত ও তানজীম আয়াতের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ।
দুই.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلا تَفَرَّقُوا}
‘আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’- আলে ইমরান: ১০৩
আল্লাহ তাআলা আদেশ দিচ্ছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাকতে। আর এসব জামাত ও তানজীম মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করার জন্য নয়, যেমনটা কেউ কেউ মনে করে; বরং যতদিন একক জামাত গঠন করার সুযোগ না আসবে, ততদিন এগুলো মুসলমানদেরকে এসবের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ মাত্র। পূর্ণ ও একক ঐক্যের অপেক্ষার বাহানায় মুসলমানদেরকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বিচ্ছিন্ন ছেড়ে রাখা কল্যাণকর কিছু নয়। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা অপেক্ষা আংশিক ঐক্যও শ্রেয়। যা পরিপূর্ণ অর্জন করা যায় না, তা সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়াও যায় না।
সকল ভূখণ্ড ও অঞ্চলের দাঈদের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থন জরুরী। এই সমন্বিত আমলটিই তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন জামাত গঠন করতে তাগাদা দিচ্ছে। কেননা, ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল ও ভিন্ন ভিন্ন কর্মোপোকরণ- সবগুলোই এমন বিষয়, যেগুলো মুসলিম জামাতসমূহের পরস্পরের মাঝে স্বতন্ত্রবৈশিষ্টসম্পন্ন ভিন্নতা সৃষ্টির দাবিদার। যেমনটা জাতি, গোষ্ঠী ও জনপদের ভিন্নতার কারণে স্বাভাবিক হয়ে থাকে। এটা সকল মুসলিম এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার পরিপন্থী না। বরং ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ড, ভিন্ন ভিন্ন আমল ও ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যসম্বলিত দলসমূহের পরস্পরে নিজেদের মাঝেকার ঐক্য অনেক সময় মুসলমানদের সার্বজনীন একক ঐক্য গঠনে সহায়ক হয়।
তিন.
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنْ الْمُنْكَرِ وَأُوْلَئِكَ هُمْ الْمُفْلِحُونَ} [آل عمران: -104]
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি ‘উম্মাহ’ তথা দল থাকা চাই- যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজে বাধা দেবে। আর এরূপ লোকই সফলকাম।’- আলে ইমরান: ১০৪
আমাদের বিবাদমান বিষয়টিতে এ আয়াত সুস্পষ্ট সমাধান। আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে ‘উম্মাহ’ তথা দলবদ্ধভাবে কল্যাণের দিকে আহ্বানের আদেশ দিয়েছেন। ‘উম্মাহ’ বলা হয় জামাতকে। যেমন আল্লাহর তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِنَ النَّاسِ يَسْقُونَ}
‘তিনি (মূসা আলাইহিস সালাম) কূপের কাছে এক উম্মাহ তথা একদল লোককে পেলেন, তারা জন্তুদেরকে পানি পান করানোর কাজে রত।’- কাসাস: ২৩
{مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ}
‘আহলে কিতাবদের মধ্যে একটি উম্মাহ তথা একদল লোক ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তারা গভীর রাতে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সেজদা করে।’- আলে ইমরান: ১১৩
{مِنْهُمْ أُمَّةٌ مُقْتَصِدَةٌ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ سَاءَ مَا يَعْمَلُونَ}
‘তাদের একটি উম্মাহ তথা কিছুসংখ্যক লোক সৎপথের অনুগামী। আর তাদের অনেকে মন্দ কাজ করে যাচ্ছে।’- মায়েদা: ৬৬
জামাত ও তানজীম গঠন (আয়াতে বর্ণিত) এই ‘উম্মাহ’ তথা জামাত সৃষ্টির বাস্তবিক প্রয়োগ বৈ কিছু নয়।
চার.
