আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ১৩তম পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ১৩তম পর্ব
﴿ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴾
ইমাম ওয়াহিদী রহ. বলেন-
﴿وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ﴾ على طاعة الله والجهاد في سبيله
‘তারা আল্লাহর আনুগত্য এবং জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’র উপর অবিচল থাকার জোর দেয়।’
ইমাম রাযী রহ. বলেন-
والتواصي بالصبر يدخل فيه حمل النفس على مشقة التكليف في القيام بما يجب، وفي اجتنابهم ما يحرم إذ الإقدام على المكروه، والإحجام عن المراد كلاهما شاق شديد
‘আবশ্যক বিষয়াবলি আদায় করার মধ্যে যা কষ্টকর, তা সহ্য করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাও وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ এর অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে হারাম বিষয়াবলি থেকে বেঁচে থাকাও। কারণ, যে কাজ করতে মন চায় না, তা করা এবং যা মন চায়, তা বর্জন করা- উভয়টাই কঠিন ব্যাপার।’
ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ এর গর্জনের মাধ্যমে সমাজে এক আওয়াজ তোলা কোনো নতুন কথা নয়। সত্যের স্লোগানে স্লোগানে হৃদয়গুলোকে উষ্ণ করে, যুবসমাজের বুকে চেতনার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। সেই জাগরণে শামিল একটি বড় অংশকে সংঘবদ্ধ করাও সাধারণ ব্যাপার মাত্র! وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ এর আহ্বানে অলি-গলি, হাট-বাজার ও সাধারণ-বিশেষের সব মিলনমেলাই মুখরিত হয়।
এসব কিছু হয় প্রাথমিক স্তরে; তবে পরীক্ষার স্তর এরপরেই শুরু হয়, যখন বিরোধী জীবনব্যবস্থা গতিশীল হয়। স্বীয় রাজত্ব-কর্তৃত্ব, সর্দারি-নেতৃত্ব, স্বীয় মতবাদ ও বিশ্বাস এবং স্বীয় হস্তে খোদিত প্রবৃত্তির বানানো প্রভুদের রক্ষা করতে বিরোধী শিবির তখন শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করে।
ক্ষমতার নেশায় বুঁদ ও শক্তির হটকারিতায় ডুবে থাকা অভিজাতশ্রেণীর কাছে যখন দলিল ফুরিয়ে যায়, তখন তাদের বারান্দা থেকে এ আওয়াজ আসতে শুরু করে-
قَالُوا حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِن كُنتُمْ فَاعِلِينَ ﴿الأنبياء: ٦٨﴾
“তারা বললঃ একে(ইবরাহীম আ.) পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও।” (সূরা আম্বিয়া: ৬৮)
فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَن قَالُوا أَخْرِجُوا آلَ لُوطٍ مِّن قَرْيَتِكُمْ إِنَّهُمْ أُنَاسٌ يَتَطَهَّرُونَ ﴿النمل: ٥٦﴾
“উত্তরে তাঁর কওম শুধু এ কথাটিই বললো, লূত পরিবারকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা শুধু পাকপবিত্র সাজতে চায়।”(সূরা নামল: ৫৬)
এবার শুরু হয় আসল পরীক্ষা। খড়কুটো বেছে নেওয়ার পালা। পার্থক্য হয়ে যায় সত্য-মিথ্যা। দ্বীনের পথে বিপদ ও পরীক্ষাসমূহের ব্যাপারে এ ধারণা রাখা ঠিক নয় যে, প্রত্যেক যুগে এটি রুখসত-আজিমত তথা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবেই ছিল- যে তা পালন করবে, বড় সওয়াবের মালিক হবে। আর যে তা করবে না, তার ঈমানের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং কখনো-কখনো এ বিপদ ও পরীক্ষাসমূহ দ্বীনের আবশ্যিক বিষয়ও হতে পারে। এটি যুগ-যুগান্তরে চলে আসা আল্লাহর এক অমোঘ বিধান।
الم أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ ﴿العنكبوت: ٢﴾
“আলিফ-লাম-মীম। মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?” (সূরা আনকাবুত: ১-২)
