ট্রান্সজেন্ডারবাদের শরয়ী দৃষ্টিকোণ
জাগতিক বিচারে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এবার শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অবস্থান আলোচনা করা হচ্ছে।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি স্পষ্ট কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদ। এতে রয়েছে সৃষ্টির বিকৃতি ও শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও এটি সাধারণ রীতি-প্রকৃতি ও ইসলামের সুমহান আদর্শ পরিপন্থী একটি মতবাদ। নিম্নে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হল।
এক. ‘যিনার নিকটেও যেও না’ বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন
দুনিয়াতে মানুষের বংশধারা অব্যাহত রাখা ও বংশ পরিচয় সংরক্ষণ এবং পরিবার ও সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইসলাম যেসব যুগান্তকারী বিধান দিয়েছে তার মধ্যে একটি হল যিনা-ব্যভিচার থেকে সর্বতোভাবে বেঁচে থাকা। শুধু ব্যভিচার থেকেই নয়; বরং যেসব কাজকর্ম ও আচার-আচরণ মানুষকে ব্যভিচারে প্রলুব্ধ করে এবং মানুষকে ধীরে ধীরে ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে, সেসব থেকেও বেঁচে থাকার আদেশ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের অমোঘ ঘোষণা―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর তোমরা যিনার নিকটবর্তীও হয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। ―সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩২
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, বান্দাদের জন্য ব্যভিচার ও এর নিকটবর্তী হওয়াকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর ব্যভিচারের উপকরণ ও উপলক্ষগুলোতে জড়ানোই হল তার নিকটবর্তী হওয়া। ―তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৭২
উক্ত বিধানটি নিশ্চিত করার জন্য যিনা-ব্যভিচারের সকল উপলক্ষগুলোকেও শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, যিনা-ব্যভিচারের একটি প্রধান উপলক্ষ হল দৃষ্টি। অর্থাৎ কোনো পুরুষ পরনারীকে দেখলে কিংবা কোনো নারী পরপুরুষকে দেখলে তার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। মনের অজান্তেই তার প্রতি আকর্ষণ জাগ্রত হতে পারে। যা একসময় ব্যভিচার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। তাই পর-নারী পুরুষের পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ ও একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে। তেমনিভাবে নারীকে পর-পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে―
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْنَ، وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوْبِهِنَّ.
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তাদের কৃত কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চয়ই অবগত। আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। সাধারণত যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। আর তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে...। ―সূরা নূর (২৪) : ৩০-৩১
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন―
لَا يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ، وَلَا الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ، وَلَا يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى الرَّجُل فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ، وَلَا تُفْضِي الْمَرْأَةُ إِلَى الْمَرْأَةِ فِي الثَّوْبِ الْوَاحِدِ.
কোনো পুরুষ অপর পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোনো নারী অপর নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। কোনো পুরুষ এক কাপড়ের নিচে অপর পুরুষের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না এবং কোনো নারী এক কাপড়ের নিচে অপর নারীর শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না। ―সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৯৩
তেমনিভাবে পর-নারী ও পর-পুরুষের সাথে নির্জনে বা একান্তে অবস্থানকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
لاَ يَخْلُوَنّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ.
কোনো পুরুষ যেন অপর নারীর সাথে একান্তে অবস্থান না করে। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৬৫
এমনকি নারীকে তার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত একাকী কিংবা অন্য নারীর সাথে হজে¦র মতো ফরয বিধান পালন করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا تَحُجّنّ امْرَأَةٌ إِلّا وَمَعَهَا ذُو محْرمٍ.
মাহরাম ব্যতীত কোনো নারী যেন হজ¦ না করে। ―সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ২৪৪০
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬
আর সঙ্গত কারণেই সন্তানের বয়স দশ বছর হলে তাদের শয্যা পৃথক করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ.
তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাযের আদেশ করো। আর দশ বছর হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরের শয্যা পৃথক করে দাও। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের এক স্বভাবজাত প্রকৃতি। নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষের মাঝে এই আকর্ষণ জাগ্রত হয়। পৃথিবীর শুরু থেকে সকল যুগে ও সকল ধর্মে এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিধান ছিল। সর্বশেষ শরীয়ত ইসলামে যেমন ধর্ষণ-ব্যভিচার হারাম ও নিষিদ্ধ তেমনি পূর্ববর্তী ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ সকল ধর্মেও তা নিষিদ্ধ ছিল। দুনিয়ার সাধারণ রীতি, জ্ঞান-যুক্তি ও বিজ্ঞান সকল বিচারেই তা যথার্থ।
ইসলামী শরীয়ত একদিকে যেমন এই আকর্ষণকে নিয়ন্ত্রিত রাখার আদেশ করে অন্যদিকে তা চরিতার্থ করার জন্যও দিয়েছে সুন্দর ও সুমহান বিধান। একদিকে যেমন ঘোষণা হয়েছে―
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ.