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا خرج ثلاثة فى سفر فليؤمروا أحدهم
‘তিন ব্যক্তি সফরে বের হলে তারা যেন তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেয়।’- আবু দাউদ।
ইমাম আহমাদ রহ. তার নিজ মুসনাদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لايحل لثلاثة يكونون بفلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم
‘যে কোন তিন ব্যক্তির জন্য কোন মরু ময়দানে অবস্থান করা জায়েয হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেয়।’
এ দুই হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সফরের হালতে এক আমীরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক- যদিও মুসাফিরের সংখ্যা তিন জনই হোক না কেন।
বক্তব্যের ভাষ্য ঈঙ্গিত করছে যে, এর চেয়ে বড় যে কোন বিষয়ে অবশ্যই এক আমীরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেমনটা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ দুই হাদিসের টীকায় বলেন,
‘সবচে’ কম সংখ্যাবিশিষ্ট জামাত ও সবচে’ ছোট্ট ইজতিমার বেলায়ও যখন একজনকে আমীর বানানো আবশ্যক করেছেন, তখন তা এর চেয়ে বড় জামাত ও ইজতিমার বেলায় আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ হচ্ছে।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৬৫
তিনি আরো বলেন,
‘সফরের হালতে সৃষ্টি হওয়া ছোট্ট একটি জামাআতের বেলায়ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন একথা বুঝানোর জন্য যে, সব ধরণের জামাআতের ক্ষেত্রেই আমীর বানিয়ে নেয়া আবশ্যক।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
শাওকানি রহ. বলেন,
‘মরুময়দানে কিংবা সফরে থাকা তিন জনের বেলায়ই যখন এই বিধান; তখন গ্রাম ও শহরে বসবাসরত এর চেয়ে বেশি সংখ্যক, যারা পারস্পরিক জুলুম প্রতিরোধ ও ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর প্রতি মুখাপেক্ষী, তাদের বেলায় তো এ বিধান এর আগেই প্রযোজ্য হবে।’- নাইলুল আওতার: ৯/১২৮
এই আদেশের হেকমত কি- সেদিকে ইশারা করে শাওকানি রহ. বলেন,
‘এটি দলীল যে, তিন বা ততোধিক সংখ্যার সকলের জন্য এই বিধান- তারা তাদের একজনকে তাদের আমীর বানিয়ে নেবে। কেননা, এর মাধ্যমেই তারা পারস্পরিক মতবিরোধ থেকে মুক্তি পাবে, যে মতবিরোধ তাদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করবে। আমীর নির্ধারণ না করলে সকলেই নিজের বুঝ অনুযায়ী স্বেচ্ছাচারিতা দেখাবে। নিজ খাহেশাত মতো কাজ করবে। এভাবে তারা ধ্বংসে নিপতিত হবে। পক্ষান্তরে আমীর বানিয়ে নিলে মতবিরোধ কমে যাবে এবং একতা সৃষ্টি হবে।’- নাইলুল আওতার: ৯/১২৮
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ ব্যাপারে বলেন,
‘কেননা, পারস্পরিক ঐক্যবদ্ধ হওয়া ব্যতীত মানব জাতির মাসলাহাতসমূহের পরিপূর্ণতা সম্ভব নয়। কারণ, তারা একে অপরের মুখাপেক্ষী। আর ঐক্যবদ্ধ হতে গেলে তাদের একজন নেতা আবশ্যক।’- মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/৩৯০
পাঁচ.
