চলতি জুলাই মাসের আলকাউসার সংখ্যায় প্রেসিডেন্ট মুরসি সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখা হয়েছে। এতে কিছু সেকুলার নেতার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে এতে করে উম্মাহর অন্তরে এধরনের নেতাদের প্রতি আস্থা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
এব্যাপারে বিজ্ঞ ভাইদের অভিমত ও সংশয়গুলোর খণ্ডন কামনা করছি।
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান
* প্রবন্ধটি এই–
"ড. মুরসির ইন্তেকাল : কিছু কথা
মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
মিশরের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. হাফেজ মুহাম্মদ মুরসি গত ১৭ জুন বন্দী অবস্থায় কায়রোর একটি আদালতে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন।
তাঁর এ ইন্তেকালের ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক। যে কোনো বিবেকবান ও ইনসাফপ্রিয় মানুষই এ ঘটনায় কষ্ট পাবেন। যখন তার ইন্তেকালের খবরটি চোখে পড়ে, আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। আমি ‘থ’ হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য। মুরসির শপথগ্রহণ পরবর্তী সময়ের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাহরীর স্কয়ারে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে তিনি উদ্দীপনাপূর্ণ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম। হোটেলে বসে আমি সে ভাষণ শুনেছি। ওই ভাষণে তার ভাষা, বক্তব্য ও বডি লেংগুয়েজ দেখে এটা বোঝার সুযোগ হয়েছিল যে, মুরসি একজন অকৃত্রিম ভালো মানুষ, সৎ ও সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব। সেদিন তিনি দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হয়নি, তাঁর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা আছে। সরাসরি ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে সেদিন কথা কমই বলেছেন। সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলারিজমের বাধ্যবাধকতা তখনও ছিল। সে ভাষণে তিনি মিসরের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো ভাষায় কথা বলেছেন। তার মতো একজন মানুষ এভাবে বন্দী অবস্থায় দুনিয়া থেকে চলে যাবেন, এতে যে কোনো মানুষের মনই ব্যথিত হবে।
মিশরকে বলা হয় প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আধুনিক যুগে নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি দেশটি পরিচালনা করেননি। এ অবস্থায় হোসনি মোবারকের পতনের পর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা আসে। সেই নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের হয়ে ড. মুরসি সামনে চলে আসেন। তিনি কিন্তু ব্রাদারহুডের একদম সামনের সারির নেতা ছিলেন না। বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজে একজন দক্ষ, সুশিক্ষিত ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি সামনে আসেন। নির্বাচনেও বিজয়ী হন। ২০১২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন পশ্চিমা মদদপুষ্ট একজন নোবেল বিজয়ী ও হোসনি মোবারক সরকারের প্রধানমন্ত্রী। মিডিয়ার সহযোগিতা মুরসির তুলনায় মুরসির প্রতিদ্ব›দ্বীরা পেয়েছেন বেশি। দেশি-বিদেশি নানারকম বিরোধিতার মধ্যেও মুহাম্মাদ মুরসির বিজয় ছিল একটি বড় সাফল্যের ঘটনা।
মুরসির বিজয়ের সাফল্য বুঝতে হলে ‘আরব বসন্তের’ ঘটনাগুলো দেখতে হবে। আরব দেশগুলোতে যুগযুগ ধরে স্বৈরতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্রের দৌরাত্ম্য চলছিল। জুলুমের শিকার হয়েও মানুষ কথা বলতে পারত না। এরই এক পর্যায়ে মিসরের নির্বাচনের বছর দেড়েক আগে তিউনিসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’ শুরু হল। লোকজন রাস্তায় নেমে এল। ক্ষমতাসীন রাজা-বাদশাদের পতন ঘটতে লাগল। সে সময় কোনো কোনো পর্যবেক্ষক অবশ্য বলেছিলেন, আরব বসন্তে ইসলামপ্রিয় শক্তি বা জনতা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। কিন্তু ‘লিবারেল’ পশ্চিমা প্রগতিবাদীরা প্রথমদিকে এসব সম্ভাবনাকে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, তারা এবং তাদের মিডিয়াগুলো আরব বসন্তকে সমর্থন জানিয়েছে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে। এরই এক পর্যায়ে মিসরে তাহরীর স্কয়ারে লাগাতার বিক্ষোভ চলে। তখন মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ড. মুরসি ভোটে নির্বাচিত হলেন। মিশর এবং মিশরের বাইরে তার জনপ্রিয়তা ছিল। এরপরও তিনি ক্ষমতায় টিকতে পারলেন না। কেন?
