আইম্মায়ে আরবাআর যামানায় জিহাদ প্রসঙ্গ:
হযরতওয়ালা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে দলীল দিয়েছেন আইম্মায়ে আরবাআ (আবু হানিফা, মালেক, শাফিয়ী ও আহমাদ ইবনে হাম্বল) রাহিমাহুমুল্লাহর সীরাত দিয়ে। হযরতওয়ালার দাবি, তারা বিভিন্ন প্রকারের কষ্ট-নির্যাতন সহ্য করেছেন, তথাপি তাদের কেউ জিহাদ করেননি। তাহলে জযবাতিরা জিহাদ কোথায় পেল? তার অবস্থানকে মজবুত করতে তিনি এ প্রশ্নও রেখেছেন, “তারা সবেই জিহাদ না করার কারণে সব জাহান্নামী হবে? বা গুনাহে কবীরাতে লিপ্ত?”
প্রথমে বলে নিই, বর্তমান মুসলমানগণ মৌলিকভাবে দু ধরণের কাফেরের বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন:
এক. দখলদার প্রকাশ্য কাফের। যেমন- ইয়াহুদ, নাসারা, রাফেযী, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি।
দুই. মুসলিমনামধারী গণতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক তাগুত-মুরতাদ শাসক শ্রেণী।
হযরতওয়ালার বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, উভয় প্রকার মুজাহিদদেরই তিনি জযবাতি-খাহেশপূজারি আখ্যা দিয়েছেন। শুধু বিশেষ কোন মুজাহিদ দল তার উদ্দেশ্য না। এক কথায়- চলমান বিশ্বের সকল মুজাহিদকেই তিনি আক্রমণের নিশানা বানিয়েছেন। আমার ভুল হয়ে থাকলে হযরতওয়ালারা ইচ্ছে করলে সংশোধন করে দিতে পারবেন।
আইম্মায়ে আরবাআ জিহাদ করেছেন কি করেননি সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কয়েকটি মৌলিক কথা বলা জরুরী মনে হচ্ছে:
এক.
হযরতওয়ালা দলীল হিসেবে আইম্মায়ে আরবাআকে বেছে নিলেন কেন? কুরআন, সুন্নাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের সীরাতে কি এর কোন দলীল বা নজীর বিদ্যমান নেই যে, সব কিছু বাদ দিয়ে আইম্মায়ে আরবাআকে ধরতে হচ্ছে? আইম্মায়ে আরবাআর কথা-কাজ তো শরীয়তের দলীল নয়। আইম্মায়ে আরবাআ স্বয়ং নিজেরাই যে কুরআন, সুন্নাহ, সীরাতে রাসূল ও সীরাতে সাহাবাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন, হযরতওয়ালা সেগুলোকে দলীলরূপে পেশ করতে নারাজ হলেন কেন? তিনি তো বলতে পারতেন:
“ওহে জযবাতির দল! তোমরা যে জিহাদ জিহাদ কর, কুরআনে কোথায় জিহাদের কথা আছে? হাদিসের কোথায় জিহাদের কথা আছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি জীবনে কোনো জিহাদ করেছেন? কোনো সাহাবি কি জীবনে কোনো জিহাদ করেছেন? তাদের কেউ তো কোন একটা জিহাদও করেননি, তাহলে তোমরা জিহাদ কোথায় পেলে?”
এভাবে কুরআন সুন্নাহকে তিনি দলীলরূপে পেশ করতে পারতেন না কি? কিন্তু কেন করলেন না?
এর উত্তর মোটামুটি সকলের কাছেই পরিষ্কার যে- কুরআন, সুন্নাহ, সীরাতে রাসূল ও সীরাতে সাহাবা দেখতে গেলে দেখা যাবে: কুরআনের পাতায় পাতায় জিহাদের কথা, হাদিসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় জিহাদের কথা, রাসূলের সমগ্র জিন্দেগিই জিহাদ, প্রত্যেকজন সাহাবিই মুজাহিদ। এদিকে হাত দিতে গেলেই মুশকিল।
অধিকন্তু তখন প্রশ্ন আসবে যে, রাসূল কি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? কোনো সাহাবির কি কোনো খানকাহ বা কোনো মুরীদ ছিল? যদি না থাকে, তাহলে ওহে হযরতওয়ালারা, তোমরা খানকাহ কোথায় পেলে?
দুই.
প্রথম ইমাম আবু হানিফা রহ. এর জন্ম ৮০ হিজরিতে আর চতুর্থ ইমাম আহমাদ রহ. এর ইন্তেকাল ২৪১ হিজরিতে। এর মাঝখানে সময় হল ১৬১ বছর। বলতে গেলে সাহাবায়ে কেরামের পর বিশ্বজোড়া ইসলামের বিজয় এ সময়টাতেই হয়েছে। উমাইয়া ও আব্বাসী খলিফারা কাফের রাষ্ট্রগুলো বিজয় করে ইসলামী ভূখণ্ডে পরিণত করেছেন। হযরতওয়ালার কাছে প্রশ্ন: এ বিজয়গুলো কিভাবে হয়েছে? বাহিনি পাঠানো হয়েছিল কি’না? অস্ত্র চালানো হয়েছিল কি’না? যুদ্ধ হয়েছিল কি’না? মানুষ হত্যা হয়েছিল কি’না?
