মাসিক আলকাউসার, যিলকদ ১৪৪১ || জুলাই ২০২০ সংখ্যায় ‘হজ্ব নিয়ে স্বেচ্ছাচার এবং সৌদি সরকারের অধিকার’ শিরনামে মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ সাহেব দা.বা. একটি লিখা দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির বাহানা তুলে স্বেচ্চাচারি সৌদি সরকার হজ্ব-উমরা বন্ধ করে দেয়ায় বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে যে আঘাত লেগেছে, সে বেদনা কিঞ্চিত তুলে ধরেছেন তিনি এ লেখাতে। আলহামদুলিল্লাহ লেখাটিতে তিনি বেশ কয়েকটি সত্য কথা তুলে ধরেছেন। সবার জন্য এগুলো জেনে রাখা ভালই নয় বরং জরুরীই বলা যায়।
এক.
ব্রিটিশদের সাথে আঁতাত করে সৌদি শাসনের গোড়াপত্তন
হুজুর বলেন,
“প্রসঙ্গত এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যে, সৌদি আরবের উত্থান অথবা অন্য শব্দে বললে, জাযীরাতুল আরবে সৌদি শাসকদের দখল ও বিজয়ের পর্বটিকে সমগ্র দুনিয়ার মুসলিম মনীষীরা দুঃখ ও বেদনা নিয়েই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম মনীষীরা গভীর মর্মবেদনা অনুভব করেছিলেন এজন্য যে, বর্তমান সৌদি শাসকদের পূর্ব-পুরুষেরা উসমানী সালতানাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, বৃটিশ শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আর এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম নেতৃত্ব ও মুসলিম মনীষীরা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন, তুরস্কভিত্তিক ইসলামী খেলাফত টিকে থাকুক। সেসময় খেলাফতের প্রতিনিধিদের সরিয়ে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠাতাদের ক্ষমতা দখলের ঘটনাটিকে ভালো চোখে দেখার সুযোগ ছিল না। এসব কারণে সৌদি আরবের প্রতি মুসলিম বিশ্বের মনীষীদের বিরূপ ধারণা ও মূল্যায়ন বহাল ছিল”।
হুজুর এখানে বড় সত্যটি তুলে ধরেছেন যে, সৌদি রাষ্ট্র মূলত ব্রিটিশদের সহায়তায় ব্রিটিশদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্য অর্থে বললে, ব্রিটিশদের দালালীর মাধ্যমে এ রাষ্ট্রটির উৎপত্তি।
এর পরের অবস্থার দিকে হুজুর সামান্য ঈঙ্গিত করেছেন। বিস্তারিত বলেননি। তবে চক্ষুষ্মান কারো কাছেই এদের দালালীর বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। উসমানী সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তথা মুসলিমদের রক্তের উপর দিয়ে এ রাষ্ট্রের উৎপত্তি। এরপর থেকে তারা তাদের প্রভুদের দালালী যথাযথভাবেই করে আসছে। এ দালালীর বড় অংশ ইজরাইলের নিরাপত্তা দেয়া। ইজরাইলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। এদের কারণেই আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত।
ব্রিটিশদের দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন আমেরিকা মঞ্চে আসে, তখন তারা আমেরিকাকে প্রভু বলে গ্রহণ করে নেয়। এরপর ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার সৈনিক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে অদ্যাবধি তারা তাদের গোলামির দায়িত্ব পালন করে আসছে ওয়াফাদারির সাথে। বলা যায়, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু সৌদি আরব ও পাকিস্তান।
দুই.
এরা আমেরিকাকে জাজিরাতুল আরবে দখলদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছে
হুজুর বলেন,
“বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে বা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে বিজাতি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সৈন্য বাহিনীকে তো আগেই অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে।”
বর্তমান সৌদি আরব মূলত আমেরকার দখলে। হাজার হাজার আমেরিকান সৈন্যের বিশাল বিশাল ঘাঁটি সৌদি আরবে। ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে নিরাপত্তা বজায় রাখার অজুহাতে তারা আমেরিকানদের দাওয়াত দিয়ে সৌদি আরবে নিয়ে আসে। আমেরিকা যদি যুদ্ধের মাধ্যমে জাজিরাতুল আরব দখল করতো তাহলে মুসলিম বিশ্ব অবশ্যই তা প্রতিরোধ করতো। কিন্তু তারা ভিন্ন চাল চেলেছে। নিজেদের নিরাপত্তার বাহানা তুলে জাজিরাতুল আরব কাফেরদের হাতে তুলে দিয়েছে। অথচ একবার ঘোষণা করে দিলে সারা দুনিয়ার মুসলিম যুবকরা হারামাইন রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে ময়দানে নেমে পড়তো। এক সাদ্দাম কেন, হাজারো সাদ্দামও হারামাইনের সীমায় পা দিতে পারতো না। কিন্তু কিসের হারামাইনের নিরাপত্তা?? আসল উদ্দেশ্য ছিল, প্রভুদের নির্দেশ অনুযায়ী হারামাইনকে কাফেরদের হাতে তুলে দেয়া। সেটিই তারা করেছে। এজন্য অবশ্য পোষা দরবারি আলেমদের থেকে তারা ফতোয়াও তৈরি করিয়ে নিয়েছিল।
তিন.
