মক্কী জীবনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা
বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে এমনও লোক আছে, যারা বলে, আমরা এখন মক্কী জিন্দেগীর ধাপ অতিবাহিত করছি। তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো, এটা হলো আত্নশুদ্ধি ও ব্যক্তি গঠনের ধাপ, মোকাবেলা বা জিহাদের সময় এটা নয়। তাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়া আমাদের জন্য জরুরী নয়। কারণ এখনো আমরা ব্যক্তি গঠনের স্তর অতিক্রম করছি।
দু'টি কারণে কারণে তাদের এ চিন্তা-ভাবনার অসারতা প্রমাণ হয়।
একঃমক্কী জিন্দেগীর ব্যপারে তাদের ভাবনাই ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত।
দুইঃ ইসলাম সম্পর্কে তাদের ভাবনাই ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত।
মক্কী জিন্দেগীর ব্যাপারে তাদের চিন্তা-চেতনা ভ্রান্ত হওয়ার কারণ, তারা মনে করেছে এটা আত্নশুদ্ধি ও ব্যক্তি গঠনের ধাপ,মোকাবেলা এবং জিহদের নয়। ( ক্বিতাল বা লড়াই, নফসের সঙ্গে জিহাদ এখানে উদ্দেশ্য নয়, অস্ত্রের জিহাদ উদ্দেশ্য)।
যে ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সহাবায়ে কেরামের মক্কী জিন্দেগী নিয়ে তত্ত্ব তালাশ ও গবেষণা করবে প্রথমেই যে বিষয়টি তার সামনে প্রতিভাত হবে তা হলো চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের মোকাবেলার সবচে' কঠিন সময় ছিলো এটা।
যদি তা না হতো তাহলে কেন রাসুল সঃকে এতো কষ্ট দেওয়া হয়েছে? হযরত বিলার, আম্মার, ইয়াসির, আবু যর গিফারী রাযিয়াল্লাহু আনহুমকে কেন এতো শাস্তি দেওয়া হয়েছে? রাসুলে আরাবী ও তাঁর সাহাবীদের কেন মদীনা মুনাওয়ারাতে হিজরত করতে হয়েছে?
এসবের কারণ কি এটা ছিলো না যে, কাফের -মুশরিকদের উপাসনা ও আক্বিদা -বিশ্বাসের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়া হয়েছিলো?
এ জন্য কি ছিলো না যে, ইসলামী চিন্তা-চেতনা জাহেলী চিন্তা-চেতনা থকে ভিন্ন হয়ে যাবে?
কুফরী ধ্যান-ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা হবে? যার উপর তারা প্রতিষ্ঠিত ছিলো।
তাছাড়া সেসময় বাতিলের মোকাবেলা করা ইসলামী ব্যক্তি গঠনের পূর্ণতার একটি অধ্যায় ছিলো। তাহলে বাতিল তথা জাহিলিয়্যাতের সঙ্গে লড়াই ছাড়া এবং তাবলীগ ও জিহাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কষ্ট সহিষ্ণুতা ও নির্যাতন নিপীড়ন ভোগের অভ্যস্ততা ছাড়া ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠনের পূর্ণতা আদৌ কি সম্ভব?
যারা এমনটা মনে করে তাদের মতে কি সবর ধৈর্যের অর্থ এটাই যে, সেই বাতিল ও ভ্রান্ত ধর্ম-মতাদর্শ এবং তাদের ধ্বংসাত্নক আক্বিদা ও চিন্তা -চেতনার সামনে মুসলমান নেতিবাচক ভূমিকা নেবে?
পরাজয় মেনে নেবে? অপমান ও জিল্লতির জীবন বেছে নেবে?
বলা বাহুল্য, নবী রাসুগণও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন; কিন্তু জাহিলিয়্যাতকে নির্মূল করা, বাতিলের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া, সত্য প্রতিষ্ঠা এবং কাফের মুশরিকদের ভ্রষ্টতা ও নির্বুদ্ধিতা প্রমাণ করার পর তা করেছেন।
তারপর তারা অত্যাচার, নির্যাতন, দুঃখ-কষ্ট, পরীক্ষায় অত্যন্ত সাহসিকতা, বীরত্ব, অবিচলতা, দৃঢ়তার সাথে সর্বোপরি ঈমানী জযবাকে ধারণ করেই সব কিছু সহ্য করছেন।
সুতরাং একথা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, 'মক্কী জীবন' শুধু আত্নশুদ্ধি ও ব্যক্তি গঠনের ধাপ ছিল, দুশমনের মোকাবেলা ও জিহাদের অধ্যায় সেটা ছিলো না, তা একটি ভ্রান্ত দাবি। এ মনোভাবটাই ভুলের প্রতিষ্ঠত।
যে কোন বিবেকবানই বুঝতে সক্ষম যে, ইসলামের ব্যাপারে তাদের এই মনোভাব ভ্রান্ত হওয়ার কারণ হলো, তারা মনে করে সে সময় ইসলাম শুধু আত্নশুদ্ধি ও আক্বিদা সংশোধনে সীমিত ছিলো।
রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় কোন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপের সুযোগ ছিলো না। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিলো মাদানী জিন্দেগীর কাজ।
এ ধারণাও যে ভ্রান্ত ছিলো তার কারণ, ইসলাম পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ হয়ে গেছে।
قال الله تعالى : اليوم أكملت لكم دينكم و أتممت عليكم نعمتي و رضيت لكم الإسلام دينا،
(سورة المائدة)
(سورة المائدة)
পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর প্রত্যেক মুসলমানের উপর সব মৌলিক দায় দায়িত্ব আপনা আপনি এসে বর্তায়।
রোযা, যাকাত,হজ্ব ইত্যাদি মদিনা মুনাওয়ারাতে ফরয করা হয়েছে।
এখন কোন মুসলমানের পক্ষে একথা কি বলার সুযোগ আছে যে, এগুলো পালনে সে বাধ্য নয়। কারণ সে মক্কী জিন্দেগীর ধাপে অস্থান করছে।
সুতরাং যেমনিভাবে তার জন্য ইসলামের কোন নেযাম ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, হোক তা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, অথবা ব্যক্তি ও পারিবারিক।
কাজেই ব্যক্তি পর্যায়ে যার সমন্বয় ঘটানো সম্ভব, জাগতিকভাবে যা বাস্তবায়রযোগ্য পরিপূর্ণ চেষ্টা চালানো আবশ্যক।
তবে যেসব নেযামকার্যকর করা হুকুমতের কাজ যেমন শরয়ী হুদুদ তথা দণ্ডবিধি কার্যকর করা, যুদ্ধের জন্য বাহিনী প্ররণ করা - এগুলো হুকুমতই পালন করবে।
বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা কোন ভাবেই মক্কী জিন্দেগীর সাথে তুলনা করা যাবে না।
তাই দ্বীনে হক, রাজনৈতিক ময়দান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ, ধর্মদ্রোহী, দুশমনদের
মূলোৎপাটনের জন্য নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
(ফিতনায়ে ইরতিদাদ আওর জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ:
পৃষ্ঠা, ৮৬-৯৪)
সংগৃহীত, (আদর্শ রাষ্ট্রনীতি আদর্শ রাজনীতি, মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ)