ভিনগ্রহের প্রাণী? নাকি জীন শয়তান?
আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমের একটি সিফাত বলেছেন: 1مُهَيْمِن – মীমাংসাকারী, চূড়ান্ত ফায়সালা প্রদানকারী। মানবজাতি যেখানে বিভিন্ন মত ও পথে বিভক্ত হয়ে পেরেশান হয়ে ঘুরবে: কুরআন সেখানে মীমাংসা করে দিবে, চূড়ান্ত ফায়সালা করে দিবে। অকাট্য ফায়সালা দিবে: কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।গবেষণার পেছনে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে চলে বর্তমান দুনিয়ার কিছু গবেষণা দেখলে সত্যিই অনুভূত হয়: কুরআন মীমাংসাকারী, চূড়ান্ত ফায়সালাকারী। বরং কুরআনে বিশ্বাসীদের কাছে যেগুলো একান্ত প্রাথমিক স্তরের বিশ্বাস, গবেষকরা সেগুলোর পেছনে গবেষণা করতে করতে নিজেদের গোটা জীবন শেষ করে দিয়ে একান্ত সামান্য ও অস্পষ্ট কিছু মনে হয় বের করতে পেরেছে। এমনই একটা গবেষণা হলো: ভিনগ্রহের প্রাণী।
এই ভিনগ্রহের প্রাণী নিয়ে কত গবেষণা। কত রকমের ধারণা তাদের নিয়ে। কত সুপার পাওয়ারের অধিকারী ভাবা হচ্ছে তাদেরকে। মানবজাতী যেন তাদের সামনে অসহায়। তারা যেন চলে আসছে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে কিংবা মানবজাতীকে নিঃশেষ করে দিতে।
আমরা খালি চোখে যেসব প্রাণী দেখতে পাই, তাদেরও বাহিরে আল্লাহ তাআলা দুই প্রকার প্রাণীর কথা বলেছেন:
• জীন।
• ফেরেশতা (মালাইকা)।
এদের মধ্যে ফেরেশতা আল্লাহ তাআলার একান্ত অনুগত বান্দা। আল্লাহর আদেশের ব্যতিক্রম কিছুই তারা করে না। তারা নূরের তৈরি। তারা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারে। যেমন জীবরাইল আলাইহিস সালাম মানুষের বেশে আমাদের নবীজির কাছে আসতেন। লূত আলাইহিস সালামের কওমকে ধ্বংস করার জন্য ফেরেশতারা সুদর্শন কিশোরের বেশে এসেছিল।
এই ফেরেশতারা আসমান যমিনে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। তাদের কারও কারও এতো শক্তি আল্লাহ তাআলা দিয়ে রেখেছেন, যা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। ঈসরাফিল আলাইহি সালামের শিঙ্গার ফুঁতে গোটা আসমান যমিন তছনছ হয়ে যাবে। তারা চোখের পলকে আসমান থেকে যমিনে নামে, আবার যমিন থেকে আসমানে যায়।
অপরদিকে জীন জাতির মধ্যে ভালো মন্দ উভয় রকম আছে। শয়তান এবং তার দলবল এই জীন জাতীর লোক।
জীনেরা আগুনের তৈরি। তারাও মানুষের মতোই বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন প্রাণী। এ কারণে মানুষের মতো তারাও আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও আম্বিয়ায়ে কেরামকে মেনে চলতে আদিষ্ট। তাদেরও আছে হিসাব নিকাশ, জান্নাত জাহান্নাম।
জীন জাতি অদৃশ্যমান। আমরা তাদেরকে দেখি না, তবে তারা আমাদেরকে দেখে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ} [الأعراف: 27]
“সে (শয়তান) ও তার দল এমন স্থান থেকে তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না।” –আরাফ: ২৭
তবে কখনও যদি তারা এমন কোনো প্রাণীর সূরত ধরে আসে যেসব প্রাণীকে আমরা দেখতে পাই, তাহলে আমরা জীন দেখতে পাই। যেমন অনেক সময় সাপ ও কুকুরের বেশে জীন আসে। মানুষের বেশেও আসতে পারে। ইবলিস শয়তান মানুষের বেশে এসে বদরের যুদ্ধের সময় কাফেরদের উৎসাহ দিচ্ছিল, কিন্তু যেই দেখলো ফেরেশতা নামতে শুরু করেছে, আস্তে আস্তে সরে পড়লো। বুঝতে পারছিল: ফেরেশতার সামনে তার রক্ষা নাই।
বুঝা গেল:
