বাংলাদেশে একেশ্বরবাদ বনাম পৌত্তলিকতার লড়াই
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে একনায়কতন্ত্র দেখতেই অভ্যস্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সেখানেও একনায়কতন্ত্র চলছে। তবে চারটি ক্ষেত্র বিবেচনায় বাংলাদেশকে বর্তমান বিশ্বে তর্কাতীতভাবে বিরল বলা যেতে পারে। প্রথমটি হোল দেশটির শাসক কেবল একজন একনায়ক নন, তিনি নির্ভেজাল ফ্যাসিস্ট। আমরা অবগত আছি যে, ফ্যাসিবাদ একনায়কতন্ত্রেরই চরম রূপ। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে বর্তমান শতাব্দীতে একমাত্র ইজিপ্টের সিসি খানিকটা শেখ হাসিনার সংগে তুলনীয় হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের শাসক একজন নারী যেটা এই মুহূর্তে আমার জানা মতে আর কোন মুসলিম রাষ্ট্রে নেই। তৃতীয়ত শেখ হাসিনা যেমন সদম্ভে ও প্রকাশ্যে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিবেশী আগ্রাসী শক্তির পদতলে সমর্পণ করেছেন তারও নজির অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের চার নম্বর বিরল বৈশিষ্ট হোল, বাঙালি মুসলমানের আচার অনুষ্ঠানে পৌত্তলিকতার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি পূর্ব হতে দৃশ্যমান থাকলেও বিশেষ করে, বিগত এক যুগে এই দেশটিতে বিভিন্ন ঢং’এ পৌত্তলিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ধর্ম বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নে একেশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। আল্লাহ্*র প্রেরিত রসূলদের মধ্যে কেবল আমাদের মহান নবী হজরত মোহাম্মদ [সা:] মূর্তি বিনাশ করেন নাই, তার আগমনের অনেক আগে ইসলাম, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম [আ:] একইভাবে পৌত্তলিকতার প্রতীক মূর্তি ভেঙেছিলেন। পবিত্র কোরআন শরীফেও হজরত ইবরাহিমের [আ:] মূর্তি ভাঙ্গার কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মানসে সেই পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ নিয়েই আমার আজকের সম্পাদকীয়।
বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আজকাল একটি কথা প্রায়ই বলছেন। তার বক্তব্য হোল, ‘বাংলাদেশে ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালের চেতনার মধ্যে লড়াই চলছে। তিনি এবং তার দল একমাত্র ১৯৭১ সালের চেতনার অনুসারী এবং তারা ১৯৪৭ সালের চেতনাকে পরাজিত করতেও বদ্ধপরিকর’। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে হলে আগে আমাদের ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার অর্থ বুঝতে হবে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠী [আমাদের পূর্বপুরুষ] ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। ওবায়দুল কাদের আমাদের পূর্বপুরুষের সেই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামকে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে এখন নতুন করে লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হোল ১৯৪৭ সালের সেই সংগ্রামে ওবায়দুল কাদেরদের ‘পরম পূজনীয় জাতির পিতা’ শেখ মুজিব, জনগণের অর্থে যার মূর্তি দিয়ে বাংলাদেশ ছেয়ে ফেলা হচ্ছে, তিনি নিজেও মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব নিজে লিখেছেন, ‘আমি প্রায় সকল সময়ই পাকিস্তান, পাকিস্তান করে বেড়াই’ [পৃষ্ঠাঃ ৩৭]। অতএব, ১৯৪৭ সালে শেখ মুজিব কিছুটা হলেও ইসলামের চেতনা লালন করতেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ওবায়দুল কাদেরের থিসিস অনুযায়ী তাহলে সেই সময় শেখ মুজিবও ১৯৪৭ এর চেতনাধারী হয়ে গর্হিত অপরাধ করেছিলেন। সেই অপরাধের জন্য মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে কখনও ক্ষমা চেয়েছেন বলেও আমরা জানি না। ১৯৪৭ সালের চেতনা যদি গর্হিত হয়ে থাকে তাহলে তো আমাদের ভারতের সাথে মিশে যেতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের চেতনা অনুযায়ী সেক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন না করে পশ্চিম বঙ্গের সংগে একীভূত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। শেখ হাসিনা তাহলে কী বাংলাদেশকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছেন?
