জিহাদ-খেলাফত-নির্বাচন
উবায়দুল্লাহ ফারুকি সাহেবের বয়ানের প্রেক্ষিতে কিছু কথা
কিছু দিন হলো দেশের একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের একজন সম্মানীত আলেম একটি আলোচনায় সভায় গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। আলোচনাটি শুনার পর কিছু অভিব্যক্তি জাহির করা সমীচিন মনে করছি। ওয়ামা তাওফিকি ইল্লা বিল্লাহ!উবায়দুল্লাহ ফারুকি সাহেবের বয়ানের প্রেক্ষিতে কিছু কথা
আলোচনার লিংক:
https://www.facebook.com/100078348434774/videos/862738971813011/?extid=CL-UNK-UNK-UNK-AN_GK0T-GK1C&mibextid=2Rb1fB
আলোচনার মূল বিষয় নির্বাচন। তবে প্রসঙ্গক্রমে খেলাফত ও জিহাদের উপর ফোকাস পড়েছে। জিহাদের প্রসঙ্গে ঈমান কুফর সম্পর্কেও কিছু কথা এসেছে। আমি খুব সংক্ষেপে বক্তব্যটির কিছু পয়েন্ট এবং আমার অভিব্যক্তি তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।
এক. জিহাদি মানহাজে জড়িতদের ব্যাপারে বক্তব্য
[জিহাদিদের শতকরা আশি নব্বইজন নামায পড়ে না।]
মন্তব্য: হুজুর তথ্যটি কোন উৎস থেকে পেলেন আল্লাহ মা’লুম। তাহলে বলতে হবে, হুজুর যাদের দেখেছেন তারা আসলে জিহাদি নয়। আসল জিহাদিদের হুজুর এখন পর্যন্ত চিনতে পারেননি। কোনো দলের ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে তাদের সম্পর্কে আরও ভাল রকম জানাশুনা থাকলে ভালো।
বক্তব্য: [এদের যিন্দেগিতে তেলাওয়াত নাই। তাদের ঘরের লোকদের কুরআন সহীহ নাই। তাদের মসজিদে একজন ভাল ইমাম পর্যন্ত রাখার ফিকির নাই। দাওয়াতের কাজ নাই। একটা শিশুকে পর্যন্ত এরা কুরআন শিখায় না। গাইরে মুকাল্লিদদের বিরোধীতা করে না। মওদুদির বিরোধীতা করে না। ফেরাকে বাতিলার ব্যাপারে জনগণকে অবগত করায় না। কাউকে নামায শিখায় না। কুরআন শিখায় না। মোটকথা এদের গোটা যিন্দেগি দ্বীনের কোনো কাজে লাগছে না।]
আরও বলেন: [তারা বলে, এখন এখতেলাফ করার সময় না। এখন সবাইকে নিয়ে তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে খেলাফত কায়েম করার সময়।]
মন্তব্য: সবাইকে সাথে নিয়ে কাজ করার বিষয়টিতে সমালোচনার কি হলো বুঝলাম না। যারা নির্বাচন করেন, তারাও সবাইকে সাথে নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করেন। সবার থেকে ভোট লাভের প্রয়াস থাকে।
অধিকন্তু নাসেহানা সমালোচনা তো মুজাহিদরা করেও থাকেন। তবে এমন পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করেন, যাতে উম্মতের মাঝে অনর্থক ভাঙন না ধরে। এটা তো অবশ্যই নিন্দনীয় কিছু নয়।
