ইমাম মাহমুদের ফিতনা পর্ব – ২ । শাহ নেয়ামতুল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী
ইমাম মাহমুদ দাবীর প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো শাহ নেয়ামতুল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতা। এই কবিতা ছাড়া তাদের আলোচনা যেনো পূর্ণতা পায় না। বরাবরের মত আবারো বলছি ইসলামে এই ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, এগুলো শরীয়তের দলীলও নয়। কিন্তু কবিতাগুলো যেহেতু ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে এবং বেশিরভাগ মানুষই চোখ বন্ধ করে তা বিশ্বাস করছে তাই মনে হলো কবিতাটার সত্যতা নিয়ে আলোচনা করা সময়ের দাবী। এই দায়িত্ববোধ থেকেই শাহ নেয়ামতুল্লাহর কবিতার সূত্র অনুসন্ধান শুরু করি। এক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করেছে স্কটল্যান্ডের ইংরেজি মাসিক ম্যাগাজিন The Muslim Herald-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ যেটার নাম দেওয়া হয় “Shah Nematullah the Saint and his Qaseeda” এছাড়াও শায়েখ ডক্টর আব্দুস সালাম আজাদীর লেখা নিবন্ধ যেটার নাম “নি’মাতুল্লাহ শাহ ওয়ালির ভবিষ্যদ্বাণী ও গাযওয়া-ই হিন্দ” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।বাংলাদেশে শাহ নেয়ামতুল্লাহর কাসিদার কথা বললে সবার অন্তরে প্রথমেই যেটা ভেসে ওঠে তা হলো ২০০৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত “কাসিদা সওগাত” অথবা ২০০৫ সালে মদিনা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত “মুসলিম পুনর্জাগরণ : প্রসঙ্গ ইমাম মাহদী” বইটির কথা। যেখানে প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সহ গাযওয়াতুল হিন্দ, ইমাম মাহদির আগমনের ব্যাপারে ভবিষ্যদবানী করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে তিনি অর্থাৎ শাহ নেয়ামতুল্লাহ এই কবিতাগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া ইলহামের সাহায্যে লিখেছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতাটি ১১৫২ সালে লেখা হয়েছে। মূলত শাহ নেয়ামতুল্লাহর ব্যাপারে এতটুকু তথ্যই পাওয়া যায় এছাড়া তার জন্ম এবং মৃত্যু কত সালে হয়েছে, তিনি কোথায় এবং কার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছেন, এই কবিতাটির মূল পান্ডুলিপি কত সালে কোথা থেকে প্রকাশ করা হয় ইত্যাদি বিষয়গুলোর কোনো ইনফরমেশন পাওয়া যায় না। যেহেতু শেষ জামানার বিষয়টি আক্বীদার একটি অংশ তাই এ ব্যাপারে খুব সতর্কতা জরূরী সামান্য এদিক সেদিক হলে ঈমানের ঝুকি নিশ্চিত, অন্যদিকে শাহ নেয়ামতুল্লাহর এই কবিতাটিও ইসলামী আক্বীদার গুরুত্বপূর্ণ অংশ শেষ জামানা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করছে। কিন্তু এই কবিতার ঐতিহাসিক প্রমাণ কি? কয়জন যানে শাহ নেয়ামতুল্লাহর সম্পর্কে? কোথা থেকেই বা আসলো এই কবিতাটা? প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাওয়া হয়তো খুবই মুশকিল। তাহলে এখন যানা দরকার কে এই শাহ নেয়ামতুল্লাহ এবং কোথা থেকে আসলো এই কবিতাটা।
