আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“ফিতনার যুগে
মুজাহিদদের প্রতি নসিহত” ।।
ড. শায়খ সামী আল-উরাইদী হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ১১তম পর্ব
“ফিতনার যুগে
মুজাহিদদের প্রতি নসিহত” ।।
ড. শায়খ সামী আল-উরাইদী হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ১১তম পর্ব
ফিতনার জমানায় জবানের অবস্থান
বান্দাকে সব সময় জবান হিফাজত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ই ফিতনার জমানায় আরো গুরুত্বের সাথে নির্দেশিত। কারণ ফিতনার জমানায় কথার অনেক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যার বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়। সুতরাং বিচক্ষণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি ফিতনা ও এ-জাতীয় অন্যান্য সমস্যায় জবানকে হেফাজত করবে, ভালো ছাড়া কোনো কথা বলবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖوَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ﴿١٦﴾إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ﴿١٧﴾مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ﴿١٨﴾
‘আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ -সূরা ক্বাফ 50: ১৬-১৮
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فلا يُؤْذِ جارَهُ، ومَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، ومَن كانَ يُؤْمِنُ باللَّهِ واليَومِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أوْ لِيَصْمُتْ
‘যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের ইকরাম করে। যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ –(বুখারী-6018,মুসলিম-47)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ صَمَتَ نَجَا
‘যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।’(তিরমিযি-২৫০১)
‘যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।’(তিরমিযি-২৫০১)
ইবনে আব্দুল বার রহ. বলেন, ‘হুযাইফা ইবনে ইয়ামান রা. বলেছেন,
إنَّ الفِتْنةَ تُلقَحُ بالنَّجْوى، وتُنتَجُ بالشَّكْوى
‘নিশ্চয়ই ফিতনা গোপন পরামর্শ দ্বারা ফলপ্রসূ হয়, আর তা অভিযোগ থেকে তৈরি হয়।’ (হিলয়াতুল আওলিয়া-৬/১০৭)
হুযাইফা রা. এর এ-কথাটি নাসর ইবনে সাইয়ার গ্রহণ করেছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধের শুরু হলো কথাবার্তা ( যা একটি কবিতার অংশ)। এখানে (সেই কবিতার) কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করা হলো, যা তিনি মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের কাছে লিখে পাঠান:
أرى خلل الرّماد وميض نار ... ويوشك أن يكون لها ضرام
‘ছাইয়ের মাঝে নিভু নিভু কয়লা কখনো কখনো অগ্নিকুণ্ড হয়ে দেখা দেয়;
فإن النّار بالعودين تذكى ... وإنّ الحرب أوّلها الكلام
কারণ আগুন এমন জিনিস যা প্রজ্বলিত হওয়ার জন্য দুটি কাঠিই যথেষ্ট। আর যুদ্ধের শুরুটা হয়ে থাকে সামান্য কথাবার্তার মাধ্যমে।
فقلت من التّعجب ليت شعري ... أأيقاظٌ أميّة أم نيام
সুতরাং আমি অবাক হয়ে ভাবছি, আমার এ কবিতাটি কি জাগরণকারী নাকি ঘুমপাড়ানি।’- (বাহজাতুল মাজালিস: ১০২)
হযরত উমর রা. বলেন,
"إِنَّ لِله عِبَادًا يُمِيتُونَ الْبَاطِلَ بِهَجْرِهِ، وَيُحْيُونَ الحقّ بِذِكْرِهِ"
‘আল্লাহর কিছু বান্দা আছে যারা বাতিলকে ধ্বংস করে চুপ থাকার মাধ্যমে, হককে জিন্দা করে আলোচনার মাধ্যমে।’(হিলয়াতুল আওলিয়া-১/৫৫)
সবর, অবিচলতা, আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ
ফিতনার জমানায় বান্দার জন্য সবর, অবিচলতা ও আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা উচিত। চেষ্টা হলো সবচেয়ে বড় বিষয়। যে এগুলোকে আঁকড়ে ধরতে পারল না, তার পক্ষে ফিতনার মুকাবিলা করা সম্ভব নয়। অনেকেই এমন আছে যারা ফিতনায় ডুবে গেছে- নাউযুবিল্লাহ। এসব কিছু হয়েছে সবর না থাকার কারণে, আল্লাহর ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করার কারণে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اسْتَعِينُواْ بِالصَّبْرِ وَالصَّلاَةِ إِنَّ اللّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ
হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিয়ই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন। (সূরা বাকারা ২:১৫৩)
আল্লাহ তা’আলার বাণী,
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗوَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ﴿١٥٥﴾الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّـهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ﴿١٥٦﴾أُولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖوَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ﴿١٥٧﴾
‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয় তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।’ -সূরা বাকারা 2: ১৫৫-১৫৭
আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:
فَإِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا﴿٥﴾إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا﴿٦﴾
‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি। নিশ্চয় কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ -সূরা ইনশিরাহ 94׃ 5-6
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
وأنَّ النصرَ مع الصبرِ ، وأنَّ الفرجَ مع الكربِ ، وأنَّ مع العسرِ يُسرًا
‘নিশ্চয় সবরের সাথে রয়েছে সাহায্য। বিপদের সাথে রয়েছে আরাম। কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ -সিলসিলাতুস্ সহিহাহ: ২৩৮২
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إن من ورائكم أيام الصبر، للمتمسك فيهن يومئذ بما أنتم عليه أجر خمسين منكم، قالوا: يا نبي الله أو منهم، قال: بل منكم
رواهالطبراني، وصححهالألبانيفي السلسلة الصحيحة
‘তোমাদের পরে রয়েছে সবরের দিন। সে দিনগুলোতে যে ব্যক্তি তোমরা যে দ্বীনের উপর রয়েছ, তা আঁকড়ে ধরতে পারবে তার জন্য রয়েছে তোমাদের পঞ্চাশ জনের সাওয়াব।’ লোকেরা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের নাকি তাদের পঞ্চাশ জনের? তিনি বললেন, ‘বরং তোমাদের পঞ্চাশ জনের।’ - সিলসিলাতুস্ সহিহাহ: ৪৯৪
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ إِنَّ السَّعِيدَ لَمَنْ جُنِّبَ الْفِتَنَ وَلَمَنِ ابْتُلِيَ فَصَبَرَ فَوَاهًا
‘সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকল। আর যে ব্যক্তি ফিতনায় পড়ে ধৈর্য ধারণ করবে, তাঁর জন্য কতই না মঙ্গল! (-আবু দাউদ: ৪২৬৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي، فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي، وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرْتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا، وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَىَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا، وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
‘আমার ব্যাপারে বান্দার যেমন ধারণা -আমি তার কাছাকাছি থাকি। যখন আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথে থাকি। যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। যদি আমাকে কোনো লোকসমাজে স্মরণ করে, আমি তাকে এমন ব্যক্তিদের সামনে স্মরণ করি, যারা তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যদি আমার দিকে এক বিঘাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। যদি আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত প্রসারিত পরিমাণ অগ্রসর হই। যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে দৌড়ে আসি।’ –(বুখারী-7405,মুসলিম-6698)
তিরমিযী রহ. থেকে বর্ণিত, শাহর ইবনে হাওশাব র. বলেন,
قُلْتُ لأُمِّ سَلَمَةَ يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ مَا كَانَ أَكْثَرُ دُعَاءِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا كَانَ عِنْدَكِ قَالَتْ كَانَ أَكْثَرُ دُعَائِهِ " يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ " . قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا لأَكْثَرِ دُعَائِكَ يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ قَالَ " يَا أُمَّ سَلَمَةَ إِنَّهُ لَيْسَ آدَمِيٌّ إِلاَّ وَقَلْبُهُ بَيْنَ أُصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللَّهِ فَمَنْ شَاءَ أَقَامَ وَمَنْ شَاءَ أَزَاغَ
আমি উম্মে সালমা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আপনার কাছে থাকতেন তখন তিনি কোন দুআটি বেশি পাঠ করতেন? তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুআটি বেশি বেশি পড়তেন, (يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ)‘হে কলবের পরিবর্তনকারী! আমার কলবকে আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন।’ উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি (يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ)‘হে কলবের পরিবর্তনকারী! আমার কলবকে আপনার দ্বীনের উপর অবিচল রাখুন।’ এ দুআটি কেন বেশি বেশি পাঠ করেন? তিনি বললেন, ‘হে উম্মে সালামা! প্রত্যেক মানুষের কলব আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে রক্ষিত। অতএব, যাকে চান স্থির রাখেন, যাকে চান বিপথগামী করেন।’ –(তিরমিযী: ৩৫২২)
সুতরাং ফিতনার জমানায় সবর করা ও আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখা আবশ্যক। তাহলে ফিতনা দূর হয়ে যাবে, সর্বদা স্থির থাকবে না। সৌভাগ্যবান সে ব্যক্তি যে এমন কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করে, মুক্তির পথ অবলম্বন করে এবং তার সর্বস্ব আল্লাহর সামনে বিলিয়ে দেয়।
Comment