আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না
তিনি শায়েখ আবরারুল হক রহি. এর খলীফা, দাওয়াতুল হকের শীর্ষস্থানীয় একজন মুরুব্বী, ঢাকার বহু আলোচিত-সমালোচিত একটি মাদরাসার প্রধান মুফতী এবং শাইখুল হাদীস, ওযাহাতী তাবলীগে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালনকারী একজন মুহাক্কিক আলেম, চলমান রাজনীতি ও সরকারী লোকজন থেকে দূরে অবস্থানকারী একজন নির্ভরযোগ্য আলেমে দ্বীন, হাজারো উলামা, তলাবা ও সাধারণ মানুষের দ্বীনী রাহবার। এমন একজন বড় ব্যক্তি মাদরাসার উস্তাদদের সাপ্তাহিক মশওয়ারা মজলিসে তাবলীগ, দাওয়াতুল ইসলাম এবং জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনার প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘ জিহাদতো শরীয়তে আছে আমরা স্বীকার করি, কিন্তু আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’’
জিহাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদাত। আল্লাহ তাআলা জিহাদকে ফরয করে দিয়েছেন। ঈমানের পরেই নবীজী সা. জিহাদকে শ্রেষ্ঠ আমল বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নবীজী সা. জিহাদকে ইসলামের শীর্ষচূড়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। জিহাদের উপর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, আমর বিল-মারূফ, নাহি আনিল মুনকার, দ্বীনের প্রচার-প্রসার, হুদুদ, কিসাস বাস্তবায়নসহ মুসলিম উম্মাহর সমস্ত কল্যাণ নির্ভর করে। নবীজী সা. এর হাদীসের ভাণ্ডারে নামাযের পরই সবচেয়ে বেশি হাদীস জিহাদ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা কুরআনুল কারীমের মধ্যে ফরয ইবাদাতের মধ্য থেকে জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনাই সবচেয়ে বেশি করেছেন। জিহাদের আলোচনা যে পরিমাণ করেছেন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতের আলোচনা সে পরিমাণ করেননি। জিহাদ এমনই গুরুত্ব পূর্ণ ইবাদাত, জিহাদের প্রয়োজনে নামাযকে তার ওয়াক্ত থেকে পিছিয়ে দেয়ার তথা কাযা করার অনুমতি আছে। জিহাদের প্রয়োজনে ফরয রোযা না রাখার এবং ভঙ্গ করার অনুমতি আছে। জিহাদ ফরযে আইন হলে ফরয হজ্জও পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কোথাও কিছু লোক যদি অনাহারে না খেয়ে মরার উপক্রম হয়, আর অপরদিকে মুজাহিদ ভাইদের অর্থকড়ির প্রয়োজন দেখা দেয় সেক্ষেত্রে অনাহারীদেরকে না দিয়ে সাদাকা ও যাকাতের সমস্ত মাল মুজাহিদ ভাইদেরকে দিয়ে দেওয়া জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এই যখন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সা. এর কাছে জিহাদের অবস্থান সেক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মহব্বতের দাবিদার এবং ওয়ারাসাতে আম্বিয়ার পদবীধারী ব্যক্তি কীভাবে এ কথা বলতে পারে যে, ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’
কেউ যদি একথা বলে যে, আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না, কিংবা এ কথা বলল যে, আমাদের মাদরাসায় রোযা চলবে না- সেক্ষেত্রে কি তার ঈমান থাকবে? কস্মিন কালেও নয়। শরীয়তের ছোট থেকে ছোট একটা হুকুমকেও যদি কেউ অপছন্দ/ঘৃণা করে তাহলে তার ঈমান ভেঙ্গে যায়। যেমন কেউ যদি মেছওয়াকের সুন্নাহ কে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে তাহলে তার ঈমান ভেঙ্গে যাবে। এই যখন অবস্থা তখন জিহাদের মত এত গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদাতকে যদি কেউ আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে-অপছন্দ করে, তাহলে তার ঈমানের কী দশা হবে তাকি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
জিহাদ একটি ফরয ইবাদাত। এটি সব সময়ই ফরয থাকে। কখনো ফরযে কেফায়া হয়। আবার পরিস্থিতির কারণে কখনো ফরযে আইন হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশীদের উপরও জিহাদ ফরযে আইন। এটি কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ এবং ফুকাহায়ে কেরাম এর ফতওয়া দ্বারা সুপ্রমাণিত একটি বিষয়। এই অবস্থায় ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’ বলা আর ‘আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না’, ‘রোযা চলবে না’ বলার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? যদি কেউ আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না, রোযা চলবে না বলার কারণে বে-ঈমান হয়ে যায়, কাফের মুরতাদে পরিণত হয়, তাহলে ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না’ বলার কারণে তার ঈমানের কী হালত হবে তা পাঠকই বলুন।
