ওয়ালা-বারা এবং শরীফ হাতেম আলআউনীর বিভ্রান্তি
ঈমান সহীহ হওয়ার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা কুরআন বা দ্বীনে ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাসী হওয়াই যথেষ্ট নয়। তদ্রূপ বিশ্বাসের পাশাপাশি মহব্বত রাখাও যথেষ্ট নয়। বিশ্বাস ও মহব্বতের পাশাপাশি দ্বীনে ইসলামকে তা’জিম করা, তা’জিম পরিপন্থী কোন কিছু না করা এবং দ্বীনে ইসলামের আনুগত্য অবধারিতরূপে গ্রহণ করে নেওয়া আবশ্যক।
একইভাবে ঈমান আনার পর শুধু বিশ্বাস রাখা বা মহব্বত রাখাই ঈমানের উপর বহাল থাকার জন্য যথেষ্ট নয়। বিশ্বাস ও মহব্বত রেখেও যদি কোন কুফরি করে বা তা’জিম পরিপন্থী কোন কাজ করে, তাহলে মুরতাদ হয়ে যাবে। তার বিশ্বাস ও মহব্বত তাকে কুফর থেকে বাঁচাতে পারবে না। এর দলীল-
ক.
আহলে কিতাবরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতায় বিশ্বাস করতো। কিন্তু এরপরও তারা কাফের। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে চেনে, যেমন চেনে তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে। আর নিশ্চয় তাদের মধ্য থেকে একটি দল সত্যকে গোপন করে, অথচ তারা জানে।”- বাক্বারা ১৪৬অন্য আয়াতে বলেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمُ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে চেনে যেরূপ চেনে তাদের ছেলে-সন্তানদেরকে। যারা নিজদের ক্ষতি করেছে তারা ঈমান আনবে না।”- আনআম ২০খ.
ফিরআউন এবং তার কওমের ব্যাপারে বলেন,
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ
“আর তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করল। অথচ তাদের অন্তর তা নিশ্চিত বিশ্বাস করেছিল। অতএব দেখ, ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল।”- নামল ১৪অন্তরে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখার পরও তারা কাফের ছিল।
গ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আবু তালেব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাস করতেন এবং মহব্বতও করতেন। কিন্তু রাসূলের দ্বীনের আনুগত্য গ্রহণ না করায় কাফের ছিলেন।
ঘ.
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বাস করতো এবং মহব্বতও করতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছতে পারলে তার কদম মোবারকের ধূলি ধোয়ে দেবে বলে তামান্নাও রাখতো। কিন্তু রাসূলের দ্বীনের আনুগত্য গ্রহণ না করায় কাফের ছিলো।
কাশ্মিরি রহ. (১৩৫২ হি.) বলেন,
وهذا القرآن يشهدُ بمعرفة الكفار، قال تعالى: {يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَآءهُمْ} [البقرة: 146] وهذا أبو طالب يُقِرُ بنبوتِهِ ونباهته صلى الله عليه وسلّم ويُعْلنُ بها في أبياته، حتى دارت وسارت، فيقول:
*ودعوتَني وزعمتَ أَنَّكَ صادِق ... وصدقت فيه وكنت ثَمّ أمِينًا
*وعرفتُ دينَك لا محالةَ أنه ... من خيرِ أديانِ البَرِيَّةِ دِينا
*لولا الملامةُ أو حَذَارِ مَسَبَّةٍ ... لوجدتَّني سمحًا بذاك مُبِينًا
وهذا هرقل عظيم الروم يقول: لو أني أعلم أني أَخْلُصُ إليه لتجَشَّمْتُ لقاءه، ولو كنت عنده لغَسَلْتُ عن قدميه، وفي «فتح الباري»: عن مرسل ابن إسحق عن بعض أهل العلم: أن هرقل قال: ويحك، والله إني لأَعْلَمُ أنه نبيٌ مرسل، ولكني أخاف الرومَ على نفسي، ولولا ذلك لاتَّبعتُهُ. فهل تريدُ من التصديق أمرًا وراء ذلك؟ فلما وُجِد منهم التصديقُ والتسليمُ والإقرارُ بهذه المثابة، وَجَبَ على التعريفِ المذكورِ أن يُحْكم عليهم بالإسلام، مع اتفاقهم على كونهم كافرين.
