তৃতীয় পর্ব
এই পর্যায়ে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার ধারক হিসেবে উপস্থাপন করে বলা হল, পশ্চিমা সভ্যতাই ইসলামের আদি সভ্যতা। আর সহজে এই উদ্দেশ্য সাধনের মতলবে হাদীসের প্রামাণ্যতা অস্বীকার করা হল। ফলে পশ্চিমা সভ্যতাকে ইসলামী সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সবচেয়ে বড় বাধাটি দূর হয়ে যায়।
অবশ্য সামান্য পার্থক্য ছিল। প্রফেসর স্মিথ কুরআন-হাদীসের সরাসরি 'যুক্তিনির্ভর সমালোচনা' করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু চতুর মডার্নিস্টরা এমন কৌশল অবলম্বন করল; যাতে কুরআন-হাদীস এড়িয়ে মডার্নিজমও প্রচার পায় আবার কুরআনকে সরাসরি রদ করার অভিযোগ থেকেও বাঁচা যায়।
কারণ কুরআনকে সরাসরি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালে কেউই তাদের কথা শুনতে রাজি হত না। তাই তাঁরা এই স্লোগানের আশ্রয় নিল-
حَسْبُنَا كِتَابُ الله.
`আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট'।
তবে জানা কথা, হাদীস শরীফকে উপেক্ষা করে কুরআন মানা আর না মানা ছিল সমান কথা। কারণ হাদীস অস্বীকার করলে কুরআনের অপব্যাখ্যা ও অর্থবিকৃতির ময়দান খুলে যায়, কুরআনের যেমন ইচ্ছা অর্থ করার ফাঁক-ফোকর তৈরি হয়।
তো এই লোকেরা হাদীস শরীফের নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার অপচেষ্টায় পূর্ণ শক্তি ব্যয় করল। প্রতিটি লেখায় কুরআনের অসংখ্য আয়াত উদ্ধৃত করে কুরআনের প্রতি তাদের `গভীর প্রেম ও অনুরাগ' বোঝাতে চাইল।
হাদীসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার এই মিশন কয়েকটি ধাপ পাড়ি দিয়ে ادارۂ طلوع اسلام (`এদারায়ে তুলূয়ে ইসলাম' বা 'ইসলামের নবউত্থান' নামক একটি প্রতিষ্ঠান)-এর অধীনে স্বতন্ত্র সংগঠিত চিন্তার রূপ নিল। একটা সময় পর্যন্ত এই চিন্তাধারা না-ওয়াকিফহাল শ্রেণি ও মুক্তচিন্তাকামী লোকদের মাঝে বিশেষ সফলতা পেতে থাকল। আকর্ষণীয় সব লেখা প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদেরকে দ্বীনের 'সাচ্চা খাদেম' প্রমাণ করতে চাইল।
কিন্তু আলেমরা এই ফেতনার স্বরূপ প্রকাশ করলে এর মোহ ভাঙতে সময় লাগেনি। মুসলিমরা বুঝে গেলেন, হাদীস অস্বীকার করলে দ্বীন ও শরীয়ত এবং আকল-বুদ্ধির কী জঘন্য বিকৃতি ঘটে। তাই হাদীস অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেও মডার্নিজম প্রচারকরা তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।
চতুর্থ পর্ব
দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে ইসলামের বিকৃতিসাধন চর্চার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই মডার্নিস্টরা ইসলাম অপারেশনে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিল। তাই তৃতীয় ধাপ ব্যর্থ হওয়ার পর আমীর আলী সাহেবের মডেলে ফিরতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিকৃতিসাধনের কলা-কৌশল এত উন্নত হয়ে গিয়েছিল যে, হাদীস ও সুন্নাহকে স্বীকার করার ঘোষণা দিয়েও তারা ইসলামের নামে ইচ্ছেমতো মতবাদ চাপিয়ে দিত। এভাবে মডার্নিজম চতুর্থ ধাপে পা রাখে।
এবারে পশ্চিমা চিন্তার প্রচারকরা জনসাধারণের সামনে কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক প্রামাণ্যতা মেনে নেওয়ার কৌশল বেছে নিল। তবে কোনো হাদীস তাদের মতের বিরোধী হলে পূর্বের ন্যায় হাদীসের অর্থ বিকৃত করতে দ্বিধা করত না; পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় এই কাজে তাদের মুন্সিয়ানাও ছিল। হাদীসটির মর্ম যদি পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন হত, বিকৃত করার কোনো উপায় বের না হত, তবে হাদীসের সূত্রে দুর্বলতা দেখিয়ে, কুরআনবিরোধী বা যুক্তিবিরোধী বলে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করত।
এই কাজে গতি ফিরে পেতে একে অপরকে উৎসাহ দেওয়া এবং পারস্পরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রয়োজন ছিল।