আরব বসন্তের সময় বিশ্বের সমর্থন ছিল আন্দোলনকারীদের প্রতি- রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এরপর নির্বাচনে যখন ব্রাদারহুড বা মুরসি নির্বাচিত হলেন তখন তাদের অনেকের মোহভঙ্গ হল। বিশ্বশক্তি ‘লিবারেল’ মিডিয়াসহ বিভিন্ন পক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ভিন্ন ভিন্ন কারণে তারা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। প্রথমত, বিশ্বের ইসলামবিরোধী প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও মিডিয়াগুলো দেখল, মুরসি টিকে গেলে তো আরব বসন্তের পর আরব রাষ্ট্রগুলোয় ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় চলে আসবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমের সাথে সখ্য করে চলা আরবের বিলাসী রাজা-বাদশাহরা অন্য কারণে ভীত হয়ে পড়ল। তারা ভেবে দেখল, মিশরের ব্রাদারহুড ক্ষমতায় টিকে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার নিয়ে জনগণ সন্তুষ্ট হয়ে গেলে তো তাদেরও ক্ষমতা চলে যাবে। তৃতীয়ত, মুরসি ক্ষমতায় আসার পর আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেন। গাজার সঙ্গে মিসর সীমান্ত খুলে দিলেন। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ন্যায্য অধিকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলেন। আর ইসরাইলের আপত্তি সত্তে¡ও এসব সিদ্ধান্ত থেকে মুরসি সরে এলেন না। এতে ইসরাইল প্রচÐ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। মূলত, দেশের বাইরের এই ত্রিমুখী শক্তির বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র ও অসমর্থন মুহাম্মাদ মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির কারণ হয়ে উঠেছিল।
এরা ছিল দেশের বাইরের। দেশের ভিতরে রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, মিডিয়াসহ বিভিন্ন অংশকে মুরসিবিরোধী ষড়যন্ত্রে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিছু মানুষকে উত্তেজিত করে আবার তাহরীর স্কয়ারে জমায়েত করা হয়েছিল। নানা রকম অভিযোগ ওঠানো হচ্ছিল মুরসির বিরুদ্ধে। অথচ তার সরকার তখন পর্যন্ত এক বছরও পার করেনি।
আসলে পরবর্তী সময়ে তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনটা করানো হয়েছে। লোক জমায়েত করা হয়েছে। বিভিন্ন দিকের লোকজনকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথিত আছে, মুরসি বিরোধী আন্দোলন চলাকালে আরবের দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র থেকে দু দিন পর্যন্ত মিশরে বিমান ভরে টাকা পাঠানো হয়েছে শুধু আন্দোলনের লোক ও রসদ যোগানোর জন্য। সে আন্দোলন কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, আবদুল ফাত্তাহ সিসির নেতৃত্বে মিশরের সামরিক বাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং বন্দী করে রাখে। এতে স্পষ্টতই দেখা গেছে, দেশের ভিতরে সেক্যুলার রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, মিডিয়া ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে।
মুরসিকে উৎখাতের ক্ষেত্রে মিশরের ভেতর-বাইরের ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর। যারা আগে ইখওয়ানকে সাধারণ নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন বলত, মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই তারা বলতে থাকে, ‘ইখওয়ান’ সন্ত্রাসী সংগঠন। মুরসির সরকার ছিল নির্বাচিত সরকার। কিন্তু তাকে অভ্যুত্থান করে যারা ক্ষমতা থেকে সরাল, দেখা গেল, সেই ক্ষমতা দখলকারীদেরকেই সমর্থন জানানো হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, বাইরের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও শক্তিগুলোর অবস্থান কী ছিল।