সেই যুগের মুনাফেকদেরকে আল্লাহ তাআলা মুনাফেক সাব্যস্ত করেছেন মূলত জিহাদকে কেন্দ্র করেই। মদীনার মুনাফেকদের ব্যাপারে কুরআনে কারীমের সূরা তাওবা, আহযাব, মুনাফিকূনসহ বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, তারা জিহাদকে অপছন্দ করে, জিহাদকে ঘৃণা করে, জিহাদে বেরহওয়াকে কষ্টকর মনে করে, বিভিন্ন বাহানায় জিহাদ থেকে বেঁচে থাকতে চায়, জিহাদের পথে অর্থকড়ি খরচ করতে চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি-এসব কারণে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদেরকে মুনাফিক সাব্যস্ত করলেন এবং তাদের ব্যাপারে ঘোষণা দিলেন, ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে (চিরকাল) অবস্থান করবে’ (নিসা:১৪৫)। সেই যুগে জিহাদকে অপছন্দ করা এবং ঘৃণা করার পরিণাম ও পরিণতি যদি চিরকালের জাহান্নাম হয়ে থাকে, তাহলে জিহাদ ফরযে আইনের এই যুগে জিহাদকে অপছন্দ করা, ঘৃণা করা এবং মাদরাসায় জিহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিণাম ও পরিণতি কি ভিন্ন কিছু হবে? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করেন।
ইবনুল কাইয়্যিম রহি. এই ক্যাটাগরির আবেদ, যাহেদ এবং নামসর্বস্ব ওরাসাতুল আম্বিয়াদের সম্পর্কে খুব উত্তম কথা বলেছেন। আমরা তার বক্তব্য হুবাহু উল্লেখ করা উপযোগী মনে করছি। হয়তো পাঠকগণ এরদ্বারা উপকৃত হবেন।
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ই‘লামুল মুআক্কিয়ীনে বলেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা যে দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যে দ্বীন পালন করে গেছেন, সে সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞতা রাখেন, তারা দেখতে পান, দ্বীনদ্বার বলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অধিকাংশই (এখন) সবচেয়ে কম দ্বীনদ্বার শ্রেণীর লোক। আল্লাহর পানাহ! আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বস্তুগুলো পদদলিত হতে দেখেও, আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা লক্সিঘত হতে দেখেও, আল্লাহর দ্বীন পরিত্যক্ত হতে দেখেও এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর প্রতি বিমুখতা দেখেও যার অন্তর প্রশান্ত, যবান নিশ্চুপ- তার মধ্যে আবার কিসের দ্বীনদ্বারি? কিসের কল্যাণ? সে তো বোবা শায়তান, যেমন বাতিল বলনেওয়ালা সবাক শয়তান। দ্বীনের ধ্বংস তো এদের কারণেই হচ্ছে; উদরপূর্তির ব্যবস্থা আর গদি ঠিক থাকলে দ্বীনের কি হল না হল সে নিয়ে যাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। তাদের মধ্যে যাদের দ্বীনদারি সবচেয়ে ভালো, তাদের অবস্থা হল: একটু চিন্তিত হয় আর হালকা সমালোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়। পক্ষান্তরে যদি এদের সম্মান ও সম্পদে কোন আঘাত লাগে, তাহলে রেগে আগুন হয়ে যায়। সর্বসামর্থ্য দিয়ে নাহি আনিল মুনকারের (???) তিনো স্তর (হাত, যবান ও অন্তর) প্রয়োগ করে।
এরা যে শুধু আল্লাহর (রহমতের) দৃষ্টি থেকে পড়ে গেছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছন তা-ই নয়, বরং নিজেদের অজান্তেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুসিবতের শিকার হয়েছে। আর তাহলো- অন্তরের মৃত্যু। কেননা অন্তর যতটা প্রাণবন্ত হয় আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য তার ক্রোধ তত বেশি হয়; দ্বীনের জন্য তত বেশি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়।
ইমাম আহমদ রহ. সহ আরো অনেকে একটি আছার উল্লেখ করেছেন: আল্লাহ তায়ালা এক ফেরেশতাকে আদেশ দিলেন, অমুক অমুক জনপদ ধ্বসিয়ে দাও। ফেরেশতা আরজ করল, হে রব! কিভাবে ধ্বংস করবো, সেখানে তো অমুক ইবাদতগুজার বান্দা আছে? আল্লাহ তায়ালা জওয়াব দেন, তাকে দিয়েই শুরু করো। (অন্যায় কাজ দেখেও) আমার জন্য কোন এক দিনও তার চেহারায় অসন্তুষ্টি দেখা দেয়নি।
আবু উমার (ইবনে আব্দুল বার) রহ. ‘তামহিদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আল্লাহ তায়ালা এক নবীর নিকট ওহী পাঠান, তুমি অমুক যাহেদকে বলো, দুনিয়াবিমুখতার দ্বারা তুমি দুনিয়াতে অগ্রিম প্রশান্তি বেছে নিয়েছো। আমার ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার দ্বারা তুমি সম্মান লাভ করেছো। কিন্তু তোমার উপর আমার যে হক রয়েছে, তার জন্য তুমি কি করেছো? যাহেদ আরজ করল, হে রব! আমার উপর আপনার কোন্ হক পাওনা আছে? আল্লাহ তায়ালা জওয়াব দিলেন, আমার সন্তুষ্টির জন্য কি কোন বন্ধুকে তুমি মহব্বত করেছো? কিংবা আমার সন্তুষ্টির জন্য কি কোন শত্রুর সাথে শত্রুতা করেছো?”- ই‘লামুল মুআক্কিয়ীন ২/১২০-১২১
