ভাস্কর্য ইস্যু এবং ইস্তিহলালের সেই সংশয়টি
আপনারা সবাই হয়তো শুনে আসছেন এতোদিন যে, শরীয়তের বিধানকে অপছন্দ বা অস্বীকার না করলে কাফের হবে না। শাসকরা এটা করে না। তারা শরীয়তের বিধানকে স্বীকার করে, পছন্দও করে। কিন্তু প্রায়োগিক জীবনে আমল করে না। ভিন্ন আইন দিয়ে রাষ্ট্র চালায়।
কথাটা হয়তো সবাই শুনে থাকবেন। এটা মূলত ইরজায়ি আকিদা। কুফরকে সব সময় ইস্তিহলালের সাথে শর্তযুক্ত করা ইরজা ও জাহমিয়াত।
কুফরি কানুন দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা স্বয়ং কুফর। এর জন্য ইস্তিহলাল শর্ত নয়। তবুও আপনারা ইস্তিহলালের শর্তটা শুনে আসছেন আজীবন। কিন্তু এবারের ভাস্কর্য ইস্যু হয়তো ইস্তিহলালের চেহারা কিছুটা প্রকাশ করেছে। বরং বলতে গেলে ভয়ানক চেহারা প্রকাশ করেছে। সারা দেশের আলেম উলামারা ঐক্যবদ্ধভাবে ফতোয়া দিয়ে, আন্দোলন করেও সরকার আর সরকারের অনুসারীদের বুঝাতে সক্ষম হলো না যে, ভাস্কর্য হারাম। যতই বুঝাচ্ছেন শুধু উল্টো দিকেই গড়াচ্ছে।
এখন আপনারা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে, সরকারপক্ষ ভাস্কর্য হালাল মনে করে?
জোচ্চুর না হলে কেউ পারবেন না। সকলের কাছেই পরিষ্কার, তারা ভাস্কর্য হালাল মনে করে। বরং আলেম উলামারা ভাস্কর্যকে হারাম বলায় তারা উলামাদের কি পরিমাণ অপমান আর ভয়ানক রকমের গালিগালাজ করছে তা সবার নিকট স্পষ্ট।
এখন সরকারপক্ষের অবস্থান হলো, ভাস্কর্য হালাল। ভাস্কর্য হারাম এ কথা কুরআন সুন্নাহয় কোথাও নেই। যারা বলছে হারাম তারা মূর্খ। এরা ইসলামের দুশমন। এরা স্বার্থবাজ। স্বার্থের লোভে ঘুরিয়ে ফতোয়া দিচ্ছে। এরা সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করতে চায়।
আসলে ভাস্কর্য যে হারাম এটা তারা নিজেরাও জানে। তবে যদি বলে, ইসলামে হারাম হলেও আমরা সেটা মানি না- তাহলে সকলে স্পষ্ট বুঝে নেবে যে, এরা ইসলাম মানে না। এরা ইসলামদ্রোহী। তাই ঘুরিয়ে বলছে যে, ইসলামে হারামের কথা নেই। এটাই আসলে হাকিকত।
ভাস্কর্য থেকে কুফরি সংবিধান
আপনি কুফরি সংবিধানের শরীয়তবিরোধী বিধানের ক্ষেত্রেও এ কথাটা বলতে পারেন যে, তারা জানে শরীয়তে চোরের হাত কাটতে হয়, যিনায় দোররা লাগাতে বা রজম করতে হয়। জানে ইসলামে মদ সুদ হারাম। কিন্তু এগুলো তারা অপছন্দ করে। তাই এগুলো পাল্টে কুফরি বিধান প্রতিস্থাপন করেছে।
কেউ কেউ তো পরিষ্কারই বলছে, এগুলো সব মানবতাবিরোধী বিধান। এরা তো স্পষ্টই মুরতাদ।
আর অনেকে ঘুরিয়ে বলছে, সংবিধানে শরীয়ত বিরোধী কিছু নেই।