ইমাম আহমাদ রহ. নিজ মুসনাদে আবু সালেহের বরাতে হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এবং তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে,
(لا يزال لهذا الأمر أو على هذا الأمر عصابة على الحق ولا يضرهم خلاف من خالفهم حتى يأتيهم أمر الله)
‘এই দ্বীনের সংরক্ষণে সর্বদাই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দল থাকবে। বিরোদ্ধবাদিদের বিরোধীতা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলার ফায়সালা আসার পূর্ব পর্যন্তই তারা অটল থাকবে।’
ইবনে মাজাহ্ রহ. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি ইরশাদ করেন,
(لا تزال طائفة من أمتي قوامة على أمر الله لا يضرها من خالفها تقاتل أعداء الله كلما ذهبت حرب نشبت حرب قوم آخرين حتى تأتيهم الساعة)
‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদাই আল্লাহ তাআলার আদেশর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তাদের বিরোদ্ধবাদিরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা আল্লাহর দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে। যখনই এক যুদ্ধ শেষ হবে, তখনই আরেক কওমের সাথে যুদ্ধের সূচনা হবে। কেয়ামত আসা অবধিই এভাবে চলবে।’ হাদিসটির সনদ হাসান।
এসকল হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, তায়েফায়ে মানসূরা, যারা কেয়ামত অবধি এ দ্বীনের হেফাজত করবে, তারা সংঘবদ্ধ দল হবে। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তি হবে না। তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত "الطائفة" ও "العصابة" বিশেষণ দু’টি থেকে এমনটিই বুঝা যায়।
ছয়.
হাওয়াযেন সম্প্রদায়ের বন্দীদের ঘটনায় ইমাম বুখারী রহ. হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের রহ. থেকে বর্ণনা করেন; মারওয়ান ও মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উভয়ে তার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
(إنا لا ندري من أذن منكم في ذلك ممن لم يأذن فارجعوا حتى يرفعوا إلينا عرفاؤكم أمركم فرجع الناس فكلمهم عرفاؤهم ثم رجعوا إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فأخبروه أنهم قد طيبوا وأذنوا)
‘আমরা জানতে পারছি না যে, তোমাদের কে (বন্দীদের ফিরিয়ে দিতে) অনুমতি দিচ্ছে আর কে দিচ্ছে না। তোমরা ফিরে যাও। তোমাদের (সম্মতি-অসম্মতির) বিষয়টা তোমাদের সর্দারগণ আমাদের নিকট পেশ করা পর্যন্ত আমি কোন ফায়াসালা দিচ্ছি না। এতে লোকজন ফিরে যায়। অতঃপর তাদের সর্দারগণ তাদের সাথে কথা বলে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে সংবাদ দেয় যে, তারা সন্তুষ্ট চিত্তে অনুমতি দিয়েছে।’
عرفاء হচ্ছে عريف এর বহুবচন। عريف বলে- যে ব্যক্তি نقيب এর মতো কওমের অবস্থাদি ও অন্যান্য বিষয়ের খবরাখবর রাখে। এ হাদিস এভাবে দলীল হচ্ছে যে, হাদিসে পাওয়া গেল, লোকজন বিভিন্ন জামাতে বিভক্ত ছিল, যাদের প্রত্যেক জামাতের একজন করে عريف ছিল। এটি দলীল যে, এমন দল গঠন বৈধ, যে দলের একজন প্রধান থাকবেন, যিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন। যেমন, কোন গোষ্ঠীর শায়খ, কোন জনপদের বড় ব্যক্তিটি এবং কওমের অগ্রগণ্য লোকটি নেতৃত্ব দেন। এবং এ রকম আরো অন্যান্য। মুসলমানদের মাঝে সর্বদাই এমনটি চলে আসছে। কেউ তাতে আপত্তি করেনি। কেউ তাতে প্রশ্ন তুলেনি। এর মাঝে এবং নিজেদেরই একজনকে আমীর নির্ধারণ করে দাওয়াত ও দ্বীনের প্রচারের জন্য কোন জামাত গঠনের মাঝে কোন তফাৎ নেই।
ইবনে বাত্তাল রহ. বলেন,
‘عريف ও নিরীক্ষক নিযুক্ত করা ইমামের জন্য সুন্নত। কেননা, ইমামের জন্য সবকিছু সরাসরি নিজে দেখাশুনা করা সম্ভব নয়। কাজেই এমন কিছু লোক তার দরকার, যাদেরকে তিনি তার সহায়তার জন্য এবং এসব বিষয়ের কতক অংশ আঞ্জাম দেয়ার জন্য নির্বাচন করে নেবেন। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত করেছেন। যেন তারা পরস্পর পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন, সকল লোক যেন একশ্রেণীভুক্ত না হয়। কেননা, এমনটা হলে সুলতানের আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।’- ইবনে বাত্তাল রহ. কৃত সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ: ৮/২৪৯
সাত.