শাহ নেয়ামতুল্লাহ ছিলেন ইরানের একজন সূফী তরীকার পন্ডিত তিনি সিরিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর বংশধারা সাইয়্যাদ আবদুল কাদির, গাউস-উল আজম পর্যন্ত পৌঁছে। তার জীবনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ “Tarikh-i-Firishtah” তে পাওয়া যায়। তিনি ১৪৪১ সালে ইন্তেকাল করেন ইরানের মাহানে তার সমাধী রয়েছে। (Vol.: Discourse 3 Rauza I: page 329: published in Cawnpur)
এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো অনেকেই ধারণা করেন শাহ নেয়ামতুল্লাহ ভারতের ছিলেন কিন্তু এই দাবীর সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না মূলত প্রচলিত কবিতাগুলো অধিকাংশ ভারত নিয়ে হওয়ার কারণে এমনটা মনে করা হয়। বরং ইতিহাস প্রমাণ করে শাহ নেয়ামতুল্লাহ ইরানের ছিলেন এবং ইরানে তার সমাধিও রয়েছে। এরপর যখন তার লেখা ভবিষ্যদবানীর কবিতা সম্পর্কে যানার চেষ্টা করি এবং যেই তথ্যগুলো সামনে উঠে আসে তাতে আমি যথারীতি অবাক হয়ে যায়। মূলত শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল ধরে গভীর এক ষড়যন্ত্রের বাণিজ্য চলছে। ইরানের শাহ নেয়ামতুল্লাহ তার জীবদ্দশায় একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কবিতা লিখেছিলেন বটে এবং সেখানে তার জন্ম থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কি কি ঘটতে পারে তার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই কবিতাটি ইরানে তার মাজার থেকে উদ্ধার করা হয়। ১৮৩৩ সালে প্রাচ্যবিদ Edward G. Brown তার মাজার ভ্রমনে যান এবং সেই মাজারের মুতাওয়াল্লি তাকে এই কবিতার পান্ডুলিপি দেন তিনি ১৯০২ এ প্রকাশিত তার বই “A litterary history of persia” তে শাহ নেয়ামতুল্লাহর জীবনী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই ঘটনা উল্লেখ করেন এবং তার কিছু কবিতা অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই কবিতা শুরু হয়েছে – “কুদরাতে কিরদিগার মিবিনাম – হালাতে রোজগার মিবিনাম” অর্থাৎ আমি স্রষ্টার শক্তি দেখি, আমি দেখি সময় কিভাবে চলে যায়। এই কবিতা ভারতবর্ষে প্রথম আসে ১৮৫১ সালে শহীদ শাহ ইসমাঈল রহঃ এর লেখা “আরবাঈন ফী আহওয়াল আল-মাহদিয়্যিন” গ্রন্থে যেহেতু এখানে কবিতার কোনো সূত্রের উল্লেখ ছিলোনা তাই গবেষকগন কবিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন যেমন, ১৮৭১ সালে এই কবিতা ক্যালকাটা রিভিউ তে প্রকাশ পায়। স্যার সৈয়দ আহমাদ এই রিভিউয়ে কবিতা ও তার দেয়া ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন (Khan, review, 31-32)
এখন কথা হলো উদ্ধারকৃত পাণ্ডুলিপিতে মোট কয়টি কবিতা ছিলো এবং সেখানে কি গাজওয়াতুল হিন্দ ও ইমাম মাহমুদের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে? উত্তর হলো সেই পাণ্ডুলিপিতে মোট একটি কবিতা ছিলো যেটার নাম ছিলো “দেওয়ান” সেখানে গাজওয়াতুল হিন্দ কিংবা ইমাম মাহমুদ তো অনেক পরের কথা গোটা ভারত নিয়ে মাত্র এক লাইন আলোচনা করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে – “হালে হিন্দু খারাব মিয়াবাম – জাওরে তুর্ক ও তাতার মিবানাম” অর্থাৎ আমি দেখি ভারতের ধ্বংস, দেখি তুরকি ও তাতারদের জুলুম ও অত্যাচার। যেহেতু এই কবিতাটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে তাই বলা চলে এই কবিতা শাহ নেয়ামতুল্লাহর হওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো সন্দেহ নাই এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু এটা ছাড়াও ভারতে আরো দুইটি কবিতা শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে প্রকাশ হয় দুইটি কবিতাই লেখা হয়েছিলো ভারত নিয়ে দ্বিতীয় কবিতা শুরু হয়েছে- “রাস্ত গুইয়াম বাদশাহে দার জাহাঁ পায়দা শাওয়াদ – নামে তাইমূর বুয়াদ সাহিব-কিরাঁ পায়দা শাওয়াদ” অর্থাৎ, আমি ঠিকই বলেতেছিযে, পৃথিবীতে তইমুর নামক একজন প্রতাপশালী বাদশাহ জন্মগ্রহণ করিবেন। তৃতীয় কবিতা শুরু হয়েছে- “আঁ চুঁ আখেরি যামানা আয়াদ বাদিন যামান – শাহবায-ই সিদরাহ বিনি আয দাস্ত-ই রাইগানা” অর্থাৎ, তখন ই হবে যামানার শেষ, যখন সিদরাতুল মুনতাহার ঈগল হয়ে যাবে হাতছাড়া। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কবিতার ব্যাপারে শায়েখ আব্দুস সালাম আজাদী লেখেন – “প্রথম কবিতা প্রকাশের সাথে দ্বিতীয় কবিতাও মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায়। যেহেতু এখানে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে হুমকি ছিলো, এই জন্য সেই সময়ের মেজিস্ট্রেইট রাভেনশ’ এই কবিতার ২০ লাইন অনুবাদ করেন, এবং এই গুলো ইংরেজ হটানোর ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত বই হিসেবে বাজেয়াপ্তের মধ্যে গণ্য করেন। দ্বিতীয় কবিতাটা পরে হায়দ্রাবাদ থেকে বেনামে একজন ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ে। যাতে অনেক নতুন লাইন ও জুড়ে দেয়া হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের করুণ বিপর্যয়ে মুসলমানদের দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সময় আসে দ্বিতীয় কবিতা। যা কোন কবিতার গ্রন্থে কোনদিন ছিলোনা। এলো ভবিষ্যদ্বাণীর আকারে। খাজা হাসান নিজামি ছিলেন বিশ শতকে সুফী সাংবাদিকতার প্রাণপুরুষ। তিনি লিবিয়ার সানুসি আন্দোলন দ্বারা দারুন ভাবে প্রাভাবিত ছিলেন। এদের নেতা সৈয়দ মুহাম্মাদ আল মাহদী (১৮৪৫-১৯০২) নিজকে ইমাম মাহদী দাবী করতেন। এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে হাসান নিজামি অনেকগুলো বই প্রকাশ করেন। যার একটার নাম ছিলো কিতাবুল আমর, বা নির্দেশ নামা। এর ই একটা চ্যাপ্টার ছিলো কথিত নি’মাত উল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত তৃতীয় কবিতা। সূফীদের ইমাম ইবনে আরাবী ধারণা করতেন, ইমাম মাহদী ১৩৩৫ হিজরিতে (১৯১৭) আসবে, এর উপর ভিত্তি করে হাসান নিজামী নানা যায়গা থেকে বিশেষ করে শাহ নি’মাতুল্লাহ ওয়ালীর ভবিষ্যদ্বাণী গুলো একত্রিত করেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আফগানিস্তানের আমির আমানুল্লাহ ছিলেন ইমাম মাহদী। ফলে ভবিষ্যদ্বাণীর দরকার হতে থাকে। এইভাবে নি’মাতুল্লাহর ভবিষ্যদ্বাণী বলে ভারতীয়দের হাতে বানানো কবিতা সরব হয়ে