মুসলিম বিশ্বে আমেরিকার ঔপনিবেশিক প্রভাব যতই বাড়ছে—যার সূচনা ১৯৯১ সালের ইরাক যুদ্ধ দিয়ে, এবং যা ৯/১১-পরবর্তী ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের মাধ্যমে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে—ততই বিভিন্ন দেশেই স্কুলের পাঠ্যক্রম সংস্কার ও বইপত্র পুনর্লিখনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সৌদি আরব থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত, আমেরিকান কর্মকর্তারা স্থানীয় সরকারগুলোর ওপর চাপ দিচ্ছে যেন তারা সব কিছু মুছে ফেলে যা তাদের মতে “সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ দেয়।”
১৯৯৩ সালে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের এক বৈঠকে, কুয়েতের পার্লামেন্টের বিরোধী সদস্যরা এই চাপকে বর্ণনা করেন “নতুন এক আমেরিকান ধর্ম” শেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবে। আফগানিস্তানে, কাবুল যেন ভরে গেছে আমেরিকান ও ইউরোপীয় পরামর্শদাতায়, যারা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নামে স্কুলগুলো সংস্কারের কাজে ব্যস্ত। ইরাকেও এমন বহু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যদিও সেগুলো ধীরগতির কারণ হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ ও পশ্চিমা পরামর্শদাতাদের নিজেদের দুর্নীতি।
এই ধরনের চাপ গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়েই বাড়ছে, সাথে রয়েছে সামরিক হুমকি। এই সংস্কার প্রচেষ্টাগুলোকে অনেকে “ইসলামি শিক্ষার পশ্চিমাকরণ” হিসেবে দেখেন। হয়তো সেটাই সত্য, তবে এটা একেবারেই নতুন কিছু নয়। যদি আমরা বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে চাই, তাহলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে মুসলিম বিশ্বে আগের পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দিকে—যা শিক্ষার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং যেখানে বিদেশিদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও জড়িত ছিল।
ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের আগের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে—তখনকার শিক্ষা কেমন ছিল। এক দিক থেকে বললে, ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা ছিল অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক—তাদের পাঠদান পদ্ধতিতে যেমন, তেমনি কাঠামোতেও। একই অঞ্চলের মধ্যেই একাধিক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠশালা, মসজিদ ও শেখার সুযোগ ছিল। উদাহরণ হিসেবে, মিশরে বিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলেও, সেখানকার বিভিন্ন সুলতান, আলেম, প্রশাসক ও মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈচিত্র্য বজায় ছিল, কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। যদিও কিছু পরবর্তী শাসক চেষ্টা করেছিল স্কুলব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে, এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে কেবল ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের পর।
এই অনানুষ্ঠানিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। শিক্ষকরা রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত ছিলেন না; তারা নিজের উপার্জনে বা পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষাদান করতেন। আর আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটও ছিল না—পরিবর্তে, একজন ছাত্র পেতেন ইজাযাহ, অর্থাৎ কোনো বিশিষ্ট আলেমের কাছ থেকে একটি সুপারিশপত্র, যা তাকে সেই জ্ঞান শেখানোর অনুমতি দিত। পরে মমলুকদের আমলে কিছুটা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করা হয় আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ও স্তরভিত্তিক ডিগ্রি ব্যবস্থার মাধ্যমে।
ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষায় বই ব্যবহৃত হলেও মৌখিক শিক্ষা ছিল প্রধান। কোনো বই তখনই প্রামাণ্য ছিল, যদি সেটা জীবন্ত কোনো আলেমের মুখ থেকে শোনা এবং শেখা হতো। শিক্ষার এই পদ্ধতিতে ছাত্ররা মূলত শিক্ষক যেভাবে পাঠ করাতেন, তা লিপিবদ্ধ করত এবং আলোচনা ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নিজের মতো করে সেই পাঠ তৈরি করত। এই মৌখিকতার ভিত্তি নিহিত ছিল আরবি ভাষায়, যার মূল কাঠামো গঠিত হয় তিনটি ব্যঞ্জনের উপর—আর তা প্রাণ পায় "হারাকাত" বা স্বরের “চলনে।” শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝা যেত শ্রবণের মাধ্যমে। ফলে লিখিত পাঠ ছিল গৌণ। এমনকি, মধ্যযুগের অনেক মুসলিম আলেম একমাত্র বই পড়ে শেখাকে নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করতেন। এজন্যই শিক্ষক না থাকলেও ছাত্ররা একে অপরের সঙ্গে উচ্চস্বরে পাঠ করত, কারণ—একজন আলেম বলেছিলেন—“কানে যা যায়, তা-ই হৃদয়ে গেঁথে যায়।”
এই কথাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাক-ঔপনিবেশিক ইসলামি শিক্ষার আরেকটি মূল দিক—মুখস্থ করার গুরুত্ব। শিক্ষার্থীরা আগে মৌলিক পাঠ্যসমূহ মুখস্থ করত, তারপর সেগুলো প্রয়োগ করে জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করত। এই প্রশিক্ষণ পদ্ধতিই মুসলিম আলেমদের সক্ষম করে তোলে প্রাচীন ও সমকালীন চিন্তার গভীর সমালোচনায়। বিতর্ক ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষালোক বিনিময়ও ছিল সাধারণ প্রথা।
বলতে গেলে, ইসলামি শিক্ষার ওই জগৎ ছিল এক জীবন্ত, চিন্তাশীল ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করা জ্ঞানতন্ত্র—যা পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক কাঠামোর নিচে স্তরভিত্তিক, নির্জীব ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় রূপ নেয়।
তবে ইসলামি শিক্ষায় এই প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, এটাও ঠিক নয় যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের পরেই এসেছে। কায়রোতে মামলুক শাসকরাই ধর্মীয় শিক্ষাকে কিছুটা আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেন—সরকারি অনুদানে পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তারা একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেন। এর পেছনে ছিল মতাদর্শিক আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্য। কারণ, আল-আযহার প্রাথমিকভাবে ছিল শিয়া চিন্তার একটি কেন্দ্র, এবং মামলুকরা সেটিকে সুন্নি মতবাদের অধীনে আনতে চেয়েছিল।
সরকারি অনুদান—ছাত্রদের জন্য বৃত্তি, শিক্ষকদের জন্য সম্মানী—প্রধানত শিক্ষিত শহুরে শ্রেণির কাছে পৌঁছাত, যারা ধীরে ধীরে ইসলামি জ্ঞানের উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করত। তবে এই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানিকীকরণ কখনোই শিক্ষার পুরো প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে কাঠামোবদ্ধ করে ফেলেনি। বরং, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার শক্তিশালী ঐতিহ্য এক ধরনের মুক্তচিন্তা ও প্রাণবন্ততা বজায় রেখেছিল, যা একই সময়ে পশ্চিমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল।
তবুও, শিক্ষা তখন শুধু অভিজাত আলেমশ্রেণির একচ্ছত্র সম্পত্তি হয়ে ওঠেনি। অনেক স্থানীয় মানুষও মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—কেউ আজান দিতেন, কেউ জুমার খুতবা দেওয়ার জন্য ইমামের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, কেউ নবী (সা.)-এর প্রশংসায় কাসিদা পাঠ করতেন, কেউ ভাষা, লেখা শেখাতেন কিংবা লেখক হিসেবে কাজ করতেন। এ ধরনের দায়িত্ব পালন করার ফলে তারা অনেক সময় যুগের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কাছেও শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতেন।
তবুও, একটি চমৎকার দিক হলো—এই শিক্ষাব্যবস্থায় একটা অদ্ভুত দ্বৈততা ছিল। যেমন, ইবন আল-হাজ (মৃত্যু: ১৩৩৬ খ্রি.) তাঁর একটি গ্রন্থে সমসাময়িক আলেমশ্রেণিকে সমালোচনা করে বলেন, 'তারা নিজেদের বিলাসী পোশাকে সাধারণ জনগণকে উচ্চশিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে'।
অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন কিছু লোক থাকত, যাদের কাজ ছিল কুরআনের তিলাওয়াত করা। নির্দিষ্ট মৌসুমে হাদীসের পাঠও হতো—সুনামধন্য সংগ্রহ থেকে পাঠ করতেন তারা। এক আধুনিক গবেষক উল্লেখ করেছেন, “প্রায় প্রতিটি স্কুলেই কুরআন পাঠকদের সংগঠিত দল থাকত, যা ইঙ্গিত দেয় যে শিক্ষা ও সাধারণ ধর্মচর্চার মধ্যে সুন্দর সহাবস্থান সম্ভব হয়েছিল, কারণ এসব প্রতিষ্ঠান কেবল পাঠশালা নয়, একই সঙ্গে ইবাদতের (worship) কেন্দ্রও ছিল।”
হাদীস পাঠ ছিল এমন এক সামাজিক-ধর্মীয় অনুশীলন, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারত। এটি এমন এক খোলা জ্ঞানচর্চার পরিসর ছিল, যেখানে ‘শিক্ষা’ ও ‘ইবাদত’-এর মধ্যে কৃত্রিম প্রাচীর ছিল না। বরং, সব মুসলিমের জন্য ছিল অংশগ্রহণের সুযোগ—উচ্চশিক্ষা যেন জীবনেরই একটি সম্প্রসারণ ছিল, বর্ণিল, ব্যস্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন গোলাবারুদের পরিবর্তে ধর্মতন্ত্রের (canons) মাধ্যমে বৈশ্বিক আধিপত্য কায়েম করতে শুরু করল, তখন ইসলামি আইনের পুনর্নির্মাণ একটি কৌশল হয়ে দাঁড়ায়—যেটি ১৯ শতক থেকে ২০ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চালু ছিল। এই কৌশল পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি অত্যন্ত সফলভাবে মুসলিম সমাজে প্রয়োগ করে, এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, এতে বহু স্থানীয় নেতা পূর্ণ সহায়তা দেন। এই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আধুনিক বিদ্যালয়ব্যবস্থা’র নামে, এবং এর ছায়া আজও বর্তমান।
১৯ শতকের শেষ নাগাদ মুসলিম বিশ্বের বহু অংশেই একটি পশ্চিমঘেঁষা সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক অবকাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিভিন্ন শিক্ষানীতি ও তথাকথিত সংস্কারের গল্প বহু পণ্ডিত বলেছেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনগুলো এমন এক ব্যবস্থার ক্ষতচিকিৎসা, যার গোড়াতেই ঔপনিবেশিকতা গেঁথে আছে। এই শৃঙ্খলার প্রভাব আজও অনুভবযোগ্য, যদিও ইউরোপীয় প্রভাব কিছুটা কমে এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ভার সরে গেছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।
এই সমস্যা গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রতিফলিত হয়, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সর্বত্রই এক প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির আরোপিত কাঠামোতে পরিচালিত হয় বা তাদের উত্তরাধিকার বহন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই পশ্চিমঘেঁষা শিক্ষা ব্যবস্থার আজকের অবস্থা অনেক জায়গায় করুণ: অতি ভিড়, দুর্বল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও কম বেতনের শিক্ষক, পক্ষপাত, আত্মীয়প্রীতি এবং ফলহীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান—সব মিলিয়ে এক ধ্বংসপ্রায় ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে পারে, তাদের দ্রুতই টেনে নেয় পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগদাতারা, যারা তাদের জন্য বড় বড় বৃত্তি ও সম্মানজনক পদ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। ফলে মুসলিম বিশ্ব কার্যত তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক নেতৃত্ব ত্যাগ করে দিয়েছে—যেটি এখন পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ, নিজের করে নিয়েছে।
যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বজুড়ে আমেরিকান আধিপত্য বিস্তার করে, ফরাসি বৌদ্ধিক প্রভাবও ২০শ শতকজুড়ে বজায় ছিল। ২০শ শতকের মধ্যভাগে সাইয়্যেদ কুতুব ও অন্যান্য আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদেরা ফরাসি দার্শনিক আলেক্সি ক্যারেলের মতো চিন্তকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। তবে, এই সময়ে পশ্চিমা চিন্তা ব্যবহারে একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে: এটি আর একটি সামগ্রিক দার্শনিক ব্যবস্থা হিসেবে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করার পরিবর্তে, আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ ও কর্মীরা—যেমন মিসরের সাইয়্যেদ কুতুব (রাহি.) বা ইরানের আলী শরীয়তী (যিনি ফ্রানৎস ফ্যাননের সঙ্গে ফ্রান্সে পড়ার সময় সাক্ষাৎ করেন)—পশ্চিমা কথাবার্তাকে নিজের অস্ত্রেই আঘাত করতে শুরু করেন। এই প্রচেষ্টা ছিল একদিকে ইসলামের ভিত্তিতে একটি চিন্তা ও জীবনব্যবস্থা পুনরাবিষ্কারের, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ ও ভেঙে ফেলার একটি প্রকল্প।