যদি বলেন, এগুলোর কিছুই হয়নি, যিকিরের দ্বারা বিজয় হয়েছিল: তাহলে লোকজন আপনাকে পাগল বলবে। অতএব, না বলে উপায় নেই যে, এসব কিছুই হয়েছিল।
প্রশ্ন হল, সেগুলো জিহাদ ছিল কি’না? সেগুলোতে উলামায়ে কেরামের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছিল কি’না? সেগুলো উলামায়ে কেরামের নির্দেশনায় শরীয়ত অনুযায়ী পরিচালিত হতো কি’না? মুজাহিদিনে কেরামের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল উলামায়ে কেরাম বলতেন কি’না? তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদ কাজি সাহেবগণ মীমাংসা করতেন কি’না? গনিমতের মাল এবং গোলাম-বাঁদি কাজি সাহেবগণের তত্বাবধানে বণ্টন হতো কি’না? না বলে উপায় নেই যে, এ সব কিছুই হয়েছে।
হযরত ওয়ালার কাছে আরো প্রশ্ন: এসব জিহাদ আইম্মায়ে আরবাআর সামনেই সংঘটিত হয়েছিল কি’না? তাদের সম্মতি ছিল কি’না?
না বলে উপায় নেই যে, তাদের সম্মতিতেই হয়েছিল। বরং বলতে গেলে হানাফি, মালেকি, শাফিয়ি ও হাম্বলিরা এবং আইম্মায়ে আরবাআর শাগরেদ ও ভক্তবৃন্দরাই এসব জিহাদ করেছে, আর আইম্মায়ে আরবাআ মুজাহিদদের প্রয়োজনীয় মাসায়েল বলে ও সংকলন করে মুজাহিদদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এগুলো অস্বীকার করার কোন জু নেই। যদি তাই হয়, তাহলে জযবাতিরা জিহাদ কোথায় পেল- এ প্রশ্নের আর উত্তর দেয়ার দরকার নেই আশাকরি। আইম্মায়ে আরবাআসহ অন্য সকল উলামায়ে কেরামের সামনে এবং তাদের প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ নির্দেশনা ও তত্বাবধানে যেসব জিহাদ হতো, জযবাতিরা সেগুলোই যিন্দা করছে- যখন হযরতওয়ালারা সেগুলো মিটিয়ে দিয়েছে।
তিন.
এ সময়কালে জিহাদ ফরযে আইন ছিল না’কি ফরযে কিফায়া ছিল?
উত্তর: ফরযে কিফায়া ছিল। কারণ, তখন কোন মুসলিম ভূমি কাফের মুরতাদদের দখলে ছিল না। সাময়িক সময়ে যদি কোথাও কাফেরদের থেকে আক্রমণ হতো, মুসলমানগণ দ্রুত তা প্রতিহত করে দিতেন। মুসলিম ভূমি কাফেরদের দখলে থেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো না। বরং মুসলমানগণ নতুন নতুন বিজয়াভিযান পরিচালনা করে দিন দিন কাফেরদের ভূমি দখল করতে থাকতেন। মোটকথা তখন জিহাদ ফরযে কিফায়া ছিল, ফরযে আইন ছিল না। আর ফরযে কিফায়ার বিধান আমাদের জানা আছে যে, কতক মুসলমান জিহাদ করতে থাকলে বাকি মুসলমানদের উপর জিহাদে বের হওয়া আবশ্যক থাকে না। ইচ্ছে করলে বের হতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলে অন্যান্য কাজ-খেদমতেও মশগুল থাকতে পারেন। এ সময়ে জিহাদ উত্তম না’কি ইলম নিয়ে মশগুল থাকা উত্তম তা একটি মতভেদপূর্ণ মাসআলা। কারও কারও মতে জিহাদ উত্তম, আবার কারও কারও মতে ইলমী মাশগালা উত্তম।
যেহেতু সে সময়ে জিহাদ ফরযে আইন ছিল না, তাই যার ইচ্ছা জিহাদ করতেন, যার ইচ্ছা ইলমসহ অন্যান্য খিদমত করতেন। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটাতেই কোন বাধা নিষেধ নেই। পক্ষান্তরে বর্তমানে মুসলিম ভূমিগুলো কাফের-মুরতাদদের দখলদারিত্বের শিকার হওয়ায় জিহাদ ফরযে আইন। মা’জূর নয় এমন প্রত্যেক মুসলমানের উপর জিহাদে শরীক হওয়া নামায-রোযার মতোই ফরযে আইন। এ সময়ে কেউ জিহাদ থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আইম্মায়ে আরবাআর যামানা তার ব্যতিক্রম ছিল। অতএব, সে যামানার কোন আলেম যদি জিহাদে শরীক নাও হতেন, তাহলেও তা এ বিষয়ের দলীল হতো না যে, আলেমদের জন্য বা অন্যান্য মুসলমানদের জন্য জিহাদ নাজায়েয। তখন জিহাদও ফরযে কিফায়া ছিল, ইলমও ফরযে কিফায়া ছিল। যার যেটা ইচ্ছা করতেন। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা ব্যতিক্রম। এ সময়ে জিহাদ একেবারে তরক করে দিয়ে অন্যান্য খিদমতে লিপ্ত থাকা নাজায়েয। আইম্মায়ে আরবাআর যামানা দিয়ে বর্তমান যামানার উপর আপত্তি করা হযরতওয়ালাদের ইলমী কমতি বরং জাহালত ও অজ্ঞতার প্রমাণ।
চার.
