জিহাদ ও মুজাহিদিন নিয়ে হযরতওয়ালাদের বিভ্রান্তি-০১
ঢালকানগরের পীর আব্দুল মতীন বিন হোসাইন সাহেবের একটি বয়ান বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ৩১শে মে ২০১৯ ইং, ২৬ নং তারাবি বাদ বয়ান। বয়ানটি শুরু হয়েছিল একটি হাদিস দিয়ে, যাতে যিকিরকারীকে জিহাদকারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। এরপর সেখান থেকে হযরতওয়ালা শুরু করেছেন মুজাহিদদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কটাক্ষ আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য।
হযরতওয়ালার ভাষায় মুজাহিদ হচ্ছে:
এমন কতক জযবাতি লোক, যারা তাদের পাগলামী ও জযবাকে, তাদের বুঝ-বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে- শরীয়তের ফায়সালার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না; যারা কুরআন-সুন্নাহ ও উলামায়ে দ্বীনের ফায়সালার অনসরণের স্থলে নিজেদের খাহেশের অনুসরণকে অগ্রাধিকার দেয়; যারা হত্যা ও খুন করে উল্লাসবাজি করে; দ্বীন যিন্দা করার নামে এদিক সেদিক বোম মেরে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে; যাদের দ্বারা উম্মাহর ফায়দার স্থলে ক্ষতি হচ্ছে বেশি এবং যাদের সীমালঙ্গনের কারণে সারা বিশ্বে মুসলমানগণ অনিরাপত্তায় ভুগছে।
মোটামুটি হযরতওয়ালার যবানে এ হচ্ছে মুজাহিদদের পরিচিতি। হযরতওয়ালার ভাষায়: কিছু আয়াতের অপব্যাখ্যা করে এ ধরণের জিহাদনামী ফাসাদের প্রচার ঘটছে। আরো বলেন, এ পথে তারা যে কুরবানি পেশ করছে তা বন্ধ করে যদি তারা লোকদের দাওয়াত দিত, তাহলে এর চেয়ে লাখো-কোটি গুণ বেশি ফায়দা হতো।
এ প্রসঙ্গে তিনি বড় চার ইমামের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। প্রথমে ইমাম মালেকের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন,
“তিনি মোট কয়টা জিহাদ করছেন? ... করছিলেন কোনো জিহাদ? হ্যাঁ !? (ধমক ও আপত্তির সুরে।)”
এরপর ইমাম আহমাদ রহ. ও খালকে কুরআনের ফিতনা প্রসঙ্গ এনে বলেন,
“ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. সেই নিজের সহী মসলক প্রচার করতে থাকছেন। কিন্তু ঐ যারা কুরআন মাখলূক বলছিল, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ কি করছিলেন!? তাদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরছিলেন?!”
এরপর ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. এর প্রসঙ্গে বলেন যে তিনি,
“বড় কঠিন জুলুমের শিকার হইছেন। ... রক্তাক্ত হইছেন। কিন্তু কোথায় কোন্ জিহাদ করছেন যে, ভক্তরা আস! অস্ত্র ধর! তলোয়ার লও?! জিহাদ করছিলেন?!”
এভাবে তিনি চার ইমামের প্রসঙ্গ এনে শেষে বলেন,
“এরা জিহাদ কয়টার মধ্যে যোগ দিছে? ব..ল.. ভাই। তারা সবেই জিহাদ না করার কারণে সব জাহান্নামী হবে? বা গুনাহে কবীরাতে লিপ্ত?”
শেষমেশ বক্তব্য, এমন কিছু জযবাতি লোকের সীমালঙ্গনের কারণে সারা *দুনিয়াতে মুসলমান আজ অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গভরে এভাবে তিনি যতটুকু পেরেছেন মুজাহিদদের অপমান করার চেষ্টা করেছেন।
এ হল জিহাদ ও মুজাহিদিনের ব্যাপারে হযরতওয়ালার আকিদা ও বক্তব্য।
অভিব্যক্তি:
আব্দুল মতীন সাহেবের পীর হাকিম আক্তার সাহেব রহ.। হাকিম আক্তার সাহেব রহ. জিহাদ ও মুজাহিদদের কতটুকু ভালবাসতেন এবং তালেবানদের তিনি কি পরিমাণ সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন, তা অনেকের আশাকরি জানা আছে। শুনেছি জিহাদের কথা বলার কারণে আব্দুল মতীন সাহেব নিজ পীরের প্রতি একবার অসন্তুষ্ট হয়েছেন। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে তিনি জিহাদবিদ্বেষী হবেন স্বাভাবিক। মুজাহিদদের নিয়ে কটাক্ষ করবেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেন (যেমনটা অন্য দশজন জিহাদবিদ্বেষী করে থাকে) এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখজনক হল, তারা তাদের এ ধরণের বদ আকীদাকে শরীয়তের আবরণে চালিয়ে থাকে। বাতিল কখনই নিজেকে সরাসরি হকের বিরুদ্ধে দাড় করায় না। বরং বাতিলকে হকের আবরণে পেশ করে। আর এভাবেই এদের দ্বারা জনগণ বিভ্রান্ত হয়। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮ হি.) কত বাস্তব কথাই না বলেছেন,