শরয়ী দলীল প্রমাণ দিয়ে প্রমাণিত যে, ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে থাকা শরীয়তের অন্যতম মাকসাদ। একতাবদ্ধতা, জামাতের সংখ্যাবৃদ্ধি ও জামাতে সাথে জড়িত হওয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদায়ক এবং একাকী, বিচ্ছিন্ন ও পৃথক থাকা থেকে সতর্কীকরণমূলক অসংখ্য নস ও বিধি বিধান এটি বুঝাচ্ছে। এসব নসের কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি:
১.
عن ابن عباس - رضي الله عنهما -: أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: «خير الصحابة: أربعة وخير السرايا: أربعمائة، وخير الجيوش: أربعة آلاف، ولن يغلب اثنا عشر ألفا من قلة». أخرجه الترمذي،وأبو داود.
‘হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সর্বোত্তম সাথী হল চার জন। ছোট বাহিনির মধ্যে সর্বোত্তম হল, চার শত জনের বাহিনি। বড় বাহিনির মধ্যে সর্বোত্তম হল, চার হাজারের বাহিনি। আর বার হাজারের বাহিনি কিছুতেই সংখ্যাস্বল্পতার কারণে পরাজিত হবে না।’- তিরমিযি, আবু দাউদ।
২.
عن أبي الدرداء - رضي الله عنه - قال: سمعت رسول الله -صلى الله عليه وسلم- يقول: «ما من ثلاثة في قرية ولا بدو لا تقام فيهم الصلاة، إلا قد استحوذ عليهم الشيطان، فعليك بالجماعة، فإنما يأكل الذئب من الغنم القاصية».أخرجه أبو داود والنسائي.
‘হযরত আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোন গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যদি তিন জন লোক থাকে আর তাদের মাঝে নামায কায়েম না করা হয়, তাহলে শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়ে যায়। *কাজেই, তুমি জামাতের সঙ্গে থাক। কেননা, দলবিচ্ছিন্ন বকরিকেই বাঘে খেয়ে থাকে।’- আবু দাউদ, নাসায়ী।
৩.
عن عبد الله بن عمر - رضي الله عنهما - قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «لو يعلم الناس ما في الوحدة ما أعلم ما سار راكب بليل وحده» أخرجه البخاري والترمذي.
‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একাকী থাকার মাঝে যে ক্ষতির কথা আমি জানি লোকজন যদি তা জানতো, তাহলে কোন আরোহী রাত্রি বেলায় একাকি আরোহণ করতো না।’- বুখারী, তিরমিযি।
৪.
عن سعيد بن المسيب - رحمه الله - أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال: «الشيطان يهم بالواحد وبالاثنين، فإذا كانوا ثلاثة ما يهم، بهم». أخرجه الموطأ.
‘সায়িদ ইবনে মুসাইয়াব রহ. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, শয়তান এক জন ও দুই জনের প্রতি লোভ করে। তিন জন হয়ে গেলে আর করে না।’- মুআত্তা।
৫.
عن عمرو بن شعيب - رحمه الله - عن أبيه عن جده قال: قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: «الراكب شيطان، والراكبان شيطانان، والثلاثة ركب» أخرجه الموطأ وأبو داود والترمذي.
‘আমর ইবনে শুয়াইব রহ. তার পিতৃসূত্রে তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, একাকী আরোহী ব্যক্তি শয়তান। দুই জান আরোহীও শয়তান। তিন জন হল পূর্ণ আরোহী জামাত।’- *মুআত্তা, আবু দাউদ, তিরমিযি।
৬.