• জীন ও ফেরেশতা অনেক সময় একে অপরকে দেখতে পায়, যেখানে আমরা তাদের কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।
• ফেরেশতার শক্তির সামনে জীন শয়তান পরাস্ত।
যদিও ফেরেশতার শক্তির সামনে জীন জাতীর রক্ষা নাই, তবে মানুষের তুলনায় জীনের অনেক বেশি শক্তি-সামর্থ্য রয়েছে। কুরআনে কারীমে এসেছে, জীনেরা আসমানের কাছাকাছি যেতো এবং আসমানে ফেরেশতারা কি কথাবার্তা বলতো তা কিছু কিছু শুনতে পারতো। কুরআন নাযিল হওয়ার পর থেকে এই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন জীনেরা আসমানের কাছে আর নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে না। আল্লাহ তাআলা তারকারাজির মাধ্যমে আশ্চর্য রকমের মিসাইল সিস্টেম বসিয়ে রেখেছেন। কোনো গায়েবের কথা শুনে তা নিয়ে পৃথিবীতে আসা শুরু করতে না করতেই তাকে ভস্ম করে দেয়া হয়।
আল্লাহ তাআলা জীনদের কথা এভাবে বিধৃত করেছেন:
{وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا (8) وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا (9)} [الجن: 8، 9]
“আমরা আকাশে অনুসন্ধান করতে চাইলাম, তখন দেখলাম তা কঠোর পাহারাদার ও উল্কাপিণ্ড দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। আমরা আগে সংবাদ শোনার জন্য আকাশের কোনো কোনো স্থানে গিয়ে বসে থাকতে পারতাম, কিন্তু এখন কেউ গিয়ে শুনতে চাইলে সে দেখতে পায়: এক উল্কাপিণ্ড তার উপর নিক্ষেপের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।” –জীন: ৮-৯
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
{إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ (6) وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ (7) لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَى وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ (8) دُحُورًا وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ (9) إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ (10)} [الصافات: 6 - 10]
“নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজির শোভা দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছি। প্রত্যেক দুষ্ট শয়তান থেকে রক্ষা করেছি। ফলে তারা ঊর্ধ জগতের কথাবার্তা শুনতে পারে না; সকল দিক থেকে তাদের উপর নিক্ষেপ করা হয়। তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়, আর আখেরাতে তাদের জন্য আছে স্থায়ী শাস্তি। তবে কেউ কোনো কিছু ছুঁ মেরে নিয়ে যেতে চাইলে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড তার পশ্চদ্ধাবন করে।” –সাফফাত: ৬-১০
তো আমরা দেখতে পাচ্ছি: জীনেরা এতোই শক্তির অধিকারী আর এতোই দ্রুতগতির যে, এরা আসমান পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবং মূহুর্তে চলেও আসতে পারে। যেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার হওয়ার পরও মানুষ খবু সামান্যই শূন্যে উপরের দিকে উঠতে পারে, সেখানে জীনেরা স্বাভাবিকভাবেই আসমান পর্যন্ত চলে যেতে পারে। তারা কিভাবে যায়? যেভাবেই যাক একথা সত্য যে, তারা যেতে পারে। আর এই গতি ও শক্তি তারা আজ আবিষ্কার করেছে যে তা নয়, যখন মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির ধারে কাছেও ছিল না, তখনও তাদের এই শক্তি ছিল। এটা তাদের আবিষ্কৃত শক্তি নয়, আল্লাহ তাআলা স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে এই শক্তি দিয়ে রেখেছেন।
