মৃত্যু যখন এত কাছে :
এক :
মাত্রই দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছি। বড় বোনের বাড়ি যাওয়ার দাওয়াত এল। সিএনজি চালিত লেগুনাতে উঠলাম। প্রশস্ত পথ চিড়ে গাড়ি ছুটে চলছে গন্তব্য পানে। হঠাৎ গাড়ির সামনের চাকা ব্লাস্ট হয়ে গেল। গাড়ি কেঁপে উঠল। সাথে যাত্রীরাও। দেখতে না দেখতে মুহূর্তেই ঘটে গেল ঘটনাটি। কাত হয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে গাড়ি গড়িয়ে পড়ল রাস্তার কিনারে। ভেতরে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবাই আলুভর্তা হবার যোগার। একের ওপর অন্যজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কেউ পদতলে, কেউ বগল চাপায় আর কেউ ভেঙে যাওয়া টুকরোর আঘাতে; সবাই কমবেশ ক্ষতবিক্ষত। গাড়ির দরজা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কেউ সহজে বের হতে পারছে না। সবাইকে বের হবার সুযোগ করে দিলাম। অনেকের হাত-পা ধরে বের হতে সাহায্য করলাম। সবাই বের হওয়ার পর নিজেও বের হয়ে এলাম। যাত্রীদের অবস্থা ভয়ানক। অর্ধেকের মতো যাত্রী আধামরা বেহুঁশ। বাকিদের প্রায় সবাই-ই কমবেশ আহত। নিজের প্রতি লক্ষ করলাম যে, আমার আঘাত কেমন। না, তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন নজরে পড়ল না। শুধু কানে হাত দিলে দেখলাম, কানের পাশে সামান্য এক ফোঁটা রক্ত। কিন্তু কোনো আঘাত বা ব্যথা অনুভব করলাম না। আশপাশের লোকজন সবাই আহত যাত্রীদের সেবা ও হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। আমাকে কেউ যাত্রী ভাবছে না। আমিও কয়েকজনের সাহায্যে হাত বাড়ালাম। পরে তাদের কী হয়েছিল, খোঁজ নিতে পারিনি। শারীরিকভাবে সম্ভবত আমি একজনই অক্ষত ছিলাম। আল্লাহর শোকর। এখানে তিনভাবে মৃত্যুর আশংকা ছিল। ক. গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে গেলে পুরো গাড়িতে আগুন ধরে যেত। বের হওয়ার চান্স ছিল না বললেই চলে। খ. রোডে হরদম বড় ও ভারী গাড়ি চলমান। গাড়ির চাপায় পড়লে পিষ্ট হয়ে যেতাম সবাই। আল্লাহর রহম যে, এক্সিডেন্টের সময় সামনে পেছনে বড় কোনো গাড়ি ছিল না। গ. রাস্তার পাশে ছিল গভীর পানির খাল। আল্লাহর মেহেরবানি যে, গাড়িটি রাস্তার পাশে থাকা একটি গাছে আটকে গিয়েছিল। নইলে সরাসরি পানিতে পড়ে সবার সলিল সমাধি ঘটতে পারত।
দুই :
ইফতা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন। জন্ডিসে আক্রান্ত হলাম। সাধারণ জন্ডিস নয়, বি-ভাইরাসযুক্ত মারাত্মক এক জন্ডিস। বাড়ি চলে এলাম। টেস্ট করার পর জানা গেল, জন্ডিসের পয়েন্ট ৩.৫০ -এ পৌঁছেছে। সাধারণত ২ বা ৩ পয়েন্ট হলেই বড় ধরনের জন্ডিস বলে ধরা হয়। টেস্ট রিপোর্টে পুরোপুরি আস্থা আসছিল না। পরদিন আব্বুর সাথে পার্শ্ববর্তী এক জেলার বিখ্যাত এক চিকিৎসকের কাছে গেলাম। বংশানুক্রমিক এ চিকিৎসার বেশ নামডাক। সুনাম আছে, তাদের চিকিৎসা নিয়ে কেউ ব্যর্থ হয়নি। ডাক্তারের কাছে সব হালত খুলে বললে সেখানে আরও ভালোভাবে ব্লাড টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা হলো। এবারের রিপোর্ট ছিল আরও মারাত্মক। ফলাফল দেখাল ৪.