যে তার দুই চোয়াল ও দুই উরুর মধ্যস্থিত অঙ্গের (জিহ্বা ও লজ্জাস্থান) জামানত দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪
অন্যদিকে ইরশাদ হয়েছে―
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ.
হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে। আর যার বিয়ের সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোযা তার প্রবৃত্তির চাহিদা প্রশমনকারী। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৬৫
বস্তুত শরীয়তের এই একটি বিধান যদি নিশ্চিত করা যায় এবং ব্যভিচার ও এর সকল উপলক্ষ থেকে মানুষ নিজেকে সংযত রাখতে পারে, তাহলে ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রসহ সর্বত্রই শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। সুখী ও সমৃদ্ধ একটি সমাজ গড়ে উঠবে।
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদ মূলত অবাধ, যথেচ্ছ ও বিকৃত উপায়ে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার দ্বার উন্মোচন করে। যার ফলে সমাজে সমকামিতা, বেহায়াপনা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। বস্তুত মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো সুযোগ তো এতে থাকছেই না; বরং যথেচ্ছ প্রবৃত্তি-চারণের সুযোগ তৈরি হয়।
তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদে সন্তান ধারণ ও সন্তান লালন-পালনের মতো কোনো বিষয় নেই। এগুলো থেকে বরং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডারবাদ শুধু নিজের প্রবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করতে শেখায়। সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের ঝামেলায় জড়াতে উৎসাহিত করে না। এতে করে একদিকে যেমন দুনিয়ায় মানবের বংশধারা ব্যাহত হবে, তেমনি তার বংশবিস্তারও লোপ পাবে। যার দরুন সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বে এক মহাবিপর্যয় তৈরি হবে। অথচ ইসলামী শরীয়তে মানবের বংশ বৃদ্ধিই কাম্য। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
تزوجوا الودود الولود، فإني مكاثر بكم الأمم يوم القيامة.
তোমরা অধিক মহব্বতকারী ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী নারীকে বিয়ে করো। কেননা, কিয়ামতের দিন তোমাদের নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর আধিক্যের গর্ব করব। ―সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৫৯৪
দুই. সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় সুরক্ষিত রাখার বিধান লঙ্ঘিত হয়
ইসলামী শরীয়ত সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এর জন্য সব রকমের সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
الوَلَدُ لِلْفِرَاشِ، وَلِلْعَاهِرِ الحَجَرُ.
সন্তান হল বৈধ স্ত্রীর জন্য আর ব্যভিচারিণীর জন্য হল বঞ্চনা। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৫৮
একারণে বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা ও ব্যভিচারের মাধ্যমে জন্ম লাভকারী সন্তানকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না; বরং তার জন্য ইসলামের পৃথক বিধিবিধান রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
أَيُّمَا رَجُلٍ عَاهَرَ بِحُرَّةٍ أَوْ أَمَةٍ فَالوَلَدُ وَلَدُ زِنَا لَا يَرِثُ وَلَا يُورَثُ.
যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন নারী অথবা বাদীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় (আর এতে কোনো সন্তানের জন্ম হয়) তাহলে সেটা জারজ সন্তান। সে ব্যভিচারী থেকে মিরাস পাবে না এবং ব্যভিচারীও তার থেকে মিরাস পাবে না। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ২১১৩
আর সঙ্গত কারণেই ইসলামে পরকীয়া ও বহুগামিতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ؟ ... قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ.
আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলাম, সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ কী?...
আমি আবারো আরয করলাম, এরপর কোন্টি? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬
রুফাই ইবনে সাবেত আনসারী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا يَحِلُّ لِامْرِئٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يَسْقِيَ مَاءَه زَرْعَ غَيْرِه، يَعْنِي: إِتْيَانَ الْحُبَالَى.
আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির জন্য অন্যের ক্ষেতে সেচ দেওয়া অর্থাৎ গর্ভবতী নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া বৈধ নয়। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৩১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে মানবের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় বলতে কিছুই থাকবে না। কেননা, এই মতবাদ অনুসারে একজন ব্যক্তি ফন্দি খাটিয়ে যখন তখন নিজেকে একেক লিঙ্গের ঘোষণা করে অবাধ বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে পারে।
তিন. নারী-পুরুষ একে অপরের নিষিদ্ধ সাদৃশ্য অবলম্বন
ইসলাম নারী-পুরুষকে একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বন করতেও নিষেধ করেছে। এটি জঘন্যতম কবীরা গুনাহ ও লানতযোগ্য কাজ। হাদীসে এ ধরনের নারী ও পুরুষের প্রতি অভিস¤পাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত―
لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء، والمتشبهات من النساء بالرجال.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর সাদৃশ্য ধারণকারী পুরুষ ও পুরুষের সাদৃশ্য ধারণকারী নারীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৫, ৬৮৩৪
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
ليس منا من تشبه بالرجال من النساء، ولا من تشبه بالنساء من الرجال.
পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারী ও নারীর সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষ আমাদের দলভুক্ত নয়। ―আলজামিউস সগীর, হাদীস ৭৬৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৮৭৫
বলাবাহুল্য, উপরোক্ত সাদৃশ্য দুই ধরনের হতে পারে। যথা : সাময়িক ও অস্থায়ী এবং স্থায়ী। উভয় প্রকারের সাদৃশ্যই নিষিদ্ধ। সাময়িক সাদৃশ্য সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
لعن الله الواشِمات والمستوشمات، والمتنمصات والمتفلجات للحسن، المغيرات خلق الله... .
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য উল্কি আঁকিয়ে ও যে এঁকে দিতে বলে, ভ্রূ উত্তোলনকারী নারী ও দাঁত সরু করে মাঝে ফাঁক সৃষ্টিকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন। কেননা, এগুলো আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেয়। ... ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৫
আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, জনৈকা নারী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! বসন্ত রোগে আমার এক মেয়ের মাথার চুল পড়ে গিয়েছে। আমি তাকে বিয়ে দিয়েছি। আমি কি তার মাথায় পরচুলা স্থাপন করব? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন―
لعن الله الواصلة والمَوصولة.
পরচুলা স্থাপনকারী নারী ও পরচুলা ব্যবহারকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলার অভিসম্পাত। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪১
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫০৯৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪১৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৩
আর স্থায়ী সাদৃশ্য (যা ‘তাবদীলু খালকিল্লাহ’ তথা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত।) হল, অঙ্গ সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে পুরুষের জন্য নারীর অথবা নারীর জন্য পুরুষের আকৃতি ধারণ করা। যেমন কোনো পুরুষের খোজা হওয়া। ইসলামে এটিও নিষিদ্ধ।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের সঙ্গে স্ত্রীগণ থাকত না। তাই আমরা আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি খোজা হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে এই অভিশপ্ত সাদৃশ্যই ধারণ করা হয়। কখনো অস্থায়ী ও সাময়িক সাদৃশ্য ধারণ করা হয়। যেমন, পুরুষ হয়ে নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ইত্যাদি অবলম্বন করা হয়। আবার কখনো সার্জারির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। যেমন, ছেলে হয়ে মেয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা কিংবা মেয়ে হয়ে ছেলের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ও নিজের মেয়েলি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপসারণ করা ইত্যাদি।
চার. ট্রান্সজেন্ডারবাদে রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি
ট্রান্সজেন্ডারবাদের সবচেয়ে জঘন্য ও গর্হিত দিক হল, এতে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি ঘটে। অথচ আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধন সম্পূর্ণ হারাম ও জঘন্যতম কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیْدًا، اِنْ یَّدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖۤ اِلَّاۤ اِنٰثًا وَ اِنْ یَّدْعُوْنَ اِلَّا شَیْطٰنًا مَّرِیْدًا، لَّعَنَهُ اللهُ وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِیْبًا مَّفْرُوْضًا، وَّ لَاُضِلَّنَّهُمْ وَ لَاُمَنِّیَنَّهُمْ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُبَتِّكُنَّ اٰذَانَ الْاَنْعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَ مَنْ یَّتَّخِذِ الشَّیْطٰنَ وَلِیًّا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِیْنًا، یَعِدُهُمْ وَ یُمَنِّیْهِمْ وَ مَا یَعِدُهُمُ الشَّیْطٰنُ اِلَّا غُرُوْرًا، اُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ وَ لَا یَجِدُوْنَ عَنْهَا مَحِیْصًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এটি ব্যতীত যাকে ইচ্ছা সবকিছু ক্ষমা করেন। আর কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। তাঁর পরিবর্তে তারা দেবীরই পূজা করে এবং বিদ্রোহী শয়তানেরই পূজা করে। আল্লাহ তাকে লানত করেন। আর সে বলে, আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব। তাদের অন্তরে মিথ্যা আশা-ভরসা সৃষ্টি করব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই পশুর কর্ণচ্ছেদ করবে। তাদেরকে আরো আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। আর কেউ আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্ত। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশা-ভরসা দেয়। আর শয়তান তাদেরকে শুধু প্রবঞ্চনারই প্রতিশ্রুতি দেয়। ওদের বাসস্থান জাহান্নাম এবং তারা সেখান থেকে পলায়নের কোনো পথ পাবে না। ―সূরা নিসা (৪) : ১১৬-১২১
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রাহ. উপরে বর্ণিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করার পর বলেন―
وَهَذِه الْأُمُورُ كُلُّهَا قَدْ شَهِدَتِ الْأَحَادِيثُ بِلَعْنِ فَاعِلِهَا، وَأَنَّهَا مِنَ الْكَبَائِرِ. وَاخْتُلِفَ فِي الْمَعْنَى الَّذِي نُهِيَ لِأَجْلِهَا، فَقِيلَ: لِأَنَّهَا مِنْ بَابِ التَّدْلِيسِ. وَقِيلَ: مِنْ بَابِ تَغْيِيرِ خَلْقِ اللَّهِ تَعَالَى، كَمَا قَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ، وَهُوَ أَصَحُّ.
