নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মোকাবেলা করা জায়েয বরং প্রশংসনীয়
পূর্বোক্ত আলেচনা থেকে স্পষ্ট, শত্রু সংখ্যা যতই হোক, মোকাবেলা করা কাশ্মিরিদের জন্য ফরয। দ্বিগুণ বা তার কম হওয়ার শর্ত প্রযোজ্য নয়। এ আলোচনা থেকে আশাকরি শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার মূর্খতাও স্পষ্ট। শরীয়তের এমন সুস্পষ্ট বিষয় এবং যার ব্যাপারে স্বয়ং ইবনে তাইমিয়া রহ. এর স্পষ্ট নসও বিদ্যমান (যে ইবনে তাইমিয়াকে আশ্রয় করে তারা নিজেদেরকে সালাফি দাবি করে)- এমন স্পষ্ট বিষয়কে যারা অস্বীকার করে, অপব্যাখ্যা করে: তারা কিসের সালাফি? সালাফিয়্যাত আর হাদিস হাদিস করে এরা উম্মাহকে ধোঁকায় ফেলতে চায়। তাগুতের নেক দৃষ্টি লাভের জন্য তারা সব কিছুই করে। এদের সাথে ইবনে তাইমিয়ার কি সম্পর্ক, আর সালাফিয়্যাতেরই বা কি সম্পর্ক? এগুলো সব ধোঁকা। শুধু আল্লাহ আরশে সমাসীন কি’না, তাবিজ ব্যবহার বৈধ কি’না- এসব মাসআলার জিগির তোলে সালাফিয়্যাতের রং লাগাতে চায়। যখন কুফর বিততাগুতের কথা আসে, কিতাল ফি সাবিলিল্লাহর কথা আসে- তখন মুনাফিকদের মতো এদের চোখ ছানা বড় হয়ে যায়, যেন মৃত্যুর মূর্চা শুরু হয়ে গেছে। এরা আর যাই হোক- ইবনে তাইমিয়ার সাথে এদের কোন সম্পর্ক নেই। সালাফিয়্যাত থেকেও এরা হাজারো লাখো ক্রোশ দূরে।
যাহোক, শায়খ মূর্খতা বা স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কুরআনে কারীমের আয়াতগুলোর অপব্যাখ্যা করে শত্রু সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হলে জিহাদ নিষেধ করে দিয়েছেন। আমরা আলহামদুলিল্লাহ দেখিয়েছি, কুরআন সুন্নাহর আলোকে এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা আর ধোঁকা। শত্রু সংখ্যা বেশি এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মোকাবেলা করা শুধু জায়েযই নয় বরং প্রশংসনীয়। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কয়েকটি সূরত তুলে ধরে বলেন,
"الرجل أو الطائفة يقاتل منهم أكثر من ضعفيهم إذا كان في قتالهم منفعة للدين، وقد غلب على ظنهم أنهم يقتلون"
كالرجل: يحمل وحده على صف الكفار ويدخل فيهم. ويسمي العلماء ذلك: "الانغماس في العدو"؛ فإنه يغيب فيهم كالشيء ينغمس فيه فيما يغمره.
وكذلك الرجل: يقتل بعض رؤساء الكفار بين أصحابه. مثل أن يثب عليه جهرة إذا اختلسه، ويرى أنه يقتله ويغتفل بعد ذلك
والرجل: ينهزم أصحابه فيقاتل وحده أو هو وطائفة معه العدو وفي ذلك نكاية في العدو، ولكن يظنون أنهم يقتلون
فهذا كله جائز عند عامة علماء الإسلام من أهل المذاهب الأربعة وغيرهم. وليس في ذلك إلا خلافا شاذا. وأما الأئمة المتبعون كـ: "الشافعي" و"أحمد" وغيرهما فقد نصوا على جوز ذلك. وكذلك: هو مذهب: "أبي حنيفة، و"مالك" وغيرهما. ودليل ذلك: الكتاب، والسنة، وإجماع سلف الأمة. اهـ
كالرجل: يحمل وحده على صف الكفار ويدخل فيهم. ويسمي العلماء ذلك: "الانغماس في العدو"؛ فإنه يغيب فيهم كالشيء ينغمس فيه فيما يغمره.
