ইসলামের শান্তি বনাম গান্ধীর শান্তি - ড. ইয়াদ কুনাইবি
ইসলাম শান্তির ধর্ম না, এই বক্তব্য নিয়ে বেশ কিছু আপত্তি আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। আমার মনে হয় এ আপত্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করাটা উপকারী হবে।
প্রথমত, যে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমি এ বক্তব্য দিয়েছিলাম সেটা বুঝতে পারলে হয়তো আমার ও আপনাদের মতামত অনেকটা কাছাকাছি চলে আসবে। আমি কথাগুলো বলেছিলাম নিউযিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার পর। এ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে কাফিররা ইসলামের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। এটা ছিল দাওয়াহর এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
আমি তখন লক্ষ করলাম, পশ্চিমে থাকা আমাদের অনেক মুসলিম ভাই বলছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। অ্যামেরিকা থাকাকালে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠানগুলোতেও (Interfaith Dialogue) বিভিন্ন বক্তাকে নিয়মিত এ কথাটা বলতে শুনতাম।
আচ্ছা, আমাকে একটা বিষয় একটু বুঝিয়ে দিন। ধরুন, পশ্চিমা কিছু খ্রিস্টানদের জন্য একটা লেকচারের ব্যবস্থা করা হলো। শিরোনাম ঠিক করা হলো, ‘কেন ইসলাম শান্তির ধর্ম?’
এ লেকচারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বোঝানো হলো—ইসলামে শান্তির অর্থ বশ্যতা স্বীকার, দুর্বলতা কিংবা অপমান না; বরং ইসলামের অবস্থান হলো, শান্তির জন্য এমন শক্তির প্রয়োজন, যা শান্তির প্রতিরক্ষা করবে। দুনিয়ার বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করা আগ্রাসী শত্রুর সাথে শান্তির স্থাপনের কথা ইসলাম বলে না; বরং এ ধরনের লোকেদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মাধ্যমেই সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
অর্থাৎ লেকচারে ইসলামের আলোকে শান্তির সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেয়া হবে। পুরো বিষয়টি বিস্তারিত বুঝিয়ে দেয়া হবে।
ব্যাপারটা এভাবে উপস্থাপন করা হলে আমার আপত্তি নেই। যখন ইসলামের আলোকে শান্তির সংজ্ঞা দেয়া হবে এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা তাদের সামনে তুলে ধরা হবে, তখন এটা বলতে কোনো বাধা নেই যে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়, সেটার সাথেও এই ব্যাখ্যার কোনো সংঘর্ষ নেই।
কিন্তু আসলে কি এমন হয়? পশ্চিমা বিশ্বে অবস্থান করা মুসলিমরা যখন কাফিরদের সামনে ইসলামকে উপস্থাপন করে তখন কি এভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করা হয়? ব্যাপারগুলো কি বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা হয়? যেসব পরিস্থিতিতে এ ধরনের কথা বলা হয়, সাধারণত সেখানে কি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে?
না; বরং দেখা যায় যে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’, বলা হচ্ছে, তারপর হয়তো এমন কিছু আয়াত আনা হয় যেখানে শান্তির কথা আছে। কিন্তু যেখানে যুদ্ধের কথা আছে, সেই আয়াতগুলোর কথা বলা হয় না।
একটু চিন্তা করুন। যখন একজন অমুসলিম লোক শুনছে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম, তখন তার মনে প্রথম কোন অর্থটা আসছে? ‘শান্তি’ বলতে সে কী বুঝছে?