ওঠে। তিনি একথা অকপটে স্বীকার ও করেছেন তার লেখা ‘হাযরাত ইমাম মাহদী গ্রন্থের ৬৩-৬৪ পৃষ্ঠায়। এই কবিতাগুলোর প্রচারে বেশি কাজ করেছে “দীনদার আঞ্জুমান” নামক এক সংস্থার সামরিক শাখা “হিযবুল্লাহর” এর বিভিন্ন অফিস ও জনশক্তি। এদের নেতা সৈয়দ সিদ্দীক হুসাইন ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে মহানবী (সা) কর্তৃক নির্দেশ প্রাপ্ত দাঈ ইলাল্লাহ। তারাই এই কবিতা গুলো সারা পাক-ভারতে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। এরা নি’মাতুল্লাহ শাহ ওয়ালির নামে ৪টা কবিতা সম্বলিত একটা বই বের করে, যার মাধ্যমে কবির পরিচয় ও নতুন করে দেয়। তিনি নাকি সমরকন্দের লোক ছিলেন বটে, কিন্তু কিরমান ও কাশ্মীরের মানুষদের খেদমাত করেছেন। বইটার নাম হলো “হাক্বীক্বাতে ক্বীয়ামে পাকিস্তান বা তাওসীক্বে বিশারাত” মানে ভবিষ্যদ্বাণীর আলোকে পাকিস্তান রাস্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল হাকিকাত। ” (Spirituality (আধ্যাত্মিকতা), নি’মাতুল্লাহ শাহ ওয়ালির ভবিষ্যদ্বাণী ও গাযওয়া-ই- হিন্দ।। শায়েখ ডক্টর আব্দুস সালাম আজাদী।)
শাহ নেয়ামতুল্লাহর প্রথম কবিতা বাদে বাকিগুলোর ব্যাপারে ইসলামিক স্কলার এবং গবেষকদের মন্তব্য-
১৯৪৭-৪৮ এ প্রাকশিত কবিতা “জং” এ, “মাআরিফ” এ, “ইমরোজে” দেখা যায়। যেহেতু আযমগড়ের “মাআরিফ” হলো গবেষণা জার্ণাল, ফলে এই কবিতা গুলোর অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তারা প্রথম কবিতাটার বিশ্বস্ততা খুঁজে পায়, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় কবিতা দুটো জাল, ও অন্যের কবিতা নি’মাতুল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া বলে প্রমান পায়। তারা একে বানানো ও রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার বলে গণ্য করে। (মাআরিরফ, ভলিউম ৬১, নং২, ফেব্রু ১৯৪৮)।
এরপর ক্বামার ইসলামপুরী বলেন – ভারত বর্ষে গত ১০০ বছরে শায়খ নি’মাতুল্লাহের নামের কবিতা দুটিতে ৮০টা লাইন বানিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানে ২৫ বছরে বানানো হয়েছে ৫৮টি লাইন। (ইসলামপুরী, হাযরাত মাহদী, ৫৭)।
ডঃ চৌধুরি মুহাম্মাদ নাইম বলেনঃ আমি ১৯৭১ সালে মাশরিক (লাহোর), চাটান (লাহোর) এ ১৯৭২ সালে এই কবিতা প্রকাশ হতে দেখেছি। এব্যাপারে ইহসান কুরাইশি সাবিরি একটা আর্টকেল লেখেন, তিনি বলেনঃ নি’মাতুল্লাহর প্রথম কবিতা ছাড়া আর দুইটি কবিতা ছিলো বানানো, জালিয়াত। (চাটান, ১০ জানুয়ারী ১৯৭২, পৃ ১৩)।
কাসিদা সওগাত ও ইমাম মাহমুদের জালিয়াতি
উপরে উল্লেখিত তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে আমরা যানতে পারলাম শাহ নেয়ামতুল্লাহর প্রথম কবিতা দেওয়ান ছাড়া বাকি কবিতাগুলো ছিলো অন্যের বানানো জাল কবিতা। আর এই বানোয়াট কবিতাগুলোর সংমিশ্রনে গঠিত আরেকটি কবিতা ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার সময় প্রকাশিত হয় যেটাকে আজ আমরা কাসিদা সওগাত ইত্যাদি নামে যানি। যখন কিনা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কবিতা জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে এরপর এটাও যে সেই ষড়যন্তেরই একটি অংশ আশা করি এ ব্যাপারে সম্মানিত পাঠকদের মনে আর কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও এটা যে জাল তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো-