তার মানে, তারা শরীয়তের স্থলে যেসব কুফরি বিধান প্রতিস্থাপন করেছে সেগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। এগুলো শরীয়তবিরোধী নয়। আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে এগুলো দিয়ে রাষ্ট্রচালনাও শরীয়তে হালাল। এভাবে স্পষ্টই তারা শরীয়তের হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল জ্ঞান করছে। কিন্তু এরপরও আমরা বলে বেড়াচ্ছি, তাদের মধ্যে ইস্তিহলাল নেই।
আসলে প্রথম গ্রুপের মতো এরাও ইসলামের বিধান অপছন্দ করে। যুগের অনুপোযোগী মনে করে। কিন্তু পরিষ্কার বললে আবার জনসাধারণ ক্ষেপে যায় কি’না। সেই ভয়ে ঘুরিয়ে বলছে। কিন্তু শেষমেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা কিন্তু একটাই, শরীয়তের বিধানকে অস্বীকার করা হচ্ছে। হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম মনে করা হচ্ছে। আর আমরা শুধু তাদের পক্ষে হুসনে জনের ভিত্তিতে উজরখাহি করেই যাচ্ছি: তাদের মধ্যে ইস্তিহলাল নেই।
ইস্তিহলাল নেই- কিভাবে সম্ভব?
ইস্তিহলাল তাদের কথা বার্তা থেকেই স্পষ্ট। এরপরও আপনি একটু চিন্তা করুন, একটা লোক আজীবন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কোনোভাবেই ইসলাম কায়েম হতে দেবে না। যারা কায়েম করতে চাইবে তারা দুনিয়ার সবচে জঘন্য অপরাধী বলে গণ্য। আপনি কি এরপরও বলতে পারছেন, লোকটা ইসলাম বিদ্বেষী নয়? তাহলে দুশমনির আর কি মাত্রা দেখালে সে ইসলামবিদ্বেষী হবে?
আমি আপনাদের একটা মাসআলা শুনাই। হাসকাফি রহ. (১০৮৮হি.) বলেন,
وَلَوْ أَكَلَ عَمْدًا شُهْرَةً بِلَا عُذْرٍ يُقْتَلُ. -الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (2/ 413)
যে ব্যক্তি রমযানের দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃত সুপ্রকাশ্যে আহার করবে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে। -আদদুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারের সাথে মূদ্রিত): ২/৪১৩, কিতাবুস সাওম
যে ব্যক্তি রমযানের দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃত সুপ্রকাশ্যে আহার করবে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে। -আদদুররুল মুখতার (রদ্দুল মুহতারের সাথে মূদ্রিত): ২/৪১৩, কিতাবুস সাওম
ইবনে আবিদিন রহ. (১২৫২হি.) এর ব্যাখ্যায় বলেন,
قال الشرنبلالي صورتها: تعمد من لا عذر له الأكل جهارا يقتل؛ لأنه مستهزئ بالدين أو منكر لما ثبت منه بالضرورة ولا خلاف في حل قتله. –الدر المختار وحاشية ابن عابدين (رد المحتار) (2/ 414)