আর বাকি বিষয়গুলোর ব্যাপারে কথা হলো, একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে সমাজের সর্বস্তরে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বাস্তবায়ন করা মুজাহিদদের মিশন। এজন্য তারা সমাজের সর্বস্তরেই কাজ করে থাকেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে প্রকাশ করেন না যে, আমি জিহাদি মানহাজের লোক। নতুবা বাস্তবে মুজাহিদদের কার্যক্রম এবং আমল আখলাম এমন নয় অবশ্যই, যেমনটা হুজুর বলছেন। তাহলে সেটাই বলতে হবে যে, প্রকৃত মুজাহিদদের হুজর চিনতে পারেননি।
দুই. জিহাদের ব্যাপারে বক্তব্য
[গরীবের উপর যেমন যাকাত ফরয নয়, পাবলিকের উপরও জিহাদ ফরয নয়। জিহাদ রাষ্ট্র ক্ষমতাওয়ালাদের উপর ফরয। জিহাদের জন্য আমীরে আম লাগবে। যার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা আছে। হুদুদ কেসাস কায়েম করার শক্তি আছে।]
আরও বলেন: [সায়্যিদ আহমাদ শহীদের রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল না। তিনি জিহাদ করেছেন। তিনি দখলদার ইংরেজদের বিরুদ্ধে করেছেন। দখলদারদের বিরুদ্ধে করা যাবে।]
মন্তব্য: তাহলে বুঝা গেল, কাফের যদি দখলদার হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে সবাই জিহাদ করতে পারবে, রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হওয়া জরুরী নয়। মুজাহিদগণ তো এমন দখলদারদের বিরুদ্ধেই জিহাদ করছেন বা জিহাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। বেশকম এতটুকু যে, কোনো দখলদার দেশি আরও কোনোটা বিদেশি। কোনোটা ঈমানের দাবিদার না, আর কোনোটা মুসলিম নামধারী কাফের।
অধিকন্তু সাধারণ মুসলমানদের উপর সাধারণ হালতে জিহাদ ফরয নয়: এটি হুজুর কোনো দলীল বা রেফারেন্সের আলোকে বলেননি। জিহাদ শুধু তাদের উপরই ফরয, যাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আছে: এমন কোনো শর্তের কথা তো কিতাবাদিতে নাই। এমনসব নাজুক বিষয়ে হুজুর যদি অনুগ্রহপূর্বক দলীলভিত্তিক কথা বলেন, তাহলে আরও ভালো হয়।
বক্তব্য: [যেসব রাষ্ট্রে মুসলমানরা বসবাস করতে পারে, জামাতে নামায পড়তে পারে, জুমা পড়তে পারে, ঈদ পড়তে পারে; হয়তো হজ্ব করতে পারে না, ওয়াজ মাহফিল করতে পারে না: সেসব রাষ্ট্রে জিহাদ হারাম। এ হিসেবে বার্মায় জিহাদ হতে পারে, যদি ইসলামি হুকুমত থাকে। চীনের একটা প্রদেশে যেহেতু মুসলমানরা মাজলুম, তাই তাদের অসিলা করে সেখানেও জিহাদ ফরয হতো, যদি ইসলামি হুকুমত থাকতো। এছাড়া পৃথিবীর কোথাও জিহাদ জায়েয নয়। আমেরিকা ইউরোপেও জায়েয নয়। কারণ, সেখানে মুসলমানরা থাকতে পারে, নামায পড়তে পারে, জুমা করতে পারে, ঈদ করতে পারে, মসজিদ মাদ্রাসা আছে, ওয়াজ মাহফিল তাফসির মাহফিল হতে পারে।]