৫০ পয়েন্ট। ডাক্তার সান্ত্বনা দিলেন যে, এর চেয়েও মারাত্মক রোগী তাদের চিকিৎসায় নিরাময় লাভ করেছে। পনেরো দিনের ওষুধ ও কিছু দিকনির্দেশনা নিয়ে ফিরে এলাম। প্রতিদিন তিন চারবার গোসলের পাশাপাশি কঠোর নিয়ম পালন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলাম। মাছ, গোশত, ডিম, দুধসহ ভালোমানের সব খাবারে নিষেধাজ্ঞা। নিরামিষ আর সব্জি খেতে খেতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। পনেরো দিন পর ডাক্তারের কাছে গেলে আবারও সেই একই ওষুধ ও নিয়ম বাতলে দিলেন। টেস্ট করাতে চাইলে অনুমতি মিলল না। কষ্ট ও ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরে এলাম। আবারও পনেরো দিন অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে ডোজ শেষ করলাম। এবার টেস্টের পালা। অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ যে-ই দেখছিল, সবার একই কথা, আমার অবস্থার নাকি উন্নতি তো হয়ইনি; বরং অনেক অনেক অবনতি ঘটেছে। বিষয়টি নিজেও উপলব্ধি করতে পারছিলাম। পুরো শরীর পীতবর্ণের হয়ে গেছে। পেশাব লালচে রং ধারণ করেছে। আব্বু-আম্মুর চোখেও হতাশার ছাপ। তারপরও সবাই আশা করছিল, বাহ্যিক আলামত যতই ভয়ানক হোক, টেস্টে হয়ত ভালো ফলাফল আসবে। ত্রিশতম দিনে নিজ জেলায় টেস্ট করালাম। টেস্টের রিপোর্ট দেখে আমি হার্টফেল হবার যোগাড়। ২৮.৫০ পয়েন্ট! অবিশ্বাস্য!! আমার চাচাত ভাই বলল, এটা ভুল রিপোর্ট। আমিও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সায় দিয়ে বললাম, সম্ভবত তাই হবে। কিন্তু ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। কোনোমতে বাড়ি ফিরে এলাম। আব্বু রিপোর্ট দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভাবগম্ভীর, প্রচণ্ড মেধাবী ও দুর্দান্ত সাহসী মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও ভয়ে চুপসে গেলাম। আম্মু অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। অনুভব করলাম, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। তারপরও সবাই ভাবছে, হয়ত রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হবে। পরদিন আব্বু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সব দেখেশুনে অনেকটা অবাক হলেন। টেস্ট করাতে পাঠালেন। এবার আরও ভয়ংকর রিপোর্ট অপেক্ষা করছিল। একদিনের ব্যবধানে ৩১.৫০ পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছে। এবার ডাক্তারের মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমাদের শেষ যে ধারণা ছিল, সেটুকুও নিমিষে মিলিয়ে গেল। এবার সবাই নিশ্চিত যে, দ্রুতই আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কথায় প্রকাশ করল না কেউ। ডাক্তার আবারও পূর্বের ওষুধ দিয়ে আব্বুকে বলল, আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দুআ করেন। পরিস্থিতি কী হয়, কিছু বুঝতে পারছি না। আজ শত বছর ধরে এ ওষুধ কাজ করে আসছে। কিন্তু এই প্রথম আমাদের ওষুধ খাওয়ার পরও রোগীর এমন অবনতি ঘটল। চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার ওষুধের পাশাপাশি বিশেষভাবে দুআ, রোনাজারি ও সদকা দেওয়া শুরু হলো। একটি খাসী কুরবানি করা হলো। আত্মীয়স্বজন সবাই আসা-যাওয়া ও দেখাশোনা করতে থাকল। আব্বু-আম্মুও চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছিল। যশোরের আমার মুহসিন উস্তাজ বিশেষভাবে দুআ করলেন। তাদের সম্মিলিত দুআ ও রোনাজারি এবার কাজ শুরু করল। ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতির ছোয়া লক্ষ করছিলাম। পনেরো দিন পর এবার রিপোর্ট অনেকটা সুখময় হয়ে আসল। ৩১.৫০ থেকে নেমে এবার ৬.০০ পয়েন্টে চলে এসেছে। সবার মধ্যে স্বস্তি ও উৎফুল্লতা ফিরে এল। এরপর আরও কিছুদিনের নিবিড় পরিচর্যায় ধীরে ধীরে আল্লাহ সুস্থতা দান করলেন। এমনকি বি-ভাইরাস পর্যন্ত দূর হয়ে গেল। ডাক্তারও অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অকপটে স্বীকার করল, এমন পেরেশানিতে কখনও পড়তে হয়নি। আমিও হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি আপনাদের ওপর তাঁর খাস রহমত বর্ষণ করেছেন। এভাবেই মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখে এলাম। এ শোকর কীভাবে আদায় করি, তার কোনো ভাষা জানা নেই। শুধু একটি বাক্যই বলি, "আল-হামদুলিল্লাহ"।
তিন :
সম্ভবত তখন ইফতা তৃতীয় বর্ষে বা উলুমুল হাদিসের প্রথম বর্ষে পড়ি। পারিবারিক একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে আমার একজন উস্তাজ আমন্ত্রিত ছিলেন। পরদিন সকালেই তাঁকে যেতে হবে অনেক দূরের এক সফরে। সকালে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। বললাম, বাইকে করে আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবো ইনশাআল্লাহ। হুজুর খুশি হলেন। সকালে মেঘলা আকাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায়ই হুজুরকে নিয়ে বের হলাম। বাসস্ট্যান্ডে হুজুরকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে বৃষ্টি প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। চোখেমুখে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা কাটা হয়ে বিঁধছে। সকালের রাস্তা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে। সব আমাকেই সামাল দিতে হবে। প্রচণ্ড তাড়া। স্পিডমিটার ৮০/৮৫ ছুঁইছুঁই করছে। সামনে ছোট্ট একটি বাজার। দোকানের মধ্যে থাকা কিছু লোকের চিৎকার শুনতে পেলাম। মনে হলো, আমাকে লক্ষ্য করেই কিছু বলল। পাত্তা দিলাম না। কিন্তু সামনেই ছিল ভয়ংকর বিপদ। বাজার থেকে ১০০ মিটার সামনে যেতেই নজরে পড়ল রাস্তার মাঝে আড়াআড়ি করে কাটা ছয়-সাত ফুট প্রস্থ ও দুই ফুটের মতো গভীর একটি খাল। মাঝে এবড়োখেবড়ো করে কিছু ইট বসানো। বৃষ্টি অধিক হওয়ায় পানি, কাদা, ইট মিলে জগাখিচুড়ি এক রূপ ধারণ করেছে। এখানে আগে কালভার্ট ছিল। কালভার্ট ভেঙে যাওয়ায় রাস্তায় মাটি ভরাট করে কোনোমতে যাওয়ার উপযোগী করা হয়েছে। যাওয়ার সময় কাদা ও পানি না থাকায় এবং হুজুরের সাথে কথা বলতে থাকায় তখন এটা ভালো করে খেয়াল করিনি। আর