অতি উৎসাহী সালাফীদের একটি বড় ইসলামী গোষ্ঠী, যারা সশস্ত্রভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তারাও মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। তাদের এই ভূমিকা গেছে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি, ইসরাইল ও সেক্যুলারদের পক্ষে। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মাথায় ঢুকিয়েছে- ‘মুরসি ক্ষমতায় এসে ইসলামী শাসন কায়েম করেননি।’ ইসলামী শাসন কায়েম না করার অজুহাতে তারা সমর্থন দিলেন ইসরাইল ও সেক্যুলারদের তৈরি করা আন্দোলনে, তাদেরই পক্ষে। এখান থেকে বুঝে আসে, বৃহত্তর অঙ্গনে বুঝে-শুনে ইসলামের কাজ করা আর অতি উৎসাহী হয়ে অবুঝের মত কাজ করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। শুনেছি, মুরসি বিরোধী আন্দোলনকারী অনেক সালাফী পরে মন খারাপ করেছে, আক্ষেপ করেছে, নিজেদের ভূমিকা নিয়ে কান্নাকাটিও করেছে।
কেউ কেউ বলে থাকে, মিশরের ড. মুরসি ও তুরস্কের এরদোগান নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং তারা পুরোপুরি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেও পারেননি। সুতরাং তাদের পক্ষে সমর্থন বা অবস্থান নেওয়া কোনো ইসলামপন্থীর ভূমিকা হতে পারে না।
এটা আসলে চরমপন্থা অবলম্বনকারী অবুঝ লোকদের অবস্থান। সামগ্রিক দিক না দেখেই তারা এজাতীয় মন্তব্য করে থাকে। মুরসি-এরদোগানকে কেউ আসলে ‘খলীফা’ মনে করে না, দাবিও করে না। যারা তাদের পক্ষে কথা বলে, তারা তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও বাস্তবতার আলোকেই বলে। যেখানে নিয়ন্ত্রক রাজনীতিকরা ছিল ইসরাইলের পক্ষে, সেক্যুলারিজমের পক্ষে, ইসলামী অনুশাসনের বিপক্ষে, সেখানে যারা ক্ষমতায় এসে এই ধারাটা ঘুরিয়ে দেন এবং ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন- তাদেরকে এই কাজটুকুর জন্য সাধুবাদ জানানো যেতেই পারে।
এটা হচ্ছে তুলনামূলক সাধুবাদ, অপেক্ষাকৃত আনুকুল্যের প্রতি সমর্থন। এর অর্থ এটা নয় যে, তাদের পদক্ষেপটাকে ইসলামী সরকার বা ইসলামী শাসনের অনুরূপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে গেছে।
তুলনামূলক বাস্তবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখুন, মাত্র এক বছরে মুহাম্মাদ মুরসি নীল নদের পাশে বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সিনাই অঞ্চলে বিভিন্ন অর্থকরী ও কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দেশে দেশে সফর শুরু করেছিলেন। আপনাকে দুটি দিক দেখতে হবে। দেখবেন, এক পক্ষ ইসরাইলের পক্ষে, সেক্যুলারিজমের পক্ষে কাজ করছে। আরেক পক্ষ এদের বিরুদ্ধে থেকে নিজেদের বিশ্বাস ও দেশের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। এখানে আপনি কার পক্ষে যাবেন?
একইভাবে আপনি আসুন তুরস্কে। সেখানে খেলাফত পরবর্তী সময়ে কামাল ও তার অনুসারীরা এমন এক নৈরাজ্য কায়েম করেছিল যে, দেশের সঙ্গে ইসলামের মিলিত সকল স্তম্ভ ধ্বংস করে দিল। আযান বন্ধ করে দিল। প্রকাশ্যে দ্বীনী শিক্ষা নিষিদ্ধ করল। ইসলামী বর্ণমালা নিষিদ্ধ করে দিল। সেক্যুলারিজমকে শুধু আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠাই করল না, বাস্তবায়নও করল সব জায়গায়। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান- সেনাবাহিনী, আদালত ও শিক্ষাঙ্গন, সম্পূর্ণ ইসলামবিদ্বেষী করে গড়ে তুলল। এ অবস্থার মধ্যে তুরস্কে অসংখ্য কুরবানীর পর সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের বর্তমান প্রতিনিধি হচ্ছেন এরদোগান। তাকে তার চেষ্টার জন্য সমর্থন জানানো মানে তাকে ‘খলীফা’ দাবি করা নয়, তাকে ‘দরবেশ’ ও ‘বুযুর্গ’ দাবি করাও নয়। তুরস্কে ইসলাম বিদ্বেষী যুগের সাথে তুলনা করে এরদোগানের প্রশংসা করা হয়। আগের ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলারিজম দাড়ি রাখতে না দেওয়া, হিজাব পরতে না দেওয়াসহ মুসলমানদের ব্যক্তিগত জীবনেও ইসলাম পালনে যে সংকট সৃষ্টি করেছিল, এরদোগানের যুগ এসে সে সংকট দূর করেছে। আপনি কি এখন তাকেও সেক্যুলার কামাল ও তার অনুসারীদের মতো করেই দেখবেন?