من ترا حاجی بگویم تو مرا حاجی بگو
'আমি তোমাকে হাজ্বী ডাকব তুমিও আমাকে হাজ্বী ডাকবে'।
এই উদ্দেশ্যে লাহোরে ادارۂ ثقافت اسلامى ('এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী' বা ইসলামী সংস্কৃতি পরিষদ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ثقافت (সাকাফাত বা সংস্কৃতি) পত্রিকা প্রকাশিত হয়, ইসলামের আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ইতিপূর্বে স্যার সৈয়দসহ অন্যান্য মডার্নিস্ট যেসব মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, সেগুলো প্রমাণ করতে বহু গ্রন্থ রচিত হয়।
যেমন, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়, সংগীত পরিবেশন ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বৈধতা দেওয়া হয়, ছবি তোলা ও ফটোগ্রাফি করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, নারীদের মুখ খোলার রায়ও সমর্থন পায় এবং পর্দার বিধান দূরে ঠেলে দেওয়া হয়।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্যার সৈয়দ বা হাদীস অস্বীকারকারীদের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করা হয়।
তবে একটি পার্থক্য ছিল। পুরোনো মডেলের যে মডার্নিস্টরা এই বিষয়গুলোতে কলম ধরেছিলেন, তারা বেশ সাহসিকতার সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ভালবাসি, আমাদের সমাজে এই সংস্কৃতি গড়তে চাই।'
কিন্তু নতুন মডেলের প্রচারকারীরা এই সৎসাহস দেখাতে পারলেন না। তারা বারবার দাবি করলেন, 'আমরা পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসারী নই। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা মন্দ দিক এবং এর বদৌলতে পশ্চিমা সমাজ কী কী অধঃপতনের শিকার হয়েছে, তা আমরাও জানি।'
কিন্তু তারা দ্বিচারিতা করলেন। তারা সেই সব মন্দ বিষয় সমর্থন করলেন, যেগুলোর কারণে পশ্চিমারা নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এই স্ববিরোধী কর্মরীতি তাদের প্রকৃত হালই প্রকাশ করে। ভাবটা এমন, 'পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণের কুফল আমরা যৌক্তিকভাবে বুঝি, কিন্তু-
اپنی نظر کو کیا کروں ، مجھ کوتو وہ پسند ہیں
'কী করব, আমাদের চোখে সেটাই ভালো লাগে।'
'এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী'র উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন খলীফা আবদুল হাকীম। শেষ পর্যন্ত তিনিও সরাসরি হাদীস অস্বীকারের মডেল বদলে এমন দ্বৈত রীতি গ্রহণ করেছিলেন।
আরেকজন ছিলেন জাফর শাহ ফুলওয়ারী। 'ছাকাফাত' থেকে ফুলওয়ারীর অনেকগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য, তার বেশ কিছু লেখা আমার পড়া হয়েছিল, কয়েকটি নিয়ে আমার পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।
এই শ্রেণির যুক্তি কতটা 'ওজনদার', সেটার বিশদ ধারণা পেতে হলে আপনাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পড়তে হবে। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা দেখা যাক। জনাব ফুলওয়ারী কমিউনিজমের একটি মৌলিক চিন্তা প্রমাণ করতে গিয়ে দাবি করলেন, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক জমি-জমা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জাতীয় সম্পত্তি, জমি কাউকে স্থায়ী মালিক হিসেবে নয়, বরং সাময়িক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।
এই দাবির বিপক্ষে কুরআন-হাদীসের বহু দলীল থাকা সত্ত্বেও তিনি দাবিটি প্রমাণে একটি মজার যুক্তি দেন। হাদীসে এসেছে-
جُعِلَتْ لِيَ الْأرْضُ مَسْجِدًا.
'আমার জন্য গোটা পৃথিবীকে মসজিদ বানানো হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'মসজিদ তো কারো ব্যক্তি মালিকানা নয়। যখন পুরো পৃথিবীর যমিনকে মসজিদ বলা হচ্ছে, এর মানে, জমি-জমা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ হতে পারে না'!
