আমাদের দেশের মানুষের মুখে মুখে, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় প্রায় শোনা যায়, পত্র-পত্রিকা এবং বই-পুস্তকেও লেখা থাকে “দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ।” এমনকি কতিপয় বক্তার ওয়াজের মধ্যেও হাদিস হিসেবে বলতে শুনা যায়: ِحُبِّ الوَطَنِ مِنَ الإيمان “হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ঈমান-“দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।”
কিন্তু হাদিস বিশারদগণের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি মিথ্যাচার। মুহাদ্দিসগণ, এটিকে জাল ও বানোয়াট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জালালুদ্দীন সুয়ুতি রহ. আদ্দুরারুল মুনতাছিরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরাহ (খ. ০১ পৃ. ০৯) নামক কিতাবে, ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশি রহ. আললু’লু’ (পৃ. ২৭) নামক কিতাবে, আল্লামা ইবন ইয়ুসুফ মাকদিসি হাম্বলি রহ. আল ফাওয়াইদুল মাওযুয়া’ (পৃ. ১০৩) নামক কিতাবে– এরা সকলেই উক্ত হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, لَم أَقِف عَلَيْه ‘এটি আমি খুঁজে পাইনি।’ অর্থাৎ, হাদিসটি ভিত্তিহীন।
আল্লামা যারকানি রহ. বলেন, لا أعرفه ‘এটি সম্পর্কে আমি জানিনা।’ (মুখতাসারুল মাকাসিদ পৃ. ৯৫)
আল্লামা মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, لا أصل له عند الحفاظ ‘হাদিসের হাফিজদের নিকট এর কোনো ভিত্তি নেই।’ (আল আসরার পৃ. ১০৯)
অনুরূপভাবে আল্লামা সাখাবি রহ. আল্লামা আজলূনী রহ. আলহূত মুহাম্মাদ বিন দারবিশ রহ. প্রমুখও এটিকে বানোয়াট, জাল ও ভিত্তিহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (আল মাকাসিদ পৃ. ১৯৫ কাশফুল খাফা খ. ০১ পৃ. ৪১৩ আসনাল মাতালিব পৃ. ৯৫)
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম সাগানী তার ‘আল মাওযূআত’ বা বানোয়াট হাদিস শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদিস সম্পর্কে বলেন: موضوع বা বানোয়াট (হাদিস নং ৮১)
শাইখ আলবানী রহঃ বলেন:
“দেশপ্রেম ঈমানের অন্তর্ভুক্ত” এটি বানোয়াট হাদিস যেমনটি ইমাম সাগানী এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন। এর মর্মার্থটিও সঠিক নয়। কারণ দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা নিজের জীবন ও অর্থ-সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকার মতই একটি বিষয়। এগুলো মানুষের স্বভাবগত প্রবৃত্তি। সুতরাং এই ভালবাসা যেমন বিশেষ প্রশংসা পাওয়ার হকদার নয় তেমনি এটি ঈমানের অপরিহার্য অনুষঙ্গও নয়। কেননা, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই ভালবাসা বিদ্যমান রয়েছে-চাই সে মুমিন হোক অথবা কাফের হোক।” (সিলসিলা যঈফা হাদিস নং ৩৬)
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহ. বলেন:
“দেশকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ” কথাটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে বলা হয়ে থাকে। এটি একটি মিথ্যাচার। দেশকে ভালবাসতে হলে, এ কারণে ভালবাসতে হবে যে, সেটি ইসলামি রাষ্ট্র- চাই তা আপনার জন্মভূমি হোক বা দূরের কোনো দেশ হোক। সবগুলোই ইসলামী দেশ। প্রতিটি ইসলামি দেশকে রক্ষা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।”
(শাইখ আল্লামা উসাইমীন রহ. কর্তৃক রিয়াযুস সালেহীন গ্রন্থের ব্যাখ্যা)
ইসলাম দেশপ্রেমের প্রতি অনুপ্রাণিত করে এবং এটি প্রশংসনীয়ও বটে। কেননা, স্বয়ং রাসূল্লাহ ﷺ –এর জীবনেও বিভিন্ন সময়ে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছিল। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
ما أطيبَكِ مِن بلدةٍ وأحَبَّك إليَّ، ولولا أنَّ قومي أخرَجوني منكِ ما سكَنْتُ غيرَكِ
‘হে মক্কা! তুমি কতই না উত্তম দেশ! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি! তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিলে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো দেশে বসবাস করতাম না।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান ৩৭০৯)।
সহিহ বুখারিতে এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ، فَأَبْصَرَ دَرَجَاتِ الْمَدِينَةِ أَوْضَعَ نَاقَتَهُ، وَإِنْ كَانَتْ دَابَّةً حَرَّكَهَا. قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ زَادَ الْحَارِثُ بْنُ عُمَيْرٍ عَنْ حُمَيْدٍ حَرَّكَهَا مِنْ حُبِّهَا