আমার কেন যেন মনে হয়, যারা সব তুলনামূলক ভালোমন্দের বিশ্লেষণকে অবজ্ঞা করে তারা আসলে ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ ভালোভাবে দেখেননি, পড়েননি। এমনকি কুরআনে কারীমও মন দিয়ে পড়েননি। সকল কাফেরই কাফের। কিন্তু কোনো কোনো কাফের ছিল অধিক কঠোর। কোনো কোনো কাফের ছিল কম কঠোর। ইসলামের শুরুর যুগে কোনো কোনো কাফেরের সাথে যুদ্ধ করা হয়েছে, কোনো কাফেরের সাথে সন্ধি করা হয়েছে। ইসলামে তুলনামূলক ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলা বা দেখার রীতি আগে থেকেই চলে এসেছে। অথচ সামান্য পড়াশোনা করেই অনেকে এখন একতরফা ও অপরিণত কথা ছড়িয়ে দেয়।
যাইহোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বন্দী অবস্থায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাফেজ মুহাম্মাদ মুরসির এই ইন্তেকালের ঘটনায় কি বিশেষ কোনো শিক্ষা বা সংকেত রয়েছে।
শিক্ষা ও সংকেত তো অবশ্যই আছে। তবে তা শুধু মুরসির একার জীবনেই নয়, এমন শিক্ষা ইতিহাসে বহু মনীষীর জীবনে পাবেন। সবাই সবসময় বাহ্যিকভাবে কামিয়াব হননি। জিহাদের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। উপমহাদেশে নিকট অতীতেও যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছেন- যেমন, বালাকোটে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ., মহিশুরের টিপু সুলতান রাহ., বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাহ.; তাদের ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। এখানে কাউকে অন্যের সাথে তুলনা করা বা কাছাকাছি মর্যাদার দেখানো উদ্দেশ্য নয়; বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকতে গিয়ে মুরসির চেয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্বগণ অতীতে নশ্বর জীবনের বাজী হেরেছেন। উদাহরণগুলো দ্বারা শুধু তাই দেখানো হল। তবে ষড়যন্ত্র ও প্রলোভনের সামনেও মুহাম্মাদ মুরসির দৃঢ়তা ও অনমনীয়তা একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয়। বন্দী করার পর তাকে অনেক রকম প্রলোভন ও অপশন দেওয়া হয়েছিল। তিনি নত হননি। ইসলামের জন্য জিহাদ যেমন কঠিন ত্যাগ ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি বড় অঙ্গন, তেমনি দ্বীনের নানা রকম সেবা ও খেদমতেও ত্যাগ ও ঝুঁকি, মেহনত-মোজাহাদার দিক রয়েছে।
ড. মুহাম্মাদ মুরসির নামাযে জানাযায়ও লোক জমায়েত হতে দেওয়া হয়নি। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও গোপনীয়তার মধ্যে জানাযা হয়েছে।
এমন ঘটনাও দেশে দেশে যুগে যুগে ঘটেছে। যাদেরকে যুলুম করে, ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়, সেই মৃত ব্যক্তিকে অত্যাচারীরা জীবিত অবস্থার চেয়েও বেশি ভয় করে। মিশরের স্বৈরশাসকদের ভেতর ভয় ছিল, প্রকাশ্যে মুরসির জানাযার নামায আয়োজন করতে দিলে তা স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশে পরিণত হতে পারে। এ কারণে তারা দেয়নি। পৃথিবীর বহু দেশই এমনটা করে থাকে।
অত্যাচারীরা জানে, এক মুরসিকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারলেও মিশর ও মিশরের বাইরের অসংখ্য ইসলামপ্রিয় ও ইনসাফপ্রিয় মানুষকে শেষ করে দেওয়া সম্ভব নয়। সকল নির্যাতনের মধ্যেও সময়ে সময়ে মুরসিরা ঠিকই বের হয়ে আসবে, সফলও হবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরও পতন হবে। মুমিনের দুআ ও প্রত্যাশা এরকমই।"
এব্যাপারে বিজ্ঞ ভাইদের অভিমত ও সংশয়গুলোর খণ্ডন কামনা করছি।
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান
* প্রবন্ধটি এই–
"ড. মুরসির ইন্তেকাল : কিছু কথা
মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