মন্তব্য: জিহাদের এ শর্তটি একেবারেই নতুন। কাফেররা যতক্ষণ না রাষ্ট্রক্ষমতা মুসলিমদের হাতে সমর্পণ করে, নত হয়ে জিযিয়া প্রদান করত দারুল ইসলামে যিম্মি হয়ে বসবাস করতে সম্মত হবে, ততক্ষণ তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত দ্বারা ফরয। তাদের দেশে কিছু মুসলিম থাকতে পারা বা ঈদ জুমা করতে পারাই যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে উম্মার কোনো ইমামের কোনো দ্বিমত নেই। যদি হুজুর দাবিতে সত্যবাদি হয়ে থাকেন, তাহলে নিজের দাবির স্বপক্ষে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ পেশ করুন।
উল্লেখ্য, যেহেতু আমরা মুজতাহিদ নই, তাই শুধু কুরআনের কোনো আয়াত বা কোনো হাদিস বলে দেয়াই যথেষ্ট নয়। সে আয়াত হাদিসের আলোকে কোন্ ফকিহ বিষয়টি বলেছেন, সে ফকিহের উদ্ধৃতি পেশ করাও আবশ্যক। বিশেষত আমরা যে মাযহাব মেনে চলি, সে মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য তো অবশ্যই পেশ করতে হবে। আর যদি তাদের রায় গ্রহণ না করা হয়, তাহলে গ্রহণ না করার পেছনে গ্রহণযোগ্য শরয়ী দলীল পেশ করতে হবে।
তিন. ঈমান কুফরের ব্যাপারে বক্তব্য
বক্তব্য: [ঈমান কুফরের সম্পর্ক কলবের সাথে। কলবে যদি জুহুদ (অস্বীকার) না থাকে, তাহলে হাজার কুফরি কাজ করলেও কাফের হবে না।]
মন্তব্য: হুজুর আসলে মুনাফিক আর মুরতাদ উভয়কে এক কাতারে গণ্য করে ফেলেছেন। মুনাফিক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে ভিতরে ভিতরে কাফের, কিন্তু বাহ্যত তার থেকে কুফরি কোনো কাজ দলীল প্রমাণের আলোকে প্রমাণিত নয়। আল্লাহ তাআলা অহির মাধ্যমে মুনাফিকদের পরিচয় রাসূলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এই তিনশো লোক মুনাফিক। অহি ছাড়া তাদের চিনার পথ নেই। কথায় কাজে কুফরের কিছু আলামত প্রকাশ পেলেও তা এ পর্যায়ের নয় যে, তাকে কাফের বলা যায়।
পক্ষান্তরে যার থেকে একটা সুস্পষ্ট কুফরি প্রকাশ পেয়ে যাবে, সে মুরতাদ হয়ে যাবে। যেমন কেউ রাসূলকে নিয়ে কটুক্তি করলো (নাউজুবিল্লাহ)। এমন ব্যক্তির অন্তর দেখার দায়িত্ব আমাদের না। অধিকন্তু এ ধরনের ব্যক্তির অন্তরে বিশ্বাস থাকলেও সে কাফের। ঈমানের জন্য শুধু অন্তরের বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। যেমন, ইয়াহুদিরা রাসূলকে সত্য নবী বলে জানতো। কিন্তু এতটুকুতেই তারা ঈমানদার হয়ে যায়নি।
কাজেই হুজুর যে আকিদার কথা বলছেন, তা আহলুস সুন্নাহর আকিদার পরিপন্থী। মনের অগোচরেই এ ধরনের আকিদা এখন আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে যাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের হিফাজত করুন।
চার. নির্বাচনের ব্যাপারে মন্তব্য
বক্তব্য: [নির্বাচন একটা মুবাহ জিনিস। হারাম বা মাকরুহ নয়। সংসদ পর্যন্ত যাওয়ার এটি একটি ওয়াসেতা-মাধ্যম মাত্র।]
আরও বলেন, [এটি একটি বেওকুফি সিস্টেম, যেখানে আলেম জাহেল, দক্ষ অদক্ষ সবাইকে সমান ধরা হয়।]
আরও বলেন, [গণতন্ত্র একটি কুফরি নেজাম।]
