সবাই উল্টো: তাহলে কি আমি ভুল করছি?
সবাই বলছে, আমি জঙ্গি। আমি সন্ত্রাসী। আমি উগ্রবাদি। আমি জযবাতি। আমি ভাসাভাসা দৃষ্টির অধিকারী। আমি স্বল্পজ্ঞানী। আমি খারিজি।
তাহলে কি আমার ভুল হয়ে গেল?
এত মানুষ আমার বিপক্ষে। আমি হকের উপর আর তারা ভুল- এটা কি সম্ভব?
হুজুরদেরও তো অধিকাংশ আমার বিরুদ্ধে। এত হুজুর কি ভুল করছেন? তারা কি বুঝেন না? না’কি আমারই ভুল হচ্ছে? ভুল পথে হাঁটছি না তো আমি?
প্রশ্নটা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত আমরা এমন এক সমাজে বড় হয়েছি, জন্মের পর থেকেই যেখানে শিরক কুফর আর ফিসক ফুজুর। বিভ্রান্তি আর ফিতনা। ঈমানি পরিবেশে আমরা বড় হইনি। হয়তো যখন থেকে আমি বুঝি তখন থেকেই শুনে আসছি, বোমা মেরে ইসলাম কায়েম করা যায় না। প্রধান বক্তা অনেক জোর গলায় কথাটা বলে গেছেন। সবাই গিলেছেও। কথাটা কয়েক যুগ ধরে আমার হৃদয়ে লেগে আছে। আজ আমি বলছি, বোমা মারা ছাড়া ইসলাম কায়েম হয় না। সন্দেহ হতেই পারে, আমার ভুল হয়ে গেল কি’না?
কিন্তু যদি আপনার জন্ম হতো আফগানে, চোখ খুলেই দেখতেন আকাশ থেকে বোমার বর্ষণ। ট্যাংক। কামান। মেশিন গান। আপনার বাবার হাতে। ভাইয়ের কাঁধে। দেয়ালে টানানো। বিছানার পাশে।
দেখতেন আজ বাবা লাশ হয়ে এসেছেন। কাল ভাই। পর দিন চাচা।
যদি এমন সমাজে আপনি বেড়ে উঠতেন, আপনাকে বুঝাতে হতো না যে, বোমা মারা ছাড়া ইসলাম কায়েম হয় কি’না।
জন্ম থেকেই আমি ফিতনায় ডুবা। বিভ্রান্তিতে ভরা। আজ হঠাৎ যদি বলে বসি, খানকায় বসে ইসলাম কায়েম হবে না, তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, আমি ভুল করছি কি’না।
আমি এখানে একেবারে সাদামাটা কয়েকটা কথা বলবো।
প্রিয় ভাই, প্রতিটি আদম সন্তানের পিছে আল্লাহ তাআলা নিযুক্ত করেছেন একটা করে শয়তান। সে তাকে বিভ্রান্তির পথে ডাকে। এ হল জিন শয়তান। আর আমার মতোই দেখতে রয়েছে হাজারো মানুষ শয়তান। এরাও আমাকে বিভ্রান্ত করে। সাথে সাথে আমার বুকের ভেতর আছে একটা নফস। নফসে আম্মারা। সেও আমাকে ডাকে বিভ্রান্তির দিকে। এভাবে জিন শয়তান, মানুষ শয়তান আর নফসে আম্মারার দ্বারা প্রতিটি আদম সন্তান বেষ্টিত। এ বেষ্টনি ভেদ করে হকের কাছে পৌঁছা এত সহজ নয়। এজন্যই আপনি দেখছেন, দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ সেই আল্লাহতেই বিশ্বাসী নয়, যে আল্লাহ তাদের সৃষ্টি করেছেন আর যার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে।
প্রতিটি আদম সন্তানকে আল্লাহ তাআলা ঈমান দিয়ে দুনিয়াতে পাঠান। আর তাকে দুনিয়াতে পাঠানোর হাজারো হাজার বছর আগে সকল বনি আদমকে একত্র করে আল্লাহ তাআলা সবার থেকে ঈমানের স্বীকৃতি নিয়েছেন। সবাই স্বীকার করেছে, হে আল্লাহ, আপনিই আমাদের রব। আমরা আপনাকে মেনে নিলাম।