এই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত অথচ ইসলাম-ভিত্তিক আন্দোলনগুলোকেই বর্তমানে আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে—সুন্নি বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণের পেছনে কুতুবের (রাহি.) ভাবনা যেমন প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি ইরানে শিয়া দুনিয়ায় আলী শরীয়তীর চিন্তা রেখেছে গভীর ছাপ। এই ধারার চিন্তাই কিছু ক্ষেত্রে উপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙতে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করেছে; যার সবচেয়ে প্রকাশ্য উদাহরণ ইরানের ইসলামি বিপ্লব।
তবে, এখানেও একটি দ্বৈততা লক্ষণীয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ইরানের শিক্ষা ব্যবস্থা আজও মূলত সেই কাঠামোর মধ্যেই চলমান, যা পহলভি শাসনামলে গঠিত হয়েছিল—যদিও বিপ্লবের পর সেটিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ইসলামিকরণ ঘটেছে। এমনকি ইরানের সবচেয়ে স্বাধীন ও ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান—হাওযা (hawzah)—ও আধুনিকতার চাপে পড়ে এখন সমমানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সুবিধা দিচ্ছে।
এই একই গল্প আমরা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও দেখতে পাই। এবং যে উপসংহার অনিবার্যভাবে উঠে আসে তা হলো—স্কুল ও শিক্ষা এখন আধুনিক সামাজিক শৃঙ্খলার অংশে পরিণত হয়েছে। আর এই সামাজিক শৃঙ্খলা নিজেই পশ্চিমা অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত এবং ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে বিশ্বায়নের পথে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই, এই কাঠামোর মধ্যে থাকা অবস্থায় স্কুল কখনোই এর বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না; সে কেবল এই ব্যবস্থাকেই পরিবেশন করে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরও শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ঔপনিবেশিক অবকাঠামো রয়ে গেছে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় এটিকে কোনো না কোনো মাত্রায় ‘ইসলামায়িত’ করা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মৌলিক গঠন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি—যেমন সনদের প্রথা, বয়সভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস, প্রতিদিনের ও প্রতিসপ্তাহের সময়সূচি, বছরের ১০ মাস ধরে ৫ দিন করে ১২ বছর পর্যন্ত পাঠদান ইত্যাদি। এই কাঠামো অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আজ আমরা যে শিক্ষাকে ‘ইসলামী’ আখ্যা দিচ্ছি, তার ভেতরেও মূলত সেই পুরনো, ঔপনিবেশিক ও পশ্চিমা চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোই বিদ্যমান, কেবল কিছু লোকজ আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে।
ইসলামী শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনা চলছে, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক কম। এর কারণ কোনো চিন্তার ঘাটতি নয়; বরং এটি প্রমাণ করে কতটা গভীরভাবে আধুনিক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেতনায় প্রোথিত হয়ে গেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি এক অর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন; এবং এক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে শিক্ষার লক্ষ্য হলো জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
একই সময়ে আমাদের এই কথাটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে, পশ্চিমা ব্যবস্থাটি নিজেই এখন দারিদ্র্যপীড়িত ও অস্থির। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, পরিবেশগত বিপর্যয়, আমেরিকার নেতৃত্বে ক্রমাগত যুদ্ধকে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা, এবং পশ্চিমা সমাজে অপরাধ ও সামাজিক অধঃপতন—সব মিলিয়ে এই ব্যবস্থা আজ নিজস্ব পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
