খাওয়ারেজদের মানহাজ দিয়ে বিচার করবেন না
আমাদের দেশের একজন বড় আলেম মারা গেলেন। তাঁর এক শাগরেদ তাঁর জানাযায় শরীক হয়নি। কেনো? কারণ, তিনি না’কি মুরতাদ ছিলেন।
নিঃসন্দেহে এ ধরণের আকিদা বর্তমান খারেজি শ্রেণীর অনেকে পোষণ করে। এ ধরনের ঘটনাকে দলীল বানিয়ে আলেম সমাজের অনেকেই জিহাদ বিমুখতার প্রয়াস পান। জিহাদের আলোচনা তুলতে গেলেই তারা এ ধরনের দুয়েকটা উদাহরণ সামনে নিয়ে আসেন।
আমরা এ ধরনের বাড়াবাড়ি অস্বীকার করি না। এর চেয়ে বড় বাড়াবাড়িও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো,
- সবাইকে কি একই মানহাজে বিচার করবেন?
- এ ধরনের বাড়াবাড়ির কারণে কি জিহাদের ফরজিয়্যাত রহিত হয়ে যাবে আপনার উপর থেকে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর দরকার।
খাওয়ারেজ দুনিয়াতে আজ নতুন জন্ম নেয়নি। তারা পুরাতন ভাইরাস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানাতেই এর উৎপত্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন গনিমত বণ্টন করছিলেন। এক বুযুর্গ টাইপের লোক এসে আপত্তি শুরু করলো, ‘মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় করুন। কি ধরনের বণ্টন করছেন! এ বণ্টন তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হচ্ছে না’।
সুবহানাল্লাহ! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বণ্টন আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী হচ্ছে না!! সে রাসূলকে দ্বীন শিখাতে এসেছে। অথচ বাহ্যত লোকটা মুনাফিক ছিল না। ইবাদতগুজার ছিল। কিন্তু এমনই নির্বোধ যে, স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আপত্তি তুলতেও পরোয়া করেনি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إن من ضئضئ هذا أو في عقب هذا قوما يقرءون القرآن لا يجاوز حناجرهم يمرقون من الدين مروق السهم من الرمية يقتلون أهل الإسلام ويدعون أهل الأوثان، لئن أنا أدركتهم لأقتلنهم قتل عاد.
“এ লোকের বংশ থেকে এমন এক সম্প্রদায় বের হবে, যারা করআন তো পড়বে কিন্তু তা তাদের গলদেশ পেরিয়ে নিচে নামবে না (অর্থাৎ কুরআন পড়বে কিন্তু বুঝবে না)। শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে। তারা মুসলমানদের হত্যা করবে কিন্তু মূর্তি পূজারিদের ছেড়ে দেবে। যদি আমি তাদের পেয়ে যাই, তাহলে আদ জাতির মতো এদেরকে (সমূলে) হত্যা করবো।” -সহীহ বুখারি ৩৩৪৪, সহীহ মুসলিম ২৪৯৯আরেক হাদিসে এসেছে,
إنه يخرج من ضئضئ هذا قوم يتلون كتاب الله رطبا لا يجاوز حناجرهم يمرقون من الدين كما يمرق السهم من الرمية وأظنه قال لئن أدركتهم لأقتلنهم قتل ثمود.
“এ লোকের বংশ থেকে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যারা সতেজভাবে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে; কিন্তু তা তাদের গলদেশ পেরিয়ে নিচে নামবে না। শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে। -বর্ণনাকারী বলন- আমার ধারণা, তিনি এও বলেছেন, যদি আমি তাদের পেয়ে যাই, সামূদ জাতির মতো তাদেরকে (সমূলে) হত্যা করবো।” –সহীহ বুখারি ৪৩৫১, সহীহ মুসলিম ২৫০০উল্লেখ্য, এ লোকের বংশ বলতে এ ধরনের লোক উদ্দেশ্য, সরাসরি এ লোকের বংশ উদ্দেশ্য নয়। কারণ, পরবর্তী খাওয়ারেজরা সরাসরি তার বংশের লোক নয়।
অন্য হাদিসে এসেছে,
يأتي في آخر الزمان قوم حدثاء الأسنان سفهاء الأحلام يقولون من خير قول البرية يمرقون من الإسلام كما يمرق السهم من الرمية لا يجاوز إيمانهم حناجرهم فأينما لقيتموهم فاقتلوهم فإن قتلهم أجر لمن قتلهم يوم القيامة.