فأقول: إنّ الجزءَ الذي يمتاز به الإيمان والكفر، هو التزام الطاعة (1) مع الردع والتبري عن دين سواه، فإذا التزم الطاعة فقد خرجَ عن ضلالة الكفر ودخل في هَدْي الإسلام. وحينئذٍ تبين لك وجه كفر هؤلاء الكفرة مع تصديقهم ومعرفتهم، وذلك لأن أبا طالب وإن أعلن بحقية دينه، إلا أنه لم يلتزم طاعته، ولم يدخل في دينه، ولذا قال: لولا الملامة أو حذار مسبة .... إلخ، فآثر النار على العار. وهكذا هِرَقل، وإن تمنى لقاءه وَبجَّلَه وعظمه بظهر الغيب، لكنه خشي الرومَ أشدَّ خشية، فلم يلتزم طاعته. وكذلك حال الكفار الذين أخبر الله سبحانه عن معرفتهم، فإنهم مع معرفتهم الحقَ، صفحوا عن كلمة الحق، ولم يَدِينُوا بدين الإسلام. اهـ فيض الباري شرح صحيح البخاري: 1/125، كتاب الإيمان.
*ودعوتَني وزعمتَ أَنَّكَ صادِق ... وصدقت فيه وكنت ثَمّ أمِينًا
*وعرفتُ دينَك لا محالةَ أنه ... من خيرِ أديانِ البَرِيَّةِ دِينا
*لولا الملامةُ أو حَذَارِ مَسَبَّةٍ ... لوجدتَّني سمحًا بذاك مُبِينًا
وهذا هرقل عظيم الروم يقول: لو أني أعلم أني أَخْلُصُ إليه لتجَشَّمْتُ لقاءه، ولو كنت عنده لغَسَلْتُ عن قدميه، وفي «فتح الباري»: عن مرسل ابن إسحق عن بعض أهل العلم: أن هرقل قال: ويحك، والله إني لأَعْلَمُ أنه نبيٌ مرسل، ولكني أخاف الرومَ على نفسي، ولولا ذلك لاتَّبعتُهُ. فهل تريدُ من التصديق أمرًا وراء ذلك؟ فلما وُجِد منهم التصديقُ والتسليمُ والإقرارُ بهذه المثابة، وَجَبَ على التعريفِ المذكورِ أن يُحْكم عليهم بالإسلام، مع اتفاقهم على كونهم كافرين.
فأقول: إنّ الجزءَ الذي يمتاز به الإيمان والكفر، هو التزام الطاعة (1) مع الردع والتبري عن دين سواه، فإذا التزم الطاعة فقد خرجَ عن ضلالة الكفر ودخل في هَدْي الإسلام. وحينئذٍ تبين لك وجه كفر هؤلاء الكفرة مع تصديقهم ومعرفتهم، وذلك لأن أبا طالب وإن أعلن بحقية دينه، إلا أنه لم يلتزم طاعته، ولم يدخل في دينه، ولذا قال: لولا الملامة أو حذار مسبة .... إلخ، فآثر النار على العار. وهكذا هِرَقل، وإن تمنى لقاءه وَبجَّلَه وعظمه بظهر الغيب، لكنه خشي الرومَ أشدَّ خشية، فلم يلتزم طاعته. وكذلك حال الكفار الذين أخبر الله سبحانه عن معرفتهم، فإنهم مع معرفتهم الحقَ، صفحوا عن كلمة الحق، ولم يَدِينُوا بدين الإسلام. اهـ فيض الباري شرح صحيح البخاري: 1/125، كتاب الإيمان.
