নব্য জাহেলিয়াতের মূর্তিঃ লিবারেলিজম বা উদারনৈতিকতা! ১
উস্তাদ ইয়াহিয়া আব্দুল হাফিজ
জাহেলি যুগে আরবের মুশরিকরা অসংখ্য মূর্তির উপাসনা করতো। তিনশ ষাটটির মতো মূর্তি তারা বাইতুল্লাহর অভ্যন্তরে এবং এর আশাপাশে স্থাপন করে রেখেছিল। তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় মূর্তিটি ছিল হুবাল। হুবালের পর তাদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল তিনটি নারী মূর্তি – লাত, মানাত ও উযযা।
বর্তমানেও আমরা দেখতে পাই, আরব্য জাহেলিয়াতের মতো নব্য জাহেলিয়াতেরও তিন মূর্তি রয়েছে। গনতন্ত্র, সেকুলারিজম ও লিবারেলিজম।
জাহেলি যুগে যেমন তখনকার মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাসে লাত, মানাত ও উযযা একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল ঠিক তেমন নব্য জাহেলিয়াতের তিনটি মূর্তিও একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের আজকের আলোচনা এই ত্রিমূর্তির সরৃবশেষটিকে নিয়ে।
পরিচয়
লিবারেলিজমের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এসব সংজ্ঞায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। বিভিন্ন ধ্যানধারণা, ব্যাখ্যা, প্রয়োগের নীতি যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে লিবারেলিজম শব্দটি দ্বারা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদি বুঝানো হয়ে থাকে।
যেমন অর্থনীতিশাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে অর্থনৈতিক উদারনৈতিকতাবাদ (Economic Liberalism) কিংবা উদারনৈতিক পুঁজিবাদ (Liberal Capitalism) বলা হয়। এই নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগত পলিসিকে লিবারেল বলা হয়।
একইভাবে বর্তমান গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারাকে উদারনৈতিক বা লিবারেল রাজনীতি বলা হয়। যেমন আমেরিকার দুই প্রধান দলের মধ্যে অনেকে রিপাবলিকান দলকে রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল এবং ডেমোক্রেটিক দলকে লিবারেল আখ্যায়িত করে।
একইভাবে কেউ হয়তো ব্রিটেনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে টোরি পার্টিকে রক্ষণশীল এবং লেবার পার্টিকে লিবারেল বলতে পারেন।
তেমনিভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকে আওয়ামী লীগকে তুলনামূলকভাবে লিবারেল এবং বিএনপিকে রক্ষনশীল ও জাতীয়তাবাদী ধারার বলে থাকেন।
এই প্রবন্ধে আমরা যখন "লিবারেলিজম বা লিবারেল " শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি, তখন উপরোক্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা রাজনৈতিক ধারাকে বুঝাচ্ছি না।
লিবারেলিজম বলতে আমরা বুঝাচ্ছি একটি বৃহত্তর নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে, যে দর্শনের জন্ম হয়েছে ইউরোপের রেনেসা, প্রটেস্টান্ট রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্টের গর্ভ থেকে।
আমরা যে বৃহত্তর অর্থে লিবারেলিজম নিয়ে আলোচনা করছি সে দিক থেকে রিপাবলিকান-ডেমোক্রেট, টোরি-লেবার, আওয়ামী-বিএনপি- সকলেই লিবারেল ধারার অনুসারী। আধুনিক পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে কাঠামো আজ আমরা দেখি মোটাদাগে তার পুরোটাই লিবারেল।
লিবারেল দর্শনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (individualism), ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের নীতি।
এই মূলনীতিগুলো থেকে পরবর্তী সময় বাকস্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তা, যৌনতার স্বাধীনতা, লৈঙ্গিক সমতার মতো বিভিন্ন ধারণা উদ্ভূত হয়।
বর্তমানে লিবারেলিজমের ধারণার সাথে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ এবং সেক্যুলার শাসন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে লিবারেলিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিল ব্রিটিশ থমাস হবস (মৃত্যু. ১৬৭৯ ইং) ও জন লক (মৃত্যু. ১৭০৪ ইং)। তারা সর্বপ্রথম ব্যক্তির কর্মের চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এবং সামাজিক চুক্তি তথা সোশাল কন্ট্রাক্টের ধারণাকে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করে।
এর মধ্যে জন লককে অনেকেই সর্বপ্রথম লিবারেল দার্শনিক হিসাবে গণ্য করে থাকে। পরে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে লিবারেলিজম প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই পর্যায়ের লিবারেলিজমের সাথে লিবারেলিজমের আজকের চেহারার বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। তবে উভয়ের মৌলিক কাঠামো এক। ভলতেয়ার (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) ও রুশোর (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) মতো ফরাসী দার্শনিকরা এই পর্যায়ে লিবারেল দর্শনে নতুন কিছু মাত্রা যোগ করে।
বিশেষ করে জনমত, সরকার এবং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু ধারণা যুক্ত হয় যা পরবর্তীতে লিবারেল দর্শনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠে। পরবর্তী সময় ইমানুয়েল কান্ট (মৃত্যু. ১৮০৪ ইং), বেন্থাম (মৃত্যু. ১৮৩২ ইং), জন স্টুয়ার্ট মিলসহ (মৃত্যু. ১৮৭৩ ইং) বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং আমেরিকান দার্শনিক লিবারেল দর্শনের ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে।
চলবে ইন শা আল্লাহ....