[১] কাসিদা সওগাতের ভূমিকাতে বলা হয়েছে এই কবিতা ১১৫২ সালে শাহ নেয়ামতুল্লাহ রচনা করেছেন অথচ শাহ নেয়ামতুল্লাহর মৃত্যু ১৪৪১ সালে কবিতার রচনাকাল এবং মৃত্যুর সাল হিসাব করলে দাঁড়ায় শাহ নেয়ামতুল্লাহ তিনশত বছরেরও বেশি সময় জীবিত ছিলেন যা খুবই হাস্যকর এবং অযোক্তিক। এরপর একই কবিতার দ্বিতীয় সংস্করনে এসেছে একরকম আবার প্রথমটাতে এসেছে ঠিক তার বিপরীত যেমন- চতুর্থ কবিতা অর্থাৎ কাসিদা সওগাত এর প্রথমটাতে বলা হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আল্লাহর সাহায্যে আফগানিস্তান থেকে হাবিবুল্লাহ সাহেবে কিরান নামক একজন ব্যাক্তি অস্ত্র ধারন করবে অতঃপর মুসলিমরা বিজয়ী হবে অর্থাৎ আফগানবাসী আনন্দিত হবে (ফারসীতে সরাসরী আফগানবাসী বলা হয়েছে) । আর দ্বিতীয়টাতে বলা হয়েছে ভারত ভাগ হওয়ার পরে হিন্দুস্তানে মুশরিকরা মুসলিমদের উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাবে পরে পাঞ্জাবের কেন্দ্র কাশ্মীর মুসলমানরা দখল করবে বিপরীতে হিন্দুরা মুসলিমদের একটি বড় সহর দখল করবে অতঃপর মুহাররম মাসে মুসলিমরা তলোয়ার হাতে নিবে তখন হাবিবুল্লাহ সাহেবে কিরান নামক একজন ব্যাক্তি আল্লাহর সাহায্যে তলোয়ার হাতে নিয়ে অগ্রসর হবে। একটু লক্ষ করুন দুইটি কবিতাতে হাবিবুল্লাহ নামক একজনের আগমনের কথা বলা হয়েছে দুইটাতে তার আগমনের সময়কাল নিয়ে এক বিড়াট পার্থক্য রয়েছে রয়েছে অসংগতি। একটাতে বলা হয়েছে হাবিবুল্লাহ আসবেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আফগানিস্তান থেকে অন্যটাতে বলা হয়েছে তিনি আসবেন হিন্দুস্তান থেকে ১৯৪৭ অর্থাৎ ভারত ভাগ হওয়ার ও অনেক পরে। একজন ব্যাক্তি কিভাবে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিতে পারেন?
[২] এটি বানোয়াট হওয়ার একটি অভ্যন্তরীণ প্রমাণ রয়েছে যা এই কবিতার লাইনগুলিতে দেখা যায়। প্রথমে এই কাব্যের প্রতিটি স্তবক ভারতীয়-শৈলী-ফার্সিতে লেখা এবং শাহ নেমাতুল্লাহর সময়ের ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই কবিতায় এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলো সেই সময়ে কখনোই উহ্য অর্থে ব্যবহৃত হতো না। তাছাড়া কবিতায় উল্লিখিত কয়েকটি দেশ শাহ নেমাতুল্লাহর সময়ে ওই নামে পরিচিত ছিল না। এই ক্ষেত্রে “JAPAN” এর কথা বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। কিন্তু তখন এই দ্বীপটি ওই নামে পরিচিত ছিল না। “জাপান” নাম দেওয়া হয়েছিল ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কো পোলোর চীন সফরের পর চীনারা এই দ্বীপটিকে “CHIPEN-KUE” নামে ডাকত যা পরবর্তীতে ‘CHIPANGI’ তে পরিবর্তিত হয় এবং ইংরেজি ভাষায় একে বলা হতে থাকে “JAPAN’। (Japan by David Murray)। (“Ma’arif”: February, 1948. Quoted from “Daily Jang”, Rawalpindi: dated 25th December, 1971: page: 3).