প্রিয় পাঠক! বর্তমান বাংলাদেশে দ্বীনদার বলে সমাজে যারা প্রসিদ্ধ তাদের অধিকাংশের অবস্থাই কিন্তু ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর বিবৃতির সাথে মিলে যায়। আমি এখানে মাত্র একজন বড় ব্যক্তির হালত তুলে ধরলাম। অনুসন্ধানি দৃষ্টি দিলে এরকম আরো অনেককে খুঁজে পাওয়া যাবে। এদের ভক্ত ও মুরীদ হাজারো আলেম-উলামার অবস্থাও কিন্তু এমনই। মিষ্টার ফরীদ উদ্দীন মাসুদকে এই জন্য ধন্যবাদ দেই যে, সে তার জিহাদ বিরোধী অবস্থান গোপন করেনি, উম্মতকে দ্বিধাদন্ধে ফেলেনি। সে নিজের ভিতরের বিষকে প্রকাশ করে দিয়েছে। কিন্তু দ্বীনের রাহবার দাবিদারদের মধ্যে আজ হাজারো ‘গোপন ফরীদ’ জন্ম নিয়েছে। এই ‘গোপন ফরীদদের’ দ্বারা উম্মত বেশী গোমরাহ হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা উম্মতকে হেফাজত করেন। আমীন।
আল্লাহর হুকুম জিহাদ-কিতাল বর্তমানে ঈমান যাচাঁইয়ের কষ্টিপাথর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি জিহাদ-কিতাল দ্বারাই এখন মুমিনদের ঈমান পরীক্ষা করে নিতে পারবেন। কে খাঁটি ঈমানদার আর কে নির্ভেজাল মুনাফিক আপনি জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনা দ্বারাই তা পরিস্কারভাবে বুঝে নিতে পারবেন। জিহাদের মাসআলায় আজ পুরো পৃথিবীর মানুষ দু‘ভাগে বিভক্ত হয়েপড়েছে। তালেবান-আলকায়েদাসহ অন্যান্য হকপন্থী জিহাদী দলগুলোর সাথে জড়িত, সম্পৃক্ত ও তাদেরকে যারা ভালবাসে পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন মুষ্টিমেয় কিছু লোক জঙ্গী-সন্ত্রাসীহ নানাধরনের অপবাদ উপেক্ষা করে আল্লাহর হুকুম জিহাদকে ধরে রেখেছে। জিহাদের জন্য নিজের সবকিছু কুরবান করে দিচ্ছে। অপর দিকে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানসহ পৃথিবীর সমগ্র কাফের জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে মুসলিমদের সমস্ত দল-উপদলও জিহাদ ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে জিহাদকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সালাফী, আহলে হাদীস, মাযহাবী, লা-মাযহাবী, হক্কানী পীরের মুরীদ, ভণ্ড পীরের ভক্ত, মারেফতী, বাতেনী, শিয়া, রেজভী, বেরেলবী, কাদিয়ানী, জামাতী, মিলাদী, কিয়ামী, তাবলীগী, কওমী-দেওবন্দী নির্বিশেষে সব ঘরনার নামধারী মুসলিমগণ জিহাদকে রহিত ও অকার্যকর করার ক্ষেত্রে আজ কাফেরদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছে। কেমন যেন এখন জিহাদই কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই শ্রেণির দ্বীনের রাহবার(?)দের সামনে জিহাদ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসগুলো পাঠ করলেই আপনি তাদের চেহারায় ঘৃণা, অপছন্দ ও বিরক্তির স্পষ্ট আলামত ভেসে উঠতে দেখবেন। অন্তরের নেফাকের কারণে শতচেষ্টা সত্ত্বেও তারা বিরক্তি ও অপছন্দের আলামত লুকাতে পারবে না। সে গোস্বায় লাল হয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে আপনাকে হয়তো থামিয়ে দিবে, কিংবা ঘার ধাক্কা দিয়ে আপনাকে কামরা থেকে বের করে দিবে। তাদের কেউ কেউ তো আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রকেই জিহাদের চাদর পরিয়ে দিয়েছে। আর কেউ কেউ তথাকথিত ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ কেই জিহাদ মনে করে প্রকৃত জিহাদ থেকে বাঁচার পাঁয়তারা করছে। আবার কেউ অঘোষিতভাবে মাদরাসায় জিহাদকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে, আর কেউ ঘোষণা দিয়েই নিষিদ্ধ করেছে।
এই যখন উম্মতের রাহবার এবং প্রসিদ্ধ দ্বীনদার (?) শ্রেণির অবস্থা তখন আপনাকে সতর্ক না থেকে কোনো উপায় নেই। এজাতীয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অনুকরণ, অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকুন। নিজের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাজত করুন। তাওহীদ, শিরক, তাগুত, তাগুতবর্জন নিয়ে কথা বলে এবং জিহাদকে ভালবাসে, জিহাদ ও কিতালের ফযীলত বর্ণনা করে, মানুষকে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি উৎসাহিত করে আর সাধ্যানুযায়ী নিজেও জিহাদের ফরীযা আদায়ে চেষ্টা করে এমন আলেমদেরকে খুঁজে বের করুন। তাদেরকে নিজের দ্বীনী রাহবাররূপে গ্রহণ করুন। তাদের সাথে লেগে থাকুন। অন্ধ অনুসরণ পরিত্যাগ করে দলীল ভিত্তিক ইলম অর্জনের চেষ্টা করুন। ফেতনার এই জমানায় কঠিনভাবে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরুন। নবীজী সা. এর সীরাত অধ্যায়ন করুন। খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অন্যান্য বড় বড় মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের জীবনী অধ্যায়ন করে তাঁদের মত জীবন গড়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা আপনার পদচুম্বন করছে। যাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হল সেই তো সফলকাম হল। জাহান্নামের স্পর্শ থেকে বাঁচতে পারা আর জান্নাতে দাখেল হতে পারাইতো মুমিনের সফলতা । এরচেয়ে বড় সফলতা আর কিছুতেই নেই। হে আল্লাহ তুমি এই কিতাবের সংকলক ও পাঠকদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেও আর জান্নাতে দাখেল করিয়ে দেও।