এরা পবিত্র হিজায ভূমিকে ইউরোপ বানানো হচ্ছে
হুজুর বলেন,
“রিয়াদের সেই গভর্নর সালমানই এখন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান। অথচ তিনি আর তার ছেলে এমবিএস মিলে এখন তাদের বর্ণিত সেই সৌদি আরবকেই কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! আধুনিকতা আনয়নের নামে সৌদি আরবের দ্বীনী বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বলতাকে কীভাবে তারা ম্লান করে দিচ্ছেন! বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে বা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে বিজাতি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সৈন্য বাহিনীকে তো আগেই অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে। তার সাথে এখন ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাহযীব-তামাদ্দুনের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে।”
আরও বলেন,
“শুরু হল সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ও জীবনাচারে পাশ্চাত্যায়নের খোলামেলা মহড়া। এর আগে বাদশাহ আবদুল্লাহ্র আমলেই লোহিত সাগরের পাড়ে ইউরোপীয় ধাঁচে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সহশিক্ষার পরিবেশপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে সফর হয়েছে আমার। সে যেন পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি অঙ্গন পবিত্র হারামাইনের মাঝামাঝি ভ‚মিতে। আর বর্তমান বাদশাহ ও তার পুত্রের এসব কর্মকাÐ দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল, সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বদলে যেতে পারে। আশংকা করা হচ্ছিল, ওই পবিত্র ভূমি থেকে রূহানিয়াতপূর্ণ পরিবেশ ধীরেধীরে সরে যেতে থাকবে। সেটারই প্রকাশ এখন ঘটছে।”
হুজুর ভদ্র ভাষায় একটু ঈঙ্গিত করেছেন মাত্র। সৌদি যুবরাজগুলো যে কত বড় বড় মদখোর ও যিনাকার সে অশ্লীলতার ইতিহাস তো সু্প্রসিদ্ধ। আর এখন গোটা হিজায ভূমিকে একটা বেশ্বালয়ে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। অনেক দূর এগিয়েও গেছে তারা। নারীর ক্ষমতায়নের নামে যিনার পরিবেশ সুলভ ও সরগরম করার এবং পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করার চক্রান্ত এখন বিশ্ব মুসলিমকে সৌদি শাসন নিয়ে ভাবাতে শুরু করেছে।
চার.
এরা খাদেমুল হারামাইন হওয়ার অযোগ্য
হুজুর বলেন,
“এই যে দ্বীন এবং দ্বীনী চেতনা-বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে সৌদি শাসকদের এত দূরে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং ঘটেছে, এরপর তাদের ‘খাদেমুল হারামাইন আশশারীফাইন’ পরিচিতি বহন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ... হারামাইন শারীফাইনের ব্যবস্থাপনায় তাদের এই ভীতিকাতরতা ও দুর্বলচিত্ততা এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে যে, হারামাইনের খাদেম হওয়ার যোগ্যতা তাদের আছে কি না! এ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না!”
আরও বলেন,
“আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنْ اَوْلِیَآؤُهٗۤ اِلَّا الْمُتَّقُوْنََ.
শুধু মুত্তাকীগণই এর (মসজিদে হারামের) তত্ত¡বধায়ক। -সূরা আনফাল (৮) ৩৪
আমরা দুআ করি, হারামাইন শরীফাইনের ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের হাতে দিন, যারা মুত্তাকী। যারা নেককার, সদাচারী এবং যারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য নয়; শুধু আল্লাহ তাআলাকে রাজি-খুশি করার জন্য কাজ করবেন। অথবা এখন যারা হারামাইন শরীফাইনের দায়িত্বে আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে যোগ্যতা দান করুন। তাদেরকে নেককার বানিয়ে দিন।”
অর্থাৎ এরা মুত্তাকিও নয়, নেককারও নয়, খাদেমুল হারামাইন হওয়ার যোগ্যও নয়।
পাঁচ.