হাদীসসমূহ থেকে সাদৃশ্যের উপরোক্ত সকল কাজ লানতযোগ্য হওয়া ও কবীরা গুনাহ হওয়া প্রতীয়মান হয়। তবে এসব কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে কী তাৎপর্য রয়েছে, সে সম্পর্কে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। কেউ বলেন, এটি তাদলীস। আর কারো মতে, এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. উল্লেখ করেছেন। আর এটিই বিশুদ্ধ মত। ―তাফসীরে কুরতুবী ৫/২৫২; আলমুফহিম লিমা উশকিলা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম ৫/৪৪৪
পাঁচ. সর্বোপরি ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি ঈমান বিধ্বংসী কুফরি মতবাদ
ট্রান্সজেন্ডারবাদ ইসলাম ও মুসলমানদের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেননা সন্তান হওয়া-না হওয়া, সন্তানের ছেলে বা মেয়ে হওয়া একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ন্ত্রণে। এতে কারো কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কোনো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ওষুধ-পথ্য কিংবা কোনো ডাক্তার-কবিরাজের এতে কোনো এখতিয়ার নেই। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَ، اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ.
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। ―সূরা শূরা (৪২) : ৪৯-৫০
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে যখন তখন ছেলে বা মেয়ে বনে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়। যা সৃষ্টির বিকৃতির পাশাপাশি ঈমান বিধ্বংসীও বটে। তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন সুন্নাহ্র অসংখ্য বিধানে ব্যাপক পরিবর্তন ও চরম বিকৃতি ঘটবে। এর মাধ্যমে ইসলামের সালাত, হজ¦, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়, পর্দা, সতর, শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি), রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধানের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুমতি দান করুন। ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা ও এর ভয়াবহতা অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। বিশ্বের গোটা মুসলিম উম্মাহ্কে এর ভয়াল গ্রাস থেকে হেফাযত করুন। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীল মহলকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন এবং ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো একটি কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!
তথ্যসূত্র:- মাসিক আলকাউসার
========================
প্রথম পর্ব:-
https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...ব#post197824
দ্বিতীয় পর্ব:-
https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...ব#post197854
জাগতিক বিচারে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এবার শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদের অবস্থান আলোচনা করা হচ্ছে।
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি স্পষ্ট কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদ। এতে রয়েছে সৃষ্টির বিকৃতি ও শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন। এছাড়াও এটি সাধারণ রীতি-প্রকৃতি ও ইসলামের সুমহান আদর্শ পরিপন্থী একটি মতবাদ। নিম্নে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হল।
এক. ‘যিনার নিকটেও যেও না’ বিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন
দুনিয়াতে মানুষের বংশধারা অব্যাহত রাখা ও বংশ পরিচয় সংরক্ষণ এবং পরিবার ও সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ইসলাম যেসব যুগান্তকারী বিধান দিয়েছে তার মধ্যে একটি হল যিনা-ব্যভিচার থেকে সর্বতোভাবে বেঁচে থাকা। শুধু ব্যভিচার থেকেই নয়; বরং যেসব কাজকর্ম ও আচার-আচরণ মানুষকে ব্যভিচারে প্রলুব্ধ করে এবং মানুষকে ধীরে ধীরে ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে, সেসব থেকেও বেঁচে থাকার আদেশ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদের অমোঘ ঘোষণা―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর তোমরা যিনার নিকটবর্তীও হয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ। ―সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩২
ইমাম ইবনে কাসীর রাহ. আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, বান্দাদের জন্য ব্যভিচার ও এর নিকটবর্তী হওয়াকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন―
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً وَ سَآءَ سَبِیْلًا.