রাসূলুল্লাহ ﷺ সফর থেকে ফিরে যখন মদিনার উঁচু রাস্তাগুলো দেখতেন তখন তিনি তাঁর উটনী দ্রুতগতিতে চালাতেন তার বাহন অন্য জানোয়ার হলে তিনি তাকে তাড়া দিতেন। আর এমনটি করতেন মদিনার প্রতি ভালোবাসার কারণে। (বুখারি ১৮৬৫)
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানি রহ. এই হাদিসের ব্যখ্যায় লিখেন,
في الحديث دلالة على فضل المدينة وعلى مشروعية حب الوطن والحنين إليه
হাদিসটিতে মদিনার মর্যাদা এবং স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগের বৈধতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। (ফাতহুল বারী খ. ০৩ পৃ. ৬২১)
যাহোক, দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা মানুষের প্রকৃতিগত বিষয়। সকল ধর্মের লোকই তাদের দেশকে ভালবাসে। কিন্তু কোনো ইসলামি দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা মুসলিম ও সুনাগরিক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোনো ইসলামী দেশ যদি কাফের দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন ঐ দেশে বসবাসকারী প্রতিটি মুসলিমের জন্য সর্বাত্মকভাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে যায়। আবার অন্য দিকে দেশ থেকে যদি ইসলাম পালন করা অসম্ভব হয়ে যায় এবং জান-মাল ও ইজ্জত-সম্ভ্রম অনিরাপদ পড়ে তখন দেশ ছেড়ে ‘হিজরত’ও করতে হতে পারে।
ইসলাম হল সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য মহান আল্লাহ্ কর্তৃক দেয়া পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান। সকল মানুষের সমগ্র জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি নিষেধ ইসলাম সবিস্তারে বর্ণনা করেছে। আপনি কিভাবে ঘুমাবেন, খাবেন, হাটবেন এমন কি টয়লেট করবেন তাও ইসলাম বলে দিয়েছে। ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আন্তর্জাতিক / আন্তঃরাষ্ট্রিয় সম্পর্ক সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান রয়েছে। এমনকি পছন্দ অপছন্দ, ভালোবাসা ঘৃণার মানদণ্ডও ইসলামে সবিস্তারে বর্ননা রয়েছে। সে অনুযায়ী দেশপ্রেমের বিষয়েও ইসলামের বক্তব্য আছে।
তবে, যারা দেশপ্রেমের সবক দেয়, তারা দেশপ্রেম বলতে কোন দেশের প্রতি প্রেম-ভালবাসার কথা বুঝায়?
- যে দেশ আল্লাহর আইন শরিয়াহ'র অনুসরণ করে?
- নাকি, যে দেশ মানুষের খায়েশাতের বা ইচ্ছার অনুসরণ করে?
যদি বলেন ইসলামিক দেশ তাহলে, ইসলাম তো এ কথা বলে না যে, আমার দেশ (আমার এলাকা/ আমার জন্মস্থান) ভাল থাকুক অন্য সকল দেশ জলে যাক। বরং ইসলাম চায় সকলেই ভাল থাকুক পৃথিবীতে এবং আখিরাতে। ইসলাম জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না। আপনি কোন এলাকার, আমেরিকার নাকি নাইজেরিয়ার ইসলামে তার কোন মূল্য নাই। আপনি প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে নাকি ঝাড়ুদারের ছেলে তারও কোন মূল্য নাই। মূল্য আপনার ইমানের।
একটি শরিয়াহ শাসিত ইসলামিক দেশ তার অধিবাসী সকল নাগরিককে দুই ভাগে বিভক্ত করে, এবং তদানুযায়ী আইন বিচার ফয়সালার নির্দেশ করে।
১/ মুসলমান ২/ কাফের
ঈমানওয়ালারা মুসলিম বলে পরিচিত হবে, আর ইসলামের বিধিবিধান প্রত্যেক মুসলিমকে বাধ্যতামূলক পালন করতে হবে। এবং মুসলিমরাই হবে উচ্চ শ্রেণীর নাগরিক। একটি শরিয়াহ শাসিত রাষ্ট্রে- রাষ্ট্রীয় সকল দায়-দায়িত্ব মুসলিমদের হাতেই থাকবে। আর কাফিররা জিজিয়ার দেয়ার বিনিময়ে মুসলিমদের নিকট জীবনের নিরাপত্তা পাবে। এবং তারা থাকবে নিন্ম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে জিম্মি কাফির নিজ আঙ্গিনায় নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু সে তার ধর্ম প্রচার করতে পারবে না। আবার কেউ তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না। তবে সে চাইলেই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে, মুসলিমদের সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করলে ইসলামী রাষ্ট্রে তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড।
মুসলিমরা জাকাত দিবে, তাও আবার বছরে একবার। যা আবার সকলের জন্য ধার্য করা হয় না। প্রকাশ্য বা গোপন কোন প্রকারের ভ্যাট, ট্যাক্স বা কর দিতে হয় না। কেউ অন্যায় করলে শরিয়াহ অনুযায়ী বিচার হবে। ইসলামী শরিয়াহ'য় যে বিষয়ে যে বিধান আছে, তা ক্ষেত্রানুসারে সকলের উপর সমানভাবে প্রয়োগ হবে।
তো, এদেশ কি ইসলামী রাষ্ট্র? যার প্রতি আমাদের ভালোবাসা দেখাতে হবে?