“এই কুরআনই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, কাফেরদের মা’রেফত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তারা তাকে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) তেমনই চেনে, যেমন চেনে তাদের ছেলে সন্তানদেরকে।’ এই যে আবু তালেব! সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়্যাত ও মহত্বের স্বীকৃতি দিতো। তার কবিতার পংক্তিতে সে তা সুস্পষ্ট ঘোষণা করছে। সে বলছে,
*তুমি আমাকে আহ্বান করেছ এবং বলেছো যে, তুমি সত্যবাদি ... এতে তুমি সত্যই বলেছো এবং এ ব্যাপারে তুমি বিশ্বস্ত।
*আমি তোমার ধর্মকে চিনতে পেরেছি যে, ... নিঃসন্দেহে তা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
*যদি তিরস্কারের ভয় কিংবা গালি-গালাজের আশঙ্কা না থাকতো ... তাহলে আমাকে স্পষ্টরূপেই তা গ্রহণকারী বলে দেখতে পেতে।
*আমি তোমার ধর্মকে চিনতে পেরেছি যে, ... নিঃসন্দেহে তা সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
*যদি তিরস্কারের ভয় কিংবা গালি-গালাজের আশঙ্কা না থাকতো ... তাহলে আমাকে স্পষ্টরূপেই তা গ্রহণকারী বলে দেখতে পেতে।
এই যে রোমের অধিপতি হিরাক্লিয়াস! সে বলছে, ‘আমি যদি জানতাম, আমি তাঁর (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) কাছে পৌঁছতে পারবো, তাহলে আমি অবশ্যই কষ্ট বরদাশত করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতাম। যদি আমি তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে তাঁর কদমের ধুলোাবালি ধুয়ে দিতাম।’ ফাতহুল বারিতে ইবনে ইসহাক সূত্রে মুরসাল সনদে কোনো কোনো আহলে ইলম থেকে বর্ণিত আছে, হিরাক্লিয়াস বলেছিল, ‘আফসোস তোমার জন্য! আল্লাহর কসম! আমি জানি, নিঃসন্দেহে তিনি প্রেরিত নবী। কিন্তু আমি নিজের ব্যাপারে রোমানদের আশঙ্কা করছি। যদি এমনটা না হতো, তাহলে আমি অবশ্যই তাঁর অনুসরণ করতাম।’
এর চেয়েও অধিক তাসদিক আপনি চান? এমন পর্যায়ের তাসদিক, তাসলিম ও স্বীকারোক্তি যখন তাদের থেকে পাওয়া গেছে, তখন উল্লেখিত সংজ্ঞানুযায়ী তাদেরকে মুসলমান বলে হুকুম দেয়া আবশ্যক! অথচ তারা কাফের হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত।
অতএব, আমি বলি, ঈমান ও কুফর পরস্পর থেকে আলাদা হবে যে মৌলিক জিনিসের মাধ্যমে, তা হলো, (নিজের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) আনুগত্য অবধারিত করে নেয়া, সাথে সাথে অন্য সকল ধর্ম থেকে মুক্ত হওয়া ও সম্পর্কচ্ছেদ করা। যখন আনুগত্য অবধারিত করে নেবে, তখন কুফরের গোমরাহি হতে বের হয়ে ইসলামের হেদায়াতে প্রবেশ করবে। আশা করি এখন আপনার নিকট সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তাসদিক ও মা’রেফত থাকা সত্ত্বেও এসব কাফেরের কুফরির কারণ কি ছিল। কারণ, আবু তালেব যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধর্ম হক্ব বলে ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু সে তাঁর আনুগত্য নিজের জন্য অবধারিত করে নেয়নি। তাঁর ধর্মে প্রবেশ করেনি। এ কারণেই সে বলেছে, ‘যদি তিরস্কারের ভয় কিংবা গালি-গালাজের আশঙ্কা না থাকতো ... ।’ লজ্জা (বরণের) অপেক্ষায় সে জাহান্নামকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। হিরাক্লিয়াসও তা-ই করেছে। সে যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাতের আকাক্সখা করেছে, অনুপস্থিতিতে তাঁকে সম্মান করেছে, তা’জিম করেছে, কিন্তু সে রোমানদেরকে অতিমাত্রায় ভয় পেয়েছে, ফলে তাঁর আনুগত্য নিজের জন্য অবধারিত করে নেয়নি। ঐসব কাফেরদের অবস্থাও এমনই, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জানিয়েছেন: তাদের মা’রেফাত ছিল, কিন্তু হক্ব চেনার পরও তারা হকের কালিমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইসলাম ধর্মকে নিজের ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেনি।”- ফায়জুল বারি, কিতাবুল ঈমান ১/১২৫