এই অবান্তর যুক্তির ওপর কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন দেখছি না। এই শ্রেণির যুক্তি এমনই হয়।
মডার্নাইজেশনের 'বিরাট' কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে এত নিম্নমানের যুক্তি উৎপাদন করতে থাকলে এই শ্রেণির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল। অন্যদিকে তখন পর্যন্ত পশ্চিমা চিন্তার প্রসার ঘটানোর দুই পন্থাই পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল; হাদীস অস্বীকার করে কিংবা বাহ্যত হাদীস মেনে নিয়ে।
হাদীস অস্বীকারকারী চক্রের প্রভাব দিন দিন কমে আসছিল। পরিশেষে একটি বড় আঘাতে হাদীস অস্বীকারের ফেতনার চূড়ান্ত পতন ঘটে। এই আঘাতটি ছিল সব মত ও পথের আলেমদের ঐকমত্যপূর্ণ ফতোয়া। সকল ধারার আলেমগণ স্পষ্ট ভাষায় হাদীস অস্বীকারকারীদের কাফের ঘোষণা করেছিলেন। এই আঘাতের পর হাদীস অস্বীকারকারীদের ওপর সাধারণ মানুষের অবশিষ্ট আস্থাও বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাই পুনরায় হাদীস অস্বীকারের মাধ্যমে মতলব উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না।
এখন মডার্নিস্টদের প্রয়োজন ছিল ঐ লোকদের, যারা কুরআন-হাদীস মানার ঘোষণা দিয়েও এমন দলীল উপস্থাপন করতে পারে, যা শোনামাত্রই খণ্ডনযোগ্য না হয় এবং অন্তত বেখবর মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। এই কাজের জন্য বিশেষ একজন দরকার ছিল, যিনি সরাসরি পশ্চিমা কোনো ভার্সিটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন।
মুহতারাম ড. ফজলুর রহমান এই মানদণ্ডে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সবদিক বিবেচনায় তিনি এই কাজের 'যোগ্য' ছিলেন। তিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ইহুদী প্রাচ্যবিদদের সংশ্রবে 'ইসলামী জ্ঞান' অর্জন করেছিলেন।
১৯৫৯ সালে করাচিতে مركز اسلامى تحقيقاتى اداره (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র) নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়, যা মডার্নিজম প্রসারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়। এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোট চারটি পত্রিকা চালু করা হয়, দুটি ইংরেজিতে : একটি ত্রৈমাসিক Islamic Studies অপরটি মাসিক Ummah, সন্ধান নামে একটি পত্রিকা বাংলায় এবং فکر ونظر নামে একটি পত্রিকা উর্দুতে চালু হয়।
ড. ফজলুর রহমান পাকিস্তানে এসে মডার্নিস্ট ও প্রাচীনপন্থী মূলধারা; উভয় শ্রেণি থেকে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেন। পূর্বের মডার্নিস্টদের সমালোচনাও করেন, যার অর্থ ছিল, তিনি তাদের সাথে একমত নন।
১৯৫৭ সালে লাহোরের একটি ইসলামিক সেমিনারে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে ড. ফজলুর রহমান মডার্নিজমের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন-
آزاد منش جدت پسندوں نے اس قدر دیوانہ وار اور اتنے فیصلہ کن انداز میں مغرب کی معاشرتی واخلاقی اقدار کو اسلام سے اس قدر ہم آہنگ کرنے کی کوشش کی کہ پوری طرح اس بات کی وضاحت کرنے کی بھی ضرورت نہ سمجھی کہ انہیں کیوں اپنا نا چاہئے؟
'মডার্নিজমের মুক্তমনা প্রবক্তারা এত উন্মাদ হয়ে পশ্চিমের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলোকে মীমাংসিত ও সন্দেহাতীত ধরে নিয়ে সেগুলোকে ইসলামের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রবল চেষ্টা করেছিলেন যে, কেন তাদের এই নতুন মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করেননি তারা।'
এই কথাটি তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেন। যেমন মাসিক 'ফিকর ও নযর' পত্রিকার ১৯৬৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় তিনি লেখেন-
قدامت پسند حضرات قرون وسطی کے نظریات کی رو سے اسلام کی تشریح کرتے ہیں ، لیکن جدت پسند اصحاب ان نظریات کے بجائے نئی توضیحات لاتے ہیں۔
'রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীরা মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামের ব্যাখ্যা করেন। আর মডার্নিজম সমর্থকরা পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন।' (পৃ. ৯)
তিনি আরো লেখেন-
لیکن جدت پسند بھی اسلام کا کوئی نیا ترقیاتی خاکہ نہیں پیش کرتے ، ان کی جد و جہد منفی سمت میں ہوتی ہے ، وہ اسلام کو علیحدہ یا غیر مؤثر رکھنا چاہتے ہیں، تا کہ اسلام ترقی کی راہ میں حائل نہ ہو ، ان کا خیال ہے کہ اسلامی حدود سے باہر رہ کر ہی ترقی کی منزلیں طے کی جاسکتی ہیں ، اس طرح ایک اقل اسلام کا تصور ان کے سامنے آتا ہے ، جس سے انہیں عارضی تسلی تو مل جاتی ہے لیکن یہ لادینیت کا دوسرا نام ہوتا ہے ۔
'মডার্নিজমের প্রবক্তারাও ইসলামের কোনো নতুন উন্নয়নমূলক রূপরেখা উপস্থাপন করেন না। তাদের প্রচেষ্টাও নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়। তারা ইসলামকে অকার্যকর বা একঘরে করে রাখতে চান, যাতে ইসলাম 'উন্নতি'র পথে কাঁটা না হয়। তাদের ধারণা, ইসলামের সীমারেখা থেকে বেরোতে না পারলে 'উন্নতি'র পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে ইসলামের একটি সংকুচিত পরিচয় তৈরি হয়, যা তাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও আসলে তা ধর্মহীনতারই ভিন্ন রূপ।' (প্রাগুক্ত)