মিশরের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. হাফেজ মুহাম্মদ মুরসি গত ১৭ জুন বন্দী অবস্থায় কায়রোর একটি আদালতে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন।
তাঁর এ ইন্তেকালের ঘটনা খুবই বেদনাদায়ক। যে কোনো বিবেকবান ও ইনসাফপ্রিয় মানুষই এ ঘটনায় কষ্ট পাবেন। যখন তার ইন্তেকালের খবরটি চোখে পড়ে, আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। আমি ‘থ’ হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্য। মুরসির শপথগ্রহণ পরবর্তী সময়ের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তাহরীর স্কয়ারে লাখ লাখ লোকের সমাবেশে তিনি উদ্দীপনাপূর্ণ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি তখন দেশের বাইরে ছিলাম। হোটেলে বসে আমি সে ভাষণ শুনেছি। ওই ভাষণে তার ভাষা, বক্তব্য ও বডি লেংগুয়েজ দেখে এটা বোঝার সুযোগ হয়েছিল যে, মুরসি একজন অকৃত্রিম ভালো মানুষ, সৎ ও সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব। সেদিন তিনি দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু কথাবার্তায় মনে হয়নি, তাঁর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা আছে। সরাসরি ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে সেদিন কথা কমই বলেছেন। সাংবিধানিকভাবে সেক্যুলারিজমের বাধ্যবাধকতা তখনও ছিল। সে ভাষণে তিনি মিসরের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো ভাষায় কথা বলেছেন। তার মতো একজন মানুষ এভাবে বন্দী অবস্থায় দুনিয়া থেকে চলে যাবেন, এতে যে কোনো মানুষের মনই ব্যথিত হবে।
মিশরকে বলা হয় প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আধুনিক যুগে নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধি দেশটি পরিচালনা করেননি। এ অবস্থায় হোসনি মোবারকের পতনের পর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা আসে। সেই নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের হয়ে ড. মুরসি সামনে চলে আসেন। তিনি কিন্তু ব্রাদারহুডের একদম সামনের সারির নেতা ছিলেন না। বিকল্প নেতৃত্বের খোঁজে একজন দক্ষ, সুশিক্ষিত ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি সামনে আসেন। নির্বাচনেও বিজয়ী হন। ২০১২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুরসির শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন পশ্চিমা মদদপুষ্ট একজন নোবেল বিজয়ী ও হোসনি মোবারক সরকারের প্রধানমন্ত্রী। মিডিয়ার সহযোগিতা মুরসির তুলনায় মুরসির প্রতিদ্ব›দ্বীরা পেয়েছেন বেশি। দেশি-বিদেশি নানারকম বিরোধিতার মধ্যেও মুহাম্মাদ মুরসির বিজয় ছিল একটি বড় সাফল্যের ঘটনা।
মুরসির বিজয়ের সাফল্য বুঝতে হলে ‘আরব বসন্তের’ ঘটনাগুলো দেখতে হবে। আরব দেশগুলোতে যুগযুগ ধরে স্বৈরতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্রের দৌরাত্ম্য চলছিল। জুলুমের শিকার হয়েও মানুষ কথা বলতে পারত না। এরই এক পর্যায়ে মিসরের নির্বাচনের বছর দেড়েক আগে তিউনিসিয়ায় ‘আরব বসন্ত’ শুরু হল। লোকজন রাস্তায় নেমে এল। ক্ষমতাসীন রাজা-বাদশাদের পতন ঘটতে লাগল। সে সময় কোনো কোনো পর্যবেক্ষক অবশ্য বলেছিলেন, আরব বসন্তে ইসলামপ্রিয় শক্তি বা জনতা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। কিন্তু ‘লিবারেল’ পশ্চিমা প্রগতিবাদীরা প্রথমদিকে এসব সম্ভাবনাকে মোটেই গুরুত্ব দেয়নি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, তারা এবং তাদের মিডিয়াগুলো আরব বসন্তকে সমর্থন জানিয়েছে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার কারণে। এরই এক পর্যায়ে মিসরে তাহরীর স্কয়ারে লাগাতার বিক্ষোভ চলে। তখন মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ড. মুরসি ভোটে নির্বাচিত হলেন। মিশর এবং মিশরের বাইরে তার জনপ্রিয়তা ছিল। এরপরও তিনি ক্ষমতায় টিকতে পারলেন না। কেন?
