মজলিসে শূরায় মহিলা সদস্য থাকতে পারবে কি?- তাকি উসমানী সাহেবের বিভ্রান্তি
ইমামুল মুসলিমীনের একটি বড় দায়িত্ব হল, পরামর্শ করে কাজ করা। এ ব্যাপারে কুরআন হাদিসে অনেক তারগীব এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় পরামর্শ করে কাজ করতেন। ছোট-খাট বিষয়েও পরামর্শ করতেন। সাহাবায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্যও এমনই ছিল। এটিই মুমিনদের সিফাত।
অবশ্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বা খুলাফায়ে রাশেদার নির্দিষ্ট সদস্যবিশিষ্ট নির্ধারিত কোন বোর্ড ছিল না। যখন দরকার পড়তো বড় বড় সাহাবায়ে কেরামকে একত্র করে পরামর্শ করতেন। নির্দিষ্ট কোন মজলিসে শূরা ছিল না।
যাহোক, এখন যদি আমীরুল মু’মিন পরামর্শের জন্য কোনো বোর্ড তথা মজলিসে শূরা গঠন করেন, তাহলে মহিলাদেরকে সে বোর্ডের নিয়মতান্ত্রিক সদস্য রাখা যাবে কি’না যে: শূরার তারিখে মহিলারাও উপস্থিত হবে, তাদের কাছেও পরামর্শ চাওয়া হবে এবং তাদের পরামর্শ মোতাবেক কাজও করা হবে?
যদি আমরা শরীয়তের উসূল ও মূলনীতির দিকে তাকাই, তাহলে এটার বৈধতা পাওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। যেমন,
এক.
মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার আদেশ হল,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ
“তোমরা তোমাদের নিজ গৃহে অবস্থান করবে।”- আহযাব ৩৩মজলিসে শূরায় শরীক হওয়ার জন্য মহিলারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানী, জেলা শহর বা যেখানে মজলিসে শূরা বসবে সেখানে উপস্থিত হতে যাওয়া বিনা দরকারে এ আয়াতের বিরুদ্ধাচরণ। অধিকন্তু ফিতনার আশঙ্কায় যেখানে মসজিদে যেতেও মহিলাদের নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে দূর-দূরান্ত থেকে পুরুষদের সাথে এসে এক মজলিসে শরীক হওয়ার অনুমতি কিভাবে হবে? বরং মহিলারা ঘরে থাকবে, ঘরেই প্রতিপালিত হবে- এটাই শরীয়তের কাম্য। বাহিরের কাজে অংশ নেয়া শরীয়তের কাম্য নয়। মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা হল,
مَنْ يُنَشَّأُ فِي الْحِلْيَةِ وَهُوَ فِي الْخِصَامِ غَيْرُ مُبِينٍ
“যারা অলংকার মণ্ডিত হয়ে প্রতিপালিত হয় আর তর্ক-বিতর্ককালে স্পষ্ট বক্তব্য প্রদানে অসমর্থ্য।”- যুখরুফ ১৮দুই.
সাধারণত মহিলাদের শারীরিক শক্তি, স্বরণ শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা সব কিছুই পুরুষের তুলনায় কম। পুরুষের তুলনায় তাদের দ্বীনও অপূর্ণাঙ্গ, বিবেক-বুদ্ধিও অপূর্ণাঙ্গ। হাদিসে তাদেরকে বলা হয়েছে,
ناقصات عقل ودين
“যাদের আকল ও দ্বীন উভয়ই অপূর্ণ।”- সহীহ বুখারী ৩০৪, সহীহ মুসলিম ২৫০এ কারণে শরীয়ত মহিলাদের একক সাক্ষ্য গ্রহণ করে না। সাথে পুরুষ থাকলেই কেবল গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় নয়। তখনও আবার দুই মহিলা মিলে এক পুরুষের সমান। অর্থাৎ এক মহিলা এক পুরুষের অর্ধেক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ مِنْ رِجَالِكُمْ فَإِنْ لَمْ يَكُونَا رَجُلَيْنِ فَرَجُلٌ وَامْرَأَتَانِ مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ أَنْ تَضِلَّ إِحْدَاهُمَا فَتُذَكِّرَ إِحْدَاهُمَا الْأُخْرَى
“যেসকল সাক্ষীর প্রতি তোমরা রাজি-খুশি তাদের মধ্য থেকে দু’জন পুরুষকে সাক্ষী রাখবে। যদি দু’জন পুরুষ না থাকে, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা; যাতে এক মহিলা ভুলে গেলে একজন অপরজনকে স্বরণ করিয়ে দিতে পারে।”- বাকারা ২৮২রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
« أما نقصان العقل فشهادة امرأتين تعدل شهادة رجل فهذا نقصان العقل وتمكث الليالى ما تصلى وتفطر فى رمضان فهذا نقصان الدين ».
