হিন্দু না হিন্দি? – তফাৎটা এড়িয়ে গেছি
কোনো কোনো বক্তার মুখে হয়তো আপনারা শুনেছেন: ‘হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে হিন্দুস্তানের সকলেই হিন্দু। হিন্দু একটি ভৌগলিক পরিচয়, কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পরিচয় নয়। সিন্ধু নদের উপকূলবর্তী বাসিন্দাদের আরব বণিকরা হিন্দু বলতো। সেখান থেকেই এসেছে হিন্দু। অতএব, হিন্দুস্তানের বাসিন্দা হিসেবে আমিও একজন হিন্দু’।
ডা. জাকির নায়েক (আল্লাহ তাকে মাফ করুন) এক লেকচারে তিনিও এমনটি বলেছেন।
আমার মনে হয়, আপনারা যারা এ বক্তব্যটি শুনেছেন, আপাত দৃষ্টিতে এই অভিনব (!!) বিশ্লেষণটিতে নীরবতা অবলম্বন করলেও কেউই পরিতৃপ্ত হতে পারেননি। মনে কেমন যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে।
আসলে যারা এমনটা বলেছেন, তারা হিন্দু আর হিন্দির তফাৎটা ভুলে গেছেন কিংবা এড়িয়ে গেছেন।
আরবরা সিন্ধু নদের উপকূলবর্তী বাসিন্দাদের ‘সিন্ধি’ বলতো, না ‘হিন্দি’, না ‘হিন্দু’ – সে তাহকিকে এখন যাচ্ছি না, তবে এতটুকু পরিষ্কার যে, হিন্দুস্তানের বাসিন্দা বোঝাতে ‘হিন্দু’ ব্যবহার হয় না, হয় ‘হিন্দি’। এ হিসেবেই হিন্দুস্তানী বড় বড় আলেম ও ইমামদের হিন্দি বলা হয়। যেমন সিরাজুদ্দীন আল-হিন্দি, ফরিদুদ্দীন আল-হিন্দি প্রমুখ।
পক্ষান্তরে ‘হিন্দু’ একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পরিচায়ক শব্দ। উপমহাদেশে এ শব্দটি ‘মুসলিম’ এর বিপরীতে ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে এটি এমনই এক মাশহুর, সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ শব্দ যে, কেউ কখনও এর ব্যতিক্রম বোঝে না। ‘হিন্দু’ শব্দটি যে কেউ শুনবে, তার মনে মূর্তি পূজারি একটা কাফের শ্রেণী বা সে শ্রেণীর কোনো লোক ভেসে উঠবে। যেমন ‘মুসলিম’ শব্দ শোনার সাথে সাথে ইসলাম ধর্মের অনুসারি বোঝে আসে।
ধরুন, আপনি আফ্রিকায় আছেন। সেখানকার কোনো এক পাহাড় বা মরুভূমিতে আপনি আপনার সাথী-সঙ্গীসহ সফরে আছেন। সেখানে আরও অনেক লোক আছে, যাদের আপনি চিনেন না। বিভিন্নজন বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। আপনার পাশের একজন অপরিচিত ভিনদেশী লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই আপনার পরিচয় কি? উত্তরে লোকটি যদি বলে ‘আমি একজন হিন্দু’ তাহলে যে অর্থ বুঝবেন, যদি বলে ‘আমি একজন হিন্দি’ তাহলেও কি একই অর্থ বুঝবেন? কখনই না।
ধরুন কিছুক্ষণ পর একটি সাপের কামড়ে লোকটি মারা গেল। এখন আপনি এবং আপনার সঙ্গীরা লোকটির সৎকার কোন পন্থায় করবেন?
যদি লোকটি উত্তর দিয়ে থাকে ‘আমি একজন হিন্দু’ তাহলে আপনাদের কাছে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে, লোকটি হিন্দু ধর্মের অনুসারি এক কাফের। তার জানাযা পড়া হবে না। মুসলিমদের মতো তার কাফন দাফন করা হবে না। হয়তো এভাবে পড়ে থাকার চেয়ে একটা গর্ত খোঁড়ে মাটি-ঢাকা দিয়ে দিবেন। মুসলিম হলে এমনটি করা যেতো না। গোসল দিয়ে কাফন পড়িয়ে জানাযা পড়ে কবর দিতে হতো।
পক্ষান্তরে লোকটি যদি উত্তর দিয়ে থাকে ‘আমি একজন হিন্দি’- তাহলে আপনারা সংশয়ে পড়ে যাবেন। এতটুকু বুঝবেন যে, লোকটি হিন্দুস্তান থেকে এসেছে, কিন্তু হিন্দু না মুসলিম বুঝবেন না। তখন অন্যান্য আলামত খুঁজবেন। যেমন খৎনা করা আছে কি’না, সাথে তাসবিহ বা কোনো ইসলামী বই আছে কি’না ইত্যাদি। কিংবা ধুতি পড়া কি’না, গলায় পৈতা বাধা কি’না, কপালে সিঁদুর দেয়া কি’না ইত্যাদি।
অতএব, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে হিন্দুস্তানের বাসিন্দা বোঝাতে যে শব্দটি ব্যবহার হয়, সেটি ‘হিন্দু’ নয়, ‘হিন্দি’। পক্ষান্তরে ‘হিন্দু’ শব্দটি একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারি বোঝায়। এক্ষেত্রে কেউ কখনও ব্যতিক্রম বোঝে না।