আমাদের কথা থেকে শ্রোতা কী বুঝছে, এটা জানা খুবই জরুরি।
বাস্তবতা হলো, তারা যখন শোনে ‘শান্তির ধর্ম’, তখন তারা ধরে নেয়, ইসলাম হলো এমন একটা ধর্ম, যেখানে কোনো যুদ্ধের বিধান নেই। যেটা নিরীহ, গান্ধীবাদী ধর্ম। যুলুমের মোকাবেলায় এর বিধান হলো অসহযোগ আন্দোলন বা অনশন-জাতীয় কিছু একটা করা। ‘শান্তির ধর্ম’ কথাটা শোনার পর একজন পশ্চিমা মানুষের মাথায় প্রথমে এ অর্থটাই আসবে। কারণ, আজকের দুনিয়াতে শান্তির এ ব্যাখ্যাটাই খুব জোরেশোরে প্রচার করা হয়। যারা এই বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা চায় যুলুমের মোকাবেলায় সাধারণ মানুষ অর্থহীন গান্ধীবাদী কাজকর্মে ব্যস্ত থাকুক।
একটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করুন। মুসলিমদের সাথে যখন আপনি কথা বলছেন তখন শান্তির অর্থ আলাদা করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম সেটা প্রমাণের জন্য, একজন মুসলিমের কাছে আমার ব্যাখ্যা করার দরকার নেই যে ইসলামের শান্তির অর্থ হলো নিরাপত্তা, আখিরাতের মুক্তি এবং জান্নাতে পৌঁছানোর পথ। একজন মুসলিম এটা বোঝে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন কাফির যখন ‘শান্তির ধর্ম’ কথাটা শুনছে তখন তার মাথায় প্রথম কোন অর্থটা আসছে? সে এ কথা থেকে কী বুঝছে?
ধরুন, ইসলামের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে কিছু অমুসলিম অল্প সময়ের জন্য মাসজিদে আসলো। স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি একটা সময় সে এখানে দেবে না। অল্প কিছু কথা শুনে সে চলে যাবে। সেই খ্রিস্টান বা নাস্তিক পশ্চিমা লোকটা আপনার কাছ থেকে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ শুনে ফিরে গেল।
কিছুদিন পর অন্য কেউ তাকে এসে বলবে, ওরা তো তোমাকে বলেছে ইসলাম শান্তির ধর্ম, তাই না? কিন্তু এই দেখো কুরআনে কী বলা আছে!’ তারপর সে জিহাদ আর ক্বিতালের আয়াতগুলো তাকে দেখাবে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রথম লোকটার কী প্রতিক্রিয়া হবে? তার তো এমন মনে করা স্বাভাবিক যে আপনি তার সাথে প্রতারণা করেছেন। তাকে ভুল তথ্য দিয়েছেন এবং নিজের ধর্মের ব্যাপারে সত্য গোপন করেছেন। সে ধরে নেবে সত্যবাদিতার সাথে মানুষকে নিজের ধর্মের দিকে আহ্বান করতে আপনি আগ্রহী না। ইসলাম ও মুসলিমদের ব্যাপারে তখন তার কী ধারণা হবে?
এ কারণেই, ইসলাম শান্তির ধর্ম, এ কথাটাকে দাওয়াহর স্লোগান বানানো উচিত না। কথাটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।
অন্যদিকে আপনি যদি বলেন,
‘ইসলাম হলো আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ধর্ম’, অথবা, ‘ইসলাম হলো সত্য ও ন্যায়বিচারের ধর্ম’, অথবা, ‘সব সৃষ্টির দাসত্ব আর সব মানবরচিত ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে শুধু এক আল্লাহর আনুগত্য করার ধর্ম’, তাহলে আর এ সমস্যাটা থাকে না। এ কথাগুলো সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেকোনো সময়ে, যেকোনো পরিস্থিতিতে এ কথাগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব। এখানে কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই কোনো বিশদ আলোচনার কিংবা পূর্বশর্তের। তাই স্লোগান হিসেবে এগুলো অনেক বেশি উপযুক্ত।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
আমি আমার রাসূলদের সুস্পষ্ট প্রমাণসহ পাঠিয়েছি আর তাদের সঙ্গে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও (সত্য মিথ্যার) মানদণ্ড, যাতে মানুষ ইনসাফ ও সুবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। [তরজমা, সূরা আল-হাদীদ, ২৫]