কোনো প্রকার উজর নেই এমন কোনো ব্যক্তি যদি সবার সামনে সুপ্রকাশ্যে ইচ্ছাকৃত আহার করে, তাহলে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে। কারণ, সে হয়তো দ্বীন নিয়ে উপহাস করেছে, আর না হয় (ভিতরে ভিতরে) (সাওমের মতো) জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিধানকে অস্বীকার করে থাকে (যদিও মুখ ফুটে বলে না)। আর এমন লোককে হত্যা করা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কোনোই দ্বিমত নেই। -রদ্দুল মুহতার: ২/৪১৩
সিন্ধি রহ. (১২৫৭হি.) যাহিদি রহ. (৬৫৮হি.) থেকে বর্ণনা করে বলেন, কোনো প্রকার উজর নেই এমন কোনো ব্যক্তি যদি সবার সামনে সুপ্রকাশ্যে ইচ্ছাকৃত আহার করে, তাহলে তাকে হত্যা করে দেয়া হবে। কারণ, সে হয়তো দ্বীন নিয়ে উপহাস করেছে, আর না হয় (ভিতরে ভিতরে) (সাওমের মতো) জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বিধানকে অস্বীকার করে থাকে (যদিও মুখ ফুটে বলে না)। আর এমন লোককে হত্যা করা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কোনোই দ্বিমত নেই। -রদ্দুল মুহতার: ২/৪১৩
الظاهر أن المراد القتل بالسيف. -طوالع الأنوار، كتاب الصوم، ص: 273، ت: عبد الغفار نور محمد، جامعة كراتشي
স্পষ্ট এটাই যে, (হুমকি ধমকি উদ্দেশ্য নয়, সরাসরি) তরবারি দ্বারা কতল করে দেয়া উদ্দেশ্য। -তাওয়ালিউল আনওয়ার, কিতাবুস সাওম: ২৭৩
অর্থাৎ কোনো প্রকার উজর না থাকা সত্ত্বেও রমযানের দিনের বেলায় এভাবে সবার সামনে প্রকাশ্যে দেখিয়ে দেখিয়ে খেতে বসাকে আইম্মায়ে কেরাম কুফর গণ্য করেছেন। কারণ, স্পষ্ট এটাই যে, (হুমকি ধমকি উদ্দেশ্য নয়, সরাসরি) তরবারি দ্বারা কতল করে দেয়া উদ্দেশ্য। -তাওয়ালিউল আনওয়ার, কিতাবুস সাওম: ২৭৩
- হয়তো সে আসলে সাওম যে ফরয এটাকেই অস্বীকার করছে;
- কিংবা অস্বীকার না করলেও এভাবে খেয়ে দ্বীনের সাথে উপহাস করেছে।
স্পষ্ট যে, এ দু’টোর উভয়টিই কুফর। দ্বীনের বিধান অস্বীকার করা যেমন কুফর, স্বীকার করার পর তার যথাযথ তা’জিম না করে বরং উপহাস করা বা অবমাননা করাও কুফর। বরং এটি আরও জঘন্য কুফর।
মুহতারাম পাঠক, একটু চিন্তা করুন। এভাবে আহার করাই যদি আল্লাহর বিধান অস্বীকার বা উপহাস বলে গণ্য হয়, ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায়, তাকে হত্যা করে দিতে হয়: তাহলে আপনারাই চিন্তা করুন, যারা আজীবন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, তারা কত ভয়ানক রকমের অবমাননাই না করছে! আর কত ভয়ানক রকমের কুফরিই না করছে!