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ ﴿العنكبوت: ٣﴾
“আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।” (সূরা আনকাবুত: ৩)
وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ ﴿العنكبوت: ١١﴾
“আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং নিশ্চয় জেনে নেবেন যারা মুনাফেক।” (সূরা আনকাবুত: ১১)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿آلعمران: ١٤٢﴾
“তোমাদের কি ধারণা, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও দেখেননি তোমাদের মধ্যে কারা জেহাদ করেছে এবং কারা ধৈর্য্যশীল।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৪২)
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّىٰ يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَىٰ نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ ﴿البقرة: ٢١٤﴾
“তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের উপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনি ভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্যে! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহর সাহায্যে একান্তই নিকটবর্তী।” (সূরা বাকারাহ: ২১৪)
সুতরাং সত্যের আহ্বায়কদের জন্য এটি আল্লাহর এক অমোঘ বিধান। তাঁদেরকেই পরীক্ষার ফাঁদে পা ফেলতে হয়। শত্রুর জেলখানা ও ফাঁসির মঞ্চ তাঁদের প্রাথমিক দীক্ষালয়। বিপদাপদের ঘূর্ণিঝড় তাদের অভিজ্ঞতার বিস্তীর্ণ মাঠ। সেসব বিপদাপদে দুঃখের সান্তনা হিসেবে নেমে আসে নতুন বিপদাপদ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
فَأَثَابَكُمْ غَمًّا بِغَمٍّ … ﴿آلعمران: ١٥٣﴾
“অতঃপরতোমাদেরউপরএলোশোকেরওপরেশোক”(সূরাআলে-ইমরান: ১৫৩)
যাতে এক দুঃখের সান্তনাস্বরূপ আরেক নতুন দুঃখ পেয়ে বসে। এ পথটিই এমন। যেখানে জখমের চিকিৎসা নতুন এক জখমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যাতে জখম সইতে সইতে অন্তর অবিচল হয়ে যায়।
فَأَثَابَكُمْ غَمًّا بِغَمٍّ لِّكَيْلَا تَحْزَنُوا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا مَا أَصَابَكُمْ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ﴿آلعمران: ١٥٣﴾
“অতঃপর তোমাদের উপর এলো শোকের ওপরে শোক, যাতে তোমরা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া বস্তুর জন্য দুঃখ না কর এবং যার সম্মুখীণ হচ্ছ সেজন্য বিমর্ষ না হও। আর আল্লাহ তোমাদের কাজের ব্যাপারে অবহিত রয়েছেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৩)
কারণ, পরীক্ষার নিয়মে এটিই চলমান। এভাবেই চলতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ ﴿محمد: ٣١﴾
“আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জেহাদকারীদেরকে এবং সবরকারীদেরকে এবং যতক্ষণ না আমি তোমাদের অবস্থান সমূহ যাচাই করি।” (সূরা মুহাম্মাদ: ৩১)
এ আয়াত প্রত্যেক মুসলমান এবং বিশেষত প্রত্যেক মুজাহিদের জন্য শিউরে ওঠার মতো। সর্বজ্ঞানী পরওয়ারদেগার গুরুত্বসহ ঘোষণা করছেন, মুজাহিদ ও গাইরে মুজাহিদ পার্থক্য করার জন্য এবং আল্লাহর পথে অবিচল মুজাহিদ ও তা থেকে পলায়নকারীকে প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষায় নিপতিত করব। তোমাদের উপর এমন অবস্থার সৃষ্টি করব, যাতে স্পষ্ট হয়ে যায়, তাওহীদকে স্বীকার করে নেওয়ার পর কে তা পুরোপুরি আদায় করতে পারে? জিহাদে আসার পর কে তাতে অবিচল থাকতে পারে? এমনকি নিজের প্রাণও সেই কালিমার জন্য কুরবান করে দিয়ে সফলদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াপরবশ। তাই তো সূরা মুহাম্মাদেই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন-
وَالَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ ﴿محمد: ٤﴾ سَيَهْدِيهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ ﴿محمد: ٥﴾
“যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়, আল্লাহ কখনই তাদের কর্ম বিনষ্ট করবেন না। তিনি তাদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করবেন। (সূরা মুহাম্মাদ: ৪-৫)
অর্থাৎ যারা এ কালিমার জন্য জান কুরবান করেছেন, যদিও তাঁরা শত্রুর হাতে নিজের প্রাণ হারিয়েছেন; তবুও তাঁদের কর্ম, তাঁদের চেষ্টা, তাঁদের জিহাদ, তাতে নিজের জান সঁপে দেওয়া মোটেও নিরর্থক নয়; বরং তা যথার্থই ফলপ্রসূ। আসল হলো- পরকালীন জীবন, যার প্রতি তাঁরা ঈমান রাখতেন, আল্লাহ তাঁদেরকে তাতে সফল করবেন। তাঁদের গন্তব্যস্থল জান্নাতে পৌঁছে দেবেন।
ইমাম ইবনে জারীর তবারী রহ. তাফসীরে তবারীতে বলেন, وَالَّذِينَ قُتِلُوا তে আমার মতে উত্তম কেরাত হলো, وَالَّذِينَ قَاتَلُوا ভাবার্থ হলো, যাঁরা আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করেছেন, আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করবেন না। তাদের ইহকাল-পরকালকে সাফল্যমন্ডিত করবেন।
এভাবেই আল্লাহর পথের যোদ্ধাদের পরীক্ষা আরও সহজ করে দেওয়া হয়েছে যে, পরীক্ষার আগেই বলে দেওয়া হয়েছে- পরীক্ষায় কামিয়াব হওয়ার পদ্ধতি কী?
যে কালিমা মুখে পড়া হলো, সে কালিমার পতাকা উঁচু করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করা, তার উপর অবিচল থাকা; এমনকি দুই কল্যাণ- শরীয়ত বা শাহাদাত থেকে কোনো এক কল্যাণ লাভ হবে।
আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গীকার করছেন, এ ধরনের মানুষকে তিনটি পুরস্কার দেওয়া হবে।
১. فَلَنْ يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ: তিনি তাঁদের চেষ্টাগুলোকে বিনষ্ট করবেন না। যত দীর্ঘ সময় জিহাদ করতে থাকুক। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি মুহূর্ত এবং প্রতিটি সেকেন্ডের বিনিময়ে আল্লাহ চিরস্থায়ী জান্নাত দান করবেন।
২. سَيَهْدِيهِمْ: স্বয়ং আল্লাহই তাঁদের পথ দেখাবেন; যাতে সত্যের পথে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক তাঁরা জিহাদ চালিয়ে যেতে পারেন। যত বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতি হোক না কেন, যত ফেতনার সয়লাব হোক না কেন, যত বড় বড় গাছ উপড়ে যাক না কেন, আল্লাহ তাঁদেরকে সত্যের পথে অবিচল রাখবেন।
৩. وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ: দুনিয়া-আখিরাতে তাঁদের অবস্থা ভালো করে দেবেন।
আর জানা কথা হলো, জিহাদ ও মুজাহিদদের অবস্থা ভালো হওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাঁদের জিহাদ আল্লাহর দ্বীনকে উঁচু করার জন্য, নবী কারীম ﷺ এর বাতলানো পদ্ধতি মতে হবে। জয়-পরাজয় যদিও যে কোনো এক দলেরই হবে। এমনকি সব মুজাহিদ শহীদ হয়ে গেলেও তাঁরা সফলকাম, যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং নবী ﷺ এর পদ্ধতি মতে তাঁদের জিহাদ হয়ে থাকে। তবে যদি মুজাহিদীন বিজয়ের পর বিজয় লাভ করতে থাকেন, কিন্তু নিজেদের হাতেই তারা শরীয়াহ আইনকে পদদলিত করেন, কালিমার পতাকা বুলন্দ করার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদ, দেশত্ববোধ, দলপ্রীতি বা অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে যুদ্ধ করেন, তখন এটি তাদের অবস্থা ভালো হয়েছে বলা যাবে না। বরং এটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা, যেটি থেকে প্রত্যেক মুসলমানের পানাহ চাওয়া উচিত।
Comment