১৭৫৭ সালে পলাশী'র যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের নিকট এদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। তখন থেকেই ব্রিটিশরা এদেশে তাদের মনগড়া কুফুরি আইনের মাধ্যমে শাসন চালিয়ে আসছে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় তাদের নীতি আদর্শে গড়ে তোলা পাচাটা গোলামদের হাতে এদেশের শাসনভার ছেড়ে যায়। যারা এদেশে ব্রিটিশদের বানোয়াট আইনকানুন দ্বারাই আজ পর্যন্ত এদেশ পরিচালনা করে যাচ্ছে।
অর্থাৎ সেই ১৭৫৭ সাল থেকেই এদেশে ইসলামী শাসন অনুপস্থিত। শরিয়াহর পরিভাষায় এই দেশ দারুল কুফর বা দারুল হারব। যেখানে মুসলিমদের পুনরায় শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্যই শুধুমাত্র অবস্থান করা বৈধ। নচেৎ ইসলাম কায়েম আছে এমন ভূমিতে হিজরত করা ফরজ। আর তাই এখানে দেশপ্রেমের প্রসঙ্গটাই অপ্রাসঙ্গিক।
(সংগৃহীত এবং সম্পাদিত)
কিন্তু হাদিস বিশারদগণের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি মিথ্যাচার। মুহাদ্দিসগণ, এটিকে জাল ও বানোয়াট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জালালুদ্দীন সুয়ুতি রহ. আদ্দুরারুল মুনতাছিরাহ ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরাহ (খ. ০১ পৃ. ০৯) নামক কিতাবে, ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশি রহ. আললু’লু’ (পৃ. ২৭) নামক কিতাবে, আল্লামা ইবন ইয়ুসুফ মাকদিসি হাম্বলি রহ. আল ফাওয়াইদুল মাওযুয়া’ (পৃ. ১০৩) নামক কিতাবে– এরা সকলেই উক্ত হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, لَم أَقِف عَلَيْه ‘এটি আমি খুঁজে পাইনি।’ অর্থাৎ, হাদিসটি ভিত্তিহীন।
আল্লামা যারকানি রহ. বলেন, لا أعرفه ‘এটি সম্পর্কে আমি জানিনা।’ (মুখতাসারুল মাকাসিদ পৃ. ৯৫)
আল্লামা মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, لا أصل له عند الحفاظ ‘হাদিসের হাফিজদের নিকট এর কোনো ভিত্তি নেই।’ (আল আসরার পৃ. ১০৯)
অনুরূপভাবে আল্লামা সাখাবি রহ. আল্লামা আজলূনী রহ. আলহূত মুহাম্মাদ বিন দারবিশ রহ. প্রমুখও এটিকে বানোয়াট, জাল ও ভিত্তিহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (আল মাকাসিদ পৃ. ১৯৫ কাশফুল খাফা খ. ০১ পৃ. ৪১৩ আসনাল মাতালিব পৃ. ৯৫)
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম সাগানী তার ‘আল মাওযূআত’ বা বানোয়াট হাদিস শীর্ষক গ্রন্থে এ হাদিস সম্পর্কে বলেন: موضوع বা বানোয়াট (হাদিস নং ৮১)
শাইখ আলবানী রহঃ বলেন:
“দেশপ্রেম ঈমানের অন্তর্ভুক্ত” এটি বানোয়াট হাদিস যেমনটি ইমাম সাগানী এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন। এর মর্মার্থটিও সঠিক নয়। কারণ দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা নিজের জীবন ও অর্থ-সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকার মতই একটি বিষয়। এগুলো মানুষের স্বভাবগত প্রবৃত্তি। সুতরাং এই ভালবাসা যেমন বিশেষ প্রশংসা পাওয়ার হকদার নয় তেমনি এটি ঈমানের অপরিহার্য অনুষঙ্গও নয়। কেননা, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই ভালবাসা বিদ্যমান রয়েছে-চাই সে মুমিন হোক অথবা কাফের হোক।” (সিলসিলা যঈফা হাদিস নং ৩৬)
শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমীন রহ. বলেন:
“দেশকে ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ” কথাটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস হিসেবে বলা হয়ে থাকে। এটি একটি মিথ্যাচার। দেশকে ভালবাসতে হলে, এ কারণে ভালবাসতে হবে যে, সেটি ইসলামি রাষ্ট্র- চাই তা আপনার জন্মভূমি হোক বা দূরের কোনো দেশ হোক। সবগুলোই ইসলামী দেশ। প্রতিটি ইসলামি দেশকে রক্ষা করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।”