আর ব্যভিচারের উপকরণ ও উপলক্ষগুলোতে জড়ানোই হল তার নিকটবর্তী হওয়া। ―তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৭২
উক্ত বিধানটি নিশ্চিত করার জন্য যিনা-ব্যভিচারের সকল উপলক্ষগুলোকেও শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, যিনা-ব্যভিচারের একটি প্রধান উপলক্ষ হল দৃষ্টি। অর্থাৎ কোনো পুরুষ পরনারীকে দেখলে কিংবা কোনো নারী পরপুরুষকে দেখলে তার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হতে পারে। মনের অজান্তেই তার প্রতি আকর্ষণ জাগ্রত হতে পারে। যা একসময় ব্যভিচার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। তাই পর-নারী পুরুষের পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ ও একে অপরের প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে। তেমনিভাবে নারীকে পর-পুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে―
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْا فُرُوْجَهُمْ ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ اِنَّ اللهَ خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْنَ، وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوْبِهِنَّ.
মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তাদের কৃত কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চয়ই অবগত। আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। সাধারণত যা প্রকাশ পায় তা ব্যতীত নিজেদের আভরণ প্রদর্শন না করে। আর তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে...। ―সূরা নূর (২৪) : ৩০-৩১
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন―
لَا يَنْظُرُ الرَّجُلُ إِلَى عَوْرَةِ الرَّجُلِ، وَلَا الْمَرْأَةُ إِلَى عَوْرَةِ الْمَرْأَةِ، وَلَا يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى الرَّجُل فِي ثَوْبٍ وَاحِدٍ، وَلَا تُفْضِي الْمَرْأَةُ إِلَى الْمَرْأَةِ فِي الثَّوْبِ الْوَاحِدِ.
কোনো পুরুষ অপর পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোনো নারী অপর নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। কোনো পুরুষ এক কাপড়ের নিচে অপর পুরুষের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না এবং কোনো নারী এক কাপড়ের নিচে অপর নারীর শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না। ―সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৯৩
তেমনিভাবে পর-নারী ও পর-পুরুষের সাথে নির্জনে বা একান্তে অবস্থানকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যা ব্যভিচারের দিকে ধাবিত করে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
لاَ يَخْلُوَنّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ.
কোনো পুরুষ যেন অপর নারীর সাথে একান্তে অবস্থান না করে। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৬৫
এমনকি নারীকে তার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত একাকী কিংবা অন্য নারীর সাথে হজে¦র মতো ফরয বিধান পালন করারও অনুমতি দেওয়া হয়নি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا تَحُجّنّ امْرَأَةٌ إِلّا وَمَعَهَا ذُو محْرمٍ.
মাহরাম ব্যতীত কোনো নারী যেন হজ¦ না করে। ―সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ২৪৪০
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০০৬
আর সঙ্গত কারণেই সন্তানের বয়স দশ বছর হলে তাদের শয্যা পৃথক করে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ.
তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাযের আদেশ করো। আর দশ বছর হলে নামাযের জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরের শয্যা পৃথক করে দাও। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৫
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের এক স্বভাবজাত প্রকৃতি। নির্দিষ্ট সময়ের পর মানুষের মাঝে এই আকর্ষণ জাগ্রত হয়। পৃথিবীর শুরু থেকে সকল যুগে ও সকল ধর্মে এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বিধান ছিল। সর্বশেষ শরীয়ত ইসলামে যেমন ধর্ষণ-ব্যভিচার হারাম ও নিষিদ্ধ তেমনি পূর্ববর্তী ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দুসহ সকল ধর্মেও তা নিষিদ্ধ ছিল। দুনিয়ার সাধারণ রীতি, জ্ঞান-যুক্তি ও বিজ্ঞান সকল বিচারেই তা যথার্থ।
ইসলামী শরীয়ত একদিকে যেমন এই আকর্ষণকে নিয়ন্ত্রিত রাখার আদেশ করে অন্যদিকে তা চরিতার্থ করার জন্যও দিয়েছে সুন্দর ও সুমহান বিধান। একদিকে যেমন ঘোষণা হয়েছে―
مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ.