এই ধরনের লেখার মাধ্যমে ড. ফজলুর রহমান সবাইকে বুঝিয়েছেন; তিনি নিরপেক্ষ, মডার্নিস্টদের মতো পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করতে চান না, তাই চিহ্নিত মডার্নিস্টদের কাতারে তাকে গণ্য করা উচিত নয়।
কিন্তু এখানেই প্রবল আপত্তি ওঠে; ড. সাহেবের অবস্থান যদি এমনই হয়, তাহলে যেসব বিষয়ে মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুকরণ করেছে, সেইসব বিষয়ে ড. সাহেব তাদের সাথে একমত হলেন কেন? 'এদারায়ে তাহকীকাতে ইসলামী' (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র)-এর কাজে এবং অতীত মডার্নিস্টদের কাজে তো কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিষ্ঠানটির যত 'কীর্তি' এই পর্যন্ত জনসম্মুখে এসেছে, সবগুলো একথার জ্বলন্ত প্রমাণ।
পশ্চিমের অনুকরণে সাবেক মডার্নিস্টরা সুদকে বৈধ বলেছিল, ড. সাহেবও তা-ই বলছেন। তারা বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। তারা পর্দাকে শরীয়তবহির্ভূত দাবি করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। যত বিষয়ে তারা পশ্চিমের অনুকরণ করেছে, ড. সাহেব ও তার গবেষক দল তাদের থেকে এর কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেননি। তাহলে ড. সাহেবকে সাবেক মডার্নিস্টদের থেকে আলাদা মনে করার যুক্তি কী?
সুতরাং 'মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুসরণ করেছিল'; ড. সাহেবের এই কথার মতলব এটাই দাঁড়ায়, অতীতের লোকেরা অন্ধভাবে পশ্চিমা ধারা মেনে নিয়েছিল আর আমরা রীতিমতো 'গবেষণা' করে গ্রহণ করেছি!
তার মানে তারা কি বলতে চান, যতই গবেষণা করা হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমা রীতিই অপরিহার্য প্রমাণ হয়?!
যাইহোক, ড. ফজলুর রহমানের কর্মরীতি থেকে স্পষ্ট, দ্বীন ও শরীয়তের পশ্চিমায়নের পুরোনো কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নতুন ছক এঁকেছেন, যাতে এই ধারণা দেওয়া যায় যে, কুরআন-সুন্নাহ আশ্রিত গবেষণাও পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির পক্ষেই কথা বলে।
হাঁ, ড. সাহেব প্রকাশ্যে হাদীস অস্বীকার করেন না। তার লেখাগুলোতে কুরআনের আয়াত, নবীজীর হাদীস এবং বড় বড় দ্বীনী গ্রন্থের প্রচুর উদ্ধৃতি দেখা যায়। কিন্তু তার লেখাজোখা বিশ্লেষণ করলে আমরা বলতে বাধ্য হই, তার লেখার ভঙ্গি জটিল, গোলমেলে এবং প্রাচ্যবিদদের উপস্থাপনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত। ফলে সাধারণ পাঠক পুরো লেখাটি পড়ে বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলেও উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি দেখে তার গবেষণার ধরনে মুগ্ধ হয়। পাঠক মনে করে, এত গবেষণাধর্মী লেখা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, এতে অনস্বীকার্য সব দলীল আছে। এভাবে দলীল যাচাই না করেই পাঠক প্রভাবিত হয়ে যায়।
আর যদি আহলে ইলম মনের ওপর জোর খাটিয়ে পুরো প্রবন্ধ পড়েও ফেলেন, তবে বহু চিন্তা-ভাবনার পর ড. সাহেবের দাবিগুলো বুঝতে পারলেও গোটা লেখা থেকে দাবির পক্ষে দলীল চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ড. সাহেব লেখায় যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন, তার খুব কম অংশই মূল দাবির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়।
পাঠক, এই ছিল মডার্নিজমের একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং মডার্নিস্টদের চিন্তাধারার বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।
[উর্দূ প্রবন্ধে ইংরেজি উদ্ধৃতিগুলোর অনুবাদ পেশ করা হয়েছে, বাংলা অনুবাদের সময় মূল বই থেকে উদ্ধৃতিগুলো মিলিয়ে দেখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ইংরেজি পাঠও যুক্ত করা হয়েছে। -অনুবাদক]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
সূত্র:- আলকাউসার
এই পর্যায়ে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ সভ্যতার ধারক হিসেবে উপস্থাপন করে বলা হল, পশ্চিমা সভ্যতাই ইসলামের আদি সভ্যতা। আর সহজে এই উদ্দেশ্য সাধনের মতলবে হাদীসের প্রামাণ্যতা অস্বীকার করা হল। ফলে পশ্চিমা সভ্যতাকে ইসলামী সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সবচেয়ে বড় বাধাটি দূর হয়ে যায়।
অবশ্য সামান্য পার্থক্য ছিল। প্রফেসর স্মিথ কুরআন-হাদীসের সরাসরি 'যুক্তিনির্ভর সমালোচনা' করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু চতুর মডার্নিস্টরা এমন কৌশল অবলম্বন করল; যাতে কুরআন-হাদীস এড়িয়ে মডার্নিজমও প্রচার পায় আবার কুরআনকে সরাসরি রদ করার অভিযোগ থেকেও বাঁচা যায়।
কারণ কুরআনকে সরাসরি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানালে কেউই তাদের কথা শুনতে রাজি হত না। তাই তাঁরা এই স্লোগানের আশ্রয় নিল-
حَسْبُنَا كِتَابُ الله.