আরব বসন্তের সময় বিশ্বের সমর্থন ছিল আন্দোলনকারীদের প্রতি- রাজা-বাদশাহ ও স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। কিন্তু এরপর নির্বাচনে যখন ব্রাদারহুড বা মুরসি নির্বাচিত হলেন তখন তাদের অনেকের মোহভঙ্গ হল। বিশ্বশক্তি ‘লিবারেল’ মিডিয়াসহ বিভিন্ন পক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ে গেল। ভিন্ন ভিন্ন কারণে তারা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। প্রথমত, বিশ্বের ইসলামবিরোধী প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও মিডিয়াগুলো দেখল, মুরসি টিকে গেলে তো আরব বসন্তের পর আরব রাষ্ট্রগুলোয় ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় চলে আসবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমের সাথে সখ্য করে চলা আরবের বিলাসী রাজা-বাদশাহরা অন্য কারণে ভীত হয়ে পড়ল। তারা ভেবে দেখল, মিশরের ব্রাদারহুড ক্ষমতায় টিকে গেলে এবং নির্বাচিত সরকার নিয়ে জনগণ সন্তুষ্ট হয়ে গেলে তো তাদেরও ক্ষমতা চলে যাবে। তৃতীয়ত, মুরসি ক্ষমতায় আসার পর আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেন। গাজার সঙ্গে মিসর সীমান্ত খুলে দিলেন। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ন্যায্য অধিকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করলেন। আর ইসরাইলের আপত্তি সত্তে¡ও এসব সিদ্ধান্ত থেকে মুরসি সরে এলেন না। এতে ইসরাইল প্রচÐ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। মূলত, দেশের বাইরের এই ত্রিমুখী শক্তির বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র ও অসমর্থন মুহাম্মাদ মুরসির ক্ষমতাচ্যুতির কারণ হয়ে উঠেছিল।
এরা ছিল দেশের বাইরের। দেশের ভিতরে রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, মিডিয়াসহ বিভিন্ন অংশকে মুরসিবিরোধী ষড়যন্ত্রে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিছু মানুষকে উত্তেজিত করে আবার তাহরীর স্কয়ারে জমায়েত করা হয়েছিল। নানা রকম অভিযোগ ওঠানো হচ্ছিল মুরসির বিরুদ্ধে। অথচ তার সরকার তখন পর্যন্ত এক বছরও পার করেনি।
আসলে পরবর্তী সময়ে তাহরীর স্কয়ারের আন্দোলনটা করানো হয়েছে। লোক জমায়েত করা হয়েছে। বিভিন্ন দিকের লোকজনকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথিত আছে, মুরসি বিরোধী আন্দোলন চলাকালে আরবের দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র থেকে দু দিন পর্যন্ত মিশরে বিমান ভরে টাকা পাঠানো হয়েছে শুধু আন্দোলনের লোক ও রসদ যোগানোর জন্য। সে আন্দোলন কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, আবদুল ফাত্তাহ সিসির নেতৃত্বে মিশরের সামরিক বাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং বন্দী করে রাখে। এতে স্পষ্টতই দেখা গেছে, দেশের ভিতরে সেক্যুলার রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী, মিডিয়া ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে।
মুরসিকে উৎখাতের ক্ষেত্রে মিশরের ভেতর-বাইরের ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর। যারা আগে ইখওয়ানকে সাধারণ নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন বলত, মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই তারা বলতে থাকে, ‘ইখওয়ান’ সন্ত্রাসী সংগঠন। মুরসির সরকার ছিল নির্বাচিত সরকার। কিন্তু তাকে অভ্যুত্থান করে যারা ক্ষমতা থেকে সরাল, দেখা গেল, সেই ক্ষমতা দখলকারীদেরকেই সমর্থন জানানো হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, বাইরের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও শক্তিগুলোর অবস্থান কী ছিল।