সূত্রঃ darulilm.org
উস্তাদ ইয়াহিয়া আব্দুল হাফিজ
জাহেলি যুগে আরবের মুশরিকরা অসংখ্য মূর্তির উপাসনা করতো। তিনশ ষাটটির মতো মূর্তি তারা বাইতুল্লাহর অভ্যন্তরে এবং এর আশাপাশে স্থাপন করে রেখেছিল। তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও জনপ্রিয় মূর্তিটি ছিল হুবাল। হুবালের পর তাদের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিল তিনটি নারী মূর্তি – লাত, মানাত ও উযযা।
বর্তমানেও আমরা দেখতে পাই, আরব্য জাহেলিয়াতের মতো নব্য জাহেলিয়াতেরও তিন মূর্তি রয়েছে। গনতন্ত্র, সেকুলারিজম ও লিবারেলিজম।
জাহেলি যুগে যেমন তখনকার মুশরিকদের আকিদা-বিশ্বাসে লাত, মানাত ও উযযা একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল ঠিক তেমন নব্য জাহেলিয়াতের তিনটি মূর্তিও একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমাদের আজকের আলোচনা এই ত্রিমূর্তির সরৃবশেষটিকে নিয়ে।
পরিচয়
লিবারেলিজমের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এসব সংজ্ঞায় নানা পরিবর্তনও এসেছে। বিভিন্ন ধ্যানধারণা, ব্যাখ্যা, প্রয়োগের নীতি যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে লিবারেলিজম শব্দটি দ্বারা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক দর্শন ইত্যাদি বুঝানো হয়ে থাকে।
যেমন অর্থনীতিশাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে অর্থনৈতিক উদারনৈতিকতাবাদ (Economic Liberalism) কিংবা উদারনৈতিক পুঁজিবাদ (Liberal Capitalism) বলা হয়। এই নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আগত পলিসিকে লিবারেল বলা হয়।
একইভাবে বর্তমান গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারাকে উদারনৈতিক বা লিবারেল রাজনীতি বলা হয়। যেমন আমেরিকার দুই প্রধান দলের মধ্যে অনেকে রিপাবলিকান দলকে রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল এবং ডেমোক্রেটিক দলকে লিবারেল আখ্যায়িত করে।
একইভাবে কেউ হয়তো ব্রিটেনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে টোরি পার্টিকে রক্ষণশীল এবং লেবার পার্টিকে লিবারেল বলতে পারেন।
তেমনিভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকে আওয়ামী লীগকে তুলনামূলকভাবে লিবারেল এবং বিএনপিকে রক্ষনশীল ও জাতীয়তাবাদী ধারার বলে থাকেন।
এই প্রবন্ধে আমরা যখন "লিবারেলিজম বা লিবারেল " শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি, তখন উপরোক্ত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা রাজনৈতিক ধারাকে বুঝাচ্ছি না।
লিবারেলিজম বলতে আমরা বুঝাচ্ছি একটি বৃহত্তর নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে, যে দর্শনের জন্ম হয়েছে ইউরোপের রেনেসা, প্রটেস্টান্ট রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্টের গর্ভ থেকে।
আমরা যে বৃহত্তর অর্থে লিবারেলিজম নিয়ে আলোচনা করছি সে দিক থেকে রিপাবলিকান-ডেমোক্রেট, টোরি-লেবার, আওয়ামী-বিএনপি- সকলেই লিবারেল ধারার অনুসারী। আধুনিক পশ্চিমা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যে কাঠামো আজ আমরা দেখি মোটাদাগে তার পুরোটাই লিবারেল।
লিবারেল দর্শনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (individualism), ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের নীতি।
এই মূলনীতিগুলো থেকে পরবর্তী সময় বাকস্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তা, যৌনতার স্বাধীনতা, লৈঙ্গিক সমতার মতো বিভিন্ন ধারণা উদ্ভূত হয়।
বর্তমানে লিবারেলিজমের ধারণার সাথে ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ এবং সেক্যুলার শাসন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে লিবারেলিজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিল ব্রিটিশ থমাস হবস (মৃত্যু. ১৬৭৯ ইং) ও জন লক (মৃত্যু. ১৭০৪ ইং)। তারা সর্বপ্রথম ব্যক্তির কর্মের চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এবং সামাজিক চুক্তি তথা সোশাল কন্ট্রাক্টের ধারণাকে ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করে।
এর মধ্যে জন লককে অনেকেই সর্বপ্রথম লিবারেল দার্শনিক হিসাবে গণ্য করে থাকে। পরে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে লিবারেলিজম প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই পর্যায়ের লিবারেলিজমের সাথে লিবারেলিজমের আজকের চেহারার বেশ কিছু পার্থক্য ছিল। তবে উভয়ের মৌলিক কাঠামো এক। ভলতেয়ার (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) ও রুশোর (মৃত্যু. ১৭৭৮ ইং) মতো ফরাসী দার্শনিকরা এই পর্যায়ে লিবারেল দর্শনে নতুন কিছু মাত্রা যোগ করে।
বিশেষ করে জনমত, সরকার এবং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু ধারণা যুক্ত হয় যা পরবর্তীতে লিবারেল দর্শনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠে। পরবর্তী সময় ইমানুয়েল কান্ট (মৃত্যু. ১৮০৪ ইং), বেন্থাম (মৃত্যু. ১৮৩২ ইং), জন স্টুয়ার্ট মিলসহ (মৃত্যু. ১৮৭৩ ইং) বিভিন্ন ইউরোপীয় এবং আমেরিকান দার্শনিক লিবারেল দর্শনের ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে।
চলবে ইন শা আল্লাহ....
সূত্রঃ darulilm.org
Comment