বি.দ্র. ফরযে আইন জিহাদের হুকুম যদি কেউ শুধু অলসতা বশত ছেড়ে দেয় তাহলে সে কাফের হবে না, বরং ফাসেক হবে। কিন্তু যদি কেউ জিহাদকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, জিহাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তাহলে সে কাফের ও মুরতাদে পরিণত হবে। সে যতবড় আল্লামা আর শাইখুল হাদীসই হোকনা কেন সেটা দেখার বিষয় নয়।
তিনি শায়েখ আবরারুল হক রহি. এর খলীফা, দাওয়াতুল হকের শীর্ষস্থানীয় একজন মুরুব্বী, ঢাকার বহু আলোচিত-সমালোচিত একটি মাদরাসার প্রধান মুফতী এবং শাইখুল হাদীস, ওযাহাতী তাবলীগে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালনকারী একজন মুহাক্কিক আলেম, চলমান রাজনীতি ও সরকারী লোকজন থেকে দূরে অবস্থানকারী একজন নির্ভরযোগ্য আলেমে দ্বীন, হাজারো উলামা, তলাবা ও সাধারণ মানুষের দ্বীনী রাহবার। এমন একজন বড় ব্যক্তি মাদরাসার উস্তাদদের সাপ্তাহিক মশওয়ারা মজলিসে তাবলীগ, দাওয়াতুল ইসলাম এবং জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনার প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘ জিহাদতো শরীয়তে আছে আমরা স্বীকার করি, কিন্তু আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’’
জিহাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদাত। আল্লাহ তাআলা জিহাদকে ফরয করে দিয়েছেন। ঈমানের পরেই নবীজী সা. জিহাদকে শ্রেষ্ঠ আমল বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নবীজী সা. জিহাদকে ইসলামের শীর্ষচূড়া বলে আখ্যায়িত করেছেন। জিহাদের উপর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা, আমর বিল-মারূফ, নাহি আনিল মুনকার, দ্বীনের প্রচার-প্রসার, হুদুদ, কিসাস বাস্তবায়নসহ মুসলিম উম্মাহর সমস্ত কল্যাণ নির্ভর করে। নবীজী সা. এর হাদীসের ভাণ্ডারে নামাযের পরই সবচেয়ে বেশি হাদীস জিহাদ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা কুরআনুল কারীমের মধ্যে ফরয ইবাদাতের মধ্য থেকে জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনাই সবচেয়ে বেশি করেছেন। জিহাদের আলোচনা যে পরিমাণ করেছেন নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতের আলোচনা সে পরিমাণ করেননি। জিহাদ এমনই গুরুত্ব পূর্ণ ইবাদাত, জিহাদের প্রয়োজনে নামাযকে তার ওয়াক্ত থেকে পিছিয়ে দেয়ার তথা কাযা করার অনুমতি আছে। জিহাদের প্রয়োজনে ফরয রোযা না রাখার এবং ভঙ্গ করার অনুমতি আছে। জিহাদ ফরযে আইন হলে ফরয হজ্জও পিছিয়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কোথাও কিছু লোক যদি অনাহারে না খেয়ে মরার উপক্রম হয়, আর অপরদিকে মুজাহিদ ভাইদের অর্থকড়ির প্রয়োজন দেখা দেয় সেক্ষেত্রে অনাহারীদেরকে না দিয়ে সাদাকা ও যাকাতের সমস্ত মাল মুজাহিদ ভাইদেরকে দিয়ে দেওয়া জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এই যখন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল সা. এর কাছে জিহাদের অবস্থান সেক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার মহব্বতের দাবিদার এবং ওয়ারাসাতে আম্বিয়ার পদবীধারী ব্যক্তি কীভাবে এ কথা বলতে পারে যে, ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’
কেউ যদি একথা বলে যে, আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না, কিংবা এ কথা বলল যে, আমাদের মাদরাসায় রোযা চলবে না- সেক্ষেত্রে কি তার ঈমান থাকবে? কস্মিন কালেও নয়। শরীয়তের ছোট থেকে ছোট একটা হুকুমকেও যদি কেউ অপছন্দ/ঘৃণা করে তাহলে তার ঈমান ভেঙ্গে যায়। যেমন কেউ যদি মেছওয়াকের সুন্নাহ কে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে তাহলে তার ঈমান ভেঙ্গে যাবে। এই যখন অবস্থা তখন জিহাদের মত এত গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদাতকে যদি কেউ আন্তরিকভাবে ঘৃণা করে-অপছন্দ করে, তাহলে তার ঈমানের কী দশা হবে তাকি আর বলার অপেক্ষা রাখে?