মন্তব্য: এতদসত্বেও নির্বাচনকে হুজুর মুবাহ তথা জায়েয বলছেন। তাও এতটুকু ভালো যে, একে জিহাদ আখ্যা দেননি, যেমনটা কোনো কোনো দলের ভাষ্য।
আরও বলেন, [গণতন্ত্রের নেজাম বদলানোর মতো শক্তি আমাদের নাই। অধিকন্তু এটা বদলানোর মুকাল্লাফও আমরা না (তথা আমাদের কোনো দায়িত্ব এ ব্যাপারে নেই।) নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তত রাষ্ট্রীয় মুনকার ও কুফর শিরকের বিরুদ্ধে একটু আওয়াজ তোলা যায়। এটা আল্লাহর নেআমত। যারা এর বিরোধীতা করে, এই বিরোধীতার পিছনে বিধর্মীদের হাত আছে।]
মন্তব্য: হুজুরের বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আলেম উলামারা বাস্তবে ক্ষমতায় যেতে পারবে না। শুধু কিছুটা প্রতিবাদ জানানো যাচ্ছে। আর বাস্তবেও বিষয়টি এমনই। একশো বছর ধরে গণতন্ত্র করে আজ পর্যন্ত কোথাও ইসলাম কায়েম করা সম্ভব হয়নি। তাহলে শুধু শুধু এটার পিছনে পড়ে থেকে কি লাভ?! শুধু এতটুকুই নয়, গণতন্ত্র যারা করে, সাধারণত তারা ব্যাপকভাবে জিহাদের অপব্যাখ্যাও করে থাকে।
পাঁচ. খেলাফতের ব্যাপারে বক্তব্য
বক্তব্য: [খেলাফত মাওউদ, মামুর বিহা নয়। আমলে সালেহ করলে খেলাফত অটো আসে। আবার বদ আমলের কারণে যায়ও অটো। এক সময় মুসলমানরা এক ছিল। অটোমেটিক খেলাফত হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের বদ আমলের কারণে সে খেলাফত অটো হারিয়ে গেছে। খেলাফত কায়েম করার কোনো আদেশ নেই। এটার জন্য আন্দোলন করলে, মেহনত করলে বেকার কাজ হবে, কোনো সওয়াব হবে না। খেলাফত আল্লাহর কাজ। আল্লাহর কাজে আমাদের হেল্প করার দরকার নাই।]
মন্তব্য: খেলাফত মাওউদ, খেলাফতের জন্য মেহনত করলে কোনো সওয়াব হবে না- কথাটি একেবারেই নতুন। আল্লাহ মালুম হুজুর কোত্থেকে এ ফিকরটি গ্রহণ করেছেন।
উল্লেখ্য, খেলাফত দ্বারা উদ্দেশ্য: সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক খলিফার অধীনে এক হুকুমতের মধ্যে থাকবে, একাধিক হুকমত থাকবে না।
হুজুর নিজের দাবির পক্ষে সূরা নূরের এ আয়াত দিয়ে দলীল দিয়েছেন:
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (55) [النور: 55]
হুজুর বলতে চাচ্ছেন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা খেলাফত কায়েম করে দেয়ার ওয়াদা করছেন। শর্ত হচ্ছে: আমলে সালেহ করতে হবে। তাহলে অটোমেটিক আল্লাহ তাআলা খেলাফত দিয়ে দিবেন, কোনো মেহনত করতে হবে না। হুজুর হয়তো ‘লাইয়াসতাখলিফান্না’ শব্দ থেকে কথাটি বুঝেছেন। আসলে আয়াতে ওয়াদা করা হয়েছে: নেককারদেরকে আল্লাহ তাআলা জমিনে ক্ষমতা দেবেন এবং তাদের দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে দেবেন। কিন্তু সে ক্ষমতা কি খেলাফতের আকারে হবে, না’কি আঞ্চলিক ইসলামি হুকমতের আকারে হবে; এক হুকুমতের মাধ্যমে হবে, না’কি একাধিক হুকুমতের অধীনে হবে: এগুলোর আলোচনা আয়াতে নাই। আয়াতে শুধু এতটুকু আছে যে, আল্লাহ তাআলা জালেমদের পর নেককারদের ক্ষমতায় আনবেন। যাকে আমরা সহজ কথায় বলতে পারি: আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করছেন, আমরা নেক আমল করলে তিনি ইসলামি হুকুমত কায়েম করে দেবেন।