বৃষ্টির পানিতে যে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে, তা তো কল্পনারও বাহিরে ছিল। তো ৮০/৮৫ স্পিডে বাইক চালিয়ে যখন ভয়ংকর এ খালের কাছাকাছি এসে খালটি নজরে পড়ল, তখন আমার ও খালের মাঝে উনিশ থেকে বিশ ফুটের ব্যবধান। বাইক চালনায় অভিজ্ঞ কারও অজানা নয় যে, এ মুহূর্তে ব্রেক করলে কী অবস্থা হবে। তাছাড়াও বাইকে হাইড্রোলিক ব্রেকও ছিল না। এখন দুটোর যেকোনো একটা অবলম্বন করতে হবে। হয় তাৎক্ষণিক ব্রেক করতে হবে, না-হয় এভাবেই বাইক চালিয়ে দিতে হবে। আমার অবস্থা কূপের রশিতে ঝুলন্ত ঐ ব্যক্তির মতো হয়েছিল, যার ওপরে ছিল ক্ষুধার্ত বাঘ আর নিচে ছিল মুখ হা করা অজগর। আমার হাতে সময় ছিল মাত্র দুই সেকেন্ড। এরই মধ্যে আমাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার ওপর নির্ভর করছে আমার নিহত বা আহত হওয়ার ব্যাপারটি। মাত্র দুই সেকেন্ড। মাথা প্রায় বিস্ফোরণের যোগাড়। মনে হচ্ছে, মাথার মধ্যে লক্ষ-কোটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি হতে পারে। প্রথম সেকেন্ডে সব চিন্তা একসাথে মাথায় এসে ভিড় করল। দ্বিতীয় সেকেন্ডে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, ব্রেক করা যাবে না। এভাবেই বাইকে চালিয়ে দিতে হবে। তাই করলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে শক্ত করে বাইকের ওপর বসে খালে নামিয়ে দিলাম। সামনের চাকা ইটের ওপর না দিয়ে কিছুটা কাদার মধ্যে রাখলাম। তারপরও গতির প্রচণ্ডতায় বাইক ঝাকুনি দিয়ে উঠল। আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। প্রায় দুই হাত শূন্যে উঠে খাল পার হয়ে গেলাম। জানে পানি আসল। পেছনে তাকানোর সাহস হলো না। ভালোই ভয় পেয়েছিলাম। পরে ঐ দোকানে বসে থাকা লোকেরা আমার আব্বুকে বলেছিল, আপনার ছেলের তো মৃত্যু এসেই গিয়েছিল। আমাদের মনে হলো, আল্লাহর ফেরেশতারা এসে আপনার ছেলের বাইক উঁচু করে ধরে ঐ ভয়ংকর খাল পার করে দিয়েছে। আমারও মনে হয়, আল্লাহর খাস রহমত না হলে স্বাভাবিক দক্ষতা দিয়ে নিরাপদে এ খাল পার হওয়া সম্ভব ছিল না। এর শুকরিয়াও যে কীভাবে আদায় করব, কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। শুধু একটি বাক্যই বলি, "আল-হামদুলিল্লাহ"।
এভাবেই আল্লাহ ছোট বড় অসংখ্য বিপদ থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অগণিত রহমত ও মেহেরবানি আমার ওপর বর্ষণ করেছেন। বারবার মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ জীবন তো তাঁর দেওয়া। এ বেঁচে থাকা তো তাঁরই দয়া। তাই এ জীবন তাঁর রাস্তায় দেওয়াতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং এটাই তো তাঁর হক।
জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তাই মৃত্যুর কথাই স্মরণ করি। মৃত্যুর স্মরণই আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপদেশদাতা। তার চেয়ে উপকারী বন্ধু আর কেউ নেই। শয়তান যেন আমাকে মৃত্যুর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে ফেলে, সেজন্য পূর্ণ প্রচেষ্টা ও নিয়মিত দুআ জারি রাখা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