এবার আওয়ামী বয়ানে ১৯৭১ এর চেতনা বোঝা দরকার। ইংরেজিতে লেখা আমার একটা বই ২০১৯ এর জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কাশিমপুর জেলে বন্দি থাকাকালীন বইটির পান্ডুলিপি শেষ করেছিলাম। মুসলিম বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস বিষয়ক বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছিলাম, মুসলমান পরিচয়ের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়[The victory of Bengali nationalism over Muslim identity]। সেই পাকিস্তানী আমল থেকে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বয়ান চলছে তার জন্ম হয়েছিলো উনিশ শতকে তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সহায়তাক্রমে বেঙ্গল রেনেসাঁর উৎপত্তিই হয়েছিলো কট্টর হিন্দুত্ববাদের আদর্শকে ধারণ করে। বাঙালি মুসলমান ও তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করাই ছিল সেই হিন্দু বেঙ্গল রেনেসাঁর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই কারণেই বেঙ্গল রেনেসাঁর ইতিহাসে কোন মুসলমানের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপলব্ধি করা দরকার যে, ওবায়দুল হকদের ১৯৭১ এর চেতনায় ইসলামের কোন জায়গা নাই। এই শ্রেণি যখন ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার সংঘাতের কথা বলেন সেটা একেশ্বরবাদের সাথে পৌত্তলিকতার আবহমান লড়াইয়েরই নামান্তর।
শেখ মুজিবের ব্যক্তিপূজার নামে বাংলাদেশে আজ যা চলছে তার সংগে পৌত্তলিক মূর্তি পূজার কোন চারিত্রিক প্রভেদ নাই। বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই মূর্তি পূজার সংস্কৃতি বেশ আগ্রহের সাথে গ্রহণও করেছে। পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস, মুজিব বর্ষ, ইত্যাদি অনুষ্ঠানের কর্মসূচির দিকে তাকালেই বাঙালি মুসলমান সমাজ ইসলামের একেশ্বরবাদ থেকে কতখানি বিচ্যুত হয়েছে সেটা টের পাওয়া যায়। খালি পায়ে বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলন, বিচিত্র সব মূর্তি সহকারে মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুজিব মূর্তির সামনে জোর হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, এই জাতীয় কর্মকাণ্ড পৌত্তলিকতারই বিভিন্ন রূপ। একবার শেখ মুজিবের জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনে দেখা এক দৃশ্যের বর্ণনা করছি। এক স্কুলে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিলো। শেখ মুজিবের বিশাল এক ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে মালা চড়ানো হয়েছে, সামনে সারি সারি প্রদীপ জ্বলছে। স্কুলের কোমলমতি শিশুরা সেই ছবির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে প্রণামের ভঙ্গি করছে। বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম রাষ্ট্রে কোন মৃত নেতার প্রতি এভাবে সন্মান জানানোর প্রথার কথা অন্তত আমার জানা নাই। বাংলাদেশের ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায় এবং সাংস্কৃতিক জগতে অর্ধ শতাব্দীকাল ব্যাপী একচেটিয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচারণা চালানোর ফলেই এই বিজাতীয় সংস্কৃতির এমন ভয়াবহ বিস্তার সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার গোষ্ঠী এভাবেই পৌত্তলিকতাকে বাঙালি সংস্কৃতি রূপে চালিয়ে দিচ্ছে।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অপর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন মুসলমান নিজের বাসায় জলপান করতে চান বলে আমার জানা নাই। সমাজে রীতিমতো সিল মারা মুসলমান নামের সেক্যুলারদের মধ্যে দুই একজন আমার বাড়িতে কখনও সখনও এলে পিপাসা লাগলে পানি খেতেই চেয়েছেন। কেউ কোনদিন ‘জল’ চান নাই। বাঙালি মুসলমানের ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার তাদের ধর্মপালনের অংশ নয়, এটি তাদের সংস্কৃতি। একজন বাঙালি হিন্দু যখন জল চায় সেটিও তার সংস্কৃতি। অথচ ৯০ শতাংশ বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় এখন সর্বত্র জলের জোয়ার চলছে। ক্বচিৎ ‘পানি’ শব্দটি চোখে পড়তে পারে। সংস্কৃতিকে এভাবেই পরিকল্পিতভাবে বিজাতিয়করণ করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এই গতিতে চলতে থাকলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশের জনগণ পানি শব্দটি ভুলে গিয়ে জলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে মঙ্গল প্রদীপ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতির বয়সও