এজন্য বিন বায ও ইবনে উসাইমিনের মতো আলেম, যারা ইস্তিহলাল ব্যতীত হুকুম বি গাইরি মা আনযালাল্লাহকে ইরতিদাদ মনে করেন না, তারাও বলেন, যদি ইসলামী শাসনের বিপরীতে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন শাসনব্যবস্থা চালু করে –যেমনটা তাগুতরা করেছে- তাহলে তাদের মতে এটা ইস্তিহলাল বলে গণ্য। শাসক মুরতাদ হয়ে যাবে।
যেমন ইবনে উসাইমিন রহ. (১৪২১হি.) বলেন,
من لم يحكم بما انزل الله استخفافاً به، أو احتقاراً، أو اعتقاداً أن غيره أصلح منه، وانفع للخلق أو مثله فهو كافر كفراً مخرجاً عن الملة، ومن هؤلاء من يضعون للناس تشريعات تخالف التشريعات الإسلامية لتكون منهاجاً يسير الناس عليه، فإنهم لم يضعوا تلك التشريعات المخالفة للشريعة الإسلامية إلا وهم يعتقدون أنها أصلح وأنفع للخلق، إذ من المعلوم بالضرورة العقلية، والجبلة الفطرية أن الإنسان لا يعدل عن منهاج إلى منهاج يخالفه إلا وهو يعتقد فضل ما عدل إليه ونقص ما عدل عنه. -شرح ثلاثة الأصول للعثيمين (ص: 158)
যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞাবশত, আল্লাহর বিধানকে হেয় জ্ঞান করে, কিংবা ভিন্ন বিধানকে অধিক উপযোগী, অধিক উপকারী কিংবা শরয়ী বিধানের সমান সমান মনে করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করা তরক করবে, সে দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত কাফের। এ শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত সেসব লোক, যারা ইসলামী আহকামের বিপরীত বিধি বিধান প্রণয়ন করে সেগুলোকে জীবনব্যবস্থারূপে গ্রহণ করে। কারণ, ইসলামী আহকামের বিপরীত ঐসব বিধি বিধান তারা তখনই প্রণয়ন করতে পেরেছে, যখন তাদের বিশ্বাস যে, এগুলো অধিক উপকারী। কারণ, প্রতিটি মানুষের বিবেক কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া অবলিলায়ই বলবে যে, কোনো ব্যক্তি একটি জীবনব্যবস্থা ছেড়ে অন্য একটি জীবনব্যবস্থা তখনই গ্রহণ করতে পারে, যখন তার বিশ্বাস যে, এটি আগেরটির তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং আগেরটি অপূর্ণ ছিল। -শরহু সালাসাতিল উসূল: ১৫৮
যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞাবশত, আল্লাহর বিধানকে হেয় জ্ঞান করে, কিংবা ভিন্ন বিধানকে অধিক উপযোগী, অধিক উপকারী কিংবা শরয়ী বিধানের সমান সমান মনে করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করা তরক করবে, সে দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত কাফের। এ শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত সেসব লোক, যারা ইসলামী আহকামের বিপরীত বিধি বিধান প্রণয়ন করে সেগুলোকে জীবনব্যবস্থারূপে গ্রহণ করে। কারণ, ইসলামী আহকামের বিপরীত ঐসব বিধি বিধান তারা তখনই প্রণয়ন করতে পেরেছে, যখন তাদের বিশ্বাস যে, এগুলো অধিক উপকারী। কারণ, প্রতিটি মানুষের বিবেক কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া অবলিলায়ই বলবে যে, কোনো ব্যক্তি একটি জীবনব্যবস্থা ছেড়ে অন্য একটি জীবনব্যবস্থা তখনই গ্রহণ করতে পারে, যখন তার বিশ্বাস যে, এটি আগেরটির তুলনায় শ্রেষ্ঠ এবং আগেরটি অপূর্ণ ছিল। -শরহু সালাসাতিল উসূল: ১৫৮
মোটকথা, কওল ও ফেল থেকে শাসকরা স্পষ্ট মুরতাদ। কিন্তু আমরা শত বাহানা তুলে হাজারো উজর দাঁড় করিয়ে মুসলমান প্রমাণ করার চেষ্টা করছি। যেখানে তারা নিজেরাই দ্বীন থেকে বেরিয়ে গেছে বলছে, শুধু একান্ত ব্যক্তি জীবনের কয়েকটি ইস্যু ছাড়া বাকি কোথাও তারা ধর্মীয় আইন মানে না বলছে এবং মানাকে ফিতনা ও সম্প্রীতি নষ্টের কারণ বলে দিবারাত্রি ই’লান দিচ্ছে, তারপরও আমরা কতবড় সতর্কতা অবলম্বনকারী আর কতবড় বুযুর্গ যে, এমন কট্টর কাফেরদেরকেও মুসলিম বানিয়ে ফেলছি। আল্লাহ আমাদের মাফ করেন। সহীহ বুঝ দান করেন। আমীন।
Comment