আন নাসর মিডিয়াপরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ২৬তম পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ২৬তম পর্ব
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়িত না হওয়ার শাস্তি
আল্লাহর নিয়ামতসমূহ থেকে বিতাড়ন ও বঞ্চিতকরণ:
﴿ إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴾
“নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মাঝে নিপতিত”
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ﴿ابراهيم: ٧﴾
“যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর।” (সূরা ইবরাহীম: ৭)
উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার দ্বারা নেয়ামত বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছেন এবং অকৃতজ্ঞ হওয়াকে ঐ নেয়ামত ছিনিয়ে নেওয়ার কারণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা একটি গ্রামের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেছেন-
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا قَرْيَةً كَانَتْ آمِنَةً مُّطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِّن كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ ﴿النحل: ١١٢﴾
“আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন একটি জনপদের, যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত, তথায় প্রত্যেক জায়গা থেকে আসত প্রচুর জীবনোপকরণ। অতঃপর তারা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কারণে স্বাদ আস্বাদন করালেন, ক্ষুধা ও ভীতির।” (সূরা নাহল: ১১২)
যদি আল্লাহর তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা হয়; তাহলে আল্লাহ তা‘আলা আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়াও তার জন্য সংকীর্ণ করে দেন। যে দুনিয়ার জন্য সে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শিরক ও কুফরে লিপ্ত, সে দুনিয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ক্ষুধা-পিপাসা, সংকীর্ণতা, দেউলিয়াত্ব ও ভয়-ভীতি চাপিয়ে দেন।
যে ভূমিতে যে পরিমাণ আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যাচরণ করা হয়, সে ভূমি সে পরিমাণ উৎপাদিত ফসলাদি ও তার বরকত রুখে রাখে। আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে বড় অবাধ্যাচরণ হলো, আল্লাহ তা‘আলার ভূমিতে তাঁর বিধান বাস্তবায়নের অধিকারেরই সমাপ্তি ঘটানো এবং তার সাথে কুফরী করাকে রাষ্ট্রের সার্বিক নেযাম বানিয়ে দেওয়া।
অতএব, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানের সাথে বিদ্রোহ ও অবাধ্যাচরণ এবং স্বীয় বানানো আইনের উপর একগুঁয়ে হয়ে অটল থাকার পরিণাম এ ছাড়া আর কী হতে পারত যে, আসমান ও জমিন উভয়ই রাগ ও ক্ষোভে ফেটে পড়ত। আসমান তার বারি বর্ষণ বন্ধ করে দিত আর জমিন তার বরকতসমূহ আটকে রাখত।
আর হ্যাঁ, বর্তমান পৃথিবীর অবস্থাও তাই।
সুবহানাল্লাহ! কুরআনে কারীমের একেকটি আয়াত আজ এ আধুনিক বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জ। সূরা আ’রাফের ৫৮ নং আয়াত দেখে তো মনে হয় যে, আজই এ নেযামের ব্যাপারে এ আয়াত তাজা তাজা অবতীর্ণ হচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন-
وَالْبَلَدُ الطَّيِّبُ يَخْرُجُ نَبَاتُهُ بِإِذْنِ رَبِّهِ وَالَّذِي خَبُثَ لَا يَخْرُجُ إِلَّا نَكِدًا كَذَٰلِكَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَشْكُرُونَ ﴿الأعراف: ٥٨﴾
“যে শহর উৎকৃষ্ট, তার ফসল তার প্রতিপালকের নির্দেশে উৎপন্ন হয় এবং যা নিকৃষ্ট তাতে অল্পই ফসল উৎপন্ন হয়। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ণনা করি কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্যে।” (সূরা আ‘রাফ: ৫৮)
এ আয়াতের মাঝে বলা হয়েছে যে, ভালো জমি শস্য ও ফসলাদি উৎপন্ন করে তার রবের হুকুমে। আর মন্দ জমি বা অনুর্বর ভূমি থেকে অল্পস্বল্প ছাড়া কিছুই গজায় না।
ইমাম ওয়াহিদী ও ইমাম রাযী রহ. نَكِدًا এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন-
النكد: العسر الممتنع من إعطاء الخير علي جهة البخل
অর্থাৎ, ‘কৃপণতার কারণে ভালো কোনো জিনিস (সম্পদ ব্যয় করা) প্রদান করা থেকে অপ্রতিরুদ্ধ বাধা।’
পূর্বোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের অন্তরের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। মানুষের অন্তরের ব্যাপারে নবী কারীম ﷺ ইরশাদ করেছেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : " إِنَّ العَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ ، فَإِذَا هُوَ نَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ وَتَابَ سُقِلَ قَلْبُهُ ، وَإِنْ عَادَ زِيدَ فِيهَا حَتَّى تَعْلُوَ قَلْبَهُ ، وَهُوَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ " ) كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِم مَّا كَانُوا يَكْسِبُونَ( ﴿المطففين: ١٤﴾ .