অর্থাৎ আল্লাহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন, ওয়াহি নাযিল করেছেন ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। আনুগত্য, ইবাদত ও দ্বীন কেবল আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করার জন্যে। এগুলো ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য। এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কখনো শান্তির প্রয়োজন, কখনো যুদ্ধের। কুরআনে অনেক জায়গাতে শান্তির আহ্বান করতে মানা করা হয়েছে।
যেমন আল্লাহ সুব'হানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,
فَلَا تَهِنُوا وَتَدْعُوا إِلَى السَّلْمِ وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ وَاللَّـهُ مَعَكُمْ وَلَن يَتِرَكُمْ أَعْمَالَكُمْ
অতএব তোমরা হীনবল হোয়ো না ও শান্তির আহ্বান জানিয়ো না এবং তোমরাই প্রবল। আর আল্লাহ তোমাদের সাথেই রয়েছেন এবং কখনোই তিনি তোমাদের কর্মফল হ্রাস করবেন না। [তরজমা, সূরা মুহাম্মাদ, ৩৫]
কিন্তু সত্য, ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের ব্যাপারে কখনোই আল্লাহ নিষেধ করেননি। এমন আয়াত আছে যেখানে শান্তির বদলে জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো আয়াত কিংবা হাদিস নেই যেখানে আল্লাহর বদলে অন্য কারও ইবাদত করতে বলা হয়েছে, যেখানে সত্যের বদলে মিথ্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যেখানে ন্যায়বিচারের বদলে দেয়া হয়েছে অন্যায়ের আদেশ।
কাজেই আমরা যখন বলি, ‘ইসলাম হলো অমুক মূল্যবোধের ধর্ম’, তখন সেই মূল্যবোধ ইসলামের সব শিক্ষা ও সব হুকুমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া জরুরি।
তাই আমি আবারও বলছি, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ কথাটা অমুসলিমদের কাছে দাওয়াহর ক্ষেত্রে স্লোগান হিসেবে উপযুক্ত না। বিশেষ যখন বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে না। এমনকি অধিকাংশ মুসলিমের কাছেও যেহেতু এ বিষয়গুলো আজ পরিষ্কার না, তাই তাঁদের সামনেও এটা স্লোগান হিসেবে উপযুক্ত না। কারণ, এ যুগে শক্তি দিয়ে শক্তির মোকাবিলা আর আগ্রাসনের প্রতিরোধ করার শিক্ষা দেয়ার বদলে, অধিকার অর্জন এবং যুলুম প্রতিরোধের মাধ্যম হিসেবে গান্ধীবাদকে মুসলিমদের মধ্যে প্রমোট করা হয়েছে ব্যাপকভাবে।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার কথার অর্থ এই না যে, শান্তি কাফিরদের একচেটিয়া সম্পত্তি; বরং তাদের শান্তির দাবি মিথ্যা এবং প্রকৃত শান্তি ইসলাম ছাড়া সম্ভব না।
ইসলাম একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা হয়েছে এবং আল্লাহই এর হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন।
একেক সময়ে একেক স্লোগান আসবে। তারপর আবার চলে যাবে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য, মানুষের মন জেতার জন্য ইসলামকে এসব স্লোগানের অনুবর্তী হওয়া জরুরি না। এসব স্লোগানের আদলে ইসলামকে ব্যাখ্যা করাও জরুরি না।
বরং আপনি যখন ইসলামকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবেন তখন বিশুদ্ধ ফিতরাতের অধিকারীরা ইসলামের দিকে আকর্ষিত হবে। যারা নিজের সাথে সত্যবাদী, যাদের ফিতরাহ বিশুদ্ধ, তারা ইসলামের দিকে আগ্রহী হবেই। শান্তি বলতে আজ যে বশ্যতা, নিষ্ক্রিয়তা, দুর্বলতা ও অপমানকে বোঝানো হয় সেটা বরং তাদের ফিতরাতের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।
তথ্যসূত্রঃ আয়নাঘর
Comment