সৌদি শাসন ইসলামী খেলাফত নয়
হুজুর বলেন,
“মক্কা-মদীনা হিজাযে মুকাদ্দাসের এলাকা। এই অঞ্চল ইসলামী খেলাফত ছাড়া অন্য কোনো একক রাষ্ট্রের তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী ইসলামী খেলাফত থাকলে তার অধীনে থাকত হারামাইন।”
আরও বলেন,
“অনেকেই মনে করেন, সৌদি আরবের রাজ্য সৌদিদের কাছেই থাকুক। কিন্তু মক্কা-মদীনা এই দুটি পবিত্র ভূমিকে হজ্ব-ওমরাহ ও যিয়ারতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। সৌদি শাসকদের পরিবর্তে খোদ জাযীরাতুল আরব কোনো ইসলামী খেলাফতের অধীনে এলে তখন অবশ্য ভিন্ন বিষয়। চিরকাল তো এই অবস্থা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ একদিন মুসলমানদের পবিত্র ভূমিগুলো কোনো ইসলামী খেলাফতের আওতায় আসবে। তখন সেই সরকারের সিদ্ধান্ত হবে মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির অনুকূল, ইবাদত-আমলের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল।”
আরও বলেন,
“একটা ভূখÐ দখল বা আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্ব থাকার কারণে হারামাইন শরীফাইনও ওই ভূখণ্ডের ভেতরে থাকায় তাদের একক কর্তৃত্বে থাকতে হবে- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।
হারামাইন বিশ্ব মুসলিমের মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ। মুসলমানদের কোনো খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে হারামাইন তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় যেতে পারে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকা বা ভূখÐকে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো রাজা-বাদশাহ্র আওতায় থাকতে বাধ্য নয়।”
অর্থাৎ সৌদি শাসন ইসলামী খেলাফত নয়। তারা জাজিরাতুল আরবের দখলদার মাত্র। আর হারামাইন গোটা মুসলিম উম্মাহর অধিকার। দখলদার বলে সৌদি সেখানে একক কতৃত্ব খাটানোর অধিকার রাখে না।
ছয়.
হারামাইনেও রয়েছে দরবারি মুফতি
একটি অমোঘ সত্য তুলে ধরে হুজুর বলেন,
“দরবারি কথা নয়, প্রকৃত জনমত শুনুন
.... স্বেচ্ছাচারের পক্ষে অনেক সময় অনুগত লোকজনের সমর্থন পাওয়া যায়; রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশে কিছু লোককে অনুগত বানিয়ে নেওয়া যায় অথবা কিছু লোকের কাছ থেকে শাসকদের মন-মর্জিমতো ‘ফতোয়া’ আদায় করেও নেওয়া যায়; কিন্তু এতে সঠিক মতামত ও জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। দেশে দেশেই বিদ্যমান দরবারি শায়েখ, দরবারি ‘ফতোয়া’। অনেক সময় সরকারের মনোভাব আন্দাজ করে দরবারি লোকেরা অগ্রিম ফতোয়া কিংবা অগ্রিম সাফাই বক্তব্য প্রস্তুত করে রাখে।”
হুজুর যে সত্যটি তুলে ধরেছেন: হারামাইনসহ প্রতিটি দেশেই রয়েছে দরবারি মুফতি। অতএব, সৌদিসহ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মুফতিদের থেকে প্রদত্ত ফতোয়াগুলোকে আমরা বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি না। বিশেষত যখন বর্তমানে অনেক মুফতি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শাসকদের অনুকূলে অগ্রিম অগ্রিম ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে আমরা কিভাবে এসব রাষ্ট্রীয় ফতোয়া বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি?!
ফাঁকে ফাঁকে হুজুর অনেকগুলো সত্য তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা হুজুরকে জাযায়ে খায়র দান করুন। আমীন।
বি.দ্র.
যেসব সত্য হুজুর সৌদির ব্যাপারে তুলে ধরেছেন, সেগুলো যে বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত যখন এসব রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিই সুস্পষ্ট কুফরের উপর। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতিই তার চাক্ষুষ সাক্ষি।
এক.
