তাহরিদ না তানফির: এই কি নবীর ওয়ারিশদের ফরিজা?
আল্লাহ তাআলা তার নবীকে আদেশ দিয়ে ইরশাদ করেন,
{ يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتَالِ} [الأنفال: 65]
“হে নবী, আপনি মুমিনগণকে কিতালে উৎসাহিত করুন।” -আনফাল: ৬৫
“হে নবী, আপনি মুমিনগণকে কিতালে উৎসাহিত করুন।” -আনফাল: ৬৫
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
{فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلَّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ} [النساء: 84]
“সুতরাং (হে নবী) আপনি (একাকী হলেও) আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করুন। আপনার উপর আপনার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না। তবে আপনি মুমিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উৎসাহ দিতে থাকুন।”- নিসা ৮৪
“সুতরাং (হে নবী) আপনি (একাকী হলেও) আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করুন। আপনার উপর আপনার নিজের ছাড়া অন্য কারো দায়ভার বর্তাবে না। তবে আপনি মুমিনদেরকে (জিহাদের জন্য) উৎসাহ দিতে থাকুন।”- নিসা ৮৪
এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদেশ দিচ্ছেন, তিনি যেন মুমিনগণকে কিতালে উৎসাহিত করেন, উদ্বুদ্ধ করেন।
হাফেজ ইবনে কাসির রহ. (৭৭৪ হি.) বলেন,
ولهذا كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يحرض على القتال، عند صفهم ومواجهة العدو. -تفسير ابن كثير ط العلمية (4/ 76)
“এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম যখন যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হতেন এবং শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কিতালের প্রতি উৎসাহিত করে তুলতেন।”- তাফসিরে ইবনে কাসির: ৪/৭৬
“এ কারণেই সাহাবায়ে কেরাম যখন যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হতেন এবং শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে কিতালের প্রতি উৎসাহিত করে তুলতেন।”- তাফসিরে ইবনে কাসির: ৪/৭৬
অর্থাৎ- ওয়াল্লাহু আ’লাম- সাধারণ হালতে তো জিহাদের তারগিব দিতেনই, এ ধরনের বিশেষ হালতে বিশেষভাবে তারগিব দিতেন।
জিহাদে উৎসাহিত করা ফরয
ইবনুল হুমাম রহ. (৮৬১ হি.) বলেন,
واعلم أن التحريض واجب للنص المذكور. -فتح القدير للكمال ابن الهمام (5/ 510)
“শোনো, (সূরা আনফালের) উপরোক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে (হুকুম এই সাব্যস্ত হয় যে,) তাহরিদ (তথা জিহাদে উৎসাহ দেয়া) ফরয।” –ফাতহুল কাদির: ৫/৫১০
“শোনো, (সূরা আনফালের) উপরোক্ত আয়াতের প্রেক্ষিতে (হুকুম এই সাব্যস্ত হয় যে,) তাহরিদ (তথা জিহাদে উৎসাহ দেয়া) ফরয।” –ফাতহুল কাদির: ৫/৫১০
তাহরিদ – التحريض কাকে বলে?
জিহাদে উৎসাহ দেয়ার নির্দেশে আল্লাহ তাআলা حَرِّضِ নির্দেশসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন। حَرِّض ফে’লটির মাসদার: التحريض। এটি এসেছে حَرَضٌ থেকে।
حَرَضٌ বলা হয়, মাত্রাতিরিক্ত রোগ-শোক, পেরেশানি বা কারও মুহাব্বাতে কোনো ব্যক্তি তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। শরীর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া, চলার শক্তি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাওয়া এবং দিল-দেমাগ-স্মৃতি সব নষ্ট হয়ে মূমুর্ষ অবস্থায় বিছানায় পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনা।
حَرَضٌ মূলত মাসদার হলেও সিফাত হিসেবেও ব্যবহার হয়। দীর্ঘ রোগ শোকে তিলে তিলে নিঃশেষিত শক্তিহীন স্মৃতিহীন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত জরাজীর্ণ মূমুর্ষ ব্যক্তিকে বলা হয় حَرَضٌ।[1] -তাফসিরে ইবনে আতিয়া: ৩/২৭৩
হারানো ইউসুফ আলাইহিস সালামের চিন্তায় ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এমনি পরিণতি হতে পারে বলে তার অন্য ছেলেরা আশঙ্কা করছিল।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وَابْيَضَّتْ عَيْنَاهُ مِنَ الْحُزْنِ فَهُوَ كَظِيمٌ (84) قَالُوا تَاللَّهِ تَفْتَأُ تَذْكُرُ يُوسُفَ حَتَّى تَكُونَ حَرَضًا أَوْ تَكُونَ مِنَ الْهَالِكِينَ (85)} [يوسف: 84، 85]
“তার চোখ দু’টি (ইউসুফের) শোকে (কাঁদতে কাঁদতে) সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি অসহনীয় মনস্তাপে ছিলেন ক্লিষ্ট। তার ছেলেরা বলতে লাগলো, আল্লাহর কসম (মনে তো হচ্ছে) আপনি সদা সর্বদা ইউসুফের স্মরণেই লেগে থাকবেন, শেষে মরণাপন্ন হয়ে পড়বেন, কিংবা (বিলকুল) মারাই যাবেন।” -ইউসুফ: ৮৪-৮৫
“তার চোখ দু’টি (ইউসুফের) শোকে (কাঁদতে কাঁদতে) সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি অসহনীয় মনস্তাপে ছিলেন ক্লিষ্ট। তার ছেলেরা বলতে লাগলো, আল্লাহর কসম (মনে তো হচ্ছে) আপনি সদা সর্বদা ইউসুফের স্মরণেই লেগে থাকবেন, শেষে মরণাপন্ন হয়ে পড়বেন, কিংবা (বিলকুল) মারাই যাবেন।” -ইউসুফ: ৮৪-৮৫
حَرِّض – এর দুই অর্থ
বাংলায় حَرِّضِ অর্থ হবে: তাহরিদ (التحريض) কাজটি আপনি করুন। التحريض মাসদারটি حَرَضٌ মাসদার থেকে এসেছে। উপরে যেটি বলা হয়েছে সেটি حَرَضٌ এর অর্থ। এটি যখন বাবে তাফয়িলে যাবে (التفعيل) তখন এর অর্থ কি হবে?