আইম্মায়ে আরবাআ যদি জিহাদ না করে থাকেন (অবশ্য তাদের ব্যাপারে এ কথা সঠিক নয়, আমরা পরে তা আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ), তাহলে এর দ্বারা জিহাদ হারাম প্রমাণ হয় না। বেশির চেয়ে বেশি এ কথা বলা যায় যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যক্তির জন্য জিহাদ না করে থাকার বৈধতা আছে। স্বয়ং আইম্মায়ে আরবাআর যামানাতেই আরো শত-হাজারো উলামা জিহাদ করে গেছেন। যদি আইম্মায়ে আরবাআর জিহাদ না করার দ্বারা জিহাদ হারাম প্রমাণিত হয়, তাহলে তখনকার সময়ে যেসকল উলামা ও মুসলমান জিহাদ করেছেন, তারা কি সব হারাম করেছেন? তখন যেসব অভিযান পরিচালিত হয়েছে সেগুলো কি সব হারাম হয়েছে? বরং প্রমাণিত আছে যে, আইম্মায়ে আরবাআর শাগরেদগণই সেসব জিহাদ করেছেন এবং আইম্মায়ে আরবাআ সেগুলো সমর্থন করে গেছেন। এরপরও হযরতওয়ালারা কিভাবে যে আইম্মায়ে আরবাআকে জিহাদের বিপক্ষে দাড় করাচ্ছেন এবং জিহাদ হারাম সাব্যস্থ করছেন বোধগম্য নয়।
পাঁচ.
আইম্মায়ে আরবাআসহ তখনকার সকল উলামা-মাশায়েখ মূলত জিহাদি ছিলেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিভিন্নভাবে তারা জিহাদ করে গেছেন ও সমর্থন করে গেছেন। তাদের জিহাদি খিদমাতগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছিল। যেমন:
ক. তখনকার বহু ইমাম সরাসরি জিহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন। যেমন- আবু হানিফা রহ. এর বিশিষ্ট শাগরেদ ও ফিকহি বোর্ডের অন্যতম সদস্য, আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. (১৮১ হি.)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৭/৩৬৫, ৩৭৬]; ইমাম মালেক, কাযি আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর বিশিষ্ট শাগরেদ আসাদ ইবনুল ফুরাত রহ. (২১৩ হি.)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৮/৩৫০-৩৫১]।
খ. অনেকে রিবাত তথা সীমান্ত পাহারার জন্য দূর-দূরান্তের সীমান্তে চলে গেছেন এবং রিবাতরত অবস্থায়ই ইন্তেকাল করেছেন। যেমন- ইমামু আহলিশ শাম ইমাম আওযায়ী রহ. (১৫৭ হি.)। [দেখুন: আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসীর: ১০/১২৮]; হাফেয আবু ইসহাক আলজাওহারি রহ. (২৪৭ হি.) (ইমাম মুসলিমসহ সুনানে আরবাআর সকলেই যার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৯/৫১০-৫১১]।
গ. জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং জিহাদের প্রয়োজনীয় মাসআয়েল বয়ানের জন্য স্বতন্ত্র কিতাব লিখে দিয়েছেন। যেমন: কিতাবুল জিহাদ- ইবনুল মুবারক রহ. (১৮১ হি.); আসসিয়ারুস সগীর ও আসসিয়ারুল কাবীর- ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (১৮৯ হি.)।
ঘ. হাদিসের কিতাবাদিতে জিহাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো স্বতন্ত্রভাবে এবং স্বতন্ত্র ও *উপযুক্ত শিরোনামে বিভক্ত করে করে বর্ণনা করেছেন; যেন মুজাহিদদের হাদিসের প্রয়োজনও পূরণ হয়, হাদিস থেকে উদঘাটিত মাসআলারও অবগতি হয়। যেমন: কিতাবুল আসার- আবু হানিফা, মুআত্তা- মালেক, কুতুবে সিত্তাহ ও এ জাতীয় অন্যান্য হাদিসের কিতাব।
ঙ. ফুকাহায়ে কেরাম ফিকহের কিতাবাদিতে কিতাবুল জিহাদ, সিয়ার, মাগাজি, কিতালু আহলির রিদ্দাহ, কিতালু আহলিল বাগি ইত্যাদি শিরোনামে জিহাদের প্রয়োজনীয় সকল মাসআলা বলে দিয়েছেন, যেন মুজাহিদগণের মাসআলার প্রয়োজন হলে সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন।
চ. কাযি ও বিচারকগণ মুজাহিদদের মাঝে সংঘটিত সকল বিবাদ-বিসম্বাদের সুরাহা করে দিয়েছেন। গনিমত, গোলাম-বাঁদি ও বিজিত ভূমি মুসলিম উমারা, উলামা ও কাযিগণের সুষ্ঠু তত্বাবধানে বণ্টিত হয়েছে।
ছ. যারা জিহাদে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি, তারা নিজেদের সম্পদ দিয়ে অন্য মুসলমানদের জিহাদে পাঠিয়ে জিহাদে অংশ নিয়েছেন।