(শাইখ আল্লামা উসাইমীন রহ. কর্তৃক রিয়াযুস সালেহীন গ্রন্থের ব্যাখ্যা)
ইসলাম দেশপ্রেমের প্রতি অনুপ্রাণিত করে এবং এটি প্রশংসনীয়ও বটে। কেননা, স্বয়ং রাসূল্লাহ ﷺ –এর জীবনেও বিভিন্ন সময়ে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছিল। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,
ما أطيبَكِ مِن بلدةٍ وأحَبَّك إليَّ، ولولا أنَّ قومي أخرَجوني منكِ ما سكَنْتُ غيرَكِ
‘হে মক্কা! তুমি কতই না উত্তম দেশ! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি! তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিলে আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো দেশে বসবাস করতাম না।’ (সহিহ ইবনু হিব্বান ৩৭০৯)।
সহিহ বুখারিতে এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ، فَأَبْصَرَ دَرَجَاتِ الْمَدِينَةِ أَوْضَعَ نَاقَتَهُ، وَإِنْ كَانَتْ دَابَّةً حَرَّكَهَا. قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ زَادَ الْحَارِثُ بْنُ عُمَيْرٍ عَنْ حُمَيْدٍ حَرَّكَهَا مِنْ حُبِّهَا
রাসূলুল্লাহ ﷺ সফর থেকে ফিরে যখন মদিনার উঁচু রাস্তাগুলো দেখতেন তখন তিনি তাঁর উটনী দ্রুতগতিতে চালাতেন তার বাহন অন্য জানোয়ার হলে তিনি তাকে তাড়া দিতেন। আর এমনটি করতেন মদিনার প্রতি ভালোবাসার কারণে। (বুখারি ১৮৬৫)
আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানি রহ. এই হাদিসের ব্যখ্যায় লিখেন,
في الحديث دلالة على فضل المدينة وعلى مشروعية حب الوطن والحنين إليه
হাদিসটিতে মদিনার মর্যাদা এবং স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগের বৈধতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। (ফাতহুল বারী খ. ০৩ পৃ. ৬২১)
যাহোক, দেশের প্রতি ভালবাসা থাকা মানুষের প্রকৃতিগত বিষয়। সকল ধর্মের লোকই তাদের দেশকে ভালবাসে। কিন্তু কোনো ইসলামি দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকাটা মুসলিম ও সুনাগরিক হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, কোনো ইসলামী দেশ যদি কাফের দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন ঐ দেশে বসবাসকারী প্রতিটি মুসলিমের জন্য সর্বাত্মকভাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে যায়। আবার অন্য দিকে দেশ থেকে যদি ইসলাম পালন করা অসম্ভব হয়ে যায় এবং জান-মাল ও ইজ্জত-সম্ভ্রম অনিরাপদ পড়ে তখন দেশ ছেড়ে ‘হিজরত’ও করতে হতে পারে।
ইসলাম হল সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য মহান আল্লাহ্ কর্তৃক দেয়া পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন বিধান। সকল মানুষের সমগ্র জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি নিষেধ ইসলাম সবিস্তারে বর্ণনা করেছে। আপনি কিভাবে ঘুমাবেন, খাবেন, হাটবেন এমন কি টয়লেট করবেন তাও ইসলাম বলে দিয়েছে। ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে আন্তর্জাতিক / আন্তঃরাষ্ট্রিয় সম্পর্ক সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান রয়েছে। এমনকি পছন্দ অপছন্দ, ভালোবাসা ঘৃণার মানদণ্ডও ইসলামে সবিস্তারে বর্ননা রয়েছে। সে অনুযায়ী দেশপ্রেমের বিষয়েও ইসলামের বক্তব্য আছে।
তবে, যারা দেশপ্রেমের সবক দেয়, তারা দেশপ্রেম বলতে কোন দেশের প্রতি প্রেম-ভালবাসার কথা বুঝায়?
