মেজর ডালিমের বক্তব্য: কিছু কথা এবং একাত্তরের চেতনা
মেজর ডালিমের লাইভটি যারা দেখেছেন, আশাকরি বুঝেছেন, ৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী রাজনীতির অনেক সত্য ইতিহাসই চাপা পড়ে আছে, আস্তে আস্তে যার অনেক কিছুই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নীতি এটাই যে, দ্বীনে হককে তিনি ক্রমান্বয়ে সত্য প্রমাণ করেন। এরপর যে মানে তো মানবে, নইলে জেনেবুঝে ধ্বংস হবে। আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর পর সে কোনো উজর বাহানা পেশ করতে পারবে না। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে অনেক কিছু পরিষ্কার করে দিচ্ছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে সব জাহিলিয়াতের আসল চিত্র এক সময় পরিষ্কার হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
০১- আপনারা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সাগর আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত হারানোর নেরেটিভ শুনে এসেছেন হয়তো ছোটবেলা থেকেই। যারা ৭১ দেখেনি তাদেরও মনে এই সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ ছিল, কিন্তু বলতে পারতো না। মেয়র জাহাঙ্গীর এ নিয়ে সামান্য একটু বলার পর আওয়ামিলীগের লোক হওয়া সত্ত্বেও তার কি পরিণতি হয়েছিল আপনারা দেখেছেন। কিন্তু সত্য গোপন থাকে না।
বলে রাখা কাম্য: ৩ লাখ যেটা বলা হয়েছে, সেটাও কিন্তু প্রকৃত কোনো সংখ্যা না। মিডিয়াতে বলতে হবে তাই মোটামুটি একটা সংখ্যা বলা হয়েছে। আসলে কতজন হতাহত হয়েছিল এবং হতাহতদের কতজন পাকিস্তানীদের হাতে হয়েছে- সরেজমিনে তদন্ত করতে গেলে হয়তো থলের বিড়াল আরও বেড়িয়ে আসবে।
০২- মেজর ডালিম বলেছেন, যারা অপরাধ করেছে আল্লাহ তাদের বিচার করেছেন। মনে হলো, তিনি মুজিব এবং জিয়া উভয়কেই বুঝাতে চেয়েছেন। উভয়কেই হত্যা করা হয়েছে। উভয়ের অপরাধও তিনি তুলে ধরেছেন। মুজিব ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য বিস্তারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে। জিয়া ক্ষমতা পাকাপোক্তা করার জন্য ৪ হাজার সেনা সদস্য হত্যা করেছে, কুরআন ছুঁয়ে তিনি যাদের সাথে মিলে দেশকে ভারতের গোলামী থেকে মুক্ত করার শপথ করেছিলেন। এই রক্ত মাড়িয়ে তিনি ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন। পরিণতিতে নিজের রক্ত দিয়ে সেই রক্তের বদলা আদায় করতে হয়েছে।
জিয়ার ব্যাপারে এই কথাটা প্রসিদ্ধ যে, ‘তিনি নিজ শাসনামলে অনেকগুলো বিদ্রোহ দমন করেছেন’। শব্দটা শুনতে ভদ্র হলেও এর সরল অর্থ: বহু বিরোধিকে তিনি হত্যা করেছেন, বহু জনকে গ্রেফতার করে জেলে ভরেছেন। তার সমর্থকরা একে তার একটা কৃতিত্ব হিসেবে দেখে, বিরোধিরা একটা নির্মমতা হিসেবে প্রচার করে।
এই সত্যটি প্রকাশিত হওয়ায় বিএনপি অনেকটা বিপাকে পড়েছে।
০৩- কেউ কেউ জিয়ার এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করছেন যে, দেশের স্বার্থে জিয়াকে তা করতে হয়েছে।
দেখুন, এখানে কয়েকটা ইতিহাস:
ক. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আলাদা বাংলাদেশ গঠন
খ. মুজিব হত্যা
গ. জিয়াউর রহমান কতৃক সেনা হত্যা
ঘ. জিয়া হত্যা
ঙ. চব্বিশে আওয়ামী হত্যা ও আওয়ামী সরকারের পতন।
চব্বিশের বিষয়টা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে উলামারাও সমর্থন করেন। একাত্তরকে উলামায়ে কেরাম সমর্থন করেননি।
জিয়া কতৃক সেনা হত্যার বিষয়টা সেভাবে আলোচিত না।
জিয়া হত্যার বিষয়টাকে উলামায়ে কেরামও হয়তো ভালো দৃষ্টিতে দেখেন না। কারণ, ক্ষমতা যেভাবেই দখল করুক, ক্ষমতায় আসার পর জিয়া তুলনামূলক কিছু ভালো করেছে দেশের ও মুসলমানদের জন্য। সেই তুলনায় মুজিব একটা ডাকাত ছিল, ছিল ভারতের দাবার গুটি। এ কারণে মুজিব হত্যাকে সত্যিকার অর্থে উলামায়ে কেরাম ভালো দেখতেন। শুধু যারা ইসলামী রাজনীতি করতো, তারা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতো। চব্বিশে আসার পর পট পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের অবস্থানও পরিবর্তন হতে চলেছে। অনেকটা যেন যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা।
এখানে আমি শুধু ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে চাই: আপনারা একটু ভাবুন:
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ইসলামের নামে হয়নি।
মুজিব হত্যাও ইসলামের নামে হয়নি।
চব্বিশে আওয়ামী পতনও ইসলামের নামে হয়নি।
এই সবগুলোই কিন্তু রক্তপাত। আপনারা সবগুলোকে জায়েয ও গৌরব জ্ঞান করছেন। এই কাজগুলো ইসলামের উদ্দেশ্যে, ইসলামের কল্যাণের নিয়তে, ইসলামের নামে ও জিহাদের নামে হলে আপনারা কি হুকুম দিতেন?
আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদের আওয়াজ তুললে আপনারা বলতেন, শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হারাম।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কি শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না?
মুজিব হত্যা কি শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না?
আওয়ামী পতন কি শাসকের বিরুদ্ধে ছিল না?
এগুলোর কোনোটিই দ্বীনের জন্য করা হয়নি; জায়েয হয়ে গেল। এই কাজটিই দ্বীন কায়েমের নিয়তে জিহাদ নাম দিয়ে করলে হারাম হয়ে যাবে! বে-ইনসাফি হয়ে গেল না? আসলে জায়েয-নাজায়েযের মানদণ্ড কি? নির্দিষ্ট কোনো শরয়ী ভিত কি আছে আপনাদের কাছে? নাকি যখন যেটা ধরলে পার পাওয়া যায় সেটাই? দয়া করে ইনসাফ করুন। একটু ভাবুন।
০৪- মুজিব হত্যা ও আওয়ামী পতন ইসলামের নামে বা উদ্দেশ্যে করা না হলেও এতে ইসলামের ও মুসলমানদের উপকার হয়েছে, বিধায় উলামায়ে কেরাম সমর্থন করেছেন।
একাত্তরের চেতনার মূর্তি
একাত্তরের চেতনা নামে এখনও একটা মূর্তি রয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলার রহমতে আমরা দুর্বলদের পরিকল্পনারও বাইরে গিয়ে ইতোমধ্যে তরুণ সমাজের সামনে কিছু চেতনার ভণ্ডামি ধরা পড়েছে। যেমন জাতির পিতা ও মুজিববাদি আদর্শের মতো চেতনাগুলো।
যুবক ভাইদের বলবো: আপনারা একাত্তরের চেতনাটা নিয়ে আরও একটু ভাবুন।
আসলে এটি কি আমাদের গৌরব? না আমাদের প্রতারিত হওয়ার ইতিহাস?
মুক্তির ইতিহাস, ভারতের গোলামিতে আবদ্ধ হওয়ার নির্মম সত্য?
এটি কি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে, নাকি গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করেছে?
একজন মুসলিম হিসেবে এটি কি আমাকে শক্তি দিয়েছে, নাকি দুর্বল করেছে?
যে বিদ্রোহটি উলামাদের পরামর্শে হয়নি, আল্লাহর দ্বীনের জন্য হয়নি এবং যেটি আমাকে শুধু বিভক্ত ও দুর্বল করেছে: এটি আমার আদর্শ? নাকি আমি কোনো জাহিলি চেতনায় আক্রান্ত? কেন করলাম আমি এটি? কেন আমি এটি নিয়ে এখনও গর্ব করছি? কেন আমি এটিকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে সমাজের একটা শ্রেণীকে হেয় করছি, তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখছি? এর বিনিময়ে আমি আল্লাহর কাছে কি আশা করতে পারি?
প্রিয় তরুণ ভাই, একটু ভাবুন। বিবেককে প্রশ্ন করুন। বিবেকের তাড়নাকে এড়িয়ে যাবেন না। সত্য আজ না হোক কাল প্রকাশিত হবেই। আমি আমার বিবেকের আদালতে যেন অপরাধী থেকে না যাই। কোনো জাহিলি চেতনার কলুষতা নিয়ে যেন আমি রবের দরবারে হাজির না হই। কারও চাপে, কারও ভয়ে বা কোনো স্রোতে গা ভাসিয়ে যেন আমি দ্বীনবিরোধী জাহিলি চেতনাধারীদের কাতারে শামিল না হই।
***
Comment