কিন্তু তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের বেশি কিছুতেই হবে না। অথচ এখন শুনতে পাই এগুলো নাকি বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ! জাতিসংঘের চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী সংস্থা ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিয়েও বসে আছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি যদি সাহস করে এই সব আচার-অনুষ্ঠানকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে বর্জনের প্রস্তাব করেন তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী, মৌলবাদী ইত্যাকার বিশেষণ দিয়ে জেলে পুরে ফেলা হবে।
মুসলিম বাংলার ইতিহাস নিয়ে আমার লেখা একটি বই এর কথা খানিক আগে উল্লেখ করেছি। সেই বইটির প্রধান শিরোনামের নীচে একটি ক্ষুদ্র শিরোনাম দিয়েছি। সেই ক্ষুদ্র শিরোনামটি হোল, বিশ্বাসের অসমাপ্ত লড়াই [An unfinished battle of faith]। ওবায়দুল কাদের ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার লড়াই এর কথা বলতে গিয়ে জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে বিশ্বাসের লড়াই এর কথাই প্রকৃতপক্ষে বলেছেন। বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তারা এখন আলেম সমাজের মূর্তি বিরোধী আন্দোলনকেও অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে অবজ্ঞা করছেন। তারা সম্ভবত উপলব্ধি করছেন না যে, এটা আসলে বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্বের লড়াই। কাশ্মীরের মুসলমানরা ৭০ বছর ধরে আজাদির জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। সেই লড়াই এ কত লক্ষ পুরুষ, নারী ও শিশু ভারতীয় দখলদার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন তার হিসাব নাই। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় শাসকশ্রেণির এত নিপীড়ন সত্ত্বেও কাশ্মীরি মুসলমানদের স্বাধীনতার স্পৃহা একই রকম প্রবল রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের দুর্ভাগ্য যে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেও গত পঞ্চাশ বছরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের নিকট কেবল স্বাধীনতা নয়, তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি দুটোই বিনা প্রতিবাদে বিসর্জন দিয়েছে।
সূত্র: আমার দেশ
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে একনায়কতন্ত্র দেখতেই অভ্যস্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সেখানেও একনায়কতন্ত্র চলছে। তবে চারটি ক্ষেত্র বিবেচনায় বাংলাদেশকে বর্তমান বিশ্বে তর্কাতীতভাবে বিরল বলা যেতে পারে। প্রথমটি হোল দেশটির শাসক কেবল একজন একনায়ক নন, তিনি নির্ভেজাল ফ্যাসিস্ট। আমরা অবগত আছি যে, ফ্যাসিবাদ একনায়কতন্ত্রেরই চরম রূপ। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে বর্তমান শতাব্দীতে একমাত্র ইজিপ্টের সিসি খানিকটা শেখ হাসিনার সংগে তুলনীয় হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের শাসক একজন নারী যেটা এই মুহূর্তে আমার জানা মতে আর কোন মুসলিম রাষ্ট্রে নেই। তৃতীয়ত শেখ হাসিনা যেমন সদম্ভে ও প্রকাশ্যে দেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিবেশী আগ্রাসী শক্তির পদতলে সমর্পণ করেছেন তারও নজির অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের চার নম্বর বিরল বৈশিষ্ট হোল, বাঙালি মুসলমানের আচার অনুষ্ঠানে পৌত্তলিকতার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি পূর্ব হতে দৃশ্যমান থাকলেও বিশেষ করে, বিগত এক যুগে এই দেশটিতে বিভিন্ন ঢং’এ পৌত্তলিকতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ধর্ম বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নে একেশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতা পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। আল্লাহ্*র প্রেরিত রসূলদের মধ্যে কেবল আমাদের মহান নবী হজরত মোহাম্মদ [সা:] মূর্তি বিনাশ করেন নাই, তার আগমনের অনেক আগে ইসলাম, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম [আ:] একইভাবে পৌত্তলিকতার প্রতীক মূর্তি ভেঙেছিলেন। পবিত্র কোরআন শরীফেও হজরত ইবরাহিমের [আ:] মূর্তি ভাঙ্গার কাহিনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের মানসে সেই পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ নিয়েই আমার আজকের সম্পাদকীয়।
বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আজকাল একটি কথা প্রায়ই বলছেন। তার বক্তব্য হোল, ‘বাংলাদেশে ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালের চেতনার মধ্যে লড়াই চলছে। তিনি এবং তার দল একমাত্র ১৯৭১ সালের চেতনার অনুসারী এবং তারা ১৯৪৭ সালের চেতনাকে পরাজিত করতেও বদ্ধপরিকর’। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের মর্মার্থ বুঝতে হলে আগে আমাদের ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার অর্থ বুঝতে হবে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠী [আমাদের পূর্বপুরুষ] ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। ওবায়দুল কাদের আমাদের পূর্বপুরুষের সেই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামকে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে এখন নতুন করে লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হোল ১৯৪৭ সালের সেই সংগ্রামে ওবায়দুল কাদেরদের ‘পরম পূজনীয় জাতির পিতা’ শেখ মুজিব, জনগণের অর্থে যার মূর্তি দিয়ে বাংলাদেশ ছেয়ে ফেলা হচ্ছে, তিনি নিজেও মুসলিম লীগের একজন কর্মী হিসেবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিব নিজে লিখেছেন, ‘আমি প্রায় সকল সময়ই পাকিস্তান, পাকিস্তান করে বেড়াই’ [পৃষ্ঠাঃ ৩৭]। অতএব, ১৯৪৭ সালে শেখ মুজিব কিছুটা হলেও ইসলামের চেতনা লালন করতেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ওবায়দুল কাদেরের থিসিস অনুযায়ী তাহলে সেই সময় শেখ মুজিবও ১৯৪৭ এর চেতনাধারী হয়ে গর্হিত অপরাধ করেছিলেন। সেই অপরাধের জন্য মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কাছে কখনও ক্ষমা চেয়েছেন বলেও আমরা জানি না। ১৯৪৭ সালের চেতনা যদি গর্হিত হয়ে থাকে তাহলে তো আমাদের ভারতের সাথে মিশে যেতে হয়। ওবায়দুল কাদেরের চেতনা অনুযায়ী সেক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন না করে পশ্চিম বঙ্গের সংগে একীভূত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। শেখ হাসিনা তাহলে কী বাংলাদেশকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছেন?
এবার আওয়ামী বয়ানে ১৯৭১ এর চেতনা বোঝা দরকার। ইংরেজিতে লেখা আমার একটা বই ২০১৯ এর জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। কাশিমপুর জেলে বন্দি থাকাকালীন বইটির পান্ডুলিপি শেষ করেছিলাম। মুসলিম বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস বিষয়ক বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছিলাম, মুসলমান পরিচয়ের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়[The victory of Bengali nationalism over Muslim identity]। সেই পাকিস্তানী আমল থেকে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বয়ান চলছে তার জন্ম হয়েছিলো উনিশ শতকে তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সহায়তাক্রমে বেঙ্গল রেনেসাঁর উৎপত্তিই হয়েছিলো কট্টর হিন্দুত্ববাদের আদর্শকে ধারণ করে। বাঙালি মুসলমান ও তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করাই ছিল সেই হিন্দু বেঙ্গল রেনেসাঁর অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই কারণেই বেঙ্গল রেনেসাঁর ইতিহাসে কোন মুসলমানের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপলব্ধি করা দরকার যে, ওবায়দুল হকদের ১৯৭১ এর চেতনায় ইসলামের কোন জায়গা নাই। এই শ্রেণি যখন ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার সংঘাতের কথা বলেন সেটা একেশ্বরবাদের সাথে পৌত্তলিকতার আবহমান লড়াইয়েরই নামান্তর।
শেখ মুজিবের ব্যক্তিপূজার নামে বাংলাদেশে আজ যা চলছে তার সংগে পৌত্তলিক মূর্তি পূজার কোন চারিত্রিক প্রভেদ নাই। বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ এই মূর্তি পূজার সংস্কৃতি বেশ আগ্রহের সাথে গ্রহণও করেছে। পহেলা বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস, মুজিব বর্ষ, ইত্যাদি অনুষ্ঠানের কর্মসূচির দিকে তাকালেই বাঙালি মুসলমান সমাজ ইসলামের একেশ্বরবাদ থেকে কতখানি বিচ্যুত হয়েছে সেটা টের পাওয়া যায়। খালি পায়ে বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলন, বিচিত্র সব মূর্তি সহকারে মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুজিব মূর্তির সামনে জোর হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, এই জাতীয় কর্মকাণ্ড পৌত্তলিকতারই বিভিন্ন রূপ। একবার শেখ মুজিবের জন্ম অথবা মৃত্যু দিবসে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনে দেখা এক দৃশ্যের বর্ণনা করছি। এক স্কুলে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিলো। শেখ মুজিবের বিশাল এক ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে মালা চড়ানো হয়েছে, সামনে সারি সারি প্রদীপ জ্বলছে। স্কুলের কোমলমতি শিশুরা সেই ছবির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে প্রণামের ভঙ্গি করছে। বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য কোন মুসলিম রাষ্ট্রে কোন মৃত নেতার প্রতি এভাবে সন্মান জানানোর প্রথার কথা অন্তত আমার জানা নাই। বাংলাদেশের ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায় এবং সাংস্কৃতিক জগতে অর্ধ শতাব্দীকাল ব্যাপী একচেটিয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচারণা চালানোর ফলেই এই বিজাতীয় সংস্কৃতির এমন ভয়াবহ বিস্তার সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সেক্যুলার গোষ্ঠী এভাবেই পৌত্তলিকতাকে বাঙালি সংস্কৃতি রূপে চালিয়ে দিচ্ছে।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অপর একটি উদাহরণ দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন মুসলমান নিজের বাসায় জলপান করতে চান বলে আমার জানা নাই। সমাজে রীতিমতো সিল মারা মুসলমান নামের সেক্যুলারদের মধ্যে দুই একজন আমার বাড়িতে কখনও সখনও এলে পিপাসা লাগলে পানি খেতেই চেয়েছেন। কেউ কোনদিন ‘জল’ চান নাই। বাঙালি মুসলমানের ‘পানি’ শব্দ ব্যবহার তাদের ধর্মপালনের অংশ নয়, এটি তাদের সংস্কৃতি। একজন বাঙালি হিন্দু যখন জল চায় সেটিও তার সংস্কৃতি। অথচ ৯০ শতাংশ বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় এখন সর্বত্র জলের জোয়ার চলছে। ক্বচিৎ ‘পানি’ শব্দটি চোখে পড়তে পারে। সংস্কৃতিকে এভাবেই পরিকল্পিতভাবে বিজাতিয়করণ করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এই গতিতে চলতে থাকলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশের জনগণ পানি শব্দটি ভুলে গিয়ে জলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে মঙ্গল প্রদীপ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতির বয়সও কিন্তু তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের বেশি কিছুতেই হবে না। অথচ এখন শুনতে পাই এগুলো নাকি বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের সংস্কৃতির অংশ! জাতিসংঘের চিহ্নিত ইসলামবিদ্বেষী সংস্থা ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির স্বীকৃতি দিয়েও বসে আছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশে কোন ব্যক্তি যদি সাহস করে এই সব আচার-অনুষ্ঠানকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে বর্জনের প্রস্তাব করেন তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী, মৌলবাদী ইত্যাকার বিশেষণ দিয়ে জেলে পুরে ফেলা হবে।
মুসলিম বাংলার ইতিহাস নিয়ে আমার লেখা একটি বই এর কথা খানিক আগে উল্লেখ করেছি। সেই বইটির প্রধান শিরোনামের নীচে একটি ক্ষুদ্র শিরোনাম দিয়েছি। সেই ক্ষুদ্র শিরোনামটি হোল, বিশ্বাসের অসমাপ্ত লড়াই [An unfinished battle of faith]। ওবায়দুল কাদের ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর চেতনার লড়াই এর কথা বলতে গিয়ে জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে বিশ্বাসের লড়াই এর কথাই প্রকৃতপক্ষে বলেছেন। বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত মুসলমান জনগোষ্ঠী ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তারা এখন আলেম সমাজের মূর্তি বিরোধী আন্দোলনকেও অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে অবজ্ঞা করছেন। তারা সম্ভবত উপলব্ধি করছেন না যে, এটা আসলে বাঙালি মুসলমানের অস্তিত্বের লড়াই। কাশ্মীরের মুসলমানরা ৭০ বছর ধরে আজাদির জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। সেই লড়াই এ কত লক্ষ পুরুষ, নারী ও শিশু ভারতীয় দখলদার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন তার হিসাব নাই। হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় শাসকশ্রেণির এত নিপীড়ন সত্ত্বেও কাশ্মীরি মুসলমানদের স্বাধীনতার স্পৃহা একই রকম প্রবল রয়েছে। বাঙালি মুসলমানের দুর্ভাগ্য যে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেও গত পঞ্চাশ বছরে হিন্দুত্ববাদী ভারতের নিকট কেবল স্বাধীনতা নয়, তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি দুটোই বিনা প্রতিবাদে বিসর্জন দিয়েছে।
সূত্র: আমার দেশ
Comment