মুসলমানদের জন্য—এবং অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জন্য—প্রশ্ন হলো, এই ভঙ্গুর ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে কী করা উচিত? যারা সত্যিই ভাবছেন, তাদের সামনে মূলত তিনটি পথ খোলা রয়েছে:
এক, মনে করা যে পশ্চিমা ব্যবস্থা এখনো সুস্থ ও সমৃদ্ধ, এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত ধারণার নিচে বসবাস করে যাওয়া।
দুই,পশ্চিমা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা, তারপর অন্যদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে কী করতে হবে তা বের করার চেষ্টা করা
তিন, এই ব্যবস্থার পতনের আগেই তা থেকে সরে আসা, এবং এমন এক নতুন, বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া যা লোভ, ভণ্ডামি ও অবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়—এই তিনটি তো আজকের পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নতুন জীবনব্যবস্থা, যার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু ভিন্ন রূপ অপরিহার্যভাবে জড়িত থাকবে, তা সম্ভবত গড়ে উঠবে স্থানীয় পর্যায়ে—বিভিন্ন আকারে, স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশগত বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এটি হবে একটি টেকসই জীবনব্যবস্থা, যা সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করবে ও মেনে চলবে; এটি হবে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্প্রদায়ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা; এবং এটি এমন একটি জীবনব্যবস্থা হবে যা বস্তুবাদী পশ্চিমা আধুনিকতার বাইরে গিয়ে অস্তিত্বকে অর্থ দান করবে।
১৯৯৩ সালে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের এক বৈঠকে, কুয়েতের পার্লামেন্টের বিরোধী সদস্যরা এই চাপকে বর্ণনা করেন “নতুন এক আমেরিকান ধর্ম” শেখানোর প্রচেষ্টা হিসেবে। আফগানিস্তানে, কাবুল যেন ভরে গেছে আমেরিকান ও ইউরোপীয় পরামর্শদাতায়, যারা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নামে স্কুলগুলো সংস্কারের কাজে ব্যস্ত। ইরাকেও এমন বহু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যদিও সেগুলো ধীরগতির কারণ হলো প্রতিরোধ যুদ্ধ ও পশ্চিমা পরামর্শদাতাদের নিজেদের দুর্নীতি।
এই ধরনের চাপ গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়েই বাড়ছে, সাথে রয়েছে সামরিক হুমকি। এই সংস্কার প্রচেষ্টাগুলোকে অনেকে “ইসলামি শিক্ষার পশ্চিমাকরণ” হিসেবে দেখেন। হয়তো সেটাই সত্য, তবে এটা একেবারেই নতুন কিছু নয়। যদি আমরা বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে চাই, তাহলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে মুসলিম বিশ্বে আগের পশ্চিমা ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দিকে—যা শিক্ষার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং যেখানে বিদেশিদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও জড়িত ছিল।
ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের আগের ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থাকে বুঝতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে—তখনকার শিক্ষা কেমন ছিল। এক দিক থেকে বললে, ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা ছিল অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক—তাদের পাঠদান পদ্ধতিতে যেমন, তেমনি কাঠামোতেও। একই অঞ্চলের মধ্যেই একাধিক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠশালা, মসজিদ ও শেখার সুযোগ ছিল। উদাহরণ হিসেবে, মিশরে বিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলেও, সেখানকার বিভিন্ন সুলতান, আলেম, প্রশাসক ও মুসলিম নেতাদের অংশগ্রহণের ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈচিত্র্য বজায় ছিল, কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো অন্যদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। যদিও কিছু পরবর্তী শাসক চেষ্টা করেছিল স্কুলব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে, এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে কেবল ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের পর।