ঈমান না আনার পক্ষে কাফেরদের কতগুলো খোঁড়া যুক্তি উল্লেখ করার পর শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,
وهذه الأمور وأمثالها ليست حججا تقدح في صدق الرسل بل تبين أنها تخالف إرادتهم وأهواءهم وعاداتهم فلذلك لم يتبعوهم وهؤلاء كلهم كفار بل أبو طالب وغيره كانوا يحبون النبي صلى الله عليه وسلم ويحبون علو كلمته وليس عندهم حسد له وكانوا يعلمون صدقه ولكن كانوا يعلمون أن في متابعته فراق دين آبائهم وذم قريش لهم فما احتملت نفوسهم ترك تلك العادة واحتمال هذا الذم فلم يتركوا الإيمان لعدم العلم بصدق الإيمان به؛ بل لهوى النفس. اهـ
“এসব বিষয় এবং এর সমশ্রেণীর অন্যান্য বিষয় এমন কোন দলীল নয় যা রাসূলগণের সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। বরং প্রমাণ করে যে, এগুলো তাদের মনোচাহিদা, প্রবৃত্তি ও আদত-অভ্যাসের পরিপন্থী সাব্যস্ত হয়েছে। এ কারণেই তারা রাসূলগণের আনুসরণ করেনি। এদের সকলেই কাফের। বরং আবু তালেব ও আরো অনেকে তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহব্বতও করতো। তার কালিমা বলুন্দ হোক তাও চাইতো। তার প্রতি তাদের কোন প্রতিহিংসা ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতাও তাদের জানা ছিল। কিন্তু তারা জানতো যে, রাসূলের অনুসরণ করতে গেলে তাদের বাপ-দাদাদের ধর্ম ছাড়তে হবে। কুরাইশরা তাদের গাল-মন্দ করবে। (পূর্ব পুরুষদের) ঐসব আদত-অভ্যাস পরিত্যাগ করা এবং এই গাল-মন্দ বরদাশত করার হিম্মত তাদের হয়নি। অতএব, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনার সত্যতা না জানার কারণে ঈমান ছাড়েনি, বরং প্রবৃত্তির তাড়নায় ছেড়েছে।”- মাজমুউল ফাতাওয়া ৭/১৯২-১৯৩
বুঝা গেল, কাফেরদের অনেকে সব কিছু জানা বুঝার পরও শুধু দুনিয়ার লোভে ঈমান আনেনি। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ
“তা (অর্থাৎ তাদের কুফর) এ কারণে যে, তারা দুনিয়াকে আখেরাতের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং (এ কারণে যে,) আল্লাহ তাআলা কাফের সম্প্রদায়কে (জোরপূর্বক) হেদায়াত দেন না।”- নাহল ১০৭বুঝা গেল: বিশ্বাস, মহব্বত, স্বীকারোক্তি সব থাকার পরও যদি কেউ দুনিয়ার লোভে পড়ে ঈমান ত্যাগ করে, তাহলে সেও কাফেরই গণ্য হবে। তার বিশ্বাস, তার মহব্বত, তার স্বীকারোক্তি- এসব কোনই কাজে আসবে না।
একইভাবে ঈমান আনার পর যদি কেউ কোন কুফরি কাজ করে তাহলে তার বিশ্বাস, মহব্বত, স্বীকারোক্তি কোনই কাজে আসবে না। আহলে সুন্নাহর সকলের ঐক্যমতে সে মুরতাদ। যেমন, কেউ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা সত্বেও তাকে নিয়ে কটাক্ষ করে, তাহলে সর্বসম্মতিতে সে মুরতাদ। শুধু দুনিয়ার লোভেও যদি করে তবুও মুরতাদ। অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিদ্বেষ রাখা আবশ্যক নয়। তাকে মিথ্যা ভাবাও আবশ্যক নয়। সব ঠিকঠাক থাকার পরও যদি কোন দুনিয়াবি লোভে, অর্থ-কড়ি বা পদের বা চাকরির লোভে কটাক্ষ করে তবুও মুরতাদ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ
“আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও তার রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করছিলে?! কোন অজুহাত দেখিও না। ঈমান আনার পর তোমরা যে কাফের হয়ে গেছো।”- তাওবা ৬৫-৬৬
***
উপরোক্ত আলোচনা বুঝার পর আশাকরি সহজে বুঝে আসবে যে, কোন ব্যক্তি যদি ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাস করার পরও, নিজেকে ইসলামের অনুসারি দাবি করার পরও শুধু দুনিয়ার লোভে বা চাকরি ঠিক রাখার খাতিরে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে কাফেরদের সহায়তা করে, তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ
“তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”- মায়েদা ৫১
“তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।”- মায়েদা ৫১
এ ব্যাপারে আহলে ইলমদের কয়েকটি বক্তব্য উল্লেখ করছি:
এক. ইবনে হাযম রহ. (৪৫৬ হি.)