জিহাদ একটি ফরয ইবাদাত। এটি সব সময়ই ফরয থাকে। কখনো ফরযে কেফায়া হয়। আবার পরিস্থিতির কারণে কখনো ফরযে আইন হয়ে যায়। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশীদের উপরও জিহাদ ফরযে আইন। এটি কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ এবং ফুকাহায়ে কেরাম এর ফতওয়া দ্বারা সুপ্রমাণিত একটি বিষয়। এই অবস্থায় ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না।’ বলা আর ‘আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না’, ‘রোযা চলবে না’ বলার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে? যদি কেউ আমাদের মাদরাসায় নামায চলবে না, রোযা চলবে না বলার কারণে বে-ঈমান হয়ে যায়, কাফের মুরতাদে পরিণত হয়, তাহলে ‘আমাদের মাদরাসায় জিহাদ চলবে না’ বলার কারণে তার ঈমানের কী হালত হবে তা পাঠকই বলুন।
সেই যুগের মুনাফেকদেরকে আল্লাহ তাআলা মুনাফেক সাব্যস্ত করেছেন মূলত জিহাদকে কেন্দ্র করেই। মদীনার মুনাফেকদের ব্যাপারে কুরআনে কারীমের সূরা তাওবা, আহযাব, মুনাফিকূনসহ বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হয়েছে যে, তারা জিহাদকে অপছন্দ করে, জিহাদকে ঘৃণা করে, জিহাদে বেরহওয়াকে কষ্টকর মনে করে, বিভিন্ন বাহানায় জিহাদ থেকে বেঁচে থাকতে চায়, জিহাদের পথে অর্থকড়ি খরচ করতে চায় না ইত্যাদি ইত্যাদি-এসব কারণে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদেরকে মুনাফিক সাব্যস্ত করলেন এবং তাদের ব্যাপারে ঘোষণা দিলেন, ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে (চিরকাল) অবস্থান করবে’ (নিসা:১৪৫)। সেই যুগে জিহাদকে অপছন্দ করা এবং ঘৃণা করার পরিণাম ও পরিণতি যদি চিরকালের জাহান্নাম হয়ে থাকে, তাহলে জিহাদ ফরযে আইনের এই যুগে জিহাদকে অপছন্দ করা, ঘৃণা করা এবং মাদরাসায় জিহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিণাম ও পরিণতি কি ভিন্ন কিছু হবে? আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করেন।
ইবনুল কাইয়্যিম রহি. এই ক্যাটাগরির আবেদ, যাহেদ এবং নামসর্বস্ব ওরাসাতুল আম্বিয়াদের সম্পর্কে খুব উত্তম কথা বলেছেন। আমরা তার বক্তব্য হুবাহু উল্লেখ করা উপযোগী মনে করছি। হয়তো পাঠকগণ এরদ্বারা উপকৃত হবেন।
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ই‘লামুল মুআক্কিয়ীনে বলেন:
وقد غر إبليس أكثر الخلق بأن حسن لهم القيام بنوع من الذكر والقراءة والصلاة والصيام والزهد في الدنيا والانقطاع، وعطلوا هذه العبوديات، فلم يحدثوا قلوبهم بالقيام بها، وهؤلاء عند ورثة الأنبياء من أقل الناس دينا؛ فإن الدين هو القيام لله بما أمر به، فتارك حقوق الله التي تجب عليه أسوأ حالا عند الله ورسوله من مرتكب المعاصي؛ فإن ترك الأمر أعظم من ارتكاب النهي من أكثر من ثلاثين وجها ذكرها شيخنا - رحمه الله - في بعض تصانيفه؛ ومن له خبرة بما بعث الله به رسوله - صلى الله عليه وسلم - وبما كان عليه هو وأصحابه رأي أن أكثر من يشار إليهم بالدين هم أقل الناس دينا، والله المستعان، وأي دين وأي خير فيمن يرى محارم الله تنتهك وحدوده تضاع ودينه يترك وسنة رسول الله - صلى الله عليه وسلم - يرغب عنها وهو بارد القلب ساكت اللسان؟ شيطان أخرس، كما أن المتكلم بالباطل شيطان ناطق، وهل بلية الدين إلا من هؤلاء الذين إذا سلمت لهم مآكلهم ورياساتهم فلا مبالاة بما جرى على الدين؟ ، وخيارهم المتحزن المتلمظ، ولو نوزع في بعض ما فيه غضاضة عليه في جاهه أو ماله بذل وتبذل وجد واجتهد، واستعمل مراتب الإنكار الثلاثة بحسب وسعه. وهؤلاء - مع سقوطهم من عين الله ومقت الله لهم - قد بلوا في الدنيا بأعظم بلية تكون وهم لا يشعرون، وهو موت القلوب؛ فإنه القلب كلما كانت حياته أتم كان غضبه لله ورسوله أقوى، وانتصاره للدين أكمل.