وكذلك الرجل: يقتل بعض رؤساء الكفار بين أصحابه. مثل أن يثب عليه جهرة إذا اختلسه، ويرى أنه يقتله ويغتفل بعد ذلك
والرجل: ينهزم أصحابه فيقاتل وحده أو هو وطائفة معه العدو وفي ذلك نكاية في العدو، ولكن يظنون أنهم يقتلون
فهذا كله جائز عند عامة علماء الإسلام من أهل المذاهب الأربعة وغيرهم. وليس في ذلك إلا خلافا شاذا. وأما الأئمة المتبعون كـ: "الشافعي" و"أحمد" وغيرهما فقد نصوا على جوز ذلك. وكذلك: هو مذهب: "أبي حنيفة، و"مالك" وغيرهما. ودليل ذلك: الكتاب، والسنة، وإجماع سلف الأمة. اهـ
“মাসআলা: কোনো একক ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র একটি দল তাদের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি শত্রুর মোকাবেলা করা- যখন তাদের কিতালে দ্বীনের কোনো উপকার সাধিত হয়, তবে তাদের প্রবল ধারণা যে, তারা সকলে নিহত হবে;
- যেমন, কোনো ব্যক্তি একাই কাফেরদের সারিতে হামলা করে এবং তাদের ব্যূহ ভেদ করে একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়ে। ...
- এমনিভাবে কোনো ব্যক্তি কাফেরদের অভ্যন্তরস্থ কোনো কাফের নেতাকে হত্যা করে। যেমন, চুপিসারে সুযোগ খুঁজতে লাগলো। যখন মনে করল যে তাকে হত্যা করতে পারবে, সকলের সম্মুখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
- কোনো ব্যক্তির সকল সাথি পলায়ন করলো। তখন সে একাই বা ক্ষুদ্র একটি দল নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেল। এ যুদ্ধে কাফেরদের কিছু ক্ষতি তো হবে, তবে মোটামুটি নিশ্চিত যে, তারা সকলে নিহত হবে।
চার মাযহাবের আইম্মায়ে কেরামসহ অন্য সকল ইমামের মতে এ সকল সূরত জায়েয। কিছু ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন কয়েকটি মত ছাড়া এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। শাফিয়ি ও আহমাদসহ অন্যান্য অনুস্বরণীয় ইমাম সুস্পষ্ট বলে গেছেন যে, এগুলো জায়েয। আবু হানিফা ও মালেকসহ অন্যান্য ইমামের মাযহাবও এমনই। কুরআন, সুন্নাহ ও উম্মাহর সালাফগণের ইজমা এর স্বপক্ষে দলীল।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ২১-৩১
এর পর তিনি কুরআন সুন্নাহ থেকে এর দলীল পেশ করেন। সেখান থেকে সহজ কয়েকটি দলীল তুলে ধরছি। বিস্তারিত উক্ত রিসালায় দেখা যেতে পারে।
কুরআনে কারীম থেকে দলীল
ক. আল্লাহ তাআলার বাণী- وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ
“মানুষদের মাঝে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। আল্লাহ তাআলা (এরূপ) লোকদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।”- বাকারা ২০৭আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন বিকিয়ে দেয়ার ব্যাখ্যা ইবনে তাইমিয়া রহ. এভাবে দেন,
وذلك يكون بأن يبذل نفسه فيما يحبه الله ويرضاه، وإن قتل أو غلب على ظنه أنه يقتل. اهـ
“তা এভাবে হবে যে, এমন পথে নিজের জীবন উৎস্বর্গ করে দেবে, যে পথ আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন ও যাতে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট- যদিও মৃত্যু নিশ্চিত হয় বা প্রবল ধারণা হয় যে, সে নিহত হবে।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ৩২আয়াতের শানে নুযূল থেকে বিষয়টি পরিষ্কার। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
وقد ذكر أن سبب نزول هذه الآية
أن صهيبا خرج مهاجرا من مكة إلى المدينة إلى النبي صلى الله عليه وسلم. فلحقه المشركون وهو وحده. فنشل كنانته، وقال: والله لا يأتي رجل منكم إلا رميته. فأراد قتالهم وحده، وقال: إن أحببتم أن تأخذوا مالي بمكة فخذوه، وأنا أدلكم عليه. ثم قدم على النبي صلى الله عليه وسلم. فقال النبي صلى الله عليه وسلم: "ربح البيع أبا يحي".