من لحق بدار الكفر والحرب مختارا محاربا لمن يليه من المسلمين، فهو بهذا الفعل مرتد له أحكام المرتد كلها: من وجوب القتل عليه متى قدر عليه، ومن إباحة ماله، وانفساخ نكاحه، وغير ذلك. اهـ
“যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় দারুল কুফর ও দারুল হরবে চলে যাবে এবং গিয়ে (দারুল হরবের) নিকটবর্তী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, সে তার এ কাজের দ্বারা মুরতাদ হয়ে যাবে। মুরতাদের সকল বিধি বিধান তার উপর বর্তাবে। যেমন- ধরতে সক্ষম হলে তাকে হত্যা করা ফরয, তার মাল হালাল, তার বিবাহ বাতিল ইত্যাদি।”- আলমুহাল্লাহ ১১/২৫০
আরো বলেন,
وكذلك: من سكن بأرض الهند، والسند، والصين، والترك، والسودان والروم، من المسلمين، فإن كان لا يقدر على الخروج من هنالك لثقل ظهر، أو لقلة مال، أو لضعف جسم، أو لامتناع طريق، فهو معذور. فإن كان هناك محاربا للمسلمين معينا للكفار بخدمة، أو كتابة: فهو كافر. اهـ
“তদ্রূপ যে মুসলমান হিন্দুস্তান, সিন্দু, চীন, তুর্কিদের ভূমি, সুদান বা রোমে বসবাস করে; যদি সে পরিবার বড়, সম্পদের স্বল্পতা, শারীরিক দুর্বলতা বা রাস্তা অনিরাপদ হওয়ার কারণে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে, তাহলে সে মা’জূর। পক্ষান্তরে যদি সেখানে থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, খেদমত বা লিখনীর (মতো সামান্য কিছুর) দ্বারাও কাফেরদের সহায়তা করে, তাহলে সে কাফের।”- আলমুহাল্লা ১১/২৫০
উল্লেখ্য, এসব ভূমি তখন কাফেরদের ভূমি ছিল।
আরো বলেন,
ولو أن كافرا مجاهدا غلب على دار من دور الإسلام، وأقر المسلمين بها على حالهم، إلا أنه هو المالك لها، المنفرد بنفسه في ضبطها، وهو معلن بدين غير الإسلام لكفر بالبقاء معه كل من عاونه، وأقام معه - وإن ادعى أنه مسلم. اهـ
“যদি কোন সুস্পষ্ট কাফের মুসলমানদের কোন ভূমি দখল করে নেয় কিন্তু মুসলমানদেরকে আপন হালতে সেখানে বহাল রাখে; তবে উক্ত ভূমির মালিক সে-ই এবং সে-ই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক, পাশাপাশি সে প্রকাশ্যে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম অনুসরণের দাবিদার হয়, তাহলে সেখানে থেকে গিয়ে যে-ই তাকে সহায়তা করবে এবং তার সাথে অবস্থান করবে, সে-ই কাফের হয়ে যাবে; যদিও সে নিজেকে মুসলমান দাবি করে।”- আলমুহাল্লা ১১/২৫১
উল্লেখ্য, দারুল হরবে চলে যাওয়া বা থেকে যাওয়াই মূল উদ্দেশ্য নয়, মূলকথা হলো, যে ব্যক্তিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহায়তা করবে, সেই মুরতাদ হয়ে যাবে।
প্রথম বক্তব্যে فهو بهذا الفعل مرتد -‘সে তার এ কাজের দ্বারা মুরতাদ হয়ে যাবে’- কথাটা থেকে সুস্পষ্ট যে, কাফেরদের সহায়তা করা কাজটাই কুফর। আকীদা যা-ই হোক, এ কাজের দ্বারাই কাফের হয়ে যাবে। তদ্রূপ, শেষ বক্তব্যে وإن ادعى أنه مسلم-‘ যদিও সে নিজেকে মুসলমান দাবি করে’ থেকেও বিষয়টা স্পষ্ট। সহায়তা কি হালাল মনে করে করলো, না’কি হারাম মনে করে করলো; কাফেরদের মহব্বতে করলো বা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে করলো: এসব কিছু দেখার দরকার নেই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহায়তা করলেই মুরতাদ হয়ে যাবে।
দুই. হামদ ইবনে আতিক আননজদি রহ. (১৩০১ হি.)