وقد ذكر الإمام أحمد وغيره أثرا أن الله سبحانه أوحى إلى ملك من الملائكة أن اخسف بقرية كذا وكذا، فقال: يا رب كيف وفيهم فلان العابد؟ فقال: به فابدأ؛ فإنه لم يتمعر وجهه في يوما قط .
وذكر أبو عمر في كتاب التمهيد أن الله سبحانه أوحى إلى نبي من أنبيائه أن قل لفلان الزاهد: أما زهدك في الدنيا فقد تعجلت به الراحة، وأما انقطاعك إلي فقد اكتسبت به العز، ولكن ماذا عملت فيما لي عليك؟ فقال: يا رب وأي شيء لك علي؟ قال: هل واليت في وليا أو عاديت في عدوا ؟. اهـ اعلام الموقعين ২\১২০-১২১
“ইবলিস অধিকাংশ মানুষকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে যে- নির্দিষ্ট কিছু যিকির, তিলাওয়াত, নামায, রোযা, যুহদ ও দুনিয়াত্যাগের মতো আমলসমূকে তাদের সামনে সুসজ্জিত করে দেখিয়েছে। আর তারা (আমর বিল মা’রূফ, নাহি আনিল মুনকার, জিহাদ ও দ্বীনর পথের কষ্টসাধ্য) এসব আমল পরিত্যাগ করেছে। বাস্তবে নবীগণের প্রকৃত উত্তরসুরিদের দৃষ্টিতে এরাই সবচেয়ে কম দ্বীনদার শ্রেণীর লোক। কেননা দ্বীন তো হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর আদেশ পালন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি তার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত আবশ্যকীয় হকগুলো আদায় করে না, সে আল্লাহ ও রাসূলের দৃষ্টিতে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা আদেশ পালন না করা ত্রিশ দিক দিয়ে নাফরমানী করার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। আমাদের শায়েখ (ইবনে তাইমিয়া) রহ. তার এক কিতাবে সেগুলো উল্লেখ করেছেন।وقد ذكر الإمام أحمد وغيره أثرا أن الله سبحانه أوحى إلى ملك من الملائكة أن اخسف بقرية كذا وكذا، فقال: يا رب كيف وفيهم فلان العابد؟ فقال: به فابدأ؛ فإنه لم يتمعر وجهه في يوما قط .