“শেষ যামানায় এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে, যাদের বয়স হবে স্বল্প আর বুদ্ধিতে হবে নির্বোধ। (বাহ্যত) সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ বাণী তারা বলবে, (আর বাস্তবে) শিকারের দেহ ভেদ করে নিক্ষিপ্ত তীর যেমন বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। তাদের ঈমান তাদের গলদেশ পেরিয়ে নিচে নামবে না। শোন, যেখানেই তোমরা তাদের পাবে, হত্যা করে দেবে। কেননা, তাদের হত্যা করাটা কিয়ামত দিবসে হত্যাকারীর জন্য মহা প্রতিদানের কারণ হবে।” –সহীহ বুখারি ৩৬১১, সহীহ মুসলিম ২৫১১হযরত উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমার যামানা থেকে এ ধরনের লোকের বিস্তৃতি। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এ শ্রেণীটি বিদ্যমান আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
كلما خرج قرن منهم قطع، حتى يخرج الدجال في بقيتهم –مجمع الزوائد، رقم: 10406، قال الهيثمي: رواه أحمد في حديث طويل. وشهر ثقة، وفيه كلام لا يضر، وبقية رجاله رجال الصحيح. اهـ
“যখনই তাদের কোনো একটি শিং গজাবে কেটে দেয়া হবে। অবশেষে তাদের অবশিষ্ট লোকদের মাঝে দাজ্জাল আগমন করবে।” –মাজমাউয যাওয়ায়িদ, হাদিস নং ১০৪০৬অন্য হাদিসে এসেছে,
لا يزالون يخرجون حتى يخرج آخرهم مع الدجال –مجمع الزوائد، رقم: 10409، قال الهيثمي: رواه أحمد. والأزرق بن قيس وثقه ابن حبان، وبقية رجاله رجال الصحيح. اهـ
“তাদের উৎপত্তি হতেই থাকবে। অবশেষে তাদের শেষাংশটি দাজ্জালের সাথে আগমন করবে।” –মাজমাউয যাওয়ায়িদ, হাদিস নং ১০৪০৯হাদিসের উদ্দেশ্য হয়তো এমন যে, দাজ্জালের আগমনের পর্যন্তই এ ধরনের লোক থেকে যাবে।
বুঝা গেল, এ ধরনের লোক থাকবেই চিরকাল। যদি এদেরকে ভিত্তি বানিয়ে গোটা মুজাহিদ জামাতের সমালোচনা এবং জিহাদ ত্যাগ বৈধ হতো, তাহলে জিহাদের বিধান একেবারেই উঠে যেতো। অথচ আমরা সালাফের সিরাতের দিকে তাকাই: তারা একই সাথে কাফের মুরতাদদের সাথেও কিতাল করেছেন, খাওয়াজেরদের সাথেও করেছন। উমাইয়া আব্বাসি উভয় খেলাফতকালেই খাওয়ারেজদের দৌরাত্ম্য ছিল। সালাফ তাদের বিরুদ্ধেও কিতাল করেছন, কাফেরদের বিরুদ্ধেও।
মুহাতারাম পাঠক! আমাদের দায়িত্ব ছিল সালাফের পথে চলা। খাওয়ারেজদের ভ্রান্ত মানহাজ সংশোধনের চেষ্টা করা। তাদের ব্যাপারে অপরাপর মুসলমানদের সচেতন করা। হক মানহজা ও হক মুজাহিদ জামাতের প্রচার প্রসার করা। লোকদেরকে তাদের জামাতে ভিড়ানো। হকপন্থীদের সাথে হয়ে কুফরের বিরুদ্ধে কিতাল করা। বিভ্রান্ত শ্রেণীর ভুল-ভ্রান্তিকে অজুহাত বানিয়ে ঢালাওভাবে মুজাহিদদের সমালোচনা করা, জিহাদ পরিত্যাগের সুযোগ খোঁজা এবং অন্যকেও বিমুখ করার চেষ্টা করা- এগুলো হকঅন্বেষী কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না। এগুলো তো ছিল মুনাফিকদের চরিত্র। ঠুনকো অজুহাতে সাহাবাদের সমালোচনা করতো। জিহাদ তরকের সুযোগ খুঁজে বেড়াতো।
উলামায়ে কেরামের উচিৎ মুজাহিদদের সমালোচনার বেলায় আল্লাহকে ভয় করা। একের দোষ অন্যের ঘাড়ে না চাপানো। আল্লাহর ফরয বিধানগুলো তরক করার বাহানা তালাশ না করা। শুধু ভুল খোঁজে না বেড়িয়ে মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে একটু ফিকির করা। মা-বোনদের আহাজারিতে একটু কান দেয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى
“প্রত্যেক ব্যক্তি যা কামাই করে তা কেবল তার উপরই বর্তাবে। কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না।” –আনআম ১৬৪আরো ইরশাদ করেন,
فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
“তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, নিজেদের পারস্পরিক অবস্থার সংশোধন কর এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা- যদি (প্রকৃত অর্থেই) তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।” –আনফাল ১আরো ইরশাদ করেন,
وَمَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا وَاجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيرًا
“তোমাদের কী হলো! তোমরা কিতাল করছো না আল্লাহর রাস্তায় এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের (উদ্ধারের) জন্য? যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে বের করে নিন এ জনপদ থেকে, যার অধিবাসীরা যালিম। আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কোনো অভিভাবক নির্ধারণ করে দিন এবং নিযুক্ত করে দিন আপনার পক্ষ থেকে কোনো সাহায্যকারী।” -নিসা ৭৫***
Comment