عن ابن عمر، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «لن يجمع الله أمتي على ضلالة، ويد الله على الجماعة» هكذا - ورفع يديه - «فإنه من شذ شذ في النار» رواه الخطيب البغدادي في "الفقيه والمتفقه" وابن أبي عاصم في السنة. وقال علي بن أبي طالب - رضي الله عنه - كدر الجماعة خير من صفو الفرد.
‘হযরত ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহির ব্যাপারে একমত করবেন না। জামাতের উপর আল্লাহ তাআলার হাত আছে। - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উভয় হাত উঁচু করে দেখান- এভাবে। কাজেই যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হবে, সে বিচ্ছিন্ন হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’
হাদিসটি খতীব বাগদাদি ‘আলফকিহ্ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ কিতাবে এবং ইবনে আবি আসেম ‘আসসুন্নাহ্’ কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘জামাতের ঘোলাটাও একক ব্যক্তির স্বচ্ছটা অপেক্ষা উত্তম।’
আট.
যেসব দলীল উল্লেখ করেছি, সেগুলো যে শুধু জামাত ও তানজীমের বৈধতাই বুঝাচ্ছে তাই নয়; বরং বিষয়টি ফরয পর্যায়ে গড়াবে। কেননা, আজকের দুনিয়ায় দ্বীনি খেদমতের কোন কাজই সংঘবদ্ধভাবে হওয়া ব্যতীত ফলপ্রসূ হবে না। আর মূলনীতি হল,
"ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب"
‘যে জিনিস ব্যতীত ফরয যথাযথ আদায় সম্ভব নয়, সেটাও ফরয।’
যেমনটা মারাক্বিস সুউদ- এ বলা হয়েছে,
وما وجوب واجب قد أطلقا ... به وجوبه به تحققا
এই মূলনীতির স্বপক্ষে একটি দলীল হল, হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস। তিনি বলেন, ‘মক্কা বিজয়ের বৎসর রাসূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাররুজ জাহরান পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন আমাদের মাঝে ঘোষণা দিলেন, শত্রুর মুখোমুখী হতে হবে। ফলে তিনি আমাদেরকে রোযা ভেঙে ফেলতে আদেশ দেন। আমরা সবাই রোযা ভেঙে ফেলি।’ ইমাম তিরমিযি রহ. হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, হাদিসটি হাসান সহীহ।
লক্ষণীয়, রোযাদার মুসাফিরের জন্য রোযা ভেঙে ফেলা এমনিতেই জায়েয। কিন্তু যেহেতু রোযা ভাঙা ছাড়া জিহাদ যথাযথ সম্ভব নয়, তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ভেঙে ফেলার আদেশ দিয়েছেন। যাতে মুজাহিদগণ জিহাদে এবং শত্রুর মোকাবেলায় শক্তি পায়। ফলে রোযা ভাঙা ফরয হয়ে গেছে। কেননা, ‘যে জিনিস ব্যতীত ফরয যথাযথ আদায় সম্ভব নয়, সেটাও ফরয।’
এমনই আরেকটি দলীল- আল্লাহ তাআলার এ বাণী,
{وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ} [الأنفال: 60]
‘আর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, যার দ্বারা তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের নিজেদের দুশমনদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখবে।’- আনফাল: ৬০
ই’দাদ ব্যতীত যখন জিহাদ সম্ভব নয়, তখন ই’দাদও ফরয হয়ে গেল।
***
তানজীম ও জামাতের বিরোধীরা জায়েয বাইয়াতকে কেবল মুসলমানদের সার্বজনীন একক খলিফার বাইয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেন। তাদের দাবি, এছাড়া অন্য সকল বাইয়াতের অর্থ দলাদলী ও বিচ্ছিন্নতার দিকে আহ্বান। আর এটা নব আবিষ্কৃত বিদআত।