وذكر أبو عمر في كتاب التمهيد أن الله سبحانه أوحى إلى نبي من أنبيائه أن قل لفلان الزاهد: أما زهدك في الدنيا فقد تعجلت به الراحة، وأما انقطاعك إلي فقد اكتسبت به العز، ولكن ماذا عملت فيما لي عليك؟ فقال: يا رب وأي شيء لك علي؟ قال: هل واليت في وليا أو عاديت في عدوا ؟. اهـ اعلام الموقعين ২\১২০-১২১
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা যে দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যে দ্বীন পালন করে গেছেন, সে সম্পর্কে যারা অভিজ্ঞতা রাখেন, তারা দেখতে পান, দ্বীনদ্বার বলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অধিকাংশই (এখন) সবচেয়ে কম দ্বীনদ্বার শ্রেণীর লোক। আল্লাহর পানাহ! আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বস্তুগুলো পদদলিত হতে দেখেও, আল্লাহর বেঁধে দেয়া সীমা লক্সিঘত হতে দেখেও, আল্লাহর দ্বীন পরিত্যক্ত হতে দেখেও এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর প্রতি বিমুখতা দেখেও যার অন্তর প্রশান্ত, যবান নিশ্চুপ- তার মধ্যে আবার কিসের দ্বীনদ্বারি? কিসের কল্যাণ? সে তো বোবা শায়তান, যেমন বাতিল বলনেওয়ালা সবাক শয়তান। দ্বীনের ধ্বংস তো এদের কারণেই হচ্ছে; উদরপূর্তির ব্যবস্থা আর গদি ঠিক থাকলে দ্বীনের কি হল না হল সে নিয়ে যাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। তাদের মধ্যে যাদের দ্বীনদারি সবচেয়ে ভালো, তাদের অবস্থা হল: একটু চিন্তিত হয় আর হালকা সমালোচনা করেই ক্ষ্যান্ত হয়। পক্ষান্তরে যদি এদের সম্মান ও সম্পদে কোন আঘাত লাগে, তাহলে রেগে আগুন হয়ে যায়। সর্বসামর্থ্য দিয়ে নাহি আনিল মুনকারের (???) তিনো স্তর (হাত, যবান ও অন্তর) প্রয়োগ করে।
এরা যে শুধু আল্লাহর (রহমতের) দৃষ্টি থেকে পড়ে গেছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছন তা-ই নয়, বরং নিজেদের অজান্তেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মুসিবতের শিকার হয়েছে। আর তাহলো- অন্তরের মৃত্যু। কেননা অন্তর যতটা প্রাণবন্ত হয় আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য তার ক্রোধ তত বেশি হয়; দ্বীনের জন্য তত বেশি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়।
ইমাম আহমদ রহ. সহ আরো অনেকে একটি আছার উল্লেখ করেছেন: আল্লাহ তায়ালা এক ফেরেশতাকে আদেশ দিলেন, অমুক অমুক জনপদ ধ্বসিয়ে দাও। ফেরেশতা আরজ করল, হে রব! কিভাবে ধ্বংস করবো, সেখানে তো অমুক ইবাদতগুজার বান্দা আছে? আল্লাহ তায়ালা জওয়াব দেন, তাকে দিয়েই শুরু করো। (অন্যায় কাজ দেখেও) আমার জন্য কোন এক দিনও তার চেহারায় অসন্তুষ্টি দেখা দেয়নি।
আবু উমার (ইবনে আব্দুল বার) রহ. ‘তামহিদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আল্লাহ তায়ালা এক নবীর নিকট ওহী পাঠান, তুমি অমুক যাহেদকে বলো, দুনিয়াবিমুখতার দ্বারা তুমি দুনিয়াতে অগ্রিম প্রশান্তি বেছে নিয়েছো। আমার ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার দ্বারা তুমি সম্মান লাভ করেছো। কিন্তু তোমার উপর আমার যে হক রয়েছে, তার জন্য তুমি কি করেছো? যাহেদ আরজ করল, হে রব! আমার উপর আপনার কোন্ হক পাওনা আছে? আল্লাহ তায়ালা জওয়াব দিলেন, আমার সন্তুষ্টির জন্য কি কোন বন্ধুকে তুমি মহব্বত করেছো? কিংবা আমার সন্তুষ্টির জন্য কি কোন শত্রুর সাথে শত্রুতা করেছো?”- ই‘লামুল মুআক্কিয়ীন ২/১২০-১২১
প্রিয় পাঠক! বর্তমান বাংলাদেশে দ্বীনদার বলে সমাজে যারা প্রসিদ্ধ তাদের অধিকাংশের অবস্থাই কিন্তু ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর বিবৃতির সাথে মিলে যায়। আমি এখানে মাত্র একজন বড় ব্যক্তির হালত তুলে ধরলাম। অনুসন্ধানি দৃষ্টি দিলে এরকম আরো অনেককে খুঁজে পাওয়া যাবে। এদের ভক্ত ও মুরীদ হাজারো আলেম-উলামার অবস্থাও কিন্তু এমনই। মিষ্টার ফরীদ উদ্দীন মাসুদকে এই জন্য ধন্যবাদ দেই যে, সে তার জিহাদ বিরোধী অবস্থান গোপন করেনি, উম্মতকে দ্বিধাদন্ধে ফেলেনি। সে নিজের ভিতরের বিষকে প্রকাশ করে দিয়েছে। কিন্তু দ্বীনের রাহবার দাবিদারদের মধ্যে আজ হাজারো ‘গোপন ফরীদ’ জন্ম নিয়েছে। এই ‘গোপন ফরীদদের’ দ্বারা উম্মত বেশী গোমরাহ হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা উম্মতকে হেফাজত করেন। আমীন।