مظاهرة المشركين ، ودلالتهم على عورات المسلمين ، أو الذب عنهم بلسان ، أو رضي بما هم عليه ، كل هذه مكفرات ، فمن صدرت منه – من غير الإكراه المذكور – فهو مرتد ، وإن كان مع ذلك يبغض الكفار ويحب المسلمين. اهـ
“কাফেরদের সহায়তা করা, মুসলমানদের গোপন খবরাখবর তাদের অবগত করা, যবান দিয়ে তাদের পক্ষ নেয়া, তাদের মত ও পথের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা: এ সবগুলোই কুফর। পূর্বোক্ত ইকরাহ-জবরদস্তী ব্যতীত যার থেকে এসব প্রকাশ পাবে, সে মুরতাদ; যদিও সে পাশাপাশি কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে এবং মুসলমানদের মহব্বত করে থাকে।”- আদদিফা আন আহলিস সুন্নাহ ৩০
লক্ষ করুন, ‘যদিও সে পাশাপাশি কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে এবং মুসলমানদের মহব্বত করে থাকে।’
তিন. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.)
যেসব মুসলমান তাতারদের পক্ষাবলম্বন করেছিল, তাদের তাকফির করে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) বলেন,
وكل من قفز إليهم من أمراء العسكر وغير الأمراء فحكمه حكمهم وفيهم من الردة عن شرائع الإسلام بقدر ما ارتد عنه من شرائع الإسلام. وإذا كان السلف قد سموا مانعي الزكاة مرتدين - مع كونهم يصومون. ويصلون ولم يكونوا يقاتلون جماعة المسلمين - فكيف بمن صار مع أعداء الله ورسوله قاتلا للمسلمين. اهـ
“সেনাবাহিনির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বা অন্যান্য মুসলমানের মধ্য থেকে যারাই তাতারদের দলে যোগ দেবে, তাদের বিধান তাতারদেরই অনুরূপ হবে। চেঙ্গিস খান ইসলামী শরীয়তের বিধানাবলী থেকে যে পরিমাণ রিদ্দাহ্য় লিপ্ত, তাদের মাঝেও ঐ একই পরিমাণ ইরতিদাদ বিদ্যমান। সালাফগণ যেখানে যাকাত আদায়ে অসম্মতিজ্ঞাপনকারীদেরকে মুরতাদ আখ্যায়িত করেছেন; অথচ তারা নামাযও পড়তো, রোযাও রাখতো এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেনি; তখন ঐ ব্যক্তির কি বিধান হবে, যে আল্লাহ ও রাসূলের দুশমনদের সাথে মিলে মুসলমানদের হত্যা করে?!”- মাজমুউল ফাতাওয়া ২৮/৫৩০
অর্থাৎ সে আরো আগেই মুরতাদ হয়ে যাবে। এখানে তিনি এ শর্ত করেননি যে, যারা কাফেরদের মহব্বতে তাতারদের সাথে যোগ দেবে তারাই কেবল কাফের হবে, বাকিরা হবে না। ঢালাওভাবে সকলের উপর হুকুম লাগিয়েছেন।
চার. আহমাদ শাকের রহ. (১৩৭৭ হি.)