`আল্লাহর কিতাবই আমাদের জন্য যথেষ্ট'।
তবে জানা কথা, হাদীস শরীফকে উপেক্ষা করে কুরআন মানা আর না মানা ছিল সমান কথা। কারণ হাদীস অস্বীকার করলে কুরআনের অপব্যাখ্যা ও অর্থবিকৃতির ময়দান খুলে যায়, কুরআনের যেমন ইচ্ছা অর্থ করার ফাঁক-ফোকর তৈরি হয়।
তো এই লোকেরা হাদীস শরীফের নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করার অপচেষ্টায় পূর্ণ শক্তি ব্যয় করল। প্রতিটি লেখায় কুরআনের অসংখ্য আয়াত উদ্ধৃত করে কুরআনের প্রতি তাদের `গভীর প্রেম ও অনুরাগ' বোঝাতে চাইল।
হাদীসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার এই মিশন কয়েকটি ধাপ পাড়ি দিয়ে ادارۂ طلوع اسلام (`এদারায়ে তুলূয়ে ইসলাম' বা 'ইসলামের নবউত্থান' নামক একটি প্রতিষ্ঠান)-এর অধীনে স্বতন্ত্র সংগঠিত চিন্তার রূপ নিল। একটা সময় পর্যন্ত এই চিন্তাধারা না-ওয়াকিফহাল শ্রেণি ও মুক্তচিন্তাকামী লোকদের মাঝে বিশেষ সফলতা পেতে থাকল। আকর্ষণীয় সব লেখা প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদেরকে দ্বীনের 'সাচ্চা খাদেম' প্রমাণ করতে চাইল।
কিন্তু আলেমরা এই ফেতনার স্বরূপ প্রকাশ করলে এর মোহ ভাঙতে সময় লাগেনি। মুসলিমরা বুঝে গেলেন, হাদীস অস্বীকার করলে দ্বীন ও শরীয়ত এবং আকল-বুদ্ধির কী জঘন্য বিকৃতি ঘটে। তাই হাদীস অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করেও মডার্নিজম প্রচারকরা তেমন সফলতা অর্জন করতে পারেনি।
চতুর্থ পর্ব
দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে ইসলামের বিকৃতিসাধন চর্চার নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই মডার্নিস্টরা ইসলাম অপারেশনে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিল। তাই তৃতীয় ধাপ ব্যর্থ হওয়ার পর আমীর আলী সাহেবের মডেলে ফিরতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিকৃতিসাধনের কলা-কৌশল এত উন্নত হয়ে গিয়েছিল যে, হাদীস ও সুন্নাহকে স্বীকার করার ঘোষণা দিয়েও তারা ইসলামের নামে ইচ্ছেমতো মতবাদ চাপিয়ে দিত। এভাবে মডার্নিজম চতুর্থ ধাপে পা রাখে।
এবারে পশ্চিমা চিন্তার প্রচারকরা জনসাধারণের সামনে কুরআন-হাদীসের সামগ্রিক প্রামাণ্যতা মেনে নেওয়ার কৌশল বেছে নিল। তবে কোনো হাদীস তাদের মতের বিরোধী হলে পূর্বের ন্যায় হাদীসের অর্থ বিকৃত করতে দ্বিধা করত না; পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় এই কাজে তাদের মুন্সিয়ানাও ছিল। হাদীসটির মর্ম যদি পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন হত, বিকৃত করার কোনো উপায় বের না হত, তবে হাদীসের সূত্রে দুর্বলতা দেখিয়ে, কুরআনবিরোধী বা যুক্তিবিরোধী বলে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করত।
এই কাজে গতি ফিরে পেতে একে অপরকে উৎসাহ দেওয়া এবং পারস্পরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রয়োজন ছিল।
من ترا حاجی بگویم تو مرا حاجی بگو
'আমি তোমাকে হাজ্বী ডাকব তুমিও আমাকে হাজ্বী ডাকবে'।
এই উদ্দেশ্যে লাহোরে ادارۂ ثقافت اسلامى ('এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী' বা ইসলামী সংস্কৃতি পরিষদ) নামে একটি প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ثقافت (সাকাফাত বা সংস্কৃতি) পত্রিকা প্রকাশিত হয়, ইসলামের আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ইতিপূর্বে স্যার সৈয়দসহ অন্যান্য মডার্নিস্ট যেসব মতামত ব্যক্ত করেছিলেন, সেগুলো প্রমাণ করতে বহু গ্রন্থ রচিত হয়।