এই অনানুষ্ঠানিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক। শিক্ষকরা রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত ছিলেন না; তারা নিজের উপার্জনে বা পারিবারিক পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষাদান করতেন। আর আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটও ছিল না—পরিবর্তে, একজন ছাত্র পেতেন ইজাযাহ, অর্থাৎ কোনো বিশিষ্ট আলেমের কাছ থেকে একটি সুপারিশপত্র, যা তাকে সেই জ্ঞান শেখানোর অনুমতি দিত। পরে মমলুকদের আমলে কিছুটা এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতিকে প্রতিস্থাপন করা হয় আনুষ্ঠানিক সার্টিফিকেট ও স্তরভিত্তিক ডিগ্রি ব্যবস্থার মাধ্যমে।
ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষায় বই ব্যবহৃত হলেও মৌখিক শিক্ষা ছিল প্রধান। কোনো বই তখনই প্রামাণ্য ছিল, যদি সেটা জীবন্ত কোনো আলেমের মুখ থেকে শোনা এবং শেখা হতো। শিক্ষার এই পদ্ধতিতে ছাত্ররা মূলত শিক্ষক যেভাবে পাঠ করাতেন, তা লিপিবদ্ধ করত এবং আলোচনা ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নিজের মতো করে সেই পাঠ তৈরি করত। এই মৌখিকতার ভিত্তি নিহিত ছিল আরবি ভাষায়, যার মূল কাঠামো গঠিত হয় তিনটি ব্যঞ্জনের উপর—আর তা প্রাণ পায় "হারাকাত" বা স্বরের “চলনে।” শব্দের প্রকৃত অর্থ বোঝা যেত শ্রবণের মাধ্যমে। ফলে লিখিত পাঠ ছিল গৌণ। এমনকি, মধ্যযুগের অনেক মুসলিম আলেম একমাত্র বই পড়ে শেখাকে নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করতেন। এজন্যই শিক্ষক না থাকলেও ছাত্ররা একে অপরের সঙ্গে উচ্চস্বরে পাঠ করত, কারণ—একজন আলেম বলেছিলেন—“কানে যা যায়, তা-ই হৃদয়ে গেঁথে যায়।”
এই কথাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রাক-ঔপনিবেশিক ইসলামি শিক্ষার আরেকটি মূল দিক—মুখস্থ করার গুরুত্ব। শিক্ষার্থীরা আগে মৌলিক পাঠ্যসমূহ মুখস্থ করত, তারপর সেগুলো প্রয়োগ করে জটিল সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করত। এই প্রশিক্ষণ পদ্ধতিই মুসলিম আলেমদের সক্ষম করে তোলে প্রাচীন ও সমকালীন চিন্তার গভীর সমালোচনায়। বিতর্ক ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষালোক বিনিময়ও ছিল সাধারণ প্রথা।
বলতে গেলে, ইসলামি শিক্ষার ওই জগৎ ছিল এক জীবন্ত, চিন্তাশীল ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করা জ্ঞানতন্ত্র—যা পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক কাঠামোর নিচে স্তরভিত্তিক, নির্জীব ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় রূপ নেয়।
তবে ইসলামি শিক্ষায় এই প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী অনানুষ্ঠানিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও, এটাও ঠিক নয় যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের পরেই এসেছে। কায়রোতে মামলুক শাসকরাই ধর্মীয় শিক্ষাকে কিছুটা আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেন—সরকারি অনুদানে পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তারা একটি শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেন। এর পেছনে ছিল মতাদর্শিক আধিপত্য কায়েমের উদ্দেশ্য। কারণ, আল-আযহার প্রাথমিকভাবে ছিল শিয়া চিন্তার একটি কেন্দ্র, এবং মামলুকরা সেটিকে সুন্নি মতবাদের অধীনে আনতে চেয়েছিল।
সরকারি অনুদান—ছাত্রদের জন্য বৃত্তি, শিক্ষকদের জন্য সম্মানী—প্রধানত শিক্ষিত শহুরে শ্রেণির কাছে পৌঁছাত, যারা ধীরে ধীরে ইসলামি জ্ঞানের উত্তরাধিকার বহনের দায়িত্ব গ্রহণ করত। তবে এই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানিকীকরণ কখনোই শিক্ষার পুরো প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে কাঠামোবদ্ধ করে ফেলেনি। বরং, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার শক্তিশালী ঐতিহ্য এক ধরনের মুক্তচিন্তা ও প্রাণবন্ততা বজায় রেখেছিল, যা একই সময়ে পশ্চিমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল।