আল্লাহ তাআলা কোনো জিনিসের ওয়াদা করলে সেটি মাওউদ। কিন্তু সেটি মামুর তথা আদিষ্ট হতে পারবে না তা তো না। যেমন রিজিক আল্লাহর ওয়াদা। সব মাখলুককে রিযিক আল্লাহ তাআলাই দিবেন। কিন্তু তাই বলে কি নিজের, বিবি বাচ্চা ও পিতা মাতার রিযিকের জন্য কামাই করা আমার দায়িত্ব না? অবশ্যই দায়িত্ব। রিযিক আল্লাহ দিবেন, কিন্তু আমাকে মেহনত করতে হবে। কামাই করতে হবে। ব্যবস্থা না থাকলে রিযিক হাসিলের জন্য কামাই করাকে আইম্মায়ে কেরাম ফরয বলেছেন।
ইসলামি হুকুমত ও খেলাফতের বিষয়টিও এমনই। আমলে সালেহ করলে আল্লাহ তাআলা তা দিবেন ওয়াদা করেছেন। কিন্তু এর জন্য মেহনত করতে হবে। এজন্যই তো তা আমলে সালেহের সাথে শর্তযুক্ত করেছেন। আমরা মেহনত করে আমলে সালেহ করলে তখন আল্লাহ তাআলা খেলাফত ও হুকুমত দিবেন।
কাজেই খেলাফত বা হুকুমত অটো নয়। আমলে সালেহের পেছনে মেহনত করতে করতে তখন আল্লাহ তাআলা হুকুমত দেবেন। আর আমলে সালেহের মধ্যে নামায রোযার মতো আদিষ্ট বিষয়গুলো যেমন আছে, জিহাদ কিতালের মতো আদিষ্ট বিষয়ও আছে। শুধু নামায রোযা করে বসে থাকলে তো ঘরে দু’বেলা খাবারও আসবে না। বরং যে কাজ যেমন, সেটার জন্য সে ধরনের মেহনত করতে হবে। খাবারের জন্য যেমন কামাইয়ের মেহনত করতে হয়, খেলাফতের জন্য বা হুকুমতের জন্য তার উপযোগী মেহনত করতে হবে।
আরও বলেন, [জিহাদিরা বলে, খেলাফত কায়েম করতে হবে। খেলাফত মামুর না। ইসলামি হুকুমত কায়েম করা মামুর। এটার জন্য মেহনত করলে সওয়াব পাবেন।]
আরও বলেন, [ইসলামী হুকুমত ডজন ডজন হতে পারে, কিন্তু খেলাফত একাধিক হতে পারে না।]
মন্তব্য: ইসলামী হুকুমত বলতে যেমন ধরুন, আফগানে ইসলামী হুকুমত আছে। এমন ধরনের আঞ্চলিক ইসলামী রাষ্ট্র।
হুজুরের বক্তব্য যতটুকু বুঝতে পারছি: ইসলামী শাসন কায়েম করা আল্লাহর আদেশ। সবগুলো মুসলিম ভূখণ্ডে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। এভাবে একেক শাসকের অধীনে একেকটা করে ইসলামী হুকুমত থাকতে পারে। সবাই মিলে এক খলিফার অধীনে এক শাসনের অধীনে তথা এক খেলাফতের অধীনে থাকতে হবে, এটা আল্লাহর আদেশ না।
এই কথাটিও নতুন। নতুবা আকায়িদ ও সিয়াসাতের কিতাবাদিতে পরিষ্কারই আছে যে, মুসলিম বিশ্বে খলিফা হতে হবে একজন। একাধিকজন হতে পারবে না। সাহাবায়ে কেরামের ইজমা এবং পরবর্তীতে উম্মতের ইজমা এর উপর বিদ্যমান। অল্প দুয়েকজন ছাড়া এ ব্যাপারে উম্মাহর ইমামদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নাই।