জ. উলামায়ে কেরাম সাধারণ মুসলমানদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এজন্য প্রতি বছরই কাফের ভূমিতে মুসলিম সেনাবাহিনি হামলা করতেন আর নতুন নতুন এলাকা বিজয় করতেন। কোথাও কখনও হামলা হলে নিজেদের জান-মাল উৎস্বর্গ করে মুসলমানগণ তা প্রতিহত করতেন। এজন্য তখন এমন হয়নি যে, কোন মুসলিম ভূখণ্ড কাফেররা দখল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
ঝ. মুজাহিদগণ জিহাদে যাওয়ার পর থেকে নামাযান্তে মসজিদে মসজিদে তাদের জন্য দোয়া হতো। তাদের দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাআলা বিজয় দিতেন।
ঞ. জিহাদ থেকে ফেরার পর মুজাহিদদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ইস্তেকবাল করা হতো এবং আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা হতো।
এ ছিল আইম্মায়ে আরবাআর যামানার উলামা-মাশায়েখ ও তাদের জিহাদ প্রেমের অবস্থা। পক্ষান্তরে আমাদের বর্তমান হযরতওয়ালাদের অবস্থা হল:
- নামাযে পর্যন্ত তারা জিহাদের আয়াতগুলোর তিলাওয়াত শুনতে নারাজ। এতে না’কি তাদের খুশু-খুজু নষ্ট হয়। যদি কেউ তাদের সামনে সঠিক জিহাদের আলোচনা তোলেন, তাহলে তাদের অবস্থা হয়ে যায়:
- জিহাদের আয়াত ও হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং সে সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল তো পরের কথা কথা; তাফসির, হাদিস বা ফিকহের পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে দেখতেও তারা নারাজ। আর দু’চার পৃষ্ঠা উল্টালেও সঠিকভাবে বুঝতে চান না। উল্টো বুঝেন। আল্লাহ রক্ষা করুন, অবস্থা যেন আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন:
কিন্তু ফতোয়াবাজি করার সময় এমন ভাব দেখান, এসব ব্যাপারে যেন তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বিজ্ঞ লোকটি। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
- গা বাঁচিয়ে যে শুধু খানকাহে পড়ে থাকেন তাই না, নিজেদের সাধু প্রমাণ করতে জিহাদ হারাম ফতোয়া দিতেও লজ্জা বোধ করেন না। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা বলতো:
- মুজাহিদদের আলোচনা আসলে অতি জযবাতি, দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞ, সন্ত্রাসী, ফাসাদি, অপরিণামদর্শী, খাহেশপূজারি ইত্যাদি গালিগালাজ মুখে ফেনা আসা পর্যন্ত করতে থাকেন। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা মুজাহিদদের ব্যাপারে বলতো:
- কোন মুরীদ বা ছাত্রের মাঝে জিহাদের আভাস দেখলে তার সনদ কেটে দেন এবং খানকাহ ও মাদ্রাসা থেকে বের করে দেন। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা করতে চাইতো:
এ হল হযরতওয়ালাদের মোটামুটি অবস্থা। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজতে রাখুন। আমীন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশাকরি হযরতওয়ালার এ আপত্তির জওয়াব পেয়ে যাবেন, “তারা সবেই জিহাদ না করার কারণে সব জাহান্নামী হবে? বা গুনাহে কবীরাতে লিপ্ত?”
উত্তর পরিষ্কার যে, তারা জাহান্নামীও হবে না, কবীরা গুনাহেও লিপ্ত না। কারণ, তারা সকলেই মুজাহিদ বা অন্তত জিহাদপ্রেমী ছিলেন। হযরতওয়ালাদের মতো জিহাদবিদ্বেষী ছিলেন না। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যার যেভাবে সম্ভব জিহাদের খেদমত করে গেছেন। অধিকন্তু যদি তারা কিছু নাও করতেন, তথাপি জাহান্নামী হতেন না বা কবীরা গুনাহ হতো না। কারণ, এখনকার মতো জিহাদ তখন ফরযে আইন ছিল না। ওয়াল্লাহু তাআলা আ’লাম।
হযরতওয়ালা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে দলীল দিয়েছেন আইম্মায়ে আরবাআ (আবু হানিফা, মালেক, শাফিয়ী ও আহমাদ ইবনে হাম্বল) রাহিমাহুমুল্লাহর সীরাত দিয়ে। হযরতওয়ালার দাবি, তারা বিভিন্ন প্রকারের কষ্ট-নির্যাতন সহ্য করেছেন, তথাপি তাদের কেউ জিহাদ করেননি। তাহলে জযবাতিরা জিহাদ কোথায় পেল? তার অবস্থানকে মজবুত করতে তিনি এ প্রশ্নও রেখেছেন, “তারা সবেই জিহাদ না করার কারণে সব জাহান্নামী হবে? বা গুনাহে কবীরাতে লিপ্ত?”