روي في سُنَنُ التِّرْمِذِيِّ ـ الْجَامِعُ الصَّحِيحُ >> الذَّبَائِحِ >> أَبْوَابُ تَفْسِيرِ الْقُرْآنِ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ >> بَاب وَمِنْ سُورَةِ وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِين َ >>
“নিশ্চয়ই বান্দা যখন কোনো গুনাহ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। অতএব, যদি সে তাওবাহ ও ইস্তেগফার করে, তখন তার অন্তর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যদি পুনরায় সে গুনাহর দিকে ফিরে আসে; তাহলে ঐ দাগ বাড়তে থাকে যে পর্যন্ত না, তা তার অন্তরে পরিপূর্ণ সংক্রমিত হয়ে পড়ে। আর এর নামই হলো রা’ন (জং ও মরচে) যেটা আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুতাফফিফীনে উল্লেখ করেছেন- “কখনও না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয় মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।” (সূরা মুতাফফিফীন: ১৪)[সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৩৩৩৪, শামেলা]
অতঃপর, এমন এক সময় আসে যে, পুরো অন্তর ঐ জমিনের মতো হয়ে যায়; যাকে নিমকগুল্ম খেয়ে ফেলেছে। ফলে সেটা অনুর্বর ও বিরান ভূমিতে পরিণত হয়।
যেরূপ ভালো ও উৎকৃষ্ট অন্তর হচ্ছে সেটি, যাতে আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা গালেব বা প্রবল থাকে। এ ধরনের অন্তর ওয়াজ-নসীহতের কারণে নরম ও বিগলিত হয়। ফলস্বরূপ, আমালে সালেহা বা নেক আমলসমূহ খুঁজে খুঁজে আদায় করা শুরু করে। অনুরূপভাবে ভালো ও পবিত্র ভূমি হচ্ছে সেটি, যেখানে আল্লাহ তা‘আলার দ্বীন গালেব বা বিজয়ী থাকে। ঐ ভূমিতে বসবাসকারী প্রত্যেকের চব্বিশ ঘণ্টা মহান আল্লাহর শরীয়তের ছায়ায় অতিক্রান্ত হয়, ইবাদতের ক্ষেত্রেও, মু‘আমালাতের ক্ষেত্রেও। যেখানে সুদভিত্তিক ব্যবস্থা চালু হবে না এবং বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার জয়গান থাকবে না। তাহলে, এ ধরনের ভূমি স্বীয় ফিতরাতের উপর বিদ্যমান থাকে। যা মহান আল্লাহ প্রদত্ত বারি বর্ষণে সিক্ত হয় এবং তার অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য অঙ্কুরিত হয়।
যেরূপ কোনো অন্তরে যদি গাইরুল্লাহ’র মুহাব্বত গালেব বা প্রবল থাকে, যে অন্তরে খাহেশাত বা প্রবৃত্তির অনুসরণের প্রাধান্যতা বিদ্যমান থাকে, সে অন্তর খারাপ ও বরবাদ হয়ে যায়। স্বীয় ফিতরাত বা প্রকৃতি থেকে হটে যায়। ঠিক তদ্রূপ, যে ভূমিতে কুফরের প্রাধান্যতা থাকবে, সেটিও স্বীয় ফিতরাত থেকে সটকে পড়বে। আর তখন, আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টিও আগাছা বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপকার করবে না।
যেমনিভাবে খারাপ অন্তর কল্যাণ ও খায়েরকে গ্রহণ করে না এবং ঐ কল্যাণবিহীন মন্দ জিনিসগুলোকেই গ্রহণ করে, তেমনি যে ভূমি খারাপ হয়ে যায়, সেখানে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষেরই আধিক্য থাকে; যদিও অতি সামান্য ভালো গাছপালা উত্থিত হয়।
অতএব, একটু চিন্তা করুন! ঐ ভূমি থেকে নিকৃষ্ট ভূমি আর কোনটি হতে পারে; যাতে কুফরের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যতা বিদ্যমান থাকবে যে, প্রকাশ্যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করা হয়ে থাকে। কুফরী জীবন বিধান তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকে। মানবজাতির পারস্পরিক বিচারকার্য কুরআন ব্যতীত অন্য কোনো বানানো বিধান দ্বারা করা হয়। অন্যদিকে যেখানে আল্লাহর কালিমা বিজিত থাকে; তাহলে এ ধরনের ভূমি কি শস্য ও ফসলাদি দিতে পারে?
কোনো ভূমি আল্লাহর শরীয়ত বাস্তবায়িত থাকাবস্থায় অনুর্বর ও বিরান ভূমিতে পরিণত হওয়া অনেক উত্তম ও মঙ্গলজনক ঐ ভূমি থেকে; যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর শরীয়ত ব্যতীত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকে।
কোনো ভূমি ভালো ফসল ফলানো এবং ভালো ফসল দেওয়া থেকে বিরত থাকার আসল সম্পর্ক আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও অবাধ্যতার সাথে সম্পৃক্ত। আর আল্লাহ তা‘আলা’র সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা হলো, তাঁর সাথে কুফরীতে লিপ্ত হওয়া। অতএব, যে ভূমিতে কুফর এবং কুফরী বিধানাবলি প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সে ভূমির অবস্থা ব্যভিচার আর মদ্যপানে উন্মত্ত ভূমির চেয়েও ভয়াবহ হবে।
আর এসব ব্যাপারে কুরআনে কারীমের বিভিন্ন জায়গায় আলোকপাত করা হয়েছে, যে ভূমিতে আল্লাহর সাথে নাফরমানি করা হবে, সেসব ভূমির বরকত ওঠিয়ে নেওয়া হবে।