কওমী উলামা-ত্বলাবাদের প্রতি ।। ভেবে দেখার আহবান!
কওমী মাদরাসাসমূহের সূতিকাগার দারুল উলূম দেওবন্দ মাদরাসা
একজন মুমিনের প্রথম কাজ ও প্রথম ফরজ হল ঈমান হিফাজত করা ও আমলের বিচ্যুতি থেকে বেঁচে থাকা। দুনিয়ার সব কিছু বিলীন হয়ে গেলেও; দ্বীনকে অক্ষুন্ন রাখা। সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে আমাদের অনুসরণীয় সকল সালাফ-খালাফগণ এ নীতির উপরই দুনিয়ার জীবন পরিসমাপ্ত করে পরপারের বাসিন্দা হয়েছেন। তাদের দুনিয়ায় চলার নীতি ছিল মুসলিমরা বা মুসলিমদের কোন প্রতিষ্ঠান- প্রতিষ্ঠান বা মুসলিম বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং মুসলিমরা ও মুসলিমদের সব কিছুই আল্লাহর দ্বীন টিকিয়ে রাখার জন্য। এই আদর্শ থেকে সরে আসার কারণে আমরা আজ অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত। কেননা, সাহাবায়ে কিরাম রা. যেখানে সর্বদা রক্তের বিনিময়ে দ্বীন টিকিয়ে রেখেছেন সেখানে আজ আমরা প্রতিষ্ঠান বা সামান্য চাকুরীর বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে দিচ্ছি এবং এটাকেই যথার্থ মনে করে বসে আছি!!!
তাদের উত্তরসূরী হিসেবে আমাদের নীতি হওয়ার কথা ছিল, আমাদের সব কিছু বিলীন হয়ে গেলেও; লক্ষ-কোটি মাদরাসা-মসজিদে বন্ধ হয়ে গেলেও দ্বীনের সামান্যতম ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না।
দ্বীনের মূল ভিত্তি জিহাদ। দ্বীনের হুকুম-আহকাম শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকার মূল ভিত্তি খিলাফাহ। দ্বীন শিখা ও প্রচার-প্রসারের মূল উৎস মাদরাসা। দ্বীনের জন্য তিনোটার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে প্রথম দুটিই দ্বীনের মূল। যা ব্যতীত দ্বীন না থাকার নামান্তর।
মাদরাসা-মসজিদ যেহেতু দ্বীন টিকে থাকার ভিত্তি নয়;তাই শুধু মাদরাসা-মসজিদে পড়ে থাকতে হবে এই ধরনের চিন্তা চেতনা গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা বৈ কিছুই নয়।
এই দিক দিয়ে আমাদের গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতা এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এখন আমরা মাদরাসা-মসজিদে খেদমত করাকেই দ্বীনের মূল ভিত্তি মনে করি। যারা এ খেদমতের বাহিরে গিয়ে ভিন্ন শাখায় এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দেয়, তাদেরকে হিদায়াতের পথ ছেড়ে হালাকের পথ গ্রহণ করে নিয়েছে বলে তিরস্কার করে থাকি। এটা কখনোই আমাদের সালাফদের মানহাজ নয়। বরং আমাদের সালাফদের মানহাজ ছিল ঈমান-আমল বাঁচাতে যখন যা করা প্রয়োজন, তখন তা করাই আবশ্যক। চাই সেটা মাদরাসা-মসজিদের খেদমত হোক বা ব্যবসা বা অন্য কোন পেশা হোক।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অদ্যাবধিকাল পর্যন্ত এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় শিক্ষাস্বরূপ গেঁথে রয়েছে।
অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, আমরা এখন ভুলেই গেছি যে, মাদরাসা-মসজিদের খেদমত ইসলামের খেদমতের একটি শাখা মাত্র; এটি ছাড়াও খিদমতের অসংখ্য শাখা রয়েছে। অন্য দিকে আমাদের অধিকাংশের চিন্তা-চেতনার অবস্থা হচ্ছে, জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যমও এখন শুধু মাদরাসা মসজিদের খেদমত। ফলে আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে হাজার হারাম, অনৈতিক ও অনুচিত কাজ করে যাচ্ছি বা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। আর এই বিষয়গুলোকে আমরা স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিক মনে করছি! এমনকি অনেকে তো স্বল্প মূল্যে দ্বীনকেও বিক্রি করে দিচ্ছি। এগুলো আমাদের এজন্য করতে হচ্ছে যে, এভাবে তাল মিলিয়ে না চললে, সভাপতি ও বড় হুজুরের পুজা না করলে পরেরদিন আমার জন্য ঐ মাদরাসা-মসজিদে থাকা সম্ভব হবে না। পরে আমাদের পরিবার-পরিজন না খেয়ে মরতে হবে। আর আপনি মানেন আর নাই মানেন আজ অধিকাংশ মাদরাসা ও মসজিদের অবস্থা এর ব্যতিক্রম নয়। আরও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমরা এ ধরনের নাজুক থেকে নাজুক অবস্থা স্বাভাবিক হিসেবে মেনেই এ মহলে আমাদের দিনকাল অতিবাহিত করছি। যাদের চিন্তা-চেতনা এর বিপরীত তাদেরকে যেভাবেই হোক এ মহল থেকে অপসারণ করার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছি। ফলে তাদের এ মহলে টিকে থাকা সম্ভব হয় না।