কবিতাগুলোর ভিত্তিই মিথ্যার উপর প্রতিষ্টিত এবং মিথ্যাকে প্রতিষ্টিত করতেই এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। অনুরূপ ইমাম মাহমুদ নামক মিথ্যা চরিত্রকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে এই কবিতা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এখানেও তারা জালিয়াতির উপরে জালিয়াতি করেছে। মাহমুদ ও তার মুফতিদের কর্তৃক শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামে বানোয়াট কবিতা নিয়ে জালিয়াতির কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে –
[১] তাদের দাবীর মূল বিষয়বস্তু হলো মাহদির পূর্বে মুসলিমদের আরেকজন নেতা আসবেন তিনি হিন্দুস্তানের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিবেন তার পরিচয় কি? পরিচয় তার নাম হবে মাহমুদ। কিন্তু তারা মাহমুদের ক্ষেত্রে আরেকটি নাম ব্যবহার করে “হাবিবুল্লাহ” আমরা ইতিপূর্বে যেনেছি কাসিদা সওগাতে হাবিবুল্লাহ নামক এক ব্যাক্তির আগমনের কথা বলা হয়েছে। যেহেতু কাসিদার কথিত হাবিবুল্লাহ এসেই মুশরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করবে বলে উল্লেখ রয়েছে এবং সেখানে ইমাম মাহমুদের কথা বলা হয়নি বিপরীতে মাহমুদের দাবী হলো তিনিই এই যুদ্ধের নেতা তাই কথিত হাবিবুল্লাহ দ্বারা জনগন যেন অন্য কাউকে ভেবে মাহমুদ কে প্রত্যাক্ষান না করে সেজন্যেই মাহমুদের সাথে অতিরিক্ত হাবিবুল্লাহ নামটিও জুরে দেওয়া হয়। এখন আমরা যদি একটু বাস্তবতার দিকে তাকায় যে নিজেকে কথিত মাহমুদ, হাবিবুল্লাহ দাবী করছে প্রকৃতপক্ষেই কি তার নাম মাহমুদ, হাবিবুল্লাহ? এর উত্তর একটাই এই ব্যাক্তির আসল নাম “জুয়েল” না পূর্বে কখনো তিনি মাহমুদ ছিলো আর না এখন দাবী করাতে সে মাহমুদ বলে গন্য হবে।
[২] তাদের দাবীর দ্বিতীয় চরিত্র হলো “সাহেবে কিরান” দাবী করা হয় তিনি হিন্দের যুদ্ধের সেনাপতি হবেন কাসিদা থেকেও তার ব্যাপারে দলিল দেওয়া হয়, কাসিদা সওগাতের ৪৪ নং প্যারার অনুবাদ করা হয়েছে- “সাহেবে কিরান হাবিবুল্লাহ হাতে নিবে শমসের – খোদায়ী মদদে ঝাপিয়ে পরিবে ময়দানে যুদ্ধের” এখানে অনুবাদটা হবে মূলত এমন “হাবিবুল্লাহ সাহেবে কিরান আল্লাহর সাহায্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে অগ্রসর হবেন” অর্থাৎ হাবিবুল্লাহ নামক ব্যাক্তি যার গুনাবলী বা বৈশিষ্ট হবে “সাহেবে কিরান” সাহেবে কিরান কোনো আলাদা ব্যাক্তির নাম নয় এটা একটা গুণ। অথচ কথিত মাহমুদ সাহেবে কিরান দ্বারা পৃথক এক চরিত্রের দাবী করে তাদের ব্যাখ্যা হলো সাহেবে কিরান এবং হাবিবুল্লাহ দুজন মিলে মুশরিকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। শাহ নেয়ামতুল্লাহর দ্বিতীয় কবিতায় তইমুর লং কে সাহেবে কিরান বলা হয়েছে এমনকি এই কবিতার দ্বিতীয় প্যারাতে “দ্বিতীয় সাহেবে কিরান” এর দ্বারা তইমুর লং এর পরবর্তী বাদশাকে বোঝানো হয়েছে যার শাসন হবে যুলুমের এখানে তাকেও সাহেবে কিরান বলা হয়েছে যারা ফারসী যানেন তারা ফারসী লাইনটা দেখে নিবেন। সুবহানআল্লাহ! কতই না সূক্ষভাবে ধোকা দেওয়া হয়েছে একই কবিতার যেখানে