যেমন, বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হয়, সংগীত পরিবেশন ও জন্মনিয়ন্ত্রণের বৈধতা দেওয়া হয়, ছবি তোলা ও ফটোগ্রাফি করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, নারীদের মুখ খোলার রায়ও সমর্থন পায় এবং পর্দার বিধান দূরে ঠেলে দেওয়া হয়।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্যার সৈয়দ বা হাদীস অস্বীকারকারীদের কথাগুলোই পুনরাবৃত্তি করা হয়।
তবে একটি পার্থক্য ছিল। পুরোনো মডেলের যে মডার্নিস্টরা এই বিষয়গুলোতে কলম ধরেছিলেন, তারা বেশ সাহসিকতার সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতিকে ভালবাসি, আমাদের সমাজে এই সংস্কৃতি গড়তে চাই।'
কিন্তু নতুন মডেলের প্রচারকারীরা এই সৎসাহস দেখাতে পারলেন না। তারা বারবার দাবি করলেন, 'আমরা পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসারী নই। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির নানা মন্দ দিক এবং এর বদৌলতে পশ্চিমা সমাজ কী কী অধঃপতনের শিকার হয়েছে, তা আমরাও জানি।'
কিন্তু তারা দ্বিচারিতা করলেন। তারা সেই সব মন্দ বিষয় সমর্থন করলেন, যেগুলোর কারণে পশ্চিমারা নানা বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এই স্ববিরোধী কর্মরীতি তাদের প্রকৃত হালই প্রকাশ করে। ভাবটা এমন, 'পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণের কুফল আমরা যৌক্তিকভাবে বুঝি, কিন্তু-
اپنی نظر کو کیا کروں ، مجھ کوتو وہ پسند ہیں
'কী করব, আমাদের চোখে সেটাই ভালো লাগে।'
'এদারায়ে ছাকাফাতে ইসলামী'র উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন খলীফা আবদুল হাকীম। শেষ পর্যন্ত তিনিও সরাসরি হাদীস অস্বীকারের মডেল বদলে এমন দ্বৈত রীতি গ্রহণ করেছিলেন।
আরেকজন ছিলেন জাফর শাহ ফুলওয়ারী। 'ছাকাফাত' থেকে ফুলওয়ারীর অনেকগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য, তার বেশ কিছু লেখা আমার পড়া হয়েছিল, কয়েকটি নিয়ে আমার পর্যালোচনামূলক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।
এই শ্রেণির যুক্তি কতটা 'ওজনদার', সেটার বিশদ ধারণা পেতে হলে আপনাকে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পড়তে হবে। উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা দেখা যাক। জনাব ফুলওয়ারী কমিউনিজমের একটি মৌলিক চিন্তা প্রমাণ করতে গিয়ে দাবি করলেন, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক জমি-জমা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জাতীয় সম্পত্তি, জমি কাউকে স্থায়ী মালিক হিসেবে নয়, বরং সাময়িক ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়।
এই দাবির বিপক্ষে কুরআন-হাদীসের বহু দলীল থাকা সত্ত্বেও তিনি দাবিটি প্রমাণে একটি মজার যুক্তি দেন। হাদীসে এসেছে-
جُعِلَتْ لِيَ الْأرْضُ مَسْجِدًا.
'আমার জন্য গোটা পৃথিবীকে মসজিদ বানানো হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'মসজিদ তো কারো ব্যক্তি মালিকানা নয়। যখন পুরো পৃথিবীর যমিনকে মসজিদ বলা হচ্ছে, এর মানে, জমি-জমা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ হতে পারে না'!