মুফাসসিরিনে কেরাম এর দু’টি অর্থ বলেছেন,
এক. আপনি মুমিনদেরকে حَرَضٌ-এ নিপতিত করুন। তাদের অন্তরকে বিগলিত করে একেবারে অক্ষম বানিয়ে ফেলুন। মূমুর্ষ ব্যক্তির যেমন উঠার শক্তি নাই, আপনিও এমন হৃদয়গ্রাহী ও তেজস্বী ভাষায় জিহাদের তারগিব দিন, ওয়াজ করুন; যেন মুমিনরা আপনার তারগিবের সামনে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়ে যে, কিতালে বের না হয়ে থাকা তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না হয়। আপনার ওয়াজে প্রভাবিত হয়ে তারা পাগলপারা হয়ে জিহাদের পানে ছুটবে।[2] -তাফসিরে মাজহারি: ৪/১১০
দুই. কিংবা উদ্দেশ্য: আপনি মুমিনদের থেকে حَرَضٌ বিদূরিত করুন। মরা দেহে প্রাণ সঞ্চার করুন। মরা প্রাণে শক্তি সঞ্চার করুন। একজন চিকিৎসক যেমন ওষুধ-পথ্য দিয়ে মূমুর্ষ রোগীকে বাঁচিয়ে তুলেন, আপনার সম্মোহনী ওয়াজে এভাবেই মুমিনদের জাগিয়ে তুলুন। যেন দুনিয়ার সব সম্মোহন পরিত্যাগ করে তারা জান মাল নিয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।[3] -রুহুল মাআনি: ৫/২২৬
যে ব্যাখ্যাই ধরি, উদ্দেশ্য একটাই: উম্মাহর সামনে জিহাদের ওয়াজ এমনভাবে করতে হবে, যেন উম্মাহ মনে গেঁথে যায়, জিহাদ ছাড়া কোনো উপায় নাই। জিহাদ পরিত্যাগ মানেই মরণ। জিহাদ পরিত্যাগকে তারা মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয় করবে। অকুণ্ঠচিত্তে জিহাদের রাহে জান মাল সমর্পণ করবে।
তাবলিগের জন্য যেভাবে সাথী তাশকিল করা হয়, কিংবা মাহফিলে যেভাবে মসজিদ মাদ্রাসার জন্য অর্থকড়ি, চাউলের বস্তা, সিমেন্টের বস্তা কালেকশান করা হয়: এভাবে যদি জিহাদের জন্য লোক তাশকিল করা হতো, তাহলে হয়তো আল্লাহর ফরযকৃত তাহরিদের এ ফরিজা কিছুটা আদায় হতো।
কিন্তু দুঃখজনক, জাতির রাহবার স্তরের অনেকে; জিহাদ ও খিলাফাহর পথের পথিকদের এমন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছেন, তাদের নামে মাজহুল উৎস থেকে শ্রুত এমনসব মিথ্যা বানোয়াট কথা ছাড়াচ্ছেন, যাতে তাহরিদের স্থলে তানফির হচ্ছে। আল্লাহর ফরযকৃত এ জিহাদের বিধানটি থেকে বুঝে না বুঝে মানুষ আরও দূরে সরে যাচ্ছে। যদি আল্লাহ তাআলা ই’সান করে পথ না দেখান, জিহাদ-সিয়াসাহ-খিলাফাহ-ইকামাতে দ্বীনের ব্যাপারে হক পথের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব ব্যাপারই হয়ে দাঁড়াবে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
***
(চলবে ইনশাআল্লাহ …)
[1] و «الحرض» : الذي قد نهكه الهرم أو الحب أو الحزن إلى حال فساد الأعضاء والبدن والحس، وعلى هذا المعنى قراءة الجمهور «حرضا» بفتح الراء والحاء ... وقرأ الحسن بن أبي الحسن بضمهما، وقرأت فرقة «حرضا» بضم الحاء وسكون الراء. وهذا كله المصدر يوصف به المذكر والمؤنث والمفرد والجمع بلفظ واحد. -تفسير ابن عطية = المحرر الوجيز في تفسير الكتاب العزيز (3/ 273)
[2] يا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى الْقِتالِ اى بالغ في حثهم عليه واصل الحرض ان ينهكه المرض حتى يشرفه على الهلاك كان المبالغ في الحث على الأمر يجعل المأمور عاجزا مضطرا الى فعله كما يجعل المرض عاجزا مضطرا الى الهلاك. -التفسير المظهري (4/ 110)
[3] وقال الزجاج: هو في اللغة أن يحث الإنسان على شيء حتى يعلم منه أنه حارض أي مقارب للهلاك، وعلى هذا فهو للمبالغة في الحث، وزعم في الدر المصون أن ذلك مستبعد من الزجاج، والحق معه، ويؤيده ما قاله الراغب من أن الحرض يقال لما أشرف على الهلاك والتحريض الحث على الشيء بكثرة التزيين وتسهيل الخطب فيه كأنه في الأصل إزالة الحرض. -تفسير الألوسي = روح المعاني (5/ 226)
Comment