হে উলামায়ে কিরাম! একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন, আমরা যদি শুধু মাদরাসা মসজিদেকে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে না নিতাম, তাহলে কখনোই আমাদেরকে এ অবস্থার স্বীকার হতে হতো না। আমাদের বর্তমান অবস্থা তো এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, আমাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে হারাম, অনৈতিক ও অনুচিত কাজ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও করতে হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তো নিজের অজান্তেই স্বল্প মূল্যে দ্বীনকেও বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। এ ধরনের ঈমান-আমল বিধ্বংসী অবস্থার ব্যাপারে এখন যদি আমরা না ভাবি। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার সঠিক পথ ও পন্থা অবলম্বন না করি, তাহলে অচিরেই অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে যে, শত চেষ্টা করেও যা থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব হবে না।
এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে আমাদের করণীয়-
১. আমাদেরকে এই চিন্তা-চেতনা ও আকিদা বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, একজন মুমিনের প্রথম কাজ ও প্রথম ফরজ হল, ঈমান হিফাজত করে আমলের বিচ্যুতি থেকে বেঁচে থাকা। দুনিয়ার সব কিছু বিলীন হয়ে গেলেও; দ্বীনকে অক্ষুন্ন রাখা।
কোন কারণে যদি ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সে কারণ নির্ণয় করে তা নির্মূল করার চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে তা থেকে নিরাপদ দূরে সরে যাওয়া। মাদরাসা-মসজিদ বা অন্য কোনো পরিবেশে যদি এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়, যেখানে অবস্থান করলে ঈমান-আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে যথাসম্ভব তা সংশোধনের চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করত: অন্যত্র নিরাপদ পরিবেশে অবস্থান করা।
২. আমাদেরকে এই চিন্তা চেতনা ও আকিদা-বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল করে নিতে হবে যে, মুসলিমরা বা মুসলিমদের কোন প্রতিষ্ঠান- প্রতিষ্ঠান বা মুসলিম বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং মুসলিমরা ও মুসলিমদের সব কিছুই আল্লাহর দ্বীন টিকিয়ে রাখার জন্য।
আমাদের সব কিছু বিলীন হয়ে গেলেও; লক্ষ কোটি মাদরাসা-মসজিদে বন্ধ হয়ে গেলেও দ্বীনের সামান্যতম ক্ষতি হতে দেয়া যাবে না।
৩. ঈমান-আমল পরিশুদ্ধ রাখতে যখন যা করা প্রয়োজন, তখন তা করাই আবশ্যক মনে করা। চাই সেটা মাদরাসা মসজিদের খেদমত হোক বা ব্যবসা, শ্রমিকের কাজ বা রিকশা চালানো বা অন্য যেকোন হালাল পেশা হোক।
৪. মাদরাসা মসজিদকে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম বানানো থেকে বিরত থাকা। তাহলে মাদরাসা মসজিদে খেদমতের নামে সভাপতি-বড় হুজুরের পুজা করা তো দূরের কথা এ ধরনের অবস্থাই সৃষ্টি হবে না। তারপরও মাদরাসা মসজিদে খেদমতের ক্ষেত্রে হারাম, অনৈতিক, অনুচিত কাজ এবং খালিকের আনুগত্যের বিপরীতে মাখলুকের আনুগত্য করা আশংকা সৃষ্টি হলে এ ধরনের খিদমতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্য যেকোন হালাল পেশাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া। কেননা, একজন মুমিনের প্রথম কাজ ও প্রথম ফরজ হল- ঈমান হিফাজত করে আমলের বিচ্যুতি থেকে বেঁচে থাকা। দুনিয়ার সব কিছু বিলীন হয়ে গেলেও; দ্বীনকে অক্ষুন্ন রাখা।
কোন কারণে যদি ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সে কারণ নির্ণয় করে তা নির্মূল করার চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে তা থেকে নিরাপদ দূরে সরে যাওয়া। মাদরাসা মসজিদ বা অন্য কোনো পরিবেশে যদি এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যেখানে অবস্থান করলে ঈমান-আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে যথাসম্ভব তা সংশোধনের চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে ঈমান ও আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করত: অন্যত্র নিরাপদ পরিবেশে অবস্থান করা।