প্রথমে বলে নিই, বর্তমান মুসলমানগণ মৌলিকভাবে দু ধরণের কাফেরের বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন:
এক. দখলদার প্রকাশ্য কাফের। যেমন- ইয়াহুদ, নাসারা, রাফেযী, হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি।
দুই. মুসলিমনামধারী গণতান্ত্রিক বা রাজতান্ত্রিক তাগুত-মুরতাদ শাসক শ্রেণী।
হযরতওয়ালার বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, উভয় প্রকার মুজাহিদদেরই তিনি জযবাতি-খাহেশপূজারি আখ্যা দিয়েছেন। শুধু বিশেষ কোন মুজাহিদ দল তার উদ্দেশ্য না। এক কথায়- চলমান বিশ্বের সকল মুজাহিদকেই তিনি আক্রমণের নিশানা বানিয়েছেন। আমার ভুল হয়ে থাকলে হযরতওয়ালারা ইচ্ছে করলে সংশোধন করে দিতে পারবেন।
***
আইম্মায়ে আরবাআ জিহাদ করেছেন কি করেননি সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কয়েকটি মৌলিক কথা বলা জরুরী মনে হচ্ছে:
এক.
হযরতওয়ালা দলীল হিসেবে আইম্মায়ে আরবাআকে বেছে নিলেন কেন? কুরআন, সুন্নাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের সীরাতে কি এর কোন দলীল বা নজীর বিদ্যমান নেই যে, সব কিছু বাদ দিয়ে আইম্মায়ে আরবাআকে ধরতে হচ্ছে? আইম্মায়ে আরবাআর কথা-কাজ তো শরীয়তের দলীল নয়। আইম্মায়ে আরবাআ স্বয়ং নিজেরাই যে কুরআন, সুন্নাহ, সীরাতে রাসূল ও সীরাতে সাহাবাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন, হযরতওয়ালা সেগুলোকে দলীলরূপে পেশ করতে নারাজ হলেন কেন? তিনি তো বলতে পারতেন:
“ওহে জযবাতির দল! তোমরা যে জিহাদ জিহাদ কর, কুরআনে কোথায় জিহাদের কথা আছে? হাদিসের কোথায় জিহাদের কথা আছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি জীবনে কোনো জিহাদ করেছেন? কোনো সাহাবি কি জীবনে কোনো জিহাদ করেছেন? তাদের কেউ তো কোন একটা জিহাদও করেননি, তাহলে তোমরা জিহাদ কোথায় পেলে?”
এভাবে কুরআন সুন্নাহকে তিনি দলীলরূপে পেশ করতে পারতেন না কি? কিন্তু কেন করলেন না?
এর উত্তর মোটামুটি সকলের কাছেই পরিষ্কার যে- কুরআন, সুন্নাহ, সীরাতে রাসূল ও সীরাতে সাহাবা দেখতে গেলে দেখা যাবে: কুরআনের পাতায় পাতায় জিহাদের কথা, হাদিসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় জিহাদের কথা, রাসূলের সমগ্র জিন্দেগিই জিহাদ, প্রত্যেকজন সাহাবিই মুজাহিদ। এদিকে হাত দিতে গেলেই মুশকিল।
অধিকন্তু তখন প্রশ্ন আসবে যে, রাসূল কি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন? কোনো সাহাবির কি কোনো খানকাহ বা কোনো মুরীদ ছিল? যদি না থাকে, তাহলে ওহে হযরতওয়ালারা, তোমরা খানকাহ কোথায় পেলে?
দুই.
প্রথম ইমাম আবু হানিফা রহ. এর জন্ম ৮০ হিজরিতে আর চতুর্থ ইমাম আহমাদ রহ. এর ইন্তেকাল ২৪১ হিজরিতে। এর মাঝখানে সময় হল ১৬১ বছর। বলতে গেলে সাহাবায়ে কেরামের পর বিশ্বজোড়া ইসলামের বিজয় এ সময়টাতেই হয়েছে। উমাইয়া ও আব্বাসী খলিফারা কাফের রাষ্ট্রগুলো বিজয় করে ইসলামী ভূখণ্ডে পরিণত করেছেন। হযরতওয়ালার কাছে প্রশ্ন: এ বিজয়গুলো কিভাবে হয়েছে? বাহিনি পাঠানো হয়েছিল কি’না? অস্ত্র চালানো হয়েছিল কি’না? যুদ্ধ হয়েছিল কি’না? মানুষ হত্যা হয়েছিল কি’না?
যদি বলেন, এগুলোর কিছুই হয়নি, যিকিরের দ্বারা বিজয় হয়েছিল: তাহলে লোকজন আপনাকে পাগল বলবে। অতএব, না বলে উপায় নেই যে, এসব কিছুই হয়েছিল।
প্রশ্ন হল, সেগুলো জিহাদ ছিল কি’না? সেগুলোতে উলামায়ে কেরামের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছিল কি’না? সেগুলো উলামায়ে কেরামের নির্দেশনায় শরীয়ত অনুযায়ী পরিচালিত হতো কি’না? মুজাহিদিনে কেরামের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল উলামায়ে কেরাম বলতেন কি’না? তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদ কাজি সাহেবগণ মীমাংসা করতেন কি’না? গনিমতের মাল এবং গোলাম-বাঁদি কাজি সাহেবগণের তত্বাবধানে বণ্টন হতো কি’না? না বলে উপায় নেই যে, এ সব কিছুই হয়েছে।
হযরত ওয়ালার কাছে আরো প্রশ্ন: এসব জিহাদ আইম্মায়ে আরবাআর সামনেই সংঘটিত হয়েছিল কি’না? তাদের সম্মতি ছিল কি’না?