“তাদের আকল অপূর্ণ হওয়ার দলীল এই যে, দুই মহিলার সাক্ষ্য এক পুরুষের সাক্ষ্যের সমান। এটি আকলের অপূর্ণতার কারণে। আর (হায়েযের দিনগুলোতে) তারা অনেক দিন পর্যন্ত এভাবে অবস্থান করে যে, তাদের নামায পড়তে হয় না এবং রমযানের দিনে রোযাও রাখতে হয় না। এটিই তাদের দ্বীনের অপূর্ণতা।”- সহীহ মুসলিম ২৫০সৃষ্টিগতভাবেই যারা দুর্বল এবং অপূর্ণাঙ্গ এবং শরীয়তের দৃষ্টিতেও যারা অপূর্ণাঙ্গ, তাদেরকে মুসলিম উম্মাহর স্পর্শকাতর বিষয়াশয়ে শরীক করা, তাদের থেকে পরামর্শ নেয়া, সে অনুযায়ী কাজ করা নিশ্চয়ই উম্মাহর প্রতি কল্যাণকামিতা না হয়ে তাদের সাথে খিয়ানত হবে। পুরুষ তো দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যায়নি যে, তাদের বাদ দিয়ে অপূর্ণাঙ্গ মহিলাদেরকে মজলিসে শুরায় শরীক করতে হবে। নিশ্চয়ই এটা আমানতদারি নয়। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহ তাআলার এ আদেশের পরিপন্থী,
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা অবশ্যই আমানতসমূহ উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করবে।”- নিসা ৫৮তিন.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, তারা কখনও মহিলাদেরকে পরামর্শের মজলিসে আরো দশ পুরুষের সামনে উপস্থিত করে পরামর্শ নিতেন না। আর নিয়মিত মহিলাদেরকে মজলিসে শূরার সদস্য বানানোর তো কোন প্রশ্নই আসে না।
***
উপরোক্ত মূলনীতিগুলোর আলোকে আমরা বলতে পারি, মহিলাদেরকে মজলিসে শূরার সদস্য করে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বিষয়াশয়ে তাদের থেকে পরামর্শ নেয়া শরীয়তের নির্দেশও নয়, কাম্যও নয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের ত্বরীকাও নয়। এটি সম্পূর্ণই একটি নব আবিষ্কৃত বিদআতি বিষয়। শরীয়তের উসূল-মূলনীতি ও মেজাজ পরিপন্থী একটি কাজ। আর ফিতনার আশঙ্কার কথা তো বলাই বাহুল্য।
***
এ গেল আম দলীল। আর যদি খাস দলীলের দিকে যাই, তাহলে দেখতে পাবো হযরত উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাণী,
"كنا في الجاهلية لا نعد النساء شيئا، فلما جاء الإسلام وذكرهن الله، رأينا لهن بذلك علينا حقا، من غير أن ندخلهن في شيء من أمورنا". (صحيح البخاري 5843، كتاب اللباس، باب ما كان [ص:152] النبي صلى الله عليه وسلم يتجوز من اللباس والبسط).
“জাহিলি যামানায় আমরা মহিলাদের কোন পজিশন আছে বলেই মনে করতাম না। এরপর যখন ইসলাম আসল, আল্লাহ তাআলা মহিলাদের কথা আলোচনায় আনলেন, তখন মনে হল যে, আমাদের কাছে তাদের কিছু হক পাওনা আছে। কিন্তু আমাদের (রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক) বিষয়াশয়ের কোনো কিছুতেই আমরা তাদেরকে শরীক করতে পারি না।”- সহীহ বুখারি ৫৮৪৩, কিতাবুল লিবাস। বর্ণনার শুরুর অংশটি অন্য রিওয়াতে এভাবে এসেছে,
"والله إن كنا في الجاهلية ما نعد للنساء أمرا، حتى أنزل الله فيهن ما أنزل، وقسم لهن ما قسم". (صحيح البخاري 4913، كتاب التفسير، باب {تبتغي مرضاة أزواجك}).