এক :
মাত্রই দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছি। বড় বোনের বাড়ি যাওয়ার দাওয়াত এল। সিএনজি চালিত লেগুনাতে উঠলাম। প্রশস্ত পথ চিড়ে গাড়ি ছুটে চলছে গন্তব্য পানে। হঠাৎ গাড়ির সামনের চাকা ব্লাস্ট হয়ে গেল। গাড়ি কেঁপে উঠল। সাথে যাত্রীরাও। দেখতে না দেখতে মুহূর্তেই ঘটে গেল ঘটনাটি। কাত হয়ে ডিগবাজি খেতে খেতে গাড়ি গড়িয়ে পড়ল রাস্তার কিনারে। ভেতরে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবাই আলুভর্তা হবার যোগার। একের ওপর অন্যজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কেউ পদতলে, কেউ বগল চাপায় আর কেউ ভেঙে যাওয়া টুকরোর আঘাতে; সবাই কমবেশ ক্ষতবিক্ষত। গাড়ির দরজা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কেউ সহজে বের হতে পারছে না। সবাইকে বের হবার সুযোগ করে দিলাম। অনেকের হাত-পা ধরে বের হতে সাহায্য করলাম। সবাই বের হওয়ার পর নিজেও বের হয়ে এলাম। যাত্রীদের অবস্থা ভয়ানক। অর্ধেকের মতো যাত্রী আধামরা বেহুঁশ। বাকিদের প্রায় সবাই-ই কমবেশ আহত। নিজের প্রতি লক্ষ করলাম যে, আমার আঘাত কেমন। না, তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন নজরে পড়ল না। শুধু কানে হাত দিলে দেখলাম, কানের পাশে সামান্য এক ফোঁটা রক্ত। কিন্তু কোনো আঘাত বা ব্যথা অনুভব করলাম না। আশপাশের লোকজন সবাই আহত যাত্রীদের সেবা ও হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। আমাকে কেউ যাত্রী ভাবছে না। আমিও কয়েকজনের সাহায্যে হাত বাড়ালাম। পরে তাদের কী হয়েছিল, খোঁজ নিতে পারিনি। শারীরিকভাবে সম্ভবত আমি একজনই অক্ষত ছিলাম। আল্লাহর শোকর। এখানে তিনভাবে মৃত্যুর আশংকা ছিল। ক. গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে গেলে পুরো গাড়িতে আগুন ধরে যেত। বের হওয়ার চান্স ছিল না বললেই চলে। খ. রোডে হরদম বড় ও ভারী গাড়ি চলমান। গাড়ির চাপায় পড়লে পিষ্ট হয়ে যেতাম সবাই। আল্লাহর রহম যে, এক্সিডেন্টের সময় সামনে পেছনে বড় কোনো গাড়ি ছিল না। গ. রাস্তার পাশে ছিল গভীর পানির খাল। আল্লাহর মেহেরবানি যে, গাড়িটি রাস্তার পাশে থাকা একটি গাছে আটকে গিয়েছিল। নইলে সরাসরি পানিতে পড়ে সবার সলিল সমাধি ঘটতে পারত।
দুই :
ইফতা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন। জন্ডিসে আক্রান্ত হলাম। সাধারণ জন্ডিস নয়, বি-ভাইরাসযুক্ত মারাত্মক এক জন্ডিস। বাড়ি চলে এলাম। টেস্ট করার পর জানা গেল, জন্ডিসের পয়েন্ট ৩.৫০ -এ পৌঁছেছে। সাধারণত ২ বা ৩ পয়েন্ট হলেই বড় ধরনের জন্ডিস বলে ধরা হয়। টেস্ট রিপোর্টে পুরোপুরি আস্থা আসছিল না। পরদিন আব্বুর সাথে পার্শ্ববর্তী এক জেলার বিখ্যাত এক চিকিৎসকের কাছে গেলাম। বংশানুক্রমিক এ চিকিৎসার বেশ নামডাক। সুনাম আছে, তাদের চিকিৎসা নিয়ে কেউ ব্যর্থ হয়নি। ডাক্তারের কাছে সব হালত খুলে বললে সেখানে আরও ভালোভাবে ব্লাড টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা হলো। এবারের রিপোর্ট ছিল আরও মারাত্মক। ফলাফল দেখাল ৪.