আগ্রাসী ইংরেজ ও ফরাসীদের সহায়তার বিধান আলোচনাকল্পে তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও কাযি আহমাদ শাকের রহ. (১৩৭৭ হি.) বলেন,
أما التعاون مع الإنجليز، بأي نوع من أنواع التعاون، قل أو كثر، فهو الردة الجامحة، والكفر الصُّراح ... سواء أكان ذلك من أفراد أو حكومات أو زعماء. كلهم في الكفر والردة سواء. اهـ
“ইংরেজদেরকে যেকোন প্রকারে সাহায্য করা- কম হোক বেশি হোক- তা সুনিশ্চিত রিদ্দাহ ও সুস্পষ্ট কুফর। ...সাহায্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক হোক, রাষ্ট্রীয় হোক বা নেতৃস্থানীয় লোকদের থেকে হোক- রিদ্দাহ ও কুফরে সকলেই বরাবর।”- কালিমাতুল হক ৭৬
আরো বলেন,
ولا يجوز لمسلم في أي بقعة من بقاع الأرض أن يتعاون معهم بأي نوع من أنواع التعاون، وإن التعاون معهم حكمه حكم التعاون مع الإنجليز: الردة والخروج من الإسلام جملة، أياَ كان لون المتعاون معهم أو نوعه أو جنسه. اهـ
“কোন ভূখণ্ডেই কোন মুসলিমের জন্য ফরাসীদের কোন রকম সহায়তা করা জায়েয হবে না। তাদেরকে সহায়তা করার বিধান ইংরেজদের সহায়তা করার অনুরূপ। অর্থাৎ, রিদ্দাহ ও সম্পূর্ণরূপে দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাওয়া; সহায়তাকারী যে বর্ণেরই হোক, যে শ্রেণীরই হোক আর যে জাতীরই হোক।”- কালিমাতুল হক ৭৭এ শর্ত করেননি যে, ইংরেজদের বা ফরাসিদের মহব্বতে সহায়তা করলে কাফের হবে, অন্যথায় নয়।
উপরোক্ত আলোচনার পর আশাকরি শরীফ হাতেম আলআউনীর বিভ্রান্তি বুঝতে পারবেন। তিনি এ বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন যে, কাফেরদের ও কাফেরদের দ্বীনের মহব্বত নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহায়তা করলে কাফের হবে, অন্যথায় হবে না। দুনিয়ার লোভে, চাকরির লোভে কেউ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহায়তা করলে কাফের হবে না। অন্তরে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি মহব্বত থাকলে এবং কাফেরদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলে সহায়তা যতই করুক, যতই মুসলমান হত্যা করুক, আল্লাহর দ্বীনের যতই ক্ষতি করুক- কাফের হবে না। এটি সুস্পষ্ট জাহমিয়াদের মতবাদ।
প্রথমত কথা হল, যে কাফেরদের সাথে মিলে ইসলামকে মিটিয়ে দিতে যুদ্ধে লিপ্ত, তার অন্তরে ইসলামের সত্যতার বিশ্বাস যদিও থাকতে পারে, কিন্তু ঐ পরিমাণ তা’জিম নেই, যেই পরিমাণ তা’জিম থাকলে তাকে মুসলমান ধরা যায়। বেশির চেয়ে বেশি আবু তালেবের মতো মহব্বত আছে, যা ঈমানের জন্য যথেষ্ট নয়।
দ্বিতীয়ত পূর্ণ তা’জিমও যদি থাকে, তথাপি সুষ্পষ্ট কুফরে লিপ্ত হলে এ তা’জিম তাকে কুফর থেকে বাঁচাতে পারবে না; যেমন পারে না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটাক্ষকারীকে বাঁচাতে। কাজেই আউনীর এ শর্তটি কুরআন সু্ন্নাহ পরিপন্থী জাহমি মতবাদের বক্তব্য। আমার মনে হয় এসব জাহমি, মুরজি ও দরবারিদের কিতাবাদি আগে অধ্যয়ন করাও মারকাযের বড়দের বিভ্রান্তির একটা বড় কারণ। আল্লাহ আমাদেরকে আলেমদের বিচ্যুতি এবং মুনাফিক ও দরবারি আলেমদের থেকে হিফাজত করুন। আমীন।
Comment