এই অবান্তর যুক্তির ওপর কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন দেখছি না। এই শ্রেণির যুক্তি এমনই হয়।
মডার্নাইজেশনের 'বিরাট' কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে এত নিম্নমানের যুক্তি উৎপাদন করতে থাকলে এই শ্রেণির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল। অন্যদিকে তখন পর্যন্ত পশ্চিমা চিন্তার প্রসার ঘটানোর দুই পন্থাই পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল; হাদীস অস্বীকার করে কিংবা বাহ্যত হাদীস মেনে নিয়ে।
হাদীস অস্বীকারকারী চক্রের প্রভাব দিন দিন কমে আসছিল। পরিশেষে একটি বড় আঘাতে হাদীস অস্বীকারের ফেতনার চূড়ান্ত পতন ঘটে। এই আঘাতটি ছিল সব মত ও পথের আলেমদের ঐকমত্যপূর্ণ ফতোয়া। সকল ধারার আলেমগণ স্পষ্ট ভাষায় হাদীস অস্বীকারকারীদের কাফের ঘোষণা করেছিলেন। এই আঘাতের পর হাদীস অস্বীকারকারীদের ওপর সাধারণ মানুষের অবশিষ্ট আস্থাও বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাই পুনরায় হাদীস অস্বীকারের মাধ্যমে মতলব উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না।
এখন মডার্নিস্টদের প্রয়োজন ছিল ঐ লোকদের, যারা কুরআন-হাদীস মানার ঘোষণা দিয়েও এমন দলীল উপস্থাপন করতে পারে, যা শোনামাত্রই খণ্ডনযোগ্য না হয় এবং অন্তত বেখবর মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। এই কাজের জন্য বিশেষ একজন দরকার ছিল, যিনি সরাসরি পশ্চিমা কোনো ভার্সিটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং প্রাচ্যবিদদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন।
মুহতারাম ড. ফজলুর রহমান এই মানদণ্ডে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, সবদিক বিবেচনায় তিনি এই কাজের 'যোগ্য' ছিলেন। তিনি ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ইহুদী প্রাচ্যবিদদের সংশ্রবে 'ইসলামী জ্ঞান' অর্জন করেছিলেন।
১৯৫৯ সালে করাচিতে مركز اسلامى تحقيقاتى اداره (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র) নামে একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়, যা মডার্নিজম প্রসারের দায়িত্ব কাঁধে নেয়। এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি থেকে মোট চারটি পত্রিকা চালু করা হয়, দুটি ইংরেজিতে : একটি ত্রৈমাসিক Islamic Studies অপরটি মাসিক Ummah, সন্ধান নামে একটি পত্রিকা বাংলায় এবং فکر ونظر নামে একটি পত্রিকা উর্দুতে চালু হয়।
ড. ফজলুর রহমান পাকিস্তানে এসে মডার্নিস্ট ও প্রাচীনপন্থী মূলধারা; উভয় শ্রেণি থেকে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেন। পূর্বের মডার্নিস্টদের সমালোচনাও করেন, যার অর্থ ছিল, তিনি তাদের সাথে একমত নন।
১৯৫৭ সালে লাহোরের একটি ইসলামিক সেমিনারে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে ড. ফজলুর রহমান মডার্নিজমের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন-
آزاد منش جدت پسندوں نے اس قدر دیوانہ وار اور اتنے فیصلہ کن انداز میں مغرب کی معاشرتی واخلاقی اقدار کو اسلام سے اس قدر ہم آہنگ کرنے کی کوشش کی کہ پوری طرح اس بات کی وضاحت کرنے کی بھی ضرورت نہ سمجھی کہ انہیں کیوں اپنا نا چاہئے؟
'মডার্নিজমের মুক্তমনা প্রবক্তারা এত উন্মাদ হয়ে পশ্চিমের সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলোকে মীমাংসিত ও সন্দেহাতীত ধরে নিয়ে সেগুলোকে ইসলামের সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রবল চেষ্টা করেছিলেন যে, কেন তাদের এই নতুন মূল্যবোধগুলো গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন অনুভব করেননি তারা।'
এই কথাটি তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেন। যেমন মাসিক 'ফিকর ও নযর' পত্রিকার ১৯৬৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় তিনি লেখেন-
قدامت پسند حضرات قرون وسطی کے نظریات کی رو سے اسلام کی تشریح کرتے ہیں ، لیکن جدت پسند اصحاب ان نظریات کے بجائے نئی توضیحات لاتے ہیں۔
'রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থীরা মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামের ব্যাখ্যা করেন। আর মডার্নিজম সমর্থকরা পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেন।' (পৃ. ৯)
তিনি আরো লেখেন-