একাধিক হুকুমত থাকলে একটা আরেকটার সাথে মারামারিতে জড়াবে, যেমনটা ইতিহাস স্বাক্ষি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর আনসরার বলেছিল, আমাদের মধ্য থেকে একজন আমীর হোক, আরেকজন হোক মুহাজিরদের মধ্য থেকে। তখন আবু বকর ও উমারসহ বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম তা প্রত্যাখান করেছেন। তারপর সকল সাহাবি একমত হয়েছেন যে, শাসক একজনই হবেন। পরবর্তীতে আইম্মায়ে কেরামও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। কাজেই মুসলিম বিশ্বের শাসক একজনই হবেন। তবে উম্মাহ যদি বিভক্ত হয়ে পড়ে, একেক এলাকায় একেকজন শাসক দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে যার যার অঞ্চলে ইসলামী শাসন কায়েম করা তাদের দায়িত্ব হবে। তবে এভাবে বিভক্ত হওয়াটা শরীয়তের পছন্দ নয়, জায়েযও নয়। কাজেই হুকুমত ডজন ডজন হতে পারে তা ঠিক, তবে এটি শরীয়তের স্বাভাবিক নির্দেশের পরিপন্থী।
এ গেল এক কথা। হুজুরের মূল উদ্দেশ্য: আমরা জিহাদিরা খেলাফত খেলাফত করি। অথচ খেলাফত কায়েম করার দায়িত্ব উম্মতের নেই। আল্লাহর আদেশ হচ্ছে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা, খেলাফত কায়েম করা নয়।
আসলে এখানে হুজুর ভুল বুঝেছেন। সব ভূমিতে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা যেমন ফরয, তেমনি আরেকটি ফরয হচ্ছে সব হুকুমত মিলে এক খলিফার অধীনে থাকা। উভয়টিই ফরয।
আর মুজাহিদরা যখন খেলাফতের কথা বলেন, তখন তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে যে, ইসলামী শাসন কায়েম করতে হবে। তাগুতি শাসন আমরা মানি না। খেলাফত বলতে তারা স্বাভাবিক এটাই বুঝান। আপাতত মুজাহিদদের মূল মিশন এটাই। আগে তাগুতদের সরানো হোক। খেলাফতের আদলে যে শাসন, অর্থাৎ ইসলামী শাসন, সেটা কায়েম হোক। মুজাহিদদের এটাই উদ্দেশ্য। ইসলামী শাসন কায়েম হয়ে গেলে তারপর সব শাসন এক হয়ে এক খেলাফত হবে। সেটা তখনকার বিষয়। এখনকার মূল ফোকাস: তাগুতি শাসনের পরিবর্তে ইসলামী শাসন কায়েম করা। এটাকেই তারা খেলাফত শব্দে ব্যক্ত করেন। তাদের উদ্দেশ্য কখনও এটা নয় যে, ইসলামী হুকমত কায়েমের দরকার নেই। ইসলামী হুকুমতই যদি কায়েম না থাকে, তাহলে খেলাফত কিভাবে সম্ভব? যারা খেলাফতের কথা বলে, তারা ইসলামী হুকুমত কায়েম করে খেলাফত কায়েমের কথা বলে।
বক্তব্য: [আল্লাহ তাআলা রাজা বাদশাদের জিজ্ঞেস করবেন, তারা ইসলামী হুকুমত কায়েম করেছিল কি’না। জনগণকে এ ব্যাপারে কোনো জিজ্ঞেস করা হবে না। তারা এ ব্যাপারে মুকাল্লাফ নয়। এটা রাষ্ট্র ক্ষমতাশীলদের দায়িত্ব।]