না বলে উপায় নেই যে, তাদের সম্মতিতেই হয়েছিল। বরং বলতে গেলে হানাফি, মালেকি, শাফিয়ি ও হাম্বলিরা এবং আইম্মায়ে আরবাআর শাগরেদ ও ভক্তবৃন্দরাই এসব জিহাদ করেছে, আর আইম্মায়ে আরবাআ মুজাহিদদের প্রয়োজনীয় মাসায়েল বলে ও সংকলন করে মুজাহিদদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। এগুলো অস্বীকার করার কোন জু নেই। যদি তাই হয়, তাহলে জযবাতিরা জিহাদ কোথায় পেল- এ প্রশ্নের আর উত্তর দেয়ার দরকার নেই আশাকরি। আইম্মায়ে আরবাআসহ অন্য সকল উলামায়ে কেরামের সামনে এবং তাদের প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষ নির্দেশনা ও তত্বাবধানে যেসব জিহাদ হতো, জযবাতিরা সেগুলোই যিন্দা করছে- যখন হযরতওয়ালারা সেগুলো মিটিয়ে দিয়েছে।
তিন.
এ সময়কালে জিহাদ ফরযে আইন ছিল না’কি ফরযে কিফায়া ছিল?
উত্তর: ফরযে কিফায়া ছিল। কারণ, তখন কোন মুসলিম ভূমি কাফের মুরতাদদের দখলে ছিল না। সাময়িক সময়ে যদি কোথাও কাফেরদের থেকে আক্রমণ হতো, মুসলমানগণ দ্রুত তা প্রতিহত করে দিতেন। মুসলিম ভূমি কাফেরদের দখলে থেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো না। বরং মুসলমানগণ নতুন নতুন বিজয়াভিযান পরিচালনা করে দিন দিন কাফেরদের ভূমি দখল করতে থাকতেন। মোটকথা তখন জিহাদ ফরযে কিফায়া ছিল, ফরযে আইন ছিল না। আর ফরযে কিফায়ার বিধান আমাদের জানা আছে যে, কতক মুসলমান জিহাদ করতে থাকলে বাকি মুসলমানদের উপর জিহাদে বের হওয়া আবশ্যক থাকে না। ইচ্ছে করলে বের হতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলে অন্যান্য কাজ-খেদমতেও মশগুল থাকতে পারেন। এ সময়ে জিহাদ উত্তম না’কি ইলম নিয়ে মশগুল থাকা উত্তম তা একটি মতভেদপূর্ণ মাসআলা। কারও কারও মতে জিহাদ উত্তম, আবার কারও কারও মতে ইলমী মাশগালা উত্তম।
যেহেতু সে সময়ে জিহাদ ফরযে আইন ছিল না, তাই যার ইচ্ছা জিহাদ করতেন, যার ইচ্ছা ইলমসহ অন্যান্য খিদমত করতেন। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটাতেই কোন বাধা নিষেধ নেই। পক্ষান্তরে বর্তমানে মুসলিম ভূমিগুলো কাফের-মুরতাদদের দখলদারিত্বের শিকার হওয়ায় জিহাদ ফরযে আইন। মা’জূর নয় এমন প্রত্যেক মুসলমানের উপর জিহাদে শরীক হওয়া নামায-রোযার মতোই ফরযে আইন। এ সময়ে কেউ জিহাদ থেকে বিরত থাকার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু আইম্মায়ে আরবাআর যামানা তার ব্যতিক্রম ছিল। অতএব, সে যামানার কোন আলেম যদি জিহাদে শরীক নাও হতেন, তাহলেও তা এ বিষয়ের দলীল হতো না যে, আলেমদের জন্য বা অন্যান্য মুসলমানদের জন্য জিহাদ নাজায়েয। তখন জিহাদও ফরযে কিফায়া ছিল, ইলমও ফরযে কিফায়া ছিল। যার যেটা ইচ্ছা করতেন। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা ব্যতিক্রম। এ সময়ে জিহাদ একেবারে তরক করে দিয়ে অন্যান্য খিদমতে লিপ্ত থাকা নাজায়েয। আইম্মায়ে আরবাআর যামানা দিয়ে বর্তমান যামানার উপর আপত্তি করা হযরতওয়ালাদের ইলমী কমতি বরং জাহালত ও অজ্ঞতার প্রমাণ।
চার.
আইম্মায়ে আরবাআ যদি জিহাদ না করে থাকেন (অবশ্য তাদের ব্যাপারে এ কথা সঠিক নয়, আমরা পরে তা আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ), তাহলে এর দ্বারা জিহাদ হারাম প্রমাণ হয় না। বেশির চেয়ে বেশি এ কথা বলা যায় যে, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যক্তির জন্য জিহাদ না করে থাকার বৈধতা আছে। স্বয়ং আইম্মায়ে আরবাআর যামানাতেই আরো শত-হাজারো উলামা জিহাদ করে গেছেন। যদি আইম্মায়ে আরবাআর জিহাদ না করার দ্বারা জিহাদ হারাম প্রমাণিত হয়, তাহলে তখনকার সময়ে যেসকল উলামা ও মুসলমান জিহাদ করেছেন, তারা কি সব হারাম করেছেন? তখন যেসব অভিযান পরিচালিত হয়েছে সেগুলো কি সব হারাম হয়েছে? বরং প্রমাণিত আছে যে, আইম্মায়ে আরবাআর শাগরেদগণই সেসব জিহাদ করেছেন এবং আইম্মায়ে আরবাআ সেগুলো সমর্থন করে গেছেন। এরপরও হযরতওয়ালারা কিভাবে যে আইম্মায়ে আরবাআকে জিহাদের বিপক্ষে দাড় করাচ্ছেন এবং জিহাদ হারাম সাব্যস্থ করছেন বোধগম্য নয়।
পাঁচ.