لیکن جدت پسند بھی اسلام کا کوئی نیا ترقیاتی خاکہ نہیں پیش کرتے ، ان کی جد و جہد منفی سمت میں ہوتی ہے ، وہ اسلام کو علیحدہ یا غیر مؤثر رکھنا چاہتے ہیں، تا کہ اسلام ترقی کی راہ میں حائل نہ ہو ، ان کا خیال ہے کہ اسلامی حدود سے باہر رہ کر ہی ترقی کی منزلیں طے کی جاسکتی ہیں ، اس طرح ایک اقل اسلام کا تصور ان کے سامنے آتا ہے ، جس سے انہیں عارضی تسلی تو مل جاتی ہے لیکن یہ لادینیت کا دوسرا نام ہوتا ہے ۔
'মডার্নিজমের প্রবক্তারাও ইসলামের কোনো নতুন উন্নয়নমূলক রূপরেখা উপস্থাপন করেন না। তাদের প্রচেষ্টাও নেতিবাচক দিকে ধাবিত হয়। তারা ইসলামকে অকার্যকর বা একঘরে করে রাখতে চান, যাতে ইসলাম 'উন্নতি'র পথে কাঁটা না হয়। তাদের ধারণা, ইসলামের সীমারেখা থেকে বেরোতে না পারলে 'উন্নতি'র পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। এভাবে ইসলামের একটি সংকুচিত পরিচয় তৈরি হয়, যা তাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও আসলে তা ধর্মহীনতারই ভিন্ন রূপ।' (প্রাগুক্ত)
এই ধরনের লেখার মাধ্যমে ড. ফজলুর রহমান সবাইকে বুঝিয়েছেন; তিনি নিরপেক্ষ, মডার্নিস্টদের মতো পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ করতে চান না, তাই চিহ্নিত মডার্নিস্টদের কাতারে তাকে গণ্য করা উচিত নয়।
কিন্তু এখানেই প্রবল আপত্তি ওঠে; ড. সাহেবের অবস্থান যদি এমনই হয়, তাহলে যেসব বিষয়ে মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুকরণ করেছে, সেইসব বিষয়ে ড. সাহেব তাদের সাথে একমত হলেন কেন? 'এদারায়ে তাহকীকাতে ইসলামী' (ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র)-এর কাজে এবং অতীত মডার্নিস্টদের কাজে তো কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিষ্ঠানটির যত 'কীর্তি' এই পর্যন্ত জনসম্মুখে এসেছে, সবগুলো একথার জ্বলন্ত প্রমাণ।
পশ্চিমের অনুকরণে সাবেক মডার্নিস্টরা সুদকে বৈধ বলেছিল, ড. সাহেবও তা-ই বলছেন। তারা বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। তারা পর্দাকে শরীয়তবহির্ভূত দাবি করেছিল, ড. সাহেব তা-ই করছেন। যত বিষয়ে তারা পশ্চিমের অনুকরণ করেছে, ড. সাহেব ও তার গবেষক দল তাদের থেকে এর কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেননি। তাহলে ড. সাহেবকে সাবেক মডার্নিস্টদের থেকে আলাদা মনে করার যুক্তি কী?
সুতরাং 'মডার্নিস্টরা অন্ধ অনুসরণ করেছিল'; ড. সাহেবের এই কথার মতলব এটাই দাঁড়ায়, অতীতের লোকেরা অন্ধভাবে পশ্চিমা ধারা মেনে নিয়েছিল আর আমরা রীতিমতো 'গবেষণা' করে গ্রহণ করেছি!
তার মানে তারা কি বলতে চান, যতই গবেষণা করা হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রে পশ্চিমা রীতিই অপরিহার্য প্রমাণ হয়?!
যাইহোক, ড. ফজলুর রহমানের কর্মরীতি থেকে স্পষ্ট, দ্বীন ও শরীয়তের পশ্চিমায়নের পুরোনো কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নতুন ছক এঁকেছেন, যাতে এই ধারণা দেওয়া যায় যে, কুরআন-সুন্নাহ আশ্রিত গবেষণাও পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির পক্ষেই কথা বলে।
হাঁ, ড. সাহেব প্রকাশ্যে হাদীস অস্বীকার করেন না। তার লেখাগুলোতে কুরআনের আয়াত, নবীজীর হাদীস এবং বড় বড় দ্বীনী গ্রন্থের প্রচুর উদ্ধৃতি দেখা যায়। কিন্তু তার লেখাজোখা বিশ্লেষণ করলে আমরা বলতে বাধ্য হই, তার লেখার ভঙ্গি জটিল, গোলমেলে এবং প্রাচ্যবিদদের উপস্থাপনশৈলী দ্বারা প্রভাবিত। ফলে সাধারণ পাঠক পুরো লেখাটি পড়ে বিষয়বস্তু বুঝতে না পারলেও উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি দেখে তার গবেষণার ধরনে মুগ্ধ হয়। পাঠক মনে করে, এত গবেষণাধর্মী লেখা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, এতে অনস্বীকার্য সব দলীল আছে। এভাবে দলীল যাচাই না করেই পাঠক প্রভাবিত হয়ে যায়।
আর যদি আহলে ইলম মনের ওপর জোর খাটিয়ে পুরো প্রবন্ধ পড়েও ফেলেন, তবে বহু চিন্তা-ভাবনার পর ড. সাহেবের দাবিগুলো বুঝতে পারলেও গোটা লেখা থেকে দাবির পক্ষে দলীল চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ড. সাহেব লেখায় যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন, তার খুব কম অংশই মূল দাবির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়।
পাঠক, এই ছিল মডার্নিজমের একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং মডার্নিস্টদের চিন্তাধারার বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।
[উর্দূ প্রবন্ধে ইংরেজি উদ্ধৃতিগুলোর অনুবাদ পেশ করা হয়েছে, বাংলা অনুবাদের সময় মূল বই থেকে উদ্ধৃতিগুলো মিলিয়ে দেখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ইংরেজি পাঠও যুক্ত করা হয়েছে। -অনুবাদক]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
সূত্র:- আলকাউসার