অতি উৎসাহী সালাফীদের একটি বড় ইসলামী গোষ্ঠী, যারা সশস্ত্রভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে, তারাও মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। তাদের এই ভূমিকা গেছে আন্তর্জাতিক ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি, ইসরাইল ও সেক্যুলারদের পক্ষে। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের মাথায় ঢুকিয়েছে- ‘মুরসি ক্ষমতায় এসে ইসলামী শাসন কায়েম করেননি।’ ইসলামী শাসন কায়েম না করার অজুহাতে তারা সমর্থন দিলেন ইসরাইল ও সেক্যুলারদের তৈরি করা আন্দোলনে, তাদেরই পক্ষে। এখান থেকে বুঝে আসে, বৃহত্তর অঙ্গনে বুঝে-শুনে ইসলামের কাজ করা আর অতি উৎসাহী হয়ে অবুঝের মত কাজ করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। শুনেছি, মুরসি বিরোধী আন্দোলনকারী অনেক সালাফী পরে মন খারাপ করেছে, আক্ষেপ করেছে, নিজেদের ভূমিকা নিয়ে কান্নাকাটিও করেছে।
কেউ কেউ বলে থাকে, মিশরের ড. মুরসি ও তুরস্কের এরদোগান নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং তারা পুরোপুরি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেও পারেননি। সুতরাং তাদের পক্ষে সমর্থন বা অবস্থান নেওয়া কোনো ইসলামপন্থীর ভূমিকা হতে পারে না।
এটা আসলে চরমপন্থা অবলম্বনকারী অবুঝ লোকদের অবস্থান। সামগ্রিক দিক না দেখেই তারা এজাতীয় মন্তব্য করে থাকে। মুরসি-এরদোগানকে কেউ আসলে ‘খলীফা’ মনে করে না, দাবিও করে না। যারা তাদের পক্ষে কথা বলে, তারা তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও বাস্তবতার আলোকেই বলে। যেখানে নিয়ন্ত্রক রাজনীতিকরা ছিল ইসরাইলের পক্ষে, সেক্যুলারিজমের পক্ষে, ইসলামী অনুশাসনের বিপক্ষে, সেখানে যারা ক্ষমতায় এসে এই ধারাটা ঘুরিয়ে দেন এবং ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন- তাদেরকে এই কাজটুকুর জন্য সাধুবাদ জানানো যেতেই পারে।
এটা হচ্ছে তুলনামূলক সাধুবাদ, অপেক্ষাকৃত আনুকুল্যের প্রতি সমর্থন। এর অর্থ এটা নয় যে, তাদের পদক্ষেপটাকে ইসলামী সরকার বা ইসলামী শাসনের অনুরূপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে গেছে।
তুলনামূলক বাস্তবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখুন, মাত্র এক বছরে মুহাম্মাদ মুরসি নীল নদের পাশে বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সিনাই অঞ্চলে বিভিন্ন অর্থকরী ও কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। দেশে দেশে সফর শুরু করেছিলেন। আপনাকে দুটি দিক দেখতে হবে। দেখবেন, এক পক্ষ ইসরাইলের পক্ষে, সেক্যুলারিজমের পক্ষে কাজ করছে। আরেক পক্ষ এদের বিরুদ্ধে থেকে নিজেদের বিশ্বাস ও দেশের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। এখানে আপনি কার পক্ষে যাবেন?
একইভাবে আপনি আসুন তুরস্কে। সেখানে খেলাফত পরবর্তী সময়ে কামাল ও তার অনুসারীরা এমন এক নৈরাজ্য কায়েম করেছিল যে, দেশের সঙ্গে ইসলামের মিলিত সকল স্তম্ভ ধ্বংস করে দিল। আযান বন্ধ করে দিল। প্রকাশ্যে দ্বীনী শিক্ষা নিষিদ্ধ করল। ইসলামী বর্ণমালা নিষিদ্ধ করে দিল। সেক্যুলারিজমকে শুধু আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠাই করল না, বাস্তবায়নও করল সব জায়গায়। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান- সেনাবাহিনী, আদালত ও শিক্ষাঙ্গন, সম্পূর্ণ ইসলামবিদ্বেষী করে গড়ে তুলল। এ অবস্থার মধ্যে তুরস্কে অসংখ্য কুরবানীর পর সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে যারা ক্ষমতায় এসেছেন তাদের বর্তমান প্রতিনিধি হচ্ছেন এরদোগান। তাকে তার চেষ্টার জন্য সমর্থন জানানো মানে তাকে ‘খলীফা’ দাবি করা নয়, তাকে ‘দরবেশ’ ও ‘বুযুর্গ’ দাবি করাও নয়। তুরস্কে ইসলাম বিদ্বেষী যুগের সাথে তুলনা করে এরদোগানের প্রশংসা করা হয়। আগের ইসলাম বিদ্বেষী সেক্যুলারিজম দাড়ি রাখতে না দেওয়া, হিজাব পরতে না দেওয়াসহ মুসলমানদের ব্যক্তিগত জীবনেও ইসলাম পালনে যে সংকট সৃষ্টি করেছিল, এরদোগানের যুগ এসে সে সংকট দূর করেছে। আপনি কি এখন তাকেও সেক্যুলার কামাল ও তার অনুসারীদের মতো করেই দেখবেন?