যে তার দুই চোয়াল ও দুই উরুর মধ্যস্থিত অঙ্গের (জিহ্বা ও লজ্জাস্থান) জামানত দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যামিন হব। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪
অন্যদিকে ইরশাদ হয়েছে―
يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ البَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ.
হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের যাদের বিয়ের সামর্থ্য আছে, সে যেন বিয়ে করে। আর যার বিয়ের সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা রাখে। কেননা, রোযা তার প্রবৃত্তির চাহিদা প্রশমনকারী। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৬৫
বস্তুত শরীয়তের এই একটি বিধান যদি নিশ্চিত করা যায় এবং ব্যভিচার ও এর সকল উপলক্ষ থেকে মানুষ নিজেকে সংযত রাখতে পারে, তাহলে ব্যক্তি-পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রসহ সর্বত্রই শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করবে। সুখী ও সমৃদ্ধ একটি সমাজ গড়ে উঠবে।
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদ মূলত অবাধ, যথেচ্ছ ও বিকৃত উপায়ে প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার দ্বার উন্মোচন করে। যার ফলে সমাজে সমকামিতা, বেহায়াপনা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটে। বস্তুত মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো সুযোগ তো এতে থাকছেই না; বরং যথেচ্ছ প্রবৃত্তি-চারণের সুযোগ তৈরি হয়।
তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদে সন্তান ধারণ ও সন্তান লালন-পালনের মতো কোনো বিষয় নেই। এগুলো থেকে বরং নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডারবাদ শুধু নিজের প্রবৃত্তিকে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করতে শেখায়। সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের ঝামেলায় জড়াতে উৎসাহিত করে না। এতে করে একদিকে যেমন দুনিয়ায় মানবের বংশধারা ব্যাহত হবে, তেমনি তার বংশবিস্তারও লোপ পাবে। যার দরুন সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বে এক মহাবিপর্যয় তৈরি হবে। অথচ ইসলামী শরীয়তে মানবের বংশ বৃদ্ধিই কাম্য। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
تزوجوا الودود الولود، فإني مكاثر بكم الأمم يوم القيامة.
তোমরা অধিক মহব্বতকারী ও অধিক সন্তান জন্মদানকারী নারীকে বিয়ে করো। কেননা, কিয়ামতের দিন তোমাদের নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর আধিক্যের গর্ব করব। ―সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০২৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৫৯৪
দুই. সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় সুরক্ষিত রাখার বিধান লঙ্ঘিত হয়
ইসলামী শরীয়ত সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে এবং এর জন্য সব রকমের সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে―
الوَلَدُ لِلْفِرَاشِ، وَلِلْعَاهِرِ الحَجَرُ.
সন্তান হল বৈধ স্ত্রীর জন্য আর ব্যভিচারিণীর জন্য হল বঞ্চনা। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৫৮
একারণে বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা ও ব্যভিচারের মাধ্যমে জন্ম লাভকারী সন্তানকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না; বরং তার জন্য ইসলামের পৃথক বিধিবিধান রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
أَيُّمَا رَجُلٍ عَاهَرَ بِحُرَّةٍ أَوْ أَمَةٍ فَالوَلَدُ وَلَدُ زِنَا لَا يَرِثُ وَلَا يُورَثُ.
যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন নারী অথবা বাদীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় (আর এতে কোনো সন্তানের জন্ম হয়) তাহলে সেটা জারজ সন্তান। সে ব্যভিচারী থেকে মিরাস পাবে না এবং ব্যভিচারীও তার থেকে মিরাস পাবে না। ―জামে তিরমিযী, হাদীস ২১১৩
আর সঙ্গত কারণেই ইসলামে পরকীয়া ও বহুগামিতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ؟ ... قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ؟ قَالَ: أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ.
আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলাম, সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ কী?...
আমি আবারো আরয করলাম, এরপর কোন্টি? তিনি বললেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮১১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬
রুফাই ইবনে সাবেত আনসারী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
لَا يَحِلُّ لِامْرِئٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يَسْقِيَ مَاءَه زَرْعَ غَيْرِه، يَعْنِي: إِتْيَانَ الْحُبَالَى.
আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তির জন্য অন্যের ক্ষেতে সেচ দেওয়া অর্থাৎ গর্ভবতী নারীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া বৈধ নয়। ―সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১১৩১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে মানবের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় বলতে কিছুই থাকবে না। কেননা, এই মতবাদ অনুসারে একজন ব্যক্তি ফন্দি খাটিয়ে যখন তখন নিজেকে একেক লিঙ্গের ঘোষণা করে অবাধ বেহায়াপনায় লিপ্ত হতে পারে।
তিন. নারী-পুরুষ একে অপরের নিষিদ্ধ সাদৃশ্য অবলম্বন
ইসলাম নারী-পুরুষকে একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বন করতেও নিষেধ করেছে। এটি জঘন্যতম কবীরা গুনাহ ও লানতযোগ্য কাজ। হাদীসে এ ধরনের নারী ও পুরুষের প্রতি অভিস¤পাত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত―
لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء، والمتشبهات من النساء بالرجال.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর সাদৃশ্য ধারণকারী পুরুষ ও পুরুষের সাদৃশ্য ধারণকারী নারীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৫, ৬৮৩৪
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন―
ليس منا من تشبه بالرجال من النساء، ولا من تشبه بالنساء من الرجال.
পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারী ও নারীর সাদৃশ্য অবলম্বনকারী পুরুষ আমাদের দলভুক্ত নয়। ―আলজামিউস সগীর, হাদীস ৭৬৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৮৭৫
বলাবাহুল্য, উপরোক্ত সাদৃশ্য দুই ধরনের হতে পারে। যথা : সাময়িক ও অস্থায়ী এবং স্থায়ী। উভয় প্রকারের সাদৃশ্যই নিষিদ্ধ। সাময়িক সাদৃশ্য সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন―
لعن الله الواشِمات والمستوشمات، والمتنمصات والمتفلجات للحسن، المغيرات خلق الله... .
সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য উল্কি আঁকিয়ে ও যে এঁকে দিতে বলে, ভ্রূ উত্তোলনকারী নারী ও দাঁত সরু করে মাঝে ফাঁক সৃষ্টিকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন। কেননা, এগুলো আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেয়। ... ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৫
আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, জনৈকা নারী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! বসন্ত রোগে আমার এক মেয়ের মাথার চুল পড়ে গিয়েছে। আমি তাকে বিয়ে দিয়েছি। আমি কি তার মাথায় পরচুলা স্থাপন করব? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন―
لعن الله الواصلة والمَوصولة.
পরচুলা স্থাপনকারী নারী ও পরচুলা ব্যবহারকারী নারীর প্রতি আল্লাহ তাআলার অভিসম্পাত। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪১
আরো দেখুন, সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১২৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫০৯৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪১৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৬৩
আর স্থায়ী সাদৃশ্য (যা ‘তাবদীলু খালকিল্লাহ’ তথা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত।) হল, অঙ্গ সংযোজন বা বিয়োজনের মাধ্যমে পুরুষের জন্য নারীর অথবা নারীর জন্য পুরুষের আকৃতি ধারণ করা। যেমন কোনো পুরুষের খোজা হওয়া। ইসলামে এটিও নিষিদ্ধ।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের সঙ্গে স্ত্রীগণ থাকত না। তাই আমরা আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি খোজা হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। ―সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭১
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে এই অভিশপ্ত সাদৃশ্যই ধারণ করা হয়। কখনো অস্থায়ী ও সাময়িক সাদৃশ্য ধারণ করা হয়। যেমন, পুরুষ হয়ে নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ইত্যাদি অবলম্বন করা হয়। আবার কখনো সার্জারির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়। যেমন, ছেলে হয়ে মেয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা কিংবা মেয়ে হয়ে ছেলের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ও নিজের মেয়েলি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অপসারণ করা ইত্যাদি।
চার. ট্রান্সজেন্ডারবাদে রয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি
ট্রান্সজেন্ডারবাদের সবচেয়ে জঘন্য ও গর্হিত দিক হল, এতে আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি ঘটে। অথচ আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধন সম্পূর্ণ হারাম ও জঘন্যতম কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیْدًا، اِنْ یَّدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖۤ اِلَّاۤ اِنٰثًا وَ اِنْ یَّدْعُوْنَ اِلَّا شَیْطٰنًا مَّرِیْدًا، لَّعَنَهُ اللهُ وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِیْبًا مَّفْرُوْضًا، وَّ لَاُضِلَّنَّهُمْ وَ لَاُمَنِّیَنَّهُمْ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُبَتِّكُنَّ اٰذَانَ الْاَنْعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَیُغَیِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَ مَنْ یَّتَّخِذِ الشَّیْطٰنَ وَلِیًّا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِیْنًا، یَعِدُهُمْ وَ یُمَنِّیْهِمْ وَ مَا یَعِدُهُمُ الشَّیْطٰنُ اِلَّا غُرُوْرًا، اُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ وَ لَا یَجِدُوْنَ عَنْهَا مَحِیْصًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এটি ব্যতীত যাকে ইচ্ছা সবকিছু ক্ষমা করেন। আর কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। তাঁর পরিবর্তে তারা দেবীরই পূজা করে এবং বিদ্রোহী শয়তানেরই পূজা করে। আল্লাহ তাকে লানত করেন। আর সে বলে, আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব। তাদের অন্তরে মিথ্যা আশা-ভরসা সৃষ্টি করব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই পশুর কর্ণচ্ছেদ করবে। তাদেরকে আরো আদেশ করব, ফলে তারা অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। আর কেউ আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টতই ক্ষতিগ্রস্ত। সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশা-ভরসা দেয়। আর শয়তান তাদেরকে শুধু প্রবঞ্চনারই প্রতিশ্রুতি দেয়। ওদের বাসস্থান জাহান্নাম এবং তারা সেখান থেকে পলায়নের কোনো পথ পাবে না। ―সূরা নিসা (৪) : ১১৬-১২১
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী রাহ. উপরে বর্ণিত হাদীসসমূহ উল্লেখ করার পর বলেন―
وَهَذِه الْأُمُورُ كُلُّهَا قَدْ شَهِدَتِ الْأَحَادِيثُ بِلَعْنِ فَاعِلِهَا، وَأَنَّهَا مِنَ الْكَبَائِرِ. وَاخْتُلِفَ فِي الْمَعْنَى الَّذِي نُهِيَ لِأَجْلِهَا، فَقِيلَ: لِأَنَّهَا مِنْ بَابِ التَّدْلِيسِ. وَقِيلَ: مِنْ بَابِ تَغْيِيرِ خَلْقِ اللَّهِ تَعَالَى، كَمَا قَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ، وَهُوَ أَصَحُّ.
হাদীসসমূহ থেকে সাদৃশ্যের উপরোক্ত সকল কাজ লানতযোগ্য হওয়া ও কবীরা গুনাহ হওয়া প্রতীয়মান হয়। তবে এসব কাজ নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে কী তাৎপর্য রয়েছে, সে সম্পর্কে একাধিক বক্তব্য রয়েছে। কেউ বলেন, এটি তাদলীস। আর কারো মতে, এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মাঝে বিকৃতি সাধনের অন্তর্ভুক্ত। যেমনটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. উল্লেখ করেছেন। আর এটিই বিশুদ্ধ মত। ―তাফসীরে কুরতুবী ৫/২৫২; আলমুফহিম লিমা উশকিলা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম ৫/৪৪৪
পাঁচ. সর্বোপরি ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি ঈমান বিধ্বংসী কুফরি মতবাদ
ট্রান্সজেন্ডারবাদ ইসলাম ও মুসলমানদের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থী। কেননা সন্তান হওয়া-না হওয়া, সন্তানের ছেলে বা মেয়ে হওয়া একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিয়ন্ত্রণে। এতে কারো কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কোনো চিকিৎসা, বিজ্ঞান, ওষুধ-পথ্য কিংবা কোনো ডাক্তার-কবিরাজের এতে কোনো এখতিয়ার নেই। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন―
لِلهِ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ یَخْلُقُ مَا یَشَآءُ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَ، اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ.
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের আধিপত্য আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন আবার যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। ―সূরা শূরা (৪২) : ৪৯-৫০
পক্ষান্তরে ট্রান্সজেন্ডারবাদে যখন তখন ছেলে বা মেয়ে বনে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়। যা সৃষ্টির বিকৃতির পাশাপাশি ঈমান বিধ্বংসীও বটে। তাছাড়া ট্রান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন সুন্নাহ্র অসংখ্য বিধানে ব্যাপক পরিবর্তন ও চরম বিকৃতি ঘটবে। এর মাধ্যমে ইসলামের সালাত, হজ¦, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়, পর্দা, সতর, শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি), রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধানের পরিবর্তন ও বিকৃতি ঘটবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুমতি দান করুন। ট্রান্সজেন্ডারবাদের অসারতা ও এর ভয়াবহতা অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন। বিশ্বের গোটা মুসলিম উম্মাহ্কে এর ভয়াল গ্রাস থেকে হেফাযত করুন। আর আমাদের দেশের দায়িত্বশীল মহলকে বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করার তাওফীক দান করুন এবং ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো একটি কুফরি ও অভিশপ্ত মতবাদকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে তাদেরকে বিরত রাখুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!
তথ্যসূত্র:- মাসিক আলকাউসার
========================
প্রথম পর্ব:-
https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...ব#post197824
দ্বিতীয় পর্ব:-
https://dawahilallah.com/forum/মূল-ফ...ব#post197854
Comment