আলকাউসারের একটি প্রবন্ধ নিয়ে ক’টি মন্তব্য
“ইসলামের বিধান, রাষ্ট্রীয় আইন এবং মুসলমানদের করণীয়” শিরোনামে আলকাউসারে মুফতি আবুল হাসান আব্দুল্লাহ সাহেবের একটি প্রবন্ধ এসেছে। গাজীপুরের এক পোশাক কারখানায় নামায বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। বিভিন্ন মহলের আপত্তির কারণে মালিক শেষে এ আইন উঠিয়ে নেয়। এ প্রসঙ্গে হুজুরের প্রবন্ধটি। এ ধরনের বিষয়ে মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেছেন। আমরা হুজুরকে অভিনন্দন জানাই। আল্লাহ তাআলা উনার খেদমত কবুল করেন। জাযায়ে খায়র দান করেন। তবে কয়েকটি বিষয়ে আমার আপত্তি হচ্ছে। সেটিই বলতে চাচ্ছি।
এক.
বিরোধী মহলের দাবি ছিল ‘নামায বাধ্যতামূলক করা সংবিধান পরিপন্থী’। তাই নামায বাধ্যতামূলক করা যাবে না। হুজুর দেখাতে চেয়েছেন যে, নামায বাধ্যতামূলক করা সংবিধান পরিপন্থী নয়। হুজুর বলেন,
“বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও আছে, ধর্মীয় স্বাধীনতার কথাও আছে। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার অধিকারের কথাও আছে। ইসলামে কালেমার পর সবচেয়ে বড় ইবাদত নামায। যথাসময় নামায পড়তে হয়। ইসলামে জামাতের সাথে নামায পড়ার নির্দেশনা রয়েছে এবং নামায পড়ার জন্য এটাই সর্বোত্তম পন্থা। তাই একটা কারখানার মুসলিম কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য জামাতের সাথে নামায পড়ার এই নির্দেশনা ও ব্যবস্থাপনাকে এদেশের সংবিধান অনুযায়ীই ‘সংবিধান-বিরোধী’ বলা যায় না। সংবিধানের মূলনীতির সাথে মুসলমানদের জন্য নামায পড়ার নির্দেশনাকে ‘সংবিধান-বিরোধী’ দাবি করাটা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।”
মন্তব্য
# ঈমানের পর যে নামাযের স্থান, সে নামায যে সংবিধান বিরোধী নয় সেটা প্রমাণ করতে হয় যে দেশে, সে দেশ কতটুকু ইসলামী আর সে দেশের সরকার কতটুকু ঈমানদার- সকলের ভাবা দরকার। সে সরকারের আনুগত্যের কি বিধান সেটাও চিন্তার বিষয়। সে শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে উগ্রপন্থা হবে কি’না দেখার বিষয়।
# আজ নামায বাধ্যতামূলক করার বিরোধীতা হয়েছে। এটি তো এক দিনে হয়নি। ইসলামের অসংখ্য বিধান, বরং বলতে গেলে সকল বিধান শুরু থেকেই সংবিধান বিরোধী ছিল।
সংবিধানের মূলনীতি হলো, ‘ধর্মীয় আইনের যতটুকু সংবিধানের অনুমোদনের বাহিরে সেগুলো বাতিল বলে গণ্য’। আর সংবিধান তো চার কুফরি মতবাদ: পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা তখন সংবিধানের সমালোচনা করিনি। জিহাদ ও ইসলামী শাসন যে সংবিধান বিরোধী ছিল তখন আমরা এর প্রতিবাদ করিনি। বরং যারা ইসলামী শাসন কায়েমের জন্য জিহাদে নেমেছেন তাদের সমালোচনা করেছি, উগ্রপন্থী, জযবাতি আখ্যা দিয়েছি। সেটারই কর্মফল আজ- নামায সংবিধান বিরোধী।
দুই.
হুজুর বলেছেন,
“সংবিধান কোনো অমোঘ বিষয় নয়। এটা অনেকবার সংশোধন হয়েছে। নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়া বা প্রাধান্য নির্ণয়ের সুবিধার প্রয়োজনে সংবিধান ভবিষ্যতেও সংশোধন করা যেতে পারে।”
মন্তব্য
হুজুর সাহস করে সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন। আমরা হুজুরকে সাধুবাদ জানাই। তবে এখানে একটা সূক্ষ্ম কথা না বলে পারা যায় না। সেটা হল:
সংবিধানের ভিত্তি কুফরের উপর। এটি ভিন্ন একটি কুফরি ধর্ম। এর কিছু আইন, কিছু ধারা সংশোধনের আহ্বান জানানো তো তাওহিদ পরিপন্থী। তাওহিদের দাবি তো ছিল, এ কুফরি সংবিধান এবং কুফরি শাসন বিলুপ্ত করে আল্লাহর শাসন জারি করার আওয়াজ তোলা। যারা এ শাসনের বিরোধীতা করবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঝাণ্ডা উত্তোলন করা। সংবিধান বহাল রেখে সময়ে সময়ে পরিবর্তন করার আহ্বান বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুন্দর মনে হলেও আসলে এটি একটি কুফরি দাবি।
আসতাগফিরুল্লাহ! আমি একথা বলছি না যে, হুজুর কুফরি দাবি করেছেন। আমি শুধু বাস্তবতাটা তুলে ধরতে চাচ্ছি যে, তাওহিদের দাবি কোনটি। অধিকন্তু হুজুর সংবিধান বহাল রাখার পক্ষে না। তবে অপারগতার হালতে যতটুকু পেরেছেন বলেছেন।
তিন.