আমার কেন যেন মনে হয়, যারা সব তুলনামূলক ভালোমন্দের বিশ্লেষণকে অবজ্ঞা করে তারা আসলে ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন যুগ ভালোভাবে দেখেননি, পড়েননি। এমনকি কুরআনে কারীমও মন দিয়ে পড়েননি। সকল কাফেরই কাফের। কিন্তু কোনো কোনো কাফের ছিল অধিক কঠোর। কোনো কোনো কাফের ছিল কম কঠোর। ইসলামের শুরুর যুগে কোনো কোনো কাফেরের সাথে যুদ্ধ করা হয়েছে, কোনো কাফেরের সাথে সন্ধি করা হয়েছে। ইসলামে তুলনামূলক ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলা বা দেখার রীতি আগে থেকেই চলে এসেছে। অথচ সামান্য পড়াশোনা করেই অনেকে এখন একতরফা ও অপরিণত কথা ছড়িয়ে দেয়।
যাইহোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বন্দী অবস্থায় ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাফেজ মুহাম্মাদ মুরসির এই ইন্তেকালের ঘটনায় কি বিশেষ কোনো শিক্ষা বা সংকেত রয়েছে।
শিক্ষা ও সংকেত তো অবশ্যই আছে। তবে তা শুধু মুরসির একার জীবনেই নয়, এমন শিক্ষা ইতিহাসে বহু মনীষীর জীবনে পাবেন। সবাই সবসময় বাহ্যিকভাবে কামিয়াব হননি। জিহাদের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। উপমহাদেশে নিকট অতীতেও যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন দিয়েছেন- যেমন, বালাকোটে সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ., মহিশুরের টিপু সুলতান রাহ., বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাহ.; তাদের ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। এখানে কাউকে অন্যের সাথে তুলনা করা বা কাছাকাছি মর্যাদার দেখানো উদ্দেশ্য নয়; বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকতে গিয়ে মুরসির চেয়ে বড় বড় ব্যক্তিত্বগণ অতীতে নশ্বর জীবনের বাজী হেরেছেন। উদাহরণগুলো দ্বারা শুধু তাই দেখানো হল। তবে ষড়যন্ত্র ও প্রলোভনের সামনেও মুহাম্মাদ মুরসির দৃঢ়তা ও অনমনীয়তা একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয়। বন্দী করার পর তাকে অনেক রকম প্রলোভন ও অপশন দেওয়া হয়েছিল। তিনি নত হননি। ইসলামের জন্য জিহাদ যেমন কঠিন ত্যাগ ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি বড় অঙ্গন, তেমনি দ্বীনের নানা রকম সেবা ও খেদমতেও ত্যাগ ও ঝুঁকি, মেহনত-মোজাহাদার দিক রয়েছে।
ড. মুহাম্মাদ মুরসির নামাযে জানাযায়ও লোক জমায়েত হতে দেওয়া হয়নি। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও গোপনীয়তার মধ্যে জানাযা হয়েছে।
এমন ঘটনাও দেশে দেশে যুগে যুগে ঘটেছে। যাদেরকে যুলুম করে, ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়, সেই মৃত ব্যক্তিকে অত্যাচারীরা জীবিত অবস্থার চেয়েও বেশি ভয় করে। মিশরের স্বৈরশাসকদের ভেতর ভয় ছিল, প্রকাশ্যে মুরসির জানাযার নামায আয়োজন করতে দিলে তা স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশে পরিণত হতে পারে। এ কারণে তারা দেয়নি। পৃথিবীর বহু দেশই এমনটা করে থাকে।
অত্যাচারীরা জানে, এক মুরসিকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে পারলেও মিশর ও মিশরের বাইরের অসংখ্য ইসলামপ্রিয় ও ইনসাফপ্রিয় মানুষকে শেষ করে দেওয়া সম্ভব নয়। সকল নির্যাতনের মধ্যেও সময়ে সময়ে মুরসিরা ঠিকই বের হয়ে আসবে, সফলও হবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদেরও পতন হবে। মুমিনের দুআ ও প্রত্যাশা এরকমই।"
Comment