এক দিকে আল্লাহ তাআলা সবার থেকে ঈমানের স্বীকৃতি নিলেন। যখন ভূমিষ্ট হয়, তাকে ঈমান দিয়ে জন্ম দেন। ঈমান তার রগে রেশায় মিশে থাকে। এরপর আবার স্বরণ করিয়ে দেয়ার জন্য রাসূলদের পাঠান। সাথে নিজের বাণী সম্বলিত কিতাবও দিয়ে দেন। রাসূলগণ এসে আল্লাহর দিকে ডাকেন, যে আল্লাহকে তারা দুনিয়াতে আসার আগেই মেনে নিয়েছিল। যার উপর ঈমান নিয়েই সে দুনিয়াতে এসেছে। কিন্তু এতদসত্বেও অধিকাংশ বনি আদম কাফের হয়ে যায়। কেন? তার পিতা মাতা, তার সমাজ তাকে বিভ্রান্ত করে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে। নফসে আম্মারার তাড়নায় পড়ে। যেমনটা হাদিসে বলা হয়েছে।
এ চতুর্মুখী বিভ্রান্তিতে পড়ে যখন একটা মানুষ বিচ্যুত হয়ে যায়, তখন আর তার কথা কাজ হকের মানদণ্ড বিবেচিত হয় না। এ কারণে দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ কাফের হয়ে গেলেও আমরা সংশয়ে পড়ি না যে, তাহলে কি দ্বীনে ইসলাম বাতিল?
মুহতারাম ভাই, এ চতুর্মুখী ফিতনায় পড়ে মানুষের দু’টি হালত হয়: কেউ কেউ হক বাতিল বুঝার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। হককে বাতিল বাতিলকে হক মনে করে। আজ আপনি কোটি কোটি বনি আদমকে দেখছেন, গরুর মূত্র পান করাকে ইবাদাত মনে করে। অথচ ধর্মে তো পরের কথা, সাধারণ বিবেক বুদ্ধিও তা সমর্থন করে না। বিশেষত এই আধুনিকতার যুগে। কেন? এরা হক বাতিল বুঝার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
আরেকদল হক বুঝার পরও স্বার্থের চিন্তায় হক প্রত্যাখ্যান করে। নয়তো আবু তালেবের ঈমান না আনার কি কারণ ছিল? সে কি জানতো না, মুহাম্মাদ –আল্লাহ তাঁর উপর সালাত ও সালাম বর্ষণ করুন- হক?
রোম সম্রাট হিরাকলা (হিরাক্লিয়াস) এর কথা হয়তো জানেন। সে আকাঙ্খা করেছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেলে কদম মোবারকের ধুলি ধুয়ে দিয়ে ধন্য হবে। কিন্তু রাজত্বের লোভ তাকেও কাবু করেছে।
এভাবে কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে বিভ্রান্ত। আর যখন বিভ্রান্ত তখন আমরা তার কথা কাজকে হকের মানদণ্ড মানতে পারি না।
মুহতারাম ভাই, আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত যে, অতীত যামানার এক উলামাগোষ্ঠীর ইতিহাস আমাদের সামনে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। নতুবা আমরা হয়তো চিন্তা করতেও ভয় পেতাম যে, উলামা শ্রেণী গোমরা হতে পারে। তারাও স্বার্থের সামনে দ্বীন বিসর্জন দিতে পারে। প্রিয় ভাই, সে শ্রেণীটি হলো ইয়াহুদ। আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন অন্তত দশবার যাদের দলভুক্ত হওয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থন ফরয করেছেন (পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সূরা ফাতিহায় গাইরিল মাগদুবি আ‘লাইহিম- এ)।