এ ধরনের পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন অর্থবোধক শব্দকে আরবিতে বলে ‘সরিহ’ (الصريح)।
ধরুন, এক লোক তার স্ত্রীকে বলেছে, ‘তুমি তালাক’। সমাজের যেকোনো লোক কথাটি শুনার সাথে সাথে বুঝে নিবে, লোকটি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। কেননা, ‘তালাক’ শব্দটি তালাক বুঝানোর ক্ষেত্রে ‘সরিহ’ তথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন।
পরে যদি লোকটি বলে, আমি বউকে তালাক দিইনি। তালাক শব্দের মূল অর্থ মুক্ত করে দেয়া। আমি আমার বউকে কাজ কামের ঝামেলা থেকে মুক্ত করে দিলাম। আজ থেকে আমি একজন কাজের বুয়া নিয়ে আসছি। রান্নাবান্না, কাপড় ধুয়া, ঝাড়ু-টারু দেয়া: সব কাজ আজ থেকে বুয়া করবে। আমার বউ আজ থেকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত।
লোকটির এ ধরনের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই সমাজের লোক শুনতে নারাজ। যদিও তালাক শব্দে এ ধরনের একটা ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে, কিন্তু সমাজে সে ব্যাখ্যা প্রচলিত নয়। সমাজে তালাক বলতে তালাকই বুঝায়। তাই ভিন্ন অর্থের দাবি গ্রহণযোগ্য হবে না।
হিন্দু শব্দটিও এরকমই, বরং এর চেয়েও দ্ব্যর্থহীন। ‘হিন্দু’ অর্থ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ‘হিন্দুস্তানের বাসিন্দা’ এ ধরনের ব্যাখ্যা কোনো প্রাচীন লাইব্রেরির কোনো পুরাতন পুস্তকের পাতায় লিখা থাকলেও, সেটি পুস্তকের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে।
সমাজের মানুষ কিছুতেই এ ধরনের অর্থ বোঝে না। এ ধরনের অর্থ করা বাস্তবকে অস্বীকার, শব্দের তাহরিফ ও অপব্যাখ্যা এবং সত্যকে মিথ্যা ও মিথ্যাকে সত্য করার নামান্তর।
***
আরও একটি উদাহরণ দেখুন: ‘ফেরাউন’ বলতে সমাজের মানুষ একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝে, যে মূসা আলাইহিস সালামকে নবী মানতে অস্বীকার করেছিল। বরং নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন।
অথচ ফেরাউন কোনো ব্যক্তির নাম নয়। ফেরাউন একটা পদের নাম। মিসরের শাসকদের উপাধী ছিল ফেরাউন। শাসনপদে যারা অধিষ্ঠিত হতো, সকলেই ফেরাউন। বর্তমানে যেমন প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী। এজন্যই আপনি ইতিহাসের কিতাবে পাবেন, পঞ্চম ফারাও (ফারাও মানে ফেরাউন), ষষ্ঠ ফারাও ইত্যাদি।
কিন্তু মুসলিম সমাজে এ অর্থ প্রচলিত নয়। মুসলিম সমাজে ফেরাউন বলতে সেই কাফেরটিকেই বুঝায়, যাকে আল্লাহ তাআলা ডুবিয়ে মেরেছেন।
ফতোয়া হিন্দিয়াতে এসেছে,
وفي اليتيمة سألت والدي عن رجل قال: أنا فرعون، أو إبليس فحينئذ يكفر كذا في التتارخانية. –الفتاوى الهندية (2/ 279)
“যে বলবে ‘আমি ফেরাউন’ সে কাফের হয়ে যাবে।” – হিন্দিয়া: ২/২৭৯
“যে বলবে ‘আমি ফেরাউন’ সে কাফের হয়ে যাবে।” – হিন্দিয়া: ২/২৭৯
কোনো লোক যদি বলে ‘আমি মিসরের রাজা বা প্রেসিডেন্ট’ – আমরা কি তাকে কাফের বলতে পারতাম? বেশির চেয়ে বেশি তাকে মিথ্যাবাদী বলতাম। লোকজন হয়তো তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।
কিন্তু যেহেতু ‘ফেরাউন’ শব্দের সে ভিন্ন অর্থ মুসলিম সমাজে প্রচলিত নয়, তাই ‘আমি ফেরাউন’ শব্দটি ‘আমি কাফের’ বলার সমার্থক।
‘ফেরাউন’ শব্দের সে ভিন্ন অর্থটি মুসলিম সমাজে প্রচলিত না হলেও, আলেম উলামা ও শিক্ষিত সমাজ তা অবগত। কিন্তু ‘হিন্দু’ শব্দের সেই ভিন্ন অর্থ না সমাজে পরিচিত, আর না আলেম উলামা ও শিক্ষিত সমাজে প্রচলিত।
এর পরও মুসলিম হয়ে নিজেকে ‘আমি একজন হিন্দু’ বলা কতটা ভয়াবহ একটু হিসাব করা উচিৎ।
***
একটি মজার কথা: গাযওয়ায়ে হিন্দে মুসলিমরা যখন হিন্দুদের কচুকাটা করতে থাকবে, তখন সম্প্রীতিবাদী কোনো মুসলিম ভদ্রলোক যদি নিজের পরিচয়ে ‘মুসলিম’ না বলে ‘হিন্দু’ বলে (এ অর্থে যে: আমি একজন হিন্দের অধিবাসী) তাহলে কিন্তু গর্দান কাটা পড়া থেকে বাঁচতে পারবেন না!
***
Comment