সামরিক কাজে গোপনীয়তা
সংশয়-২রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি ময়দানে নেমে কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এমনই করেছেন। আমাদের আকাবিরগণও এমনই করেছেন। আমরা বর্তমানে যে লুকিয়ে লুকিয়ে – গুপ্ত হত্যা বা গেরিলা – জিহাদ করি, এটা কি জায়েয? ইসলাম তো যা করে প্রকাশ্যে করে। এভাবে লুকিয়ে কেন? এটা কি জিহাদ?
নিরসন
بسم الله الرحمن الرحيم
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وصحبه أجمعين. أما بعد
وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وآله وصحبه أجمعين. أما بعد
ইসলামে গোপনীয়তা
[ইসলাম যা করে প্রকাশ্যে করে]- কথাটা ঢালাওভাবে সহীহ নয়। সহীহ হচ্ছে, ইসলাম যা প্রকাশ্যে করা ভাল মনে করে সেটা প্রকাশ্যে করে, আর যা গোপনে করা ভাল মনে করে সেটা গোপনে করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের দিকে তাকালেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রাপ্তির পর গোপনে গোপনে দাওয়াত দিতেন।
মক্কায় কেউ মুসলমান হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ঈমান গোপন রাখতে পরামর্শ দিতেন। হযরত আবু যর গিফারি রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ।
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম মক্কা থেকে হাবশা বা মদীনায় গোপনে গোপনে হিজরত করতেন।
মদীনার আনসারদের সাথে বাইআতে আকাবা গোপনে গোপনে হয়েছে।
গোপনীয়তার অনুপম নমুনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের ঘটনা। এমন সঙ্গোপনে ও কৌশলে তিনি হিজরত করেছেন যে, মুশরিকরা তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরও সন্ধান পায়নি।
আগের শরীয়তে গোপনীয়তা
ফিরআন বংশের এক লোক মূসা আলাইহিস সালামের দাওয়াত কবুল করে ঈমানদার হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَالَ رَجُلٌ مُؤْمِنٌ مِنْ آلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيمَانَهُ
“ফিরআউন বংশীয় এক ব্যক্তি যে মু’মিন ছিল এবং নিজ ঈমান গোপন রাখতো- সে বললো ...।”- আলমু’মিন ২৮
আসহাবে কাহফ গোপনে পলায়ন করেছিল। ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর তারা যখন তাদের একজনকে খাবার কিনতে পাঠাচ্ছিল, তখন তাকে সাবধান করে দিচ্ছিল- যেন অতি সঙ্গোপনে কাজ করে,
وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا
“সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে এবং কিছুতেই যেন কাউকে তোমাদের ব্যাপারে জানতে না দেয়।”- কাহফ ১৯
সামরিক কাজে গোপনীয়তা কাম্য
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَخُونُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ وَتَخُونُوا أَمَانَاتِكُمْ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা জেনে-শুনে আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খিয়ানত করো না এবং তোমাদের পরস্পরের আমানতনসমূহেরও খিয়ানত করো না।”- আনফাল ২৭
আল্লাহ তাআলা সামরিক গোপনীয়তাকে আমানত আখ্যা দিয়েছেন এবং তা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের অভিযান গোপন রেখেছিলেন। ঘটনাক্রমে হযরত হাতিব রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পত্র মারফত তা মুশরিকদের অবগত করতে চেয়েছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার দুশমন ও তোমাদের দুশমনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।”- মুমতাহিনা ১
মুসলমানদের সামরিক বিষয়াদি কাফেরদের অবগত করানোকে আল্লাহ তাআলা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের নামান্তর আখ্যা দিয়েছেন।
হযরত কা’ব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
لم يكن رسول الله صلى الله عليه و سلم يريد غزوة إلا ورى بغيرها
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন যুদ্ধাভিযানের ইচ্ছা করলে (সেটি গোপন রেখে) অন্য দিকে ঈঙ্গিত করতেন।”- সহীহ বুখারি ২৭৮৭
এটি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজীবনের সুন্নত যে, তিনি কোন যুদ্ধে বের হলে সাহাবায়ে কেরামকে স্পষ্ট জানাতেন না যে, কোন দিকে যাচ্ছেন। অন্য কোন দিকের ঈঙ্গিত করতেন। সাহাবায়ে কেরাম মনে করতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কোন দিকে যাচ্ছেন। অথচ রাসূলের উদ্দেশ্য থাকতো ভিন্ন। সামরিক বিষয়ে তিনি এতটাই গোপনীয়তা বজায় রাখতেন।
এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
الحرب خدعة
“যুদ্ধ কৌশলের নাম।”- সহীহ বুখারি ২৮৬৬
অর্থাৎ যুদ্ধের মূল বুনিয়াদ হল, কৌশল। যুদ্ধের জয়-পরাজয় কৌশলের উপর নির্ভরশীল, সামরিক শক্তির উপর নয়।
পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই তাদের সামরিক বিষয়াদি ও প্ল্যান-পরিকল্পনা তাদের দুশমনদের সামনে প্রকাশ করে না। এটাই যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়ম। ইসলাম এ নিয়ম মেনে চলে। এর ব্যতিক্রম করাকে খিয়ানত আখ্যায়িত করেছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমরা সতর্কতা অবলম্বন কর।”- নিসা ৭১
গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়া সতর্কতার পরিপন্থী- এটা সর্বস্বীকৃত।
দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা ব্যতীত কোন সংবাদ ছড়াতেও আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন। একে মুনাফিকদের কাজ আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ لَاتَّبَعْتُمُ الشَّيْطَانَ إِلَّا قَلِيلًا
“তাদের (মুনাফিকদের) নিকট যখন কোন সংবাদ আসে, তা শান্তির হোক বা ভীতির হোক- তারা তা ছড়িয়ে দেয়। যদি তারা তা রাসূল ও দায়িত্বশীলদের নিকট সমর্পন করে দিত, তবে সংবাদ অনুসন্ধানকারীরা তাদের থেকে সেটা জেনে নিতে পারতো (যে, তা ছড়ানোর উপযোগী কি’না)। তোমাদের উপর যদি আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও রহমত না হত, তবে অল্প সংখ্যক ছাড়া বাকি সকলে শয়তানের অনুগামী হয়ে পড়তে।”- সূরা নিসা: ৮৩
কুরআন, হাদিস ও সীরাতের আলোকে স্পষ্ট যে, গোপনীয়তা ইসলামের চিরন্তন নীতি। আল্লাহ, রাসূল ও মুসলামানদের আমানত। গোপনীয়তা প্রকাশ করা অপরিপক্ষতা, ঈমানের দুর্বলতা, নিফাক ও কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের আলামত। এরপরও যারা গোপনে জিহাদের কাজ করার কারণে মুজাহিদদের সমালোচনা করে, তাদের দ্বীনের বুঝ কতটুকু আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন। দুঃখের বিষয়, আজীবন বুখারি শরীফ পড়িয়ে আসছেন এমনসব মহিউস সুন্নাহরাই এমনসব মন্তব্য করছেন। হে আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান কর।
Comment