- যে দেশ আল্লাহর আইন শরিয়াহ'র অনুসরণ করে?
- নাকি, যে দেশ মানুষের খায়েশাতের বা ইচ্ছার অনুসরণ করে?
যদি বলেন ইসলামিক দেশ তাহলে, ইসলাম তো এ কথা বলে না যে, আমার দেশ (আমার এলাকা/ আমার জন্মস্থান) ভাল থাকুক অন্য সকল দেশ জলে যাক। বরং ইসলাম চায় সকলেই ভাল থাকুক পৃথিবীতে এবং আখিরাতে। ইসলাম জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না। আপনি কোন এলাকার, আমেরিকার নাকি নাইজেরিয়ার ইসলামে তার কোন মূল্য নাই। আপনি প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে নাকি ঝাড়ুদারের ছেলে তারও কোন মূল্য নাই। মূল্য আপনার ইমানের।
একটি শরিয়াহ শাসিত ইসলামিক দেশ তার অধিবাসী সকল নাগরিককে দুই ভাগে বিভক্ত করে, এবং তদানুযায়ী আইন বিচার ফয়সালার নির্দেশ করে।
১/ মুসলমান ২/ কাফের
ঈমানওয়ালারা মুসলিম বলে পরিচিত হবে, আর ইসলামের বিধিবিধান প্রত্যেক মুসলিমকে বাধ্যতামূলক পালন করতে হবে। এবং মুসলিমরাই হবে উচ্চ শ্রেণীর নাগরিক। একটি শরিয়াহ শাসিত রাষ্ট্রে- রাষ্ট্রীয় সকল দায়-দায়িত্ব মুসলিমদের হাতেই থাকবে। আর কাফিররা জিজিয়ার দেয়ার বিনিময়ে মুসলিমদের নিকট জীবনের নিরাপত্তা পাবে। এবং তারা থাকবে নিন্ম শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে।
ইসলামী রাষ্ট্রে জিম্মি কাফির নিজ আঙ্গিনায় নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। কিন্তু সে তার ধর্ম প্রচার করতে পারবে না। আবার কেউ তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না। তবে সে চাইলেই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে, মুসলিমদের সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু কোন মুসলিম ইসলাম ত্যাগ করলে ইসলামী রাষ্ট্রে তার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদণ্ড।
মুসলিমরা জাকাত দিবে, তাও আবার বছরে একবার। যা আবার সকলের জন্য ধার্য করা হয় না। প্রকাশ্য বা গোপন কোন প্রকারের ভ্যাট, ট্যাক্স বা কর দিতে হয় না। কেউ অন্যায় করলে শরিয়াহ অনুযায়ী বিচার হবে। ইসলামী শরিয়াহ'য় যে বিষয়ে যে বিধান আছে, তা ক্ষেত্রানুসারে সকলের উপর সমানভাবে প্রয়োগ হবে।
তো, এদেশ কি ইসলামী রাষ্ট্র? যার প্রতি আমাদের ভালোবাসা দেখাতে হবে?
১৭৫৭ সালে পলাশী'র যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশদের নিকট এদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। তখন থেকেই ব্রিটিশরা এদেশে তাদের মনগড়া কুফুরি আইনের মাধ্যমে শাসন চালিয়ে আসছে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় তাদের নীতি আদর্শে গড়ে তোলা পাচাটা গোলামদের হাতে এদেশের শাসনভার ছেড়ে যায়। যারা এদেশে ব্রিটিশদের বানোয়াট আইনকানুন দ্বারাই আজ পর্যন্ত এদেশ পরিচালনা করে যাচ্ছে।
অর্থাৎ সেই ১৭৫৭ সাল থেকেই এদেশে ইসলামী শাসন অনুপস্থিত। শরিয়াহর পরিভাষায় এই দেশ দারুল কুফর বা দারুল হারব। যেখানে মুসলিমদের পুনরায় শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্যই শুধুমাত্র অবস্থান করা বৈধ। নচেৎ ইসলাম কায়েম আছে এমন ভূমিতে হিজরত করা ফরজ। আর তাই এখানে দেশপ্রেমের প্রসঙ্গটাই অপ্রাসঙ্গিক।
(সংগৃহীত এবং সম্পাদিত)
Comment