ولا يشتبه على الناس الباطل المحض؛ بل لا بد أن يشاب بشيء من الحق. اهـ
“নিরেট বাতিলের দ্বারা লোকজন সংশয়ে পড়ে না। (সংশয়ে পড়ার জন্য) বরং কিছুটা হকের সংমিশ্রণ আবশ্যক।”- মাজমুউল ফাতাওয়া ৮/৩৭
হযরতওয়ালারা যদি সত্য করে বলতেন যে, আমরা জিহাদ অপছন্দ করি বা জিহাদে জান-মালের আশঙ্কা তাই আমরা তা করতে রাজি না, খানকার আরামের জিন্দেগি আমরা ছাড়তে পারবো না, তাহলে কেউই তাদের কথা সমর্থন করতো না। কেউ তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হতো না। কিন্তু দুঃখজনক হল, তারা নিজেদের দুর্বলতা গোপন রেখে নিজেদের বাতিল অবস্থানটির পক্ষে চতুরতার সাথে এমন কিছু যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরে, যেগুলোর অসাড়তা সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে না। আর এভাবেই তারা বিভ্রান্ত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়টিরই আশঙ্কা করে গেছেন। তিনি ইরশাদ করেন,
إنما أخاف على أمتى الأئمة المضلين (سنن ابي داود: 4254، جامع الترمذي 2229، قال الترمذي: هذا حديث حسن صحيح. اهـ)
“গোমরাহকারী ইমাম-নেতাদের তরফ থেকে আমার উম্মতের ব্যাপারে আমার আশঙ্কা হচ্ছে।”- আবু দাউদ ৪২৫৪, তিরমিযি ২২২৯
মোল্লা আলী ক্বারী রহ. (১০১৪ হি.) বলেন,
الأئمة: جمع إمام وهو مقتدى القوم ورئيسهم، ومن يدعوهم إلى قول أو فعل أو اعتقاد. اهـ
“… ইমাম-নেতা হচ্ছে কওমের অনুসৃত ব্যক্তি এবং তাদের প্রধান। তাছাড়াও এমন ব্যক্তি, যে কওমকে কোন কথা, কাজ বা আকীদার দিকে দাওয়াত দেয়।”- মিরকাত ১৫/৩৫৫
ইমামের এ ব্যাপক অর্থে আমাদের অনেক হযরতওয়ালাও পড়বেন, যাদের দ্বারা উম্মত বিভ্রান্ত হবেন বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশঙ্কা করে গেছেন। আজ আমরা এরই বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি। ওয়াইলাল্লাহিল মুশতাকা!
যিকির প্রসঙ্গ:
যিকিরের ব্যাপারে আগেও কথা হয়েছে। তাই এ নিয়ে কথা বাড়াবো না। তবে জিহাদের ফজিলতের ব্যাপারে সহীহ মুসলিম শরীফের একটি হাদিস উল্লেখ করছি-
عن أبي هريرة قال قيل للنبي صلى الله عليه و سلم ما يعدل الجهاد في سبيل الله عز و جل ؟ قال ( لا تستطيعوه ) قال فأعادوا عليه مرتين أو ثلاثا كل ذلك يقول ( لا تستطيعونه ) وقال في الثالثة ( مثل المجاهد في سبيل الله كمثل الصائم القائم القانت بآيات الله لا يفتر من صيام وصلاة حتى يرجع المجاهد في سبيل الله تعالى )
“হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করা হল, এমন কি আমল আছে যা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সমান হতে পারে? তিনি উত্তর দিলেন, তোমরা তা করতে সক্ষম নও। এভাবে দুই/তিন বার তারা একই প্রশ্নটি করলো আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবারেই জওয়াব দিলেন, তোমরা তা করতে সক্ষম নও। শেষে তৃতীয়বারে বললেন, রোযাদারের দৃষ্টান্ত হল এমন এক (ইবাদতগুজার) ব্যক্তির মতো যে (দিনভর) অনবরত রোযা রেখে চলেছে এবং আল্লাহ তাআলার (কুরআনের) আয়াতগুলোর (তিলাওয়াতের) মাধ্যমে খুশু-খুজুর সাথে (রাতভর) অনবরত নামায পড়ে চলেছে। আল্লাহর পথের মুজাহিদ (জিহাদ থেকে) ফিরে আসা পর্যন্ত সে রোযা ও নামাযে একটুও বিরতি দিচ্ছে না।”- সহীহ মুসলিম ১৮৭৮