এই জীনদের আক্রমণের সামনে মানুষ অসহায়। কিন্তু মানুষ তো আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মাখলুক, উত্তম মাখলুক। এই জীনদের থেকে আত্মরক্ষার জন্য আল্লাহ তাআলা খুব সহজ পদ্ধতি রেখেছেন। তা হলো: মাসনুন দোয়া। আপনারা জানেন, বাথরুমে যাওয়ার সময় যে দোয়াটি পড়া হয় তার অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে নারী ও পুরুষ উভয় প্রকার শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাই’। দোয়াটি পড়বেন। বাম পা দিয়ে বাথরুমে যাবেন। আপনি নিরাপদ। শয়তান জীনেরা আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। যদিও জীনদের অনেক শক্তি সামর্থ্য আছে, কিন্তু দোয়ার সামনে তারা অসহায়।
পক্ষান্তরে যারা শরীয়ার বিধি নিষেধ মেনে চলে না, দোয়া আযকার ঠিকমতো পড়ে না: শয়তান তাদের নিয়ে খেলা করে। ভয় দেখায়। ক্ষতি করে। এক দুশমন আরেক দুশমনকে বাগে পেলে যা করে জীনেরা এসব লোককে নিয়ে তাই করে। আর যারা বেঈমান? তাদের তো কথাই নেই। তারা জীনদের মুঠোয়। এসব লোক আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, ফলে আল্লাহ তাআলা তার আরেক দুশমন তথা শয়ানকে এদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। শয়তান তাদের নিয়ে খেলে। এদের সামনে নিজের শক্তি ও আশ্চর্য রকমের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। ফলে এরা আল্লাহকে বিশ্বাস না করলেও আল্লাহর অবাধ্য শয়তানে বিশ্বাস করে- ভিনগ্রহের প্রাণীর নাম করে। এদের সামনে নিজেদেরকে অসহায় মনে করে। এমনকি এদের পুজায়ও করে। আর না করেই বা উপায় কি? জীনদের শক্তির সামনে তাদের তো রক্ষার কোনো উপায় নাই। তাদের তো রব নাই, দোয়া নাই- যেমনটা আছে আমাদের।
এরা গবেষণা করতে করতে শয়তানদের কিছু অদ্ভূত উপস্থিতি, অদ্ভূত রকমের কিছু শক্তি, কিছু কর্ম খুঁজে পায়। মনে করে কত কি গবেষণা করে ফেলেছে। অথচ একজন মুসলিম শিশুর কাছেও তাদের এসব গবেষণার কোনো মূল্য নেই। একজন শিশু, যার ফেরেশতা ও জীন সম্পর্কে, নবীদের মু’জিযা, পূর্ববর্তী উম্মতদের ধ্বংসের কিছু কাহিনি এবং আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে জ্ঞান আছে: তার কাছেও এসব গবেষণা নিতান্তই মূল্যহীন, মোটেই আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ তাআলা এভাবেই তাদেরকে পেরেশানিতে ফেলে রাখেন। শয়তানদের সামনে অসহায় করে রাখেন। এরা আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করলেও শয়তানদের সামনে আত্মসম্পর্ণ করে।
আল্লাহ তাআলা কেয়মাতের দিন শয়তানদের ধরবেন আর বলবেন:
{يَامَعْشَرَ الْجِنِّ قَدِ اسْتَكْثَرْتُمْ مِنَ الْإِنْسِ} [الأنعام: 128]
“হে জীন সম্প্রদায়, তোমরা তো অসংখ্য মানুষকে বশ করে নিয়েছিলে।” –আনআম: ১২৮
অর্থাৎ দুনিয়াতে তো খুব মজা দেখিয়েছো, আজ এর শাস্তির মজা দেখ কেমন লাগে।
জীন শয়তানের সামনে পরাস্ত এসব উদভ্রান্ত লোক যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করতো, কুরআনে বিশ্বাস করতো, ফেরেশতা ও জীনের সঠিক তত্ত্ব জানতো: এতো পেরেশানির কিছুই তাদের থাকতো না।
প্রিয় ভাইয়েরা, আসুন আমরা আমাদের দ্বীনকে বুঝি। বিশেষ করে মাসনুন দোয়াগুলো অর্থ ও মর্মসহ শিখি। জায়গামতো ও সময়মতো আমল করি। জীন শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকি।
***
Comment