ব্রিটিশদের সাথে আঁতাত করে সৌদি শাসনের গোড়াপত্তন
হুজুর বলেন,
“প্রসঙ্গত এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যে, সৌদি আরবের উত্থান অথবা অন্য শব্দে বললে, জাযীরাতুল আরবে সৌদি শাসকদের দখল ও বিজয়ের পর্বটিকে সমগ্র দুনিয়ার মুসলিম মনীষীরা দুঃখ ও বেদনা নিয়েই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম মনীষীরা গভীর মর্মবেদনা অনুভব করেছিলেন এজন্য যে, বর্তমান সৌদি শাসকদের পূর্ব-পুরুষেরা উসমানী সালতানাতের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে, বৃটিশ শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আর এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম নেতৃত্ব ও মুসলিম মনীষীরা বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন, তুরস্কভিত্তিক ইসলামী খেলাফত টিকে থাকুক। সেসময় খেলাফতের প্রতিনিধিদের সরিয়ে সৌদি আরব প্রতিষ্ঠাতাদের ক্ষমতা দখলের ঘটনাটিকে ভালো চোখে দেখার সুযোগ ছিল না। এসব কারণে সৌদি আরবের প্রতি মুসলিম বিশ্বের মনীষীদের বিরূপ ধারণা ও মূল্যায়ন বহাল ছিল”।
হুজুর এখানে বড় সত্যটি তুলে ধরেছেন যে, সৌদি রাষ্ট্র মূলত ব্রিটিশদের সহায়তায় ব্রিটিশদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্য অর্থে বললে, ব্রিটিশদের দালালীর মাধ্যমে এ রাষ্ট্রটির উৎপত্তি।
এর পরের অবস্থার দিকে হুজুর সামান্য ঈঙ্গিত করেছেন। বিস্তারিত বলেননি। তবে চক্ষুষ্মান কারো কাছেই এদের দালালীর বিষয়টি অস্পষ্ট নয়। উসমানী সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তথা মুসলিমদের রক্তের উপর দিয়ে এ রাষ্ট্রের উৎপত্তি। এরপর থেকে তারা তাদের প্রভুদের দালালী যথাযথভাবেই করে আসছে। এ দালালীর বড় অংশ ইজরাইলের নিরাপত্তা দেয়া। ইজরাইলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। এদের কারণেই আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত।
ব্রিটিশদের দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন আমেরিকা মঞ্চে আসে, তখন তারা আমেরিকাকে প্রভু বলে গ্রহণ করে নেয়। এরপর ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার সৈনিক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে অদ্যাবধি তারা তাদের গোলামির দায়িত্ব পালন করে আসছে ওয়াফাদারির সাথে। বলা যায়, ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু সৌদি আরব ও পাকিস্তান।
দুই.
এরা আমেরিকাকে জাজিরাতুল আরবে দখলদারিত্বের সুযোগ করে দিয়েছে
হুজুর বলেন,
“বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে বা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে বিজাতি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সৈন্য বাহিনীকে তো আগেই অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে।”
বর্তমান সৌদি আরব মূলত আমেরকার দখলে। হাজার হাজার আমেরিকান সৈন্যের বিশাল বিশাল ঘাঁটি সৌদি আরবে। ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে নিরাপত্তা বজায় রাখার অজুহাতে তারা আমেরিকানদের দাওয়াত দিয়ে সৌদি আরবে নিয়ে আসে। আমেরিকা যদি যুদ্ধের মাধ্যমে জাজিরাতুল আরব দখল করতো তাহলে মুসলিম বিশ্ব অবশ্যই তা প্রতিরোধ করতো। কিন্তু তারা ভিন্ন চাল চেলেছে। নিজেদের নিরাপত্তার বাহানা তুলে জাজিরাতুল আরব কাফেরদের হাতে তুলে দিয়েছে। অথচ একবার ঘোষণা করে দিলে সারা দুনিয়ার মুসলিম যুবকরা হারামাইন রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে ময়দানে নেমে পড়তো। এক সাদ্দাম কেন, হাজারো সাদ্দামও হারামাইনের সীমায় পা দিতে পারতো না। কিন্তু কিসের হারামাইনের নিরাপত্তা?? আসল উদ্দেশ্য ছিল, প্রভুদের নির্দেশ অনুযায়ী হারামাইনকে কাফেরদের হাতে তুলে দেয়া। সেটিই তারা করেছে। এজন্য অবশ্য পোষা দরবারি আলেমদের থেকে তারা ফতোয়াও তৈরি করিয়ে নিয়েছিল।
তিন.