وروى أحمد بإسناده: أن رجلا حمل وحده على العدو فقال الناس: ألقى بيده إلى التهلكة. فقال عمر: كلا بل هذا ممن قال الله فيه: {وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَؤُوفٌ بِالْعِبَادِ} (البقرة:207) . اهـ
أن صهيبا خرج مهاجرا من مكة إلى المدينة إلى النبي صلى الله عليه وسلم. فلحقه المشركون وهو وحده. فنشل كنانته، وقال: والله لا يأتي رجل منكم إلا رميته. فأراد قتالهم وحده، وقال: إن أحببتم أن تأخذوا مالي بمكة فخذوه، وأنا أدلكم عليه. ثم قدم على النبي صلى الله عليه وسلم. فقال النبي صلى الله عليه وسلم: "ربح البيع أبا يحي".
وروى أحمد بإسناده: أن رجلا حمل وحده على العدو فقال الناس: ألقى بيده إلى التهلكة. فقال عمر: كلا بل هذا ممن قال الله فيه: {وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَؤُوفٌ بِالْعِبَادِ} (البقرة:207) . اهـ
“আয়াতে কারীমার শানে নুযূল প্রসঙ্গে বলা হয়:
ক. সুহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার জন্য হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় রওয়ানা দেন। মুশরিকরা তার পশ্চাদ্ধাবন করে। তখন তিনি একা মাত্র। তিনি তূণীর থেকে তীর নিলেন। বললেন, আল্লাহর কসম, যে কেউ সামনে আসবে তাকেই বিদ্ধ করবো। তিনি একাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইচ্ছা করলেন এবং বললেন, যদি আমার সম্পদ নিয়ে নেয়া (এবং বিনিময়ে আমাকে নিরাপদে হিজরতে যেতে দেয়া) তোমাদের পছন্দ হয়, তাহলে নিতে পার। আমি তা কোথায় আছে বলে দেব। এরপর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আবু ইয়াহইয়া! তোমার বিক্রি লাভেই হয়েছে’।
খ. ইমাম আহমাদ রহ. নিজ সনদে বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি একাই শত্রু বাহিনির উপর আক্রমণ করলো। তখন কিছু লোক বলতে লাগলো, লোকটি নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করেছে। তখন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু (তাদের কথা প্রত্যাখান করে) বললেন, কিছুতেই নয়! বরং সে তো ঐসব ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘মানুষদের মাঝে এমন কিছু লোকও আছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়। আল্লাহ তাআলা (এরূপ) লোকদের প্রতি অতিশয় দয়ালু’।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ৩১-৩২
খ. আল্লাহ তাআলার বাণী-
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
“আল্লাহ্ মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে। অতঃপর মারে ও মরে। তওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী কে আছে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সাথে) যে লেন-দেন করেছো, তার উপর আনন্দিত হও। আর এটাই মহা সাফল্য।”- তাওবা ১১১আল্লাহ তাআলা যখন জান-মাল কিনে নিয়েছেন, তখন তা আল্লাহর হাতে সমর্পণ করতে হবে। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
فإن المشتري يسلم إليه ما اشتراه، وذلك ببذل النفس والمال في سبيل الله وطاعته، وإن غلب على ظنه أن النفس تقتل والجواد يعقر، فهذا من أفضل الشهادة. اهـ
“কেননা, ক্রেতা যা ক্রয় করেছে, তা তার তাতে সমর্পণ করে দিতে হবে। আর তা এভাবে হবে যে, জান-মাল আল্লাহর রাস্তায় ও তার আনুগত্যে উৎস্বর্গ করবে- যদিও প্রবল ধারণা হয় যে, তার প্রাণ সংহার হবে এবং ঘোড়া কাটা পড়বে। আর এটাই শাহাদাতের সর্বশ্রেষ্ট পন্থা (যেমনটা হাদিসে এসেছে)।”- কায়িদাতুন ফিলইনগিমাসি ফিলআদুউ ৩৩এরপর ইবনে তাইমিয়া রহ. বেশ কিছু আয়াত থেকে বিষয়টি প্রমাণ করেছেন। আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় আমরা সেগুলো এখন উল্লেখ করছি না।
(ইনশাআল্লাহ চলমান)
Comment