৫. বর্তমান সময়ে মাদরাসা মসজিদে বাহিরে যেমন ঈমান-আমল পরিশুদ্ধ রাখা কষ্টকর; আপনি মানেন আর নাই মানেন মাদরাসা মসজিদের ভিতরেও ঈমান-আমল পরিশুদ্ধ রেখে জীবন-যাপন করা আরও শতগুণ বেশি কষ্টকর। কেননা, বাহিরে ঈমান-আমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কাজগুলোকে খারাপ ও মন্দই বলাই হয়। ফলে একজন আলিমের জন্য তা থেকে দূরে থাকা তেমন কঠিন হয় না। কিন্তু মাদরাসার ভিতরে অসংখ্য হারাম, অনৈতিক ও অনুচিত কাজ থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে তা করা অপরিহার্য মনে করা হয়। ফলে তা থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিরত থাকা সম্ভব হয় না।
এ ধরনের নাজুক অবস্থায় থেকে নিরাপদ থাকতে একজন তাওহিদপন্থি যোগ্য আলিমের জন্য আমি মনে করি অন্যের নেতৃত্বেশীল মাদরাসা মসজিদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা থেকে বিরত থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা মসজিদে যতটুকু সম্ভব খেদমত করা। এটা স্বল্প পরিসরে হতে পারে আবার ব্যাপক পরিসরেও হতে পারে। অর্থাৎ প্রথমে স্বল্প পরিসরে ৮-১০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু করা যেতে পারে। তবে প্রচলিত কালেকশন থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। জীবিকা নির্বাহ ও ৮-১০ ছাত্রের প্রয়োজন পুরা করার জন্য ব্যবসা কৃষিকাজ বা অন্য কোন হালাল পেশা গ্রহণ করে সব প্রয়োজন পুরা করা। ছাত্ররা নিজেদের প্রয়োজন পুরা করার সামর্থ্য না রাখলে এবং নিজের জন্যও ছাত্রদের প্রয়োজন পুরা করার সম্ভব না হলে ছাত্রদের পড়া লেখার মাঝে মাঝে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম তৈরি করে দেয়া। যাতে করে ছাত্ররা সপ্তাহে দু'একদিন কাজ করে হলেও মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করা থেকে বিরত থেকে নিজেদের প্রয়োজন নিজেরা পুরা করতে পারে। নিজেদের প্রয়োজন নিজেরা পুরা করার যতটুকু সামর্থ্য অর্জন হবে ততটুকু পরিসরে সামনে এগিয়ে যাওয়া। মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষার টাকা দিয়ে বিশাল দালান-কোঠা গড়ার অবৈধ লাঞ্ছনাকর স্বপ্ন না দেখা।
আমাদেরকে স্বরণ রাখতে হবে, কারো কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে দালান-কোঠায় ঘুমানো ও কুরমা পোলাও খাওয়ার চেয়ে খালি আকাশের নিচে ঘুমানো ও কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত কসলিয়ে খাওয়াই উত্তম ও সম্মানজনক। তবে বিশেষ প্রয়োজন নেককার, সালিহীন ও আল্লাহভীরু লোকদের কাছে চাওয়া যেতে পারে**। কিন্তু কোনক্রমেই ফাসিক, ফুজ্জার, বে-নামাজি ও বে-পর্দাশীল লোকদের কাছে চাওয়া যাবে না।
নিজের উপার্জিত অর্থের মাধ্যমে এলাকায় অসহায় মানুষের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো পুরা করা। এর দ্বারা সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনায়ও পরিবর্তন আসবে যে, হুজুররা শুধু মানুষেরটা খায় না, বরং মানুষকে খাওয়াও**। হুজুররা শুধু মানুষের বাড়িতে খায় না, বরং মানুষকে নিজের বাড়িতেও খাওয়ায়।
আমাদেরকে স্বরণ রাখতে হবে, বর্তমান এ লাঞ্ছনাকর অবস্থার পরিবর্তন আসমান থেকে ফিরেশতা এসে করি দিবে না। কেননা, আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।
এরশাদ হয়েছে,
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِم
অনুবাদঃ আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।
(সূরাঃ রা'দ, আয়াতঃ ১১)
তাই, আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার চিন্তা-চেতনা অন্তরে বদ্ধমূল করে সঠিক পথ পন্থা গ্রহণ করে এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে এখন থেকে যদি আমরা না ভাবি, সঠিক পথ পন্থা অবলম্বন করে এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে না আসি, তাহলে অচিরেই অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে শত চেষ্টা করেও যা থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব হবে না।
Collected
Comment