হুজুর বলেছেন,
“মুসলমানদের জন্য অবশ্য-পালনীয় ধর্মীয় বিধান এবং সংবিধানের কোনো নীতির মধ্যে যদি বিরোধ তৈরি হয় বা তৈরি করা হয় তখন মুসলিম নাগরিকদের মতামত থেকে তাদের ‘প্রাধান্য’ বেছে নিতে দিন। যেমন, আমরা ধরে নিলাম, দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য এমন কোনো নীতি বা বিধি চালু করল, যেটা ইসলামী আইন ও শরীয়তেরই বিষয়, আবার অপরদিকে কেউ কেউ মতামত দিলেন যে, ওই নীতি বা বিধিটি সংবিধান-বিরোধী, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের করণীয় হল, নাগরিকদের জিজ্ঞাসা করা যে, তারা কী করতে চান।”
মন্তব্য
কথাটা বাহ্যত সুন্দর মনে হলেও বাস্তবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কুফরি আইন আর ইসলামী আইনের কোনো একটা বেছে নেয়ার অপশন দেয়া হবে? নাউজুবিল্লাহি মিন যালিক। যারা ইসলাম কায়েম না করে ইসলাম ও কুফর একটা বেছে নেয়ার অপশন দেবে তাদের ঈমানের কি হবে? রেজা বিল কুফর তো স্পষ্ট যে, জনগণ কুফর চাইলে কুফর প্রতিষ্ঠা করবে, আর ইসলাম চাইলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে। যে শাসক এ ধরনের অপশন দেবে তার ঈমান থাকবে কি? আর আমি একজন মুমিন হয়ে এ ধরনের অপশন দাবি করবো, না’কি সরাসরি ইসলাম কায়েমের দাবি করবো?
হুজুর পরক্ষণেই অবশ্য বলেছেন,
“এটা প্রায় বিদিত যে, এজাতীয় পরিস্থিতিতে মুসলিম নাগরিকরদের মত ও ভাষ্য হবে ইসলামী বিধি বহাল রাখা হোক এবং সংবিধান সংশোধন করা হোক। তারা এমন বলবেন না যে, শরীয়তের ওই আইন বা বিধিটি বন্ধ বা স্থগিত করা হোক, যেমনটি বলার অধিকার আসলে কারো নেই।”
জনগণ পরে ইসলাম মেনে নেবে কি নেবে না সেটা পরের কথা। কিন্তু আগে কথা হলো, ঈমান কুফরের এ পুলসিরাতে দাঁড় করানো জায়েয হবে কি? তখন যদি কিছু লোক কুফর বেছে নেয় তাহলে এর দায় কে নেবে? এজন্য দাবি এমনটা হবে না। দাবি হবে, আমরা ইসলাম চাই। এর বিপরীতে সবকিছু প্রত্যাখ্যিত। যেসব শাসক ইসলামে রাজি হবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। এটাই মুমিনের দাবি। এটাই তাওহিদের দাবি। ঈমান কুফরের সন্ধিস্থলে দাঁড় করানোর কথা বলবেন না দয়া করে।
আরো মজার কথা হল, জনগণ ইসলাম বেছে নেবে এ ভয়েই হয়তো শাসকগোষ্ঠী জনগণকে এ দাবির সুযোগটুকুও দেয় না। তখন আপনা আপনিই প্রশ্ন এসে যায়, যেসব শাসকগোষ্ঠী কুফরের বিপরীতে আল্লাহর আইনের দাবিটুকুও জানাতে দেয় না তারা কি ঈমানদার? তারা কি আমীরুল মুমিনিন? তাদেরও কি আনুগত্য করতে হবে? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো বড়ই দরকার ছিল।
চার.
হুজুর বলেন,
“আমরা মনে করি, প্রত্যেক অফিস-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে এমন আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা রাখা দরকার, যেন মুসলমান শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা যথাসময়ে নামায পড়ার সুযোগ পান। যেন ইসলাম পালনে কারো কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। নামাযের জন্য বিরতিসহ এমন ব্যবস্থাপনা যেন সব জায়গায় রাখা হয় যে, মানুষ প্রশান্তির সঙ্গে নামায ও অন্যান্য ইবাদত করতে পারে। এমনকি আমরা এ-ও বলি, ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা যদি চায়, যথাসময়ে তাদের ধর্ম পালনেরও সুযোগ তাদের দেওয়া হোক।”
মন্তব্য
ভিন্ন ধর্মের কুফরের প্রসারের দাবিটা না জানালে ভাল হতো। কাফেরকে যদি কুফর পালনের সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে এটা তো খুশির কথা। সেখানে আমরা নিজ থেকে কিভাবে দাবি করছি, কাফেরকেও কুফর করার সুযোগ দেয়া হোক? হুজুর এ দাবিটা না জানালেও পারতেন। দাবিটা জানাতে হুজুরকে কেউ চাপ দেয়নি। আল্লাহর যমিনে আল্লাহ বিদ্রোহের এ দাবি বড় ভয়ানক ঠেকছে।
***
আবেদন: সকলের কাছে দাবি থাকবে- জযবার তাড়নায় কেউ যেন অশোভন কমেন্ট না করি।
Comment