মন্তব্য: হুজুরের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে, সব হুকুমত মিলিয়ে এক হুকুমত তথা এক খেলাফত হতে হবে, এটা শরীয়তের আদেশ না। এটার জন্য মেহনত করলে কোনো সওয়াব হবে না। তবে মুসলিম ভূমিগুলোতে ইসলামী শাসন কায়েম করতে হবে। তবে এটাতে জনগণের কোনো দায়িত্ব নেই। যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের দায়িত্ব ইসলাম কায়েম করা। তারা কায়েম না করলে তারা গুনাহগার হবে, জনগণের কোনো দায়িত্ব নেই।
তাহলে সারকথা দাঁড়াচ্ছে: রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম কায়েমের প্রচেষ্টা চালানোর কোনো দায়িত্ব জনগণের নেই। সরকার করলে করলো, নইলে জনগণের দায়িত্ব নেই।
একইভাবে জিহাদের ব্যাপারেও একই কথা বলেছেন যে, এটা সরকারী ক্ষমতাশীলদের দায়িত্ব, জনগণের দায়িত্ব নয়।
তাহলে জনগণকে জিহাদও করতে হবে না, রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম কায়েমের চেষ্টাও করতে হবে না। বরং হুজুরের বক্তব্য তো ঈঙ্গিত করে যে, এগুলো করা জনগণের জন্য জায়েযও হবে না।
আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। যদি ইসলামী হুকুমত কায়েম থাকে, রাষ্ট্র ইসলামী বিধি বিধান মতে শাসন চালায়, জিহাদের দায়িত্বও আঞ্জাম দেয়: তাহলে এক্ষেত্রে জনগণের আর তেমন কোনো দায়িত্ব নেই। রাষ্ট্র যদি কোনো কাজে ডাকে তাহলে সারা দিবে। জিহাদে বের হতে বললে বের হবে। অর্থ কড়ি দিয়ে সাহায্য করতে বললে করবে। এছাড়া স্বেচ্ছায় জিহাদ বা রাষ্ট্রীয় কল্যাণমূলক কাজে শরীক হতে চাইলে পারবে।
পক্ষান্তরে রাষ্ট্র যদি এগুলো ঠিকমতো না করে, তাহলে রাষ্ট্রকে উদ্বুদ্ধ করা, চাপ প্রয়োগ করা জনগণের দায়িত্ব। যার যেমন ক্ষমতা আছে সে অনুযায়ী দায়িত্ব বর্তাবে। না করলে গুনাহগার হবে। রবং রাষ্ট্র যদি জিহাদ ছেড়ে দেয়, তাহলে জনগণ নিজেদের মতো করে জিহাদ করবে। এটার কথাও পরিষ্কার বলেছেন আইম্মায়ে কেরাম। কারণ, রাষ্ট্র মূলত জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের পক্ষ হয়ে যদি তারা দ্বীন কায়েম করে, তাহলে তো ভাল, অন্যথায় নিজেদের দ্বীন কায়েমের দায়িত্ব জনগণের নিজেদের উপরই বর্তাবে।
আর যদি মুসলিমদের হাতে রাষ্ট্রই না থাকে, বরং বিদেশী কাফের বা দেশীয় মুরতাদরা রাষ্ট্র দখল করে নেয়, তাহলে সকল মুসলিমের দায়িত্ব: কাফের ও মুরতাদকে হটিয়ে মুসলিম ভূমি কব্জা করা। যেমনটা উবাদা বিন সামিত রাদি.র হাদিসে এসেছে: إلا أن تروا كفرا بواحا الخ ।
আমাদের অবস্থাটা এখন এটাই। বিশ বছর জিহাদ করে আমরা আফগান উদ্ধার করে সেখানে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। একে একে বাকি ভূমিগুলোও উদ্ধার করতে হবে। এ উদ্ধার করাটা মূলত দিফায়ি জিহাদ। তথা দখলদারকে হটানো। আর এ জিহাদ তো – হুজুর নিজেও বলেছেন- সবাই করতে পারবে। যেমনটা করেছেন সায়্যিদ আহমাদ শহীদ রহ.। কাজেই জিহাদিদের উপর আপত্তির কিছু দেখছি না আলহামদুলিল্লাহ।
***
Comment