একজন আলেমের অপদস্থতাকারীদেরকে আল্লাহ তাআলা এত সহজে ছেড়ে দিবেন—এতটা আশা করবার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি দয়াপরবশ; তবে একজন আলেমের অপদস্থতাকে ক্ষমা করে দিবেন—এতটাও সহজ নয়। এক্ষেত্রে বরং আল্লাহ তাআলার মুআমালা সম্পূর্ণ ভিন্ন; রূঢ় ও কঠোর। কারণ, একজন আলেমের সাথে শত্রুতা, বিরোধিতা ও বিদ্বেষের আচরণ করার অর্থ হলো সরাসরি আল্লাহ তাআলার সাথে শত্রুতা করা। আল্লাহ তাআলা এই ধরনের আচরণ সহ্য করেন না। বরং এই ধৃষ্টদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। খোদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ থেকেই আল্লাহ তাআলার এই ঘোষণার কথা শুনুন।
হযরত আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে আমার কোনো ‘ওলি’র সাথে শত্রুতা প্রদর্শন করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম।”[১]
হাদিসে ব্যবহৃত শব্দটি হলো—‘ওলি’। যার বাংলা প্রতিশব্দ—বন্ধু। এই হাদিসে উল্লিখিত বন্ধু কে? কাকে আল্লাহ তাআলা এতটা মুহাব্বত করেন, যার বিরোধিতা করলে স্বয়ং তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন? সহিহ বুখারির বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি লেখেন—“উক্ত হাদিসে আল্লাহর বন্ধু শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ওই আলেম, যিনি আল্লাহর পরিচয়ের ইলম রাখেন, সবসময় তাঁর আনুগত্য করেন এবং সর্বোপরি ইখলাসের সাথে তাঁর ইবাদত করেন।”[২] অর্থাৎ—এই হাদিসে আল্লাহর ‘ওলি’ বা বন্ধু দ্বারা আমলবান আলেম উদ্দেশ্য।
এই হাদিসে শত্রুতা প্রদর্শন বলে ব্যাপক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। শত্রুতার ধরন কেমন হবে? এর একটি উদাহরণ একই হাদিসের ভিন্ন শব্দ ব্যবহারে পাওয়া যায়। মুসনাদে আহমাদের হাদিসে নবীজির শব্দ হলো—“যে আমার কোনো বন্ধুকে অপদস্থ করবে, সে নিজের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধকে বৈধ করে নিবে।”[৩]
আল্লাহ যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, এর প্রকৃতি কী? কেমন হবে এই যুদ্ধ?
বিবরণ পড়ুন ইবনে হাজারের কলমে। তিনি লেখেন—“যুদ্ধের পরিণাম হলো ধ্বংস। আর, আল্লাহ তাআলার সাথে যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হতে পারবে না। অর্থাৎ, অর্থটা যেন এমন—সে আলেমের সাথে শত্রুতা করে তাকে ধ্বংস করা আমার জন্য অনিবার্য করে দিল। আল্লাহ তাআলা উক্ত হাদিসে যুদ্ধ শব্দ দ্বারা এর অনিবার্য পরিণতির কথাই বুঝিয়েছেন। যুদ্ধে যেমন শত্রুকে ধ্বংস করা হয়, আল্লাহও তাকে ধ্বংস করে দিবেন।”[৪]
এই ধ্বংস কখন হয়? কীভাবে হয়?
কখনো এই ধ্বংস হয় তাৎক্ষণিক। কখনো হয় বিলম্বে। কারও হয় ধ্বংস নেমে আসে জান-মাল ও সন্তান-সন্ততিতে; কেউবা হারায় ঈমান। আযাব বিলম্বিত হলে ধৃষ্ট লোকেরা তখন অট্টহাস্যে মত্ত হয়ে বিদ্রূপ করে বলে—‘কই, হুজুরদের আল্লাহ কিছু করল না?’ হাফেজ ইবনে হাজার লেখেন—“কোনো আলেমকে কষ্টপ্রদানকারী জান-মাল ও সন্তান-সন্ততিতে তড়িৎ বিপদ আসেনি বলে এতটা নিশ্চিত যেন না হয় যে, আল্লাহর প্রতিশোধ থেকে সে বেঁচে গেছে। কারণ, এদের বিপদ আসে অন্য দিক দিয়ে; আরও কঠিনতর বিপদ। দেখা যায়—তার ঈমান নিয়েই বিপদে পড়ে যেতে হয়।”[৫]
একজন নির্ভরযোগ্য আলেমকে নিয়ে যখন উদ্দেশ্যমূলক কুৎসা রটনা ও দোষারোপ করা হয়, সালাফরা একে ঈমানের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর ছাত্র বিশিষ্ট তাবেয়ি হযরত ইকরিমা রহ.। হিজরি প্রথম শতকের একজন বিখ্যাত আলেম। হিজরি দ্বিতীয় শতকের আরেকজন বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস হলেন হাম্মাদ ইবনে সালামা রহ.। তাঁদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন বলেন, “যদি তুমি কাউকে ইকরিমা ও হাম্মাদ ইবনে সালামার কুৎসা করতে দেখো, তাহলে সেই ব্যক্তির ইসলাম নিয়ে সন্দিহান হও।”[৬]
আলেমদেরকে আল্লাহ তাআলা নানাভাবে দুনিয়ায় পরীক্ষায় ফেলেন। এমনই একটি পরীক্ষা হলো—বিদ্বেষী ও মুলহিদরা তাদেরকে নিয়ে নানা ধরনের কথা বলবে; কুৎসা রটাবে, কলুষিত করার অপচেষ্টা করবে। তবে সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহর রীতি হলো—এর মাধ্যমে তিনি সেই আলেমকে আরও সম্মানিত করেন; মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। এজন্য ইমাম শাফেঈর জীবনী লিখতে গিয়ে হাফেজ যাহাবি লেখেন—“হিংসুক ও মূর্খরা তাঁর সম্পর্কে যা-কিছু বলেছে, সেসব বাতিল কথাবার্তা ইমাম শাফেঈর সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে। বান্দাদের ক্ষেত্রে এটাই সুন্নাতুল্লাহ বা আল্লাহর রীতি।”[৭]
এসব নানামাত্রিক পরিস্থিতি আমাদের চারপাশের মানুষদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে। সত্য থেকে মিথ্যা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ঘটনায় ফাসেকদের কথায় উল্লম্ফনকারী ও আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণাপ্রাপ্তদের জন্য এই আয়াত—“আমি লিখে রাখব তারা যে-আমল প্রেরণ করেছে তা এবং তাদের রেখে যাওয়া কীর্তিসমূহ।”[সুরা ইয়াসিন ৩৬ : ১২]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
টীকা
[১] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৫০২
[২] ফাতহুল বারি ১১/৩৪২, ইবনে হাজার আসকালানি, দারুল মা’রিফাহ, বৈরুত
[৩] মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২৬১৯৩
[৪] ফাতহুল বারি ১১/৩৪৩, ইবনে হাজার আসকালানি, দারুল মা’রিফাহ, বৈরুত
[৫] ফাতহুল বারি ১১/৩৪৬, ইবনে হাজার আসকালানি, দারুল মা’রিফাহ, বৈরুত
[৬] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৫/৩১, যাহাবি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ
[৭] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১০/৪৮, যাহাবি, মুয়াসসাতুর রিসালাহ
Collected
Comment