“আল্লাহর কসম! জাহিলি যামানায় আমরা মহিলাদের কোনো অবস্থান আছে বলেই মনে করতাম না। (এভাবেই চলছিল) অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাদের (সাথে সদাচরণের) ব্যাপারে যা নাযিল করার তা নাযিল করলেন এবং যে হক তাদেরকে দেয়ার তা দিলেন।”- সহীহ বুখারি ৪৯১৩, কিতাবুত তাফসীর। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাদের সাথে ভাল আচরণের আদেশ দিলেন এবং তারা নাফাকা ও মিরাস পাবে বলে বিধান দিলেন। তবে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বিষয়াশয় তেমনই রয়ে গেল যেমন আগে ছিল। আগেও যেমন সেখানে তাদের কোন অধিকার ও অংশগ্রহণ ছিল না, ইসলাম আসার পরেও তাদের কোন অধিকার নেই। অংশগ্রহণের কোন সুযোগ নেই।
আল্লামা কিরমানী রহ. (৭৮৬হি.) উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন,
(أمراً) أي شأناً بحيث يدخلن في المشورة؛ وأنزل الله فيهن مثل «وعاشروهن بالمعروف ولا تمسكوهن ضراراً فإن أطعنكم فلا تبغوا عليهن سبيلا» وقسم مثل «ولهن الربع مما تركتم وعلى المولود له رزقهن وكسوتهن». اهـ (الكواكب الدراري في شرح صحيح البخاري: 18\156-157، كتاب التفسير، بَاب {تَبْتَغِي مَرْضَاةَ أَزْوَاجِكَ})
“অর্থাৎ মহিলারা পরামর্শে শরীক হতে পারে মতো কোনো অবস্থান রাখে বলে মনে করতাম না। এরপর আল্লাহ তাআলা তাদের ব্যাপারে এ ধরণের আয়াত নাযিল করেন,
‘তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবনযাবন করবে’। ‘ক্ষতির উদ্দেশ্যে তোমরা তাদেরকে আটকে রাখবে না’। ‘অতঃপর তারা যদি তোমাদের আনুগত্য করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের পথ খুঁজো না’।
এবং তাদেরকে এ ধরণের হক দিলেন,
‘(তোমাদের সন্তানাদি না থাকলে) তোমাদের পরিত্যক্ত সম্পদের এক চতুর্থাংশ তাদের’। ‘মায়েদের ভরণ-পোষণ পিতাদের দায়িত্বে’।”- আলকাওয়াকিবুদ দারারি ১৮/১৫৬-১৫৭
মোটকথা, শারীরিক দুর্বলতা ও বুদ্ধিমত্তার কমতির কারণে জাহিলি যামানাতেও মহিলারা অপূর্ণ বিবেচিত হতো। প্রশাসনিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে অংশ নেয়ার অনুপযুক্ত বিবেচিত হতো। এমনকি তাদের কোন হক আছে বলেই মনে করা হতো না। পুরুষরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাদের ব্যবহার করতো। ইসলাম এসে পুরুষদেরকে আদেশ দিল নারীদের সাথে সদাচরণ করতে। তাদের দেখাশুনা করতে। তাদের ভরণ-পোষণ দিতে। মৃত আত্মীয়-স্বজনের রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে তাদেরকেও একটা অংশ দিতে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়াশয় আগের মতোই রয়ে গেল। সেখানে তাদের কোন অংশ নেই। শারীরিক দুর্বলতা ও আকল-বুদ্ধির কমতির কারণে সেখানে অংশ নেয়ার কোন যোগ্যতা তাদের নেই। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ বিষয়টিই পরিষ্কার করে বলেছেন,
من غير أن ندخلهن في شيء من أمورنا – ‘কিন্তু আমাদের (রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক) বিষয়াশয়ের কোনো কিছুতেই আমরা তাদেরকে শরীক করতে পারি না।’
বড়ই আফসোসের বিষয়! সাহাবায়ে কেরাম যেখানে নববী ও সাহাবি যামানাতেও মহিলাদেরকে রাষ্ট্রীয় সামান্য থেকে সামান্য বিষয়ে অংশ গ্রহণের যোগ্য মনে করতেন না, সেখানে আজকের সমাজের রাহবারগণ এ ফিতনা ফাসাদের যামানাতেও না’কি মহিলাদেরকে রাষ্ট্রীয় মজলিসে শূরার নিয়মিত সদস্য রাখাতে এবং তাদের থেকে পরামর্শ নিয়ে কাজ করাতে শরীয়তের বিপরীত কিছু দেখেন না। বড়ই আফসোস তাকি সাহেবের উপর, যিনি সাহাবায়ে কেরামের বিপরীতে এমন কথা বলতেও কোন দ্বিধা করলেন না,
كوئي ايسي واضح نص بھي موجود نهيں هے، جس كي بنا پر كها جائے كه انهيں شورى ميں شامل نهيں كيا جا سكتا-
“এমন কোন সুস্পষ্ট দলীলও অবশ্য বিদ্যমান নেই, যার ভিত্তিতে বলা যায় যে, মহিলাদেরকে শূরাতে শামিল করা যাবে না।”- ইসলাম আউর সিয়াসি নজরিয়্যাত ২৬৯বড়ই আফসোস যে, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর সুস্পষ্ট বক্তব্যটি তার কেন নজরে পড়লো না! কেনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সীরাতের পাতাগুলো তার নজরে আসলো না! যামানার বাতিল মতবাদের চাপে ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে গেলে এভাবেই মানুষ চক্ষুষ্মান হয়েও চোখে দেখে না। হে আল্লাহ তোমার কাছে এ থেকে পানাহ চাই। অহীর নূর থেকে তুমি আমাদের বঞ্চিত করো না। আমীন।
Comment