এরা পবিত্র হিজায ভূমিকে ইউরোপ বানানো হচ্ছে
হুজুর বলেন,
“রিয়াদের সেই গভর্নর সালমানই এখন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান। অথচ তিনি আর তার ছেলে এমবিএস মিলে এখন তাদের বর্ণিত সেই সৌদি আরবকেই কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! আধুনিকতা আনয়নের নামে সৌদি আরবের দ্বীনী বৈশিষ্ট্যের উজ্জ্বলতাকে কীভাবে তারা ম্লান করে দিচ্ছেন! বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে বা যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে বিজাতি সুপার পাওয়ার রাষ্ট্রের সৈন্য বাহিনীকে তো আগেই অনেকটা স্থায়ী জায়গা করে দেয়া হয়েছে সৌদি আরবে। তার সাথে এখন ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাহযীব-তামাদ্দুনের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে।”
আরও বলেন,
“শুরু হল সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ও জীবনাচারে পাশ্চাত্যায়নের খোলামেলা মহড়া। এর আগে বাদশাহ আবদুল্লাহ্র আমলেই লোহিত সাগরের পাড়ে ইউরোপীয় ধাঁচে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সহশিক্ষার পরিবেশপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে সফর হয়েছে আমার। সে যেন পুরোপুরি পশ্চিমা সংস্কৃতির একটি অঙ্গন পবিত্র হারামাইনের মাঝামাঝি ভ‚মিতে। আর বর্তমান বাদশাহ ও তার পুত্রের এসব কর্মকাÐ দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল, সৌদি আরবের দ্বীনী সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বদলে যেতে পারে। আশংকা করা হচ্ছিল, ওই পবিত্র ভূমি থেকে রূহানিয়াতপূর্ণ পরিবেশ ধীরেধীরে সরে যেতে থাকবে। সেটারই প্রকাশ এখন ঘটছে।”
হুজুর ভদ্র ভাষায় একটু ঈঙ্গিত করেছেন মাত্র। সৌদি যুবরাজগুলো যে কত বড় বড় মদখোর ও যিনাকার সে অশ্লীলতার ইতিহাস তো সু্প্রসিদ্ধ। আর এখন গোটা হিজায ভূমিকে একটা বেশ্বালয়ে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। অনেক দূর এগিয়েও গেছে তারা। নারীর ক্ষমতায়নের নামে যিনার পরিবেশ সুলভ ও সরগরম করার এবং পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করার চক্রান্ত এখন বিশ্ব মুসলিমকে সৌদি শাসন নিয়ে ভাবাতে শুরু করেছে।
চার.
এরা খাদেমুল হারামাইন হওয়ার অযোগ্য
হুজুর বলেন,
“এই যে দ্বীন এবং দ্বীনী চেতনা-বিশ্বাস ও অবস্থান থেকে সৌদি শাসকদের এত দূরে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং ঘটেছে, এরপর তাদের ‘খাদেমুল হারামাইন আশশারীফাইন’ পরিচিতি বহন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ... হারামাইন শারীফাইনের ব্যবস্থাপনায় তাদের এই ভীতিকাতরতা ও দুর্বলচিত্ততা এ প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছে যে, হারামাইনের খাদেম হওয়ার যোগ্যতা তাদের আছে কি না! এ পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার তাদের আছে কি না!”
আরও বলেন,
“আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنْ اَوْلِیَآؤُهٗۤ اِلَّا الْمُتَّقُوْنََ.
শুধু মুত্তাকীগণই এর (মসজিদে হারামের) তত্ত¡বধায়ক। -সূরা আনফাল (৮) ৩৪
আমরা দুআ করি, হারামাইন শরীফাইনের ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তাআলা এমন লোকদের হাতে দিন, যারা মুত্তাকী। যারা নেককার, সদাচারী এবং যারা অন্য কাউকে খুশি করার জন্য নয়; শুধু আল্লাহ তাআলাকে রাজি-খুশি করার জন্য কাজ করবেন। অথবা এখন যারা হারামাইন শরীফাইনের দায়িত্বে আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে যোগ্যতা দান করুন। তাদেরকে নেককার বানিয়ে দিন।”
অর্থাৎ এরা মুত্তাকিও নয়, নেককারও নয়, খাদেমুল হারামাইন হওয়ার যোগ্যও নয়।
পাঁচ.