আল্লাহর হুকুম জিহাদ-কিতাল বর্তমানে ঈমান যাচাঁইয়ের কষ্টিপাথর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি জিহাদ-কিতাল দ্বারাই এখন মুমিনদের ঈমান পরীক্ষা করে নিতে পারবেন। কে খাঁটি ঈমানদার আর কে নির্ভেজাল মুনাফিক আপনি জিহাদ সংক্রান্ত আলোচনা দ্বারাই তা পরিস্কারভাবে বুঝে নিতে পারবেন। জিহাদের মাসআলায় আজ পুরো পৃথিবীর মানুষ দু‘ভাগে বিভক্ত হয়েপড়েছে। তালেবান-আলকায়েদাসহ অন্যান্য হকপন্থী জিহাদী দলগুলোর সাথে জড়িত, সম্পৃক্ত ও তাদেরকে যারা ভালবাসে পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন মুষ্টিমেয় কিছু লোক জঙ্গী-সন্ত্রাসীহ নানাধরনের অপবাদ উপেক্ষা করে আল্লাহর হুকুম জিহাদকে ধরে রেখেছে। জিহাদের জন্য নিজের সবকিছু কুরবান করে দিচ্ছে। অপর দিকে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানসহ পৃথিবীর সমগ্র কাফের জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে মুসলিমদের সমস্ত দল-উপদলও জিহাদ ভীতিতে আক্রান্ত হয়ে জিহাদকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সালাফী, আহলে হাদীস, মাযহাবী, লা-মাযহাবী, হক্কানী পীরের মুরীদ, ভণ্ড পীরের ভক্ত, মারেফতী, বাতেনী, শিয়া, রেজভী, বেরেলবী, কাদিয়ানী, জামাতী, মিলাদী, কিয়ামী, তাবলীগী, কওমী-দেওবন্দী নির্বিশেষে সব ঘরনার নামধারী মুসলিমগণ জিহাদকে রহিত ও অকার্যকর করার ক্ষেত্রে আজ কাফেরদের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছে। কেমন যেন এখন জিহাদই কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই শ্রেণির দ্বীনের রাহবার(?)দের সামনে জিহাদ সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসগুলো পাঠ করলেই আপনি তাদের চেহারায় ঘৃণা, অপছন্দ ও বিরক্তির স্পষ্ট আলামত ভেসে উঠতে দেখবেন। অন্তরের নেফাকের কারণে শতচেষ্টা সত্ত্বেও তারা বিরক্তি ও অপছন্দের আলামত লুকাতে পারবে না। সে গোস্বায় লাল হয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে আপনাকে হয়তো থামিয়ে দিবে, কিংবা ঘার ধাক্কা দিয়ে আপনাকে কামরা থেকে বের করে দিবে। তাদের কেউ কেউ তো আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রকেই জিহাদের চাদর পরিয়ে দিয়েছে। আর কেউ কেউ তথাকথিত ‘দাওয়াত ও তাবলীগ’ কেই জিহাদ মনে করে প্রকৃত জিহাদ থেকে বাঁচার পাঁয়তারা করছে। আবার কেউ অঘোষিতভাবে মাদরাসায় জিহাদকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে, আর কেউ ঘোষণা দিয়েই নিষিদ্ধ করেছে।
এই যখন উম্মতের রাহবার এবং প্রসিদ্ধ দ্বীনদার (?) শ্রেণির অবস্থা তখন আপনাকে সতর্ক না থেকে কোনো উপায় নেই। এজাতীয় প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের অনুকরণ, অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকুন। নিজের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাজত করুন। তাওহীদ, শিরক, তাগুত, তাগুতবর্জন নিয়ে কথা বলে এবং জিহাদকে ভালবাসে, জিহাদ ও কিতালের ফযীলত বর্ণনা করে, মানুষকে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি উৎসাহিত করে আর সাধ্যানুযায়ী নিজেও জিহাদের ফরীযা আদায়ে চেষ্টা করে এমন আলেমদেরকে খুঁজে বের করুন। তাদেরকে নিজের দ্বীনী রাহবাররূপে গ্রহণ করুন। তাদের সাথে লেগে থাকুন। অন্ধ অনুসরণ পরিত্যাগ করে দলীল ভিত্তিক ইলম অর্জনের চেষ্টা করুন। ফেতনার এই জমানায় কঠিনভাবে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরুন। নবীজী সা. এর সীরাত অধ্যায়ন করুন। খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অন্যান্য বড় বড় মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের জীবনী অধ্যায়ন করে তাঁদের মত জীবন গড়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা আপনার পদচুম্বন করছে। যাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হল সেই তো সফলকাম হল। জাহান্নামের স্পর্শ থেকে বাঁচতে পারা আর জান্নাতে দাখেল হতে পারাইতো মুমিনের সফলতা । এরচেয়ে বড় সফলতা আর কিছুতেই নেই। হে আল্লাহ তুমি এই কিতাবের সংকলক ও পাঠকদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেও আর জান্নাতে দাখেল করিয়ে দেও।
বি.দ্র. ফরযে আইন জিহাদের হুকুম যদি কেউ শুধু অলসতা বশত ছেড়ে দেয় তাহলে সে কাফের হবে না, বরং ফাসেক হবে। কিন্তু যদি কেউ জিহাদকে অপছন্দ করে, ঘৃণা করে, জিহাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তাহলে সে কাফের ও মুরতাদে পরিণত হবে। সে যতবড় আল্লামা আর শাইখুল হাদীসই হোকনা কেন সেটা দেখার বিষয় নয়।
Comment