প্রিয় ভাই, এ জাতিটির উপর আল্লাহ তাআলা সবচে বেশি ইহসান করেছেন। এরা সরাসরি নবিদের সন্তান। এদের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর অধিকাংশ নবি রাসূল পাঠিয়েছেন। আসমানি খানা তাদের খাইয়েছেন। পাথর ভেদ করে ঝর্ণা সৃষ্টি করে পানির ব্যবস্থা করেছেন। মেঘমালা দিয়ে ধু ধু মরুময়দানে ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে এরাই সবচে নাফরমান। অসংখ্য নবি রাসূলকে এরা হত্যা করেছে। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য আল্লাহর কিতাব বিকৃত করেছে। অথচ আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান এদেরই সবচে বেশি ছিল। এরাই ছিল সবচে বড় আলেম। কিন্তু দুনিয়ার মোহ ইলমের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
এরা আল্লাহর কাছে সবচে নিকৃষ্ট জাতি। ইসলামের সবচে বড় দুশমন। অথচ এরা সবই জানে। এরা বুঝে শয়তান। এরা খৃস্ট ধর্মকে বিকৃত করেছে। খৃস্টানদের বিভ্রান্ত করেছে। এরা না বুঝে শয়তান। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম অনেক আছে। আল্লাহ তাআলা এ উভয় জাতি থেকে তার সবচে প্রিয় ইবাদাত সালাতে প্রতিদিন দশবার আশ্রয় প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নয়তো একজন মুসলিমের সালাতই সহীহ নয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দ্বীনে হক নিয়ে আবির্ভুত হন, তখন ওয়ারাকা বিন নাওফেল আর আব্দুল্লাহ বিন সালাম রাদি. এর মতো অল্প ক’জন আলেম ছাড়া পৃথিবীর সকল আলেম ধর্ম ব্যবসায় লিপ্ত। ধর্মকে পুঁজি করে, আল্লাহর কিতাবের অপব্যাখ্যা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন- একটা জাতির একশো জনের বলতে গেলে একশো জন আলেমই স্বার্থবাজ?? কিন্তু বাস্তবতা তাই বলে, যদিও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভবিষদ্বাণী করে গেছেন, আমার উম্মত কদমে কদমে ইয়াহুদ নাসারার অনুসরণ করবে। তাহলে কি খুব আশ্চর্যের কথা যে, বুঝে না বুঝে, কিংবা স্বার্থের লোভে আলেমরাও হকের কথা গোপন করবেন, কিংবা হককে না-হক বলবেন? এক লাখের ফতোয়া, শুকরিয়া মাহফিল, বেফাক দুর্নীতি আর হাটহাজারির কাহিনির পর আশাকরি আর দলীল দিয়ে বুঝাতে হবে না।
তবে আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনে হককে কিয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী রাখবেন। এজন্য সৃষ্টি করবেন তার কিছু মুখলিস বান্দা। যাদেরকে এ দ্বীনের গাছ হিসেবে লাগাবেন। যারা জান ও মাল দিয়ে, সাইফ ও কলম দিয়ে, বুকের রক্ত দিয়ে এ দ্বীনের সহীহ রূপ উম্মতের সামনে তুলে ধরবেন। হত্যা, বন্দী, গুম নির্যাতন কিছুই তাদের রুখতে পারবে না। আল্লাহর কুরআন আর রাসূলের বাণী তাদের পাথেয়। শত বাধার মুখেও তারা চলবেন হিদায়াতের পথে। দেখাবেন আলোর পথ।
এজন্য প্রিয় ভাই, আজ সময় এসেছে কুরআন সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার। অমুকের কথা আর অমুকের কাজ আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। দলীল বানাতে পারি না। জীবন পথের পাথেয় রূপে গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের রাহবার শুধু আল্লাহর কুরআন, রাসূলের হাদিস। সাহাবাদের সিরাত। খাইরুল কুরুনের সালাফে সালিহিন।
হে আল্লাহ! আমাদের হকের দিশা দাও। হকের পথে অবিচল থাকার তাওফিক দাও। আমীন। আমীন। আমীন।
Comment