৫০ পয়েন্ট। ডাক্তার সান্ত্বনা দিলেন যে, এর চেয়েও মারাত্মক রোগী তাদের চিকিৎসায় নিরাময় লাভ করেছে। পনেরো দিনের ওষুধ ও কিছু দিকনির্দেশনা নিয়ে ফিরে এলাম। প্রতিদিন তিন চারবার গোসলের পাশাপাশি কঠোর নিয়ম পালন করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলাম। মাছ, গোশত, ডিম, দুধসহ ভালোমানের সব খাবারে নিষেধাজ্ঞা। নিরামিষ আর সব্জি খেতে খেতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। পনেরো দিন পর ডাক্তারের কাছে গেলে আবারও সেই একই ওষুধ ও নিয়ম বাতলে দিলেন। টেস্ট করাতে চাইলে অনুমতি মিলল না। কষ্ট ও ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরে এলাম। আবারও পনেরো দিন অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে ডোজ শেষ করলাম। এবার টেস্টের পালা। অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ যে-ই দেখছিল, সবার একই কথা, আমার অবস্থার নাকি উন্নতি তো হয়ইনি; বরং অনেক অনেক অবনতি ঘটেছে। বিষয়টি নিজেও উপলব্ধি করতে পারছিলাম। পুরো শরীর পীতবর্ণের হয়ে গেছে। পেশাব লালচে রং ধারণ করেছে। আব্বু-আম্মুর চোখেও হতাশার ছাপ। তারপরও সবাই আশা করছিল, বাহ্যিক আলামত যতই ভয়ানক হোক, টেস্টে হয়ত ভালো ফলাফল আসবে। ত্রিশতম দিনে নিজ জেলায় টেস্ট করালাম। টেস্টের রিপোর্ট দেখে আমি হার্টফেল হবার যোগাড়। ২৮.৫০ পয়েন্ট! অবিশ্বাস্য!! আমার চাচাত ভাই বলল, এটা ভুল রিপোর্ট। আমিও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সায় দিয়ে বললাম, সম্ভবত তাই হবে। কিন্তু ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। কোনোমতে বাড়ি ফিরে এলাম। আব্বু রিপোর্ট দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভাবগম্ভীর, প্রচণ্ড মেধাবী ও দুর্দান্ত সাহসী মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমিও ভয়ে চুপসে গেলাম। আম্মু অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। অনুভব করলাম, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। তারপরও সবাই ভাবছে, হয়ত রিপোর্ট ভুল প্রমাণিত হবে। পরদিন আব্বু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সব দেখেশুনে অনেকটা অবাক হলেন। টেস্ট করাতে পাঠালেন। এবার আরও ভয়ংকর রিপোর্ট অপেক্ষা করছিল। একদিনের ব্যবধানে ৩১.৫০ পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছে। এবার ডাক্তারের মুখও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমাদের শেষ যে ধারণা ছিল, সেটুকুও নিমিষে মিলিয়ে গেল। এবার সবাই নিশ্চিত যে, দ্রুতই আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কথায় প্রকাশ করল না কেউ। ডাক্তার আবারও পূর্বের ওষুধ দিয়ে আব্বুকে বলল, আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দুআ করেন। পরিস্থিতি কী হয়, কিছু বুঝতে পারছি না। আজ শত বছর ধরে এ ওষুধ কাজ করে আসছে। কিন্তু এই প্রথম আমাদের ওষুধ খাওয়ার পরও রোগীর এমন অবনতি ঘটল। চরম হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার ওষুধের পাশাপাশি বিশেষভাবে দুআ, রোনাজারি ও সদকা দেওয়া শুরু হলো। একটি খাসী কুরবানি করা হলো। আত্মীয়স্বজন সবাই আসা-যাওয়া ও দেখাশোনা করতে থাকল। আব্বু-আম্মুও চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছিল। যশোরের আমার মুহসিন উস্তাজ বিশেষভাবে দুআ করলেন। তাদের সম্মিলিত দুআ ও রোনাজারি এবার কাজ শুরু করল। ধীরে ধীরে কিছুটা উন্নতির ছোয়া লক্ষ করছিলাম। পনেরো দিন পর এবার রিপোর্ট অনেকটা সুখময় হয়ে আসল। ৩১.৫০ থেকে নেমে এবার ৬.০০ পয়েন্টে চলে এসেছে। সবার মধ্যে স্বস্তি ও উৎফুল্লতা ফিরে এল। এরপর আরও কিছুদিনের নিবিড় পরিচর্যায় ধীরে ধীরে আল্লাহ সুস্থতা দান করলেন। এমনকি বি-ভাইরাস পর্যন্ত দূর হয়ে গেল। ডাক্তারও অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অকপটে স্বীকার করল, এমন পেরেশানিতে কখনও পড়তে হয়নি। আমিও হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহর শুকরিয়া যে, তিনি আপনাদের ওপর তাঁর খাস রহমত বর্ষণ করেছেন। এভাবেই মৃত্যুকে অনেক কাছ থেকে দেখে এলাম। এ শোকর কীভাবে আদায় করি, তার কোনো ভাষা জানা নেই। শুধু একটি বাক্যই বলি, "আল-হামদুলিল্লাহ"।
তিন :
সম্ভবত তখন ইফতা তৃতীয় বর্ষে বা উলুমুল হাদিসের প্রথম বর্ষে পড়ি। পারিবারিক একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে আমার একজন উস্তাজ আমন্ত্রিত ছিলেন। পরদিন সকালেই তাঁকে যেতে হবে অনেক দূরের এক সফরে। সকালে গাড়ি পাওয়া মুশকিল। বললাম, বাইকে করে আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবো ইনশাআল্লাহ। হুজুর খুশি হলেন। সকালে মেঘলা আকাশে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায়ই হুজুরকে নিয়ে বের হলাম। বাসস্ট্যান্ডে হুজুরকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে বৃষ্টি প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। চোখেমুখে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা কাটা হয়ে বিঁধছে। সকালের রাস্তা ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। বাসায় অনেক কাজ পড়ে আছে। সব আমাকেই সামাল দিতে হবে। প্রচণ্ড তাড়া। স্পিডমিটার ৮০/৮৫ ছুঁইছুঁই করছে। সামনে ছোট্ট একটি বাজার। দোকানের মধ্যে থাকা কিছু লোকের চিৎকার শুনতে পেলাম। মনে হলো, আমাকে লক্ষ্য করেই কিছু বলল। পাত্তা দিলাম না। কিন্তু সামনেই ছিল ভয়ংকর বিপদ। বাজার থেকে ১০০ মিটার সামনে যেতেই নজরে পড়ল রাস্তার মাঝে আড়াআড়ি করে কাটা ছয়-সাত ফুট প্রস্থ ও দুই ফুটের মতো গভীর একটি খাল। মাঝে এবড়োখেবড়ো করে কিছু ইট বসানো। বৃষ্টি অধিক হওয়ায় পানি, কাদা, ইট মিলে জগাখিচুড়ি এক রূপ ধারণ করেছে। এখানে আগে কালভার্ট ছিল। কালভার্ট ভেঙে যাওয়ায় রাস্তায় মাটি ভরাট করে কোনোমতে যাওয়ার উপযোগী করা হয়েছে। যাওয়ার সময় কাদা ও পানি না থাকায় এবং হুজুরের সাথে কথা বলতে থাকায় তখন এটা ভালো করে খেয়াল করিনি। আর বৃষ্টির পানিতে যে এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে, তা তো কল্পনারও বাহিরে ছিল। তো ৮০/৮৫ স্পিডে বাইক চালিয়ে যখন ভয়ংকর এ খালের কাছাকাছি এসে খালটি নজরে পড়ল, তখন আমার ও খালের মাঝে উনিশ থেকে বিশ ফুটের ব্যবধান। বাইক চালনায় অভিজ্ঞ কারও অজানা নয় যে, এ মুহূর্তে ব্রেক করলে কী অবস্থা হবে। তাছাড়াও বাইকে হাইড্রোলিক ব্রেকও ছিল না। এখন দুটোর যেকোনো একটা অবলম্বন করতে হবে। হয় তাৎক্ষণিক ব্রেক করতে হবে, না-হয় এভাবেই বাইক চালিয়ে দিতে হবে। আমার অবস্থা কূপের রশিতে ঝুলন্ত ঐ ব্যক্তির মতো হয়েছিল, যার ওপরে ছিল ক্ষুধার্ত বাঘ আর নিচে ছিল মুখ হা করা অজগর। আমার হাতে সময় ছিল মাত্র দুই সেকেন্ড। এরই মধ্যে আমাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যার ওপর নির্ভর করছে আমার নিহত বা আহত হওয়ার ব্যাপারটি। মাত্র দুই সেকেন্ড। মাথা প্রায় বিস্ফোরণের যোগাড়। মনে হচ্ছে, মাথার মধ্যে লক্ষ-কোটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি হতে পারে। প্রথম সেকেন্ডে সব চিন্তা একসাথে মাথায় এসে ভিড় করল। দ্বিতীয় সেকেন্ডে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, ব্রেক করা যাবে না। এভাবেই বাইকে চালিয়ে দিতে হবে। তাই করলাম। আল্লাহর নাম নিয়ে স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে শক্ত করে বাইকের ওপর বসে খালে নামিয়ে দিলাম। সামনের চাকা ইটের ওপর না দিয়ে কিছুটা কাদার মধ্যে রাখলাম। তারপরও গতির প্রচণ্ডতায় বাইক ঝাকুনি দিয়ে উঠল। আমিও এটাই চাচ্ছিলাম। প্রায় দুই হাত শূন্যে উঠে খাল পার হয়ে গেলাম। জানে পানি আসল। পেছনে তাকানোর সাহস হলো না। ভালোই ভয় পেয়েছিলাম। পরে ঐ দোকানে বসে থাকা লোকেরা আমার আব্বুকে বলেছিল, আপনার ছেলের তো মৃত্যু এসেই গিয়েছিল। আমাদের মনে হলো, আল্লাহর ফেরেশতারা এসে আপনার ছেলের বাইক উঁচু করে ধরে ঐ ভয়ংকর খাল পার করে দিয়েছে। আমারও মনে হয়, আল্লাহর খাস রহমত না হলে স্বাভাবিক দক্ষতা দিয়ে নিরাপদে এ খাল পার হওয়া সম্ভব ছিল না। এর শুকরিয়াও যে কীভাবে আদায় করব, কোনো ভাষা খুঁজে পাই না। শুধু একটি বাক্যই বলি, "আল-হামদুলিল্লাহ"।
এভাবেই আল্লাহ ছোট বড় অসংখ্য বিপদ থেকে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অগণিত রহমত ও মেহেরবানি আমার ওপর বর্ষণ করেছেন। বারবার মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ জীবন তো তাঁর দেওয়া। এ বেঁচে থাকা তো তাঁরই দয়া। তাই এ জীবন তাঁর রাস্তায় দেওয়াতে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং এটাই তো তাঁর হক।
জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তাই মৃত্যুর কথাই স্মরণ করি। মৃত্যুর স্মরণই আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপদেশদাতা। তার চেয়ে উপকারী বন্ধু আর কেউ নেই। শয়তান যেন আমাকে মৃত্যুর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে ফেলে, সেজন্য পূর্ণ প্রচেষ্টা ও নিয়মিত দুআ জারি রাখা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন।
#সংগৃহীত
Comment