সৌদি শাসন ইসলামী খেলাফত নয়
হুজুর বলেন,
“মক্কা-মদীনা হিজাযে মুকাদ্দাসের এলাকা। এই অঞ্চল ইসলামী খেলাফত ছাড়া অন্য কোনো একক রাষ্ট্রের তত্ত¡াবধান ও নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী ইসলামী খেলাফত থাকলে তার অধীনে থাকত হারামাইন।”
আরও বলেন,
“অনেকেই মনে করেন, সৌদি আরবের রাজ্য সৌদিদের কাছেই থাকুক। কিন্তু মক্কা-মদীনা এই দুটি পবিত্র ভূমিকে হজ্ব-ওমরাহ ও যিয়ারতকারীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। সৌদি শাসকদের পরিবর্তে খোদ জাযীরাতুল আরব কোনো ইসলামী খেলাফতের অধীনে এলে তখন অবশ্য ভিন্ন বিষয়। চিরকাল তো এই অবস্থা থাকবে না। ইনশাআল্লাহ একদিন মুসলমানদের পবিত্র ভূমিগুলো কোনো ইসলামী খেলাফতের আওতায় আসবে। তখন সেই সরকারের সিদ্ধান্ত হবে মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির অনুকূল, ইবাদত-আমলের পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল।”
আরও বলেন,
“একটা ভূখÐ দখল বা আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্ব থাকার কারণে হারামাইন শরীফাইনও ওই ভূখণ্ডের ভেতরে থাকায় তাদের একক কর্তৃত্বে থাকতে হবে- এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।
হারামাইন বিশ্ব মুসলিমের মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ। মুসলমানদের কোনো খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে হারামাইন তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় যেতে পারে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকা বা ভূখÐকে নিয়ন্ত্রণকারী কোনো রাজা-বাদশাহ্র আওতায় থাকতে বাধ্য নয়।”
অর্থাৎ সৌদি শাসন ইসলামী খেলাফত নয়। তারা জাজিরাতুল আরবের দখলদার মাত্র। আর হারামাইন গোটা মুসলিম উম্মাহর অধিকার। দখলদার বলে সৌদি সেখানে একক কতৃত্ব খাটানোর অধিকার রাখে না।
ছয়.
হারামাইনেও রয়েছে দরবারি মুফতি
একটি অমোঘ সত্য তুলে ধরে হুজুর বলেন,
“দরবারি কথা নয়, প্রকৃত জনমত শুনুন
.... স্বেচ্ছাচারের পক্ষে অনেক সময় অনুগত লোকজনের সমর্থন পাওয়া যায়; রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশে কিছু লোককে অনুগত বানিয়ে নেওয়া যায় অথবা কিছু লোকের কাছ থেকে শাসকদের মন-মর্জিমতো ‘ফতোয়া’ আদায় করেও নেওয়া যায়; কিন্তু এতে সঠিক মতামত ও জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। দেশে দেশেই বিদ্যমান দরবারি শায়েখ, দরবারি ‘ফতোয়া’। অনেক সময় সরকারের মনোভাব আন্দাজ করে দরবারি লোকেরা অগ্রিম ফতোয়া কিংবা অগ্রিম সাফাই বক্তব্য প্রস্তুত করে রাখে।”
হুজুর যে সত্যটি তুলে ধরেছেন: হারামাইনসহ প্রতিটি দেশেই রয়েছে দরবারি মুফতি। অতএব, সৌদিসহ বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় মুফতিদের থেকে প্রদত্ত ফতোয়াগুলোকে আমরা বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি না। বিশেষত যখন বর্তমানে অনেক মুফতি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শাসকদের অনুকূলে অগ্রিম অগ্রিম ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে আমরা কিভাবে এসব রাষ্ট্রীয় ফতোয়া বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে পারি?!
ফাঁকে ফাঁকে হুজুর অনেকগুলো সত্য তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা হুজুরকে জাযায়ে খায়র দান করুন। আমীন।
বি.দ্র.
যেসব সত্য হুজুর সৌদির ব্যাপারে তুলে ধরেছেন, সেগুলো যে বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের বেলায় প্রযোজ্য তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত যখন এসব রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার ভিত্তিই সুস্পষ্ট কুফরের উপর। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতিই তার চাক্ষুষ সাক্ষি।
Comment