খানকাহবাসীরা জয়ীফ-মুনকার হাদিসগুলো বাদ দিয়ে যদি এসব সহীহ হাদিসের দিকে তাকাতেন তাহলে সহজেই মুজাহিদের ফজিলত বুঝতে পারতেন। এ হাদিসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমাদের পক্ষে অন্য কোন আমলের মাধ্যমে জিহাদের সমান সওয়াব লাভ করা সম্ভব নয়। সাহাবায়ে কেরামের বার বার প্রশ্নের জওয়াবের তিনি এমন একটি আমলের কথা বলেছেন, যা কেউ করতে সক্ষম নয়। আর তা হল, লাগাতার রোযা এবং এক মূহুর্তও বিরতি ব্যতীত লাগাতার খুশু-খুজুর সাথে নামায। উদ্দেশ্য, এ আমল তোমরা করতেও পারবে না, মুজাহিদের জিহাদের সমান সওয়াবও লাভ করতে পারবে না।
ইমাম নববি রহ. (৬৭৬ হি.) বলেন,
وفي هذا الحديث عظيم فضل الجهاد لأن الصلاة والصيام والقيام بآيات الله أفضل الأعمال وقد جعل المجاهد مثل من لايفتر عن ذلك في لحظة من اللحظات ومعلوم أن هذا لايتأتى لأحد ولهذا قال صلى الله عليه وسلم لاتستطيعونه. اهـ
“এ হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, জিহাদের ফজিলত মহা ফজিলত। কেননা, নামায, রোযা ও আল্লাহ তাআলার আয়াতসমূহের আনুগত্য সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। আর এখানে মুজাহিদকে গণ্য করা হয়েছে এমন ব্যক্তির মতো যে এগুলো থেকে এক পলকও বিরত হয় না। আর সকলেরই জানা কথা যে, এটা কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা তা করতে সক্ষম নও’।”- আলমিনহাজ ১৩/২৫
যখন লাগাতার নামায, রোযা ও কুরআন তিলাওয়াতের দ্বারাও মুজাহিদের সমান সওয়াব পাওয়া যাচ্ছে না- অথচ এগুলো সকল যিকির এবং সকল আমলের চেয়েও শ্রেষ্ঠ আমল- তাহলে এমন কোন যিকিরকারী আছে যে তার যিকিরের দ্বারা মুজাহিদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হয়ে যাবে!?
বুঝা গেল, সকল নফল নামাযীর নামায, সকল নফল রোযাদারের রোযা এবং সকল যিকিরকারীর যিকিরের চেয়েও মুজাহিদের জিহাদের মর্যাদা অনেক অনেক বেশি। কিন্তু এ ধরণের ফজিলত যেহেতু সহীহ হাদিসে এসেছে, তাই এগুলো হযরতওয়ালাদের নজরে পড়ে না!!
যাহোক, এখন কথা হল, কোনো কোনো হাদিসে যে জিহাদের চেয়ে যিকির শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে-হাদিস সহীহই হোক আর জয়ীফই হোক- তার কি জওয়াব?
উত্তর:
এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র পোস্টে আলোচনা হয়েছে। তাই কথা বাড়াবো না। সংক্ষেপ উত্তর হল যা হাফেয ইবনে হাজার রহ. (৮৫২ হি.) দিয়েছেন: যে জিহাদে আল্লাহ তাআলার ইয়াদ, যিকির, আজমত ও ইস্তিহজার নেই তার চেয়ে আজমত, মহব্বত ও ইস্তিহজারওয়ালা যিকির শ্রেষ্ঠ। পক্ষান্তরে যে জিহাদ আল্লাহর ইয়াদ, যিকির ও আজমতের সাথে হয় তা সকল প্রকার যিকিরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর স্পষ্ট যে, জিহাদ সাধারণত আল্লাহ তাআলার ইয়াদ সহই হয়ে থাকে। যে মুজাহিদের উপর বিমান থেকে মিসাইল ছোঁড়া হচ্ছে, যার সম্মুখে শত্রুর শতটি ট্যাংক ধেয়ে আসছে, যার ডান-বাম সকল দিক দিয়ে শো শো শব্দে বুলেটগুরো ছুটে যাচ্ছে, যার সামনে তারই দশটি ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে- তার আল্লাহর ইয়াদের সাথে খানকাহর যিকিরের কি-ই বা তুলনা হতে পারে? শত বৎসর খানকাহয় পড়ে থাকলেও মুজাহিদের এমন একটা মূহুর্তের যিকিরের সমান হবে কি’না সন্দেহ! আর জান-মাল বিলিয়ে দেয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম।
হ্যাঁ, কিছু মুজাহিদ এমন থাকাও অসম্ভব নয় যে, জিহাদের এমন ভয়াবহ ময়দানেও তাদের আল্লাহর ইয়াদ হয় না। দুনিয়ার মহব্বতই তাদের উপর চড়াও হয়ে আছে। তাদের কথা ভিন্ন। ওয়াল্লাহু তাআলা আ’লাম।
সামনের পর্বে ইনশাআল্লাহ আইম্মায়ে আরবাআর জিহাদ প্রসঙ্গ আসবে। হযরতওয়ালা এ প্রসঙ্গে কেমন অজ্ঞতার প্রমাণ দিয়েছেন বা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন দেখা যাবে ইনশাআল্লাহ।
Comment