দ্বিতীয় সাহেবে কিরানের শাসনকে জুলমের বলা হয়েছে সেখানে বাংলা অনুবাদে সরাসরী সাহেবে কিরান উল্লেখ না করে শুধু মুঘল বাদশাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অথচ “হাবিবুল্লাহ সাহেবে কিরান” এর স্থানে বাংলাতে সাহেবে কিরানই অনুবাদ করা হয়েছে। এতে করে ঘটনা যা দাঁড়ায় (১) সাহেবে কিরান মূলত হাবিবুল্লাহর বৈশিষ্ট আলাদা কোনো ব্যাক্তি নয়। (২) কবিতায় একাধিক ব্যাক্তিকে সাহেবে কিরান বলা হয়েছে। (৩) সাহেবে কিরান আল্লাহর বিষেশ বা মনোনীত কোনো বান্দা নয় কারণ কাসিদায় জালিম শাসককেও সাহেবে কিরান বলা হয়েছে। এভাবে তারা জাল বানোয়াট কবিতার ভুলভাল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষদের গোমড়াহ করছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন –
إِنَّ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ فِتَنًا كَأَنَّهَا قِطَعُ اللَّيْلِ الْمُظْلِمِ يُصْبِحُ الرَّجُلُ فِيهَا مُؤْمِنًا وَيُمْسِي كَافِرًا وَيَبِيعُ فِيهَا أَقْوَامٌ خَلَاقَهُمْ بِعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের পূর্বে অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। সকালে একজন লোক মুমিন অবস্থায় ঘুম থেকে জাগ্রত হবে। বিকালে সে কাফেরে পরিণত হবে। বহু সংখ্যক লোক ফিতনায় পড়ে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তাদের চরিত্র ও আদর্শ বিক্রি করে দিবে।[মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।]
এই হাদিসে আমাদের জন্য সতর্কবার্তা রয়েছে অর্থাৎ শেষ জামানায় এমন সব ফিতনা প্রকাশিত হবে যা অন্ধকার রাত্রির মত ঘন কালো হবে অন্ধকারে যেমন কোনো বস্তু স্পষ্টভাবে দেখা যায় না বা বোঝা যায় না ঠিক তেমনি আমাদের সমাজে এমন কিছু কাজ্জাব এবং দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে যাদের আসল চেহারা সাধারন মুসলিমরা সহজেই বুঝতে পারবে না। এই ঘন কালো ফিতনা চিহ্নিত করতে হলে অবশ্যই কুরআন সুন্নাহর আলোই পথ চলতে হবে। আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে –
إِنَّ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ صلى الله عليه وسلم وَشَرَّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَ (إِنَّ مَا تُوعَدُونَ لاَتٍ وَمَا أَنْتُمْ بِمُعْجِزِينَ)
সর্বোত্তম কালাম হল আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম পথ নির্দেশনা হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ নির্দেশনা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল নতুনভাবে উদ্ভাবিত পন্থাসমূহ। ’’তোমাদের কাছে যার ও’য়াদা দেয়া হচ্ছে তা ঘটবেই, তোমরা ব্যর্থ করতে পারবে না’’- (সূরাহ আন’আম ৬/১৩৪)।[সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৮১)
وَ قُلۡ جَآءَ الۡحَقُّ وَ زَهَقَ الۡبَاطِلُ ؕ اِنَّ الۡبَاطِلَ کَانَ زَهُوۡقًا
আর বলুন, হক এসেছে ও বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে; নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।[১৭: ৮১]
Comment