আইম্মায়ে আরবাআসহ তখনকার সকল উলামা-মাশায়েখ মূলত জিহাদি ছিলেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বিভিন্নভাবে তারা জিহাদ করে গেছেন ও সমর্থন করে গেছেন। তাদের জিহাদি খিদমাতগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরির ছিল। যেমন:
ক. তখনকার বহু ইমাম সরাসরি জিহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন। যেমন- আবু হানিফা রহ. এর বিশিষ্ট শাগরেদ ও ফিকহি বোর্ডের অন্যতম সদস্য, আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহ. (১৮১ হি.)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৭/৩৬৫, ৩৭৬]; ইমাম মালেক, কাযি আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এর বিশিষ্ট শাগরেদ আসাদ ইবনুল ফুরাত রহ. (২১৩ হি.)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৮/৩৫০-৩৫১]।
খ. অনেকে রিবাত তথা সীমান্ত পাহারার জন্য দূর-দূরান্তের সীমান্তে চলে গেছেন এবং রিবাতরত অবস্থায়ই ইন্তেকাল করেছেন। যেমন- ইমামু আহলিশ শাম ইমাম আওযায়ী রহ. (১৫৭ হি.)। [দেখুন: আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া- ইবনে কাসীর: ১০/১২৮]; হাফেয আবু ইসহাক আলজাওহারি রহ. (২৪৭ হি.) (ইমাম মুসলিমসহ সুনানে আরবাআর সকলেই যার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন)। [দেখুন: সিয়ারু আ’লামিন নুবালা- যাহাবি: ৯/৫১০-৫১১]।
গ. জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং জিহাদের প্রয়োজনীয় মাসআয়েল বয়ানের জন্য স্বতন্ত্র কিতাব লিখে দিয়েছেন। যেমন: কিতাবুল জিহাদ- ইবনুল মুবারক রহ. (১৮১ হি.); আসসিয়ারুস সগীর ও আসসিয়ারুল কাবীর- ইমাম মুহাম্মাদ রহ. (১৮৯ হি.)।
ঘ. হাদিসের কিতাবাদিতে জিহাদের সাথে সংশ্লিষ্ট হাদিসগুলো স্বতন্ত্রভাবে এবং স্বতন্ত্র ও *উপযুক্ত শিরোনামে বিভক্ত করে করে বর্ণনা করেছেন; যেন মুজাহিদদের হাদিসের প্রয়োজনও পূরণ হয়, হাদিস থেকে উদঘাটিত মাসআলারও অবগতি হয়। যেমন: কিতাবুল আসার- আবু হানিফা, মুআত্তা- মালেক, কুতুবে সিত্তাহ ও এ জাতীয় অন্যান্য হাদিসের কিতাব।
ঙ. ফুকাহায়ে কেরাম ফিকহের কিতাবাদিতে কিতাবুল জিহাদ, সিয়ার, মাগাজি, কিতালু আহলির রিদ্দাহ, কিতালু আহলিল বাগি ইত্যাদি শিরোনামে জিহাদের প্রয়োজনীয় সকল মাসআলা বলে দিয়েছেন, যেন মুজাহিদগণের মাসআলার প্রয়োজন হলে সেখান থেকে দেখে নিতে পারেন।
চ. কাযি ও বিচারকগণ মুজাহিদদের মাঝে সংঘটিত সকল বিবাদ-বিসম্বাদের সুরাহা করে দিয়েছেন। গনিমত, গোলাম-বাঁদি ও বিজিত ভূমি মুসলিম উমারা, উলামা ও কাযিগণের সুষ্ঠু তত্বাবধানে বণ্টিত হয়েছে।
ছ. যারা জিহাদে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি, তারা নিজেদের সম্পদ দিয়ে অন্য মুসলমানদের জিহাদে পাঠিয়ে জিহাদে অংশ নিয়েছেন।
জ. উলামায়ে কেরাম সাধারণ মুসলমানদের জিহাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এজন্য প্রতি বছরই কাফের ভূমিতে মুসলিম সেনাবাহিনি হামলা করতেন আর নতুন নতুন এলাকা বিজয় করতেন। কোথাও কখনও হামলা হলে নিজেদের জান-মাল উৎস্বর্গ করে মুসলমানগণ তা প্রতিহত করতেন। এজন্য তখন এমন হয়নি যে, কোন মুসলিম ভূখণ্ড কাফেররা দখল করে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
ঝ. মুজাহিদগণ জিহাদে যাওয়ার পর থেকে নামাযান্তে মসজিদে মসজিদে তাদের জন্য দোয়া হতো। তাদের দোয়ার বরকতে আল্লাহ তাআলা বিজয় দিতেন।
ঞ. জিহাদ থেকে ফেরার পর মুজাহিদদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ইস্তেকবাল করা হতো এবং আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা হতো।
এ ছিল আইম্মায়ে আরবাআর যামানার উলামা-মাশায়েখ ও তাদের জিহাদ প্রেমের অবস্থা। পক্ষান্তরে আমাদের বর্তমান হযরতওয়ালাদের অবস্থা হল:
- নামাযে পর্যন্ত তারা জিহাদের আয়াতগুলোর তিলাওয়াত শুনতে নারাজ। এতে না’কি তাদের খুশু-খুজু নষ্ট হয়। যদি কেউ তাদের সামনে সঠিক জিহাদের আলোচনা তোলেন, তাহলে তাদের অবস্থা হয়ে যায়:
يَنْظُرُونَ إِلَيْكَ نَظَرَ الْمَغْشِيِّ عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ
“তারা তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে মৃত্যুভয়ে মূর্ছিত ব্যক্তির ন্যায়।”- মুহাম্মাদ ২০- জিহাদের আয়াত ও হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং সে সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল তো পরের কথা কথা; তাফসির, হাদিস বা ফিকহের পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে দেখতেও তারা নারাজ। আর দু’চার পৃষ্ঠা উল্টালেও সঠিকভাবে বুঝতে চান না। উল্টো বুঝেন। আল্লাহ রক্ষা করুন, অবস্থা যেন আল্লাহ তাআলা যেমন বলেছেন:
رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطُبِعَ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَفْقَهُونَ
“তারা ঘরে বসে থাকা লোকদের সাথে অবস্থান করাকেই পছন্দ করে নিয়েছে এবং তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা কিছুই বুঝতে পারে না।”- তাওবা ৮৭কিন্তু ফতোয়াবাজি করার সময় এমন ভাব দেখান, এসব ব্যাপারে যেন তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বিজ্ঞ লোকটি। যেমনটা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَإِنْ يَقُولُوا تَسْمَعْ لِقَوْلِهِمْ
“যখন তারা কথা বলবে, (বাকপটুতার কারণে) তুমি তাদের কথা শুনতেও চাইবে।”- মুনাফিকুন ৪- গা বাঁচিয়ে যে শুধু খানকাহে পড়ে থাকেন তাই না, নিজেদের সাধু প্রমাণ করতে জিহাদ হারাম ফতোয়া দিতেও লজ্জা বোধ করেন না। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা বলতো:
لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَاتَّبَعْنَاكُمْ
“যদি (শরয়ী) যুদ্ধ বলে জানতাম, তাহলে অবশ্যই তোমাদের অনুরসণ করতাম।”- আলে ইমরান ১৬৭- মুজাহিদদের আলোচনা আসলে অতি জযবাতি, দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞ, সন্ত্রাসী, ফাসাদি, অপরিণামদর্শী, খাহেশপূজারি ইত্যাদি গালিগালাজ মুখে ফেনা আসা পর্যন্ত করতে থাকেন। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা মুজাহিদদের ব্যাপারে বলতো:
غَرَّ هَؤُلَاءِ دِينُهُمْ
“এদের ধর্ম এদের বিভ্রান্ত করেছে।”- আনফাল ৪৯ لَوْ كَانُوا عِنْدَنَا مَا مَاتُوا وَمَا قُتِلُوا
“এরা যদি আমাদের কাছে থেকে যেতো তাহলে মারাও যেতো না, (অন্যদের হাতে) মারাও পড়তো না।”- আলে ইমরান ১৫৬ لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا
“এরা যদি আমাদের কথা শুনতো (এবং যুদ্ধ পরিত্যাগ করতো) তাহলে (অন্যদের হাতে) মারা পড়তে হতো না।”- আলে ইমরান ১৬৮- কোন মুরীদ বা ছাত্রের মাঝে জিহাদের আভাস দেখলে তার সনদ কেটে দেন এবং খানকাহ ও মাদ্রাসা থেকে বের করে দেন। যেমনটা নবি যুগের জিহাদবিদ্বেষীরা করতে চাইতো:
لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ
“আমরা মদীনায় ফিরে গেলে মর্যাদাবান লোকেরা হীনদেরকে সেখান থেকে বের করে দেবে।”- মুনাফিকুন ৮এ হল হযরতওয়ালাদের মোটামুটি অবস্থা। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজতে রাখুন। আমীন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আশাকরি হযরতওয়ালার এ আপত্তির জওয়াব পেয়ে যাবেন, “তারা সবেই জিহাদ না করার কারণে সব জাহান্নামী হবে? বা গুনাহে কবীরাতে লিপ্ত?”
উত্তর পরিষ্কার যে, তারা জাহান্নামীও হবে না, কবীরা গুনাহেও লিপ্ত না। কারণ, তারা সকলেই মুজাহিদ বা অন্তত জিহাদপ্রেমী ছিলেন। হযরতওয়ালাদের মতো জিহাদবিদ্বেষী ছিলেন না। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যার যেভাবে সম্ভব জিহাদের খেদমত করে গেছেন। অধিকন্তু যদি তারা কিছু নাও করতেন, তথাপি জাহান্নামী হতেন না বা কবীরা গুনাহ হতো না। কারণ, এখনকার মতো জিহাদ তখন ফরযে আইন ছিল না। ওয়াল্লাহু তাআলা আ’লাম।
Comment