বাইয়াতকে বিদআত দাবি করার ব্যাপারে আপত্তি আছে। কেনন, বিদআতের সংজ্ঞা হল, ‘বিদআত বলা হয় এমন বিষয়কে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় যেটি করার কারণ ও আবশ্যকতা দেখা দেওয়া সত্তেও এবং সেটি করার সুযোগ থাকা সত্তেও তিনি তা করেননি।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় এসব তানজীম ও জামাতের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। কাজেই, সে যামানায় এগুলো ছিল না বাহানা তুলে এগুলোকে বিদআত বলে দেয়া উচিৎ নয়। এসব তানজীমের অনুরূপ যেসব বিষয়ের আবশ্যকতা তখন দেখা দিয়েছে, সেগুলো সে যামানায়ও পাওয়া গেছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তা আমল করেছেনও। যেমন, عرفاء নির্বাচন।
আর তাদের দাবি, ‘খলিফা ছাড়া অন্য কারো বাইয়াত জায়েয নয়’- ইমাম ত্বহাবি রহ. একে প্রত্যাখান ও খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেন,
“যায়েদ ইবনে ওয়াহব থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘কোন তিন ব্যক্তি সফরে থাকলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়। এ-ই হল সে আমীর, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমীর বানিয়ে গেছেন।’
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার গোলাম নাফে রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান এবং তিনি হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذا كان ثلاثة في سفر فليؤمروا أحدهم
‘তিন ব্যক্তি সফরে থাকলে তারা যেন তাদের একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়।’
নাফে রহ. বলেন, তখন আমি আবু সালামাকে বললাম, তাহলে আপনি আমাদের আমীর।
আবু জা’ফর (তথা ত্বহাবি রহ.) বলেন, লোকজন তাদের আমীরদের থেকে দূরে অবস্থান কালে নিজেদের জন্য যে আমীর বানিয়ে নেবে, উক্ত দুই হাদিস বুঝাচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ আমীরকে মুকিম থাকাবস্থার আমীরদের সমস্তরের সাব্যস্ত করেছেন। তাদের মতো সে আমীরের আদশকেও অবশ্যশ্রবণীয় ও পালনীয় সাব্যস্ত করেছেন।”- বায়ানু মুশকিলিল আছার: ১১/২০৫
সায়্যিদ ইমাম তার মূল্যবান কিতাব ‘আলউমদাহ্ ফি ই’দাদিল উদ্দাহ্’ কিতাবে তাদের এ সংশয়ের অপনোদন করেছেন। সেখানে তিনি সালাফের অনেকগুলো বাইয়াত দেখিয়েছেন, যেগুলো তারা তাদের যামানার খলিফা ছাড়া অন্যদের হাতে দিয়েছেন। কিতাবটি দেখে নেয়া যেতে পারে।
***
তবে মনে রাখতে হবে, আমরা যখন জামাত ও তানজীম গঠনের বৈধতার কথা বলছি- তখন এর অর্থ এই নয় যে, বিদ্যমান প্রত্যেকটি জামাতে যোগ দেয়া বৈধ বলছি। বরং এটি নির্ধারণ হবে প্রত্যেক জামাতের মানহাজের ধরণের ভিত্তিতে। প্রত্যেক এমন জামাত, যার কুরআন সন্নাহ সমর্থিত মানহাজ রয়েছে এবং সেটি বিচ্যুতি ও বিদআত থেকে মুক্ত- তাতে যোগ দেয়া বৈধ। আর প্রত্যেক এমন জামাত, যা বিদআতি মানহাজের উপর চলে, কিংবা বিকৃত ফিকির লালন করে, তাতে যোগ দেয়া জায়েয নয়।
والله اعلم والحمد لله رب العالمين.
উত্তর প্রদানে:
শায়খ আবুল মুনযির আশশানকিতি
সদস্য, শরয়ী বিভাগ, মিম্বারুত তাওহিদ
Comment