তবুও, শিক্ষা তখন শুধু অভিজাত আলেমশ্রেণির একচ্ছত্র সম্পত্তি হয়ে ওঠেনি। অনেক স্থানীয় মানুষও মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—কেউ আজান দিতেন, কেউ জুমার খুতবা দেওয়ার জন্য ইমামের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, কেউ নবী (সা.)-এর প্রশংসায় কাসিদা পাঠ করতেন, কেউ ভাষা, লেখা শেখাতেন কিংবা লেখক হিসেবে কাজ করতেন। এ ধরনের দায়িত্ব পালন করার ফলে তারা অনেক সময় যুগের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কাছেও শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পেতেন।
তবুও, একটি চমৎকার দিক হলো—এই শিক্ষাব্যবস্থায় একটা অদ্ভুত দ্বৈততা ছিল। যেমন, ইবন আল-হাজ (মৃত্যু: ১৩৩৬ খ্রি.) তাঁর একটি গ্রন্থে সমসাময়িক আলেমশ্রেণিকে সমালোচনা করে বলেন, 'তারা নিজেদের বিলাসী পোশাকে সাধারণ জনগণকে উচ্চশিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে'।
অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন কিছু লোক থাকত, যাদের কাজ ছিল কুরআনের তিলাওয়াত করা। নির্দিষ্ট মৌসুমে হাদীসের পাঠও হতো—সুনামধন্য সংগ্রহ থেকে পাঠ করতেন তারা। এক আধুনিক গবেষক উল্লেখ করেছেন, “প্রায় প্রতিটি স্কুলেই কুরআন পাঠকদের সংগঠিত দল থাকত, যা ইঙ্গিত দেয় যে শিক্ষা ও সাধারণ ধর্মচর্চার মধ্যে সুন্দর সহাবস্থান সম্ভব হয়েছিল, কারণ এসব প্রতিষ্ঠান কেবল পাঠশালা নয়, একই সঙ্গে ইবাদতের (worship) কেন্দ্রও ছিল।”
হাদীস পাঠ ছিল এমন এক সামাজিক-ধর্মীয় অনুশীলন, যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারত। এটি এমন এক খোলা জ্ঞানচর্চার পরিসর ছিল, যেখানে ‘শিক্ষা’ ও ‘ইবাদত’-এর মধ্যে কৃত্রিম প্রাচীর ছিল না। বরং, সব মুসলিমের জন্য ছিল অংশগ্রহণের সুযোগ—উচ্চশিক্ষা যেন জীবনেরই একটি সম্প্রসারণ ছিল, বর্ণিল, ব্যস্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন গোলাবারুদের পরিবর্তে ধর্মতন্ত্রের (canons) মাধ্যমে বৈশ্বিক আধিপত্য কায়েম করতে শুরু করল, তখন ইসলামি আইনের পুনর্নির্মাণ একটি কৌশল হয়ে দাঁড়ায়—যেটি ১৯ শতক থেকে ২০ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চালু ছিল। এই কৌশল পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি অত্যন্ত সফলভাবে মুসলিম সমাজে প্রয়োগ করে, এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, এতে বহু স্থানীয় নেতা পূর্ণ সহায়তা দেন। এই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আধুনিক বিদ্যালয়ব্যবস্থা’র নামে, এবং এর ছায়া আজও বর্তমান।
১৯ শতকের শেষ নাগাদ মুসলিম বিশ্বের বহু অংশেই একটি পশ্চিমঘেঁষা সামাজিক ব্যবস্থার মৌলিক অবকাঠামো তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর বিভিন্ন শিক্ষানীতি ও তথাকথিত সংস্কারের গল্প বহু পণ্ডিত বলেছেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তনগুলো এমন এক ব্যবস্থার ক্ষতচিকিৎসা, যার গোড়াতেই ঔপনিবেশিকতা গেঁথে আছে। এই শৃঙ্খলার প্রভাব আজও অনুভবযোগ্য, যদিও ইউরোপীয় প্রভাব কিছুটা কমে এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ভার সরে গেছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে।
এই সমস্যা গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রতিফলিত হয়, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় সর্বত্রই এক প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির আরোপিত কাঠামোতে পরিচালিত হয় বা তাদের উত্তরাধিকার বহন করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই পশ্চিমঘেঁষা শিক্ষা ব্যবস্থার আজকের অবস্থা অনেক জায়গায় করুণ: অতি ভিড়, দুর্বল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও কম বেতনের শিক্ষক, পক্ষপাত, আত্মীয়প্রীতি এবং ফলহীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান—সব মিলিয়ে এক ধ্বংসপ্রায় ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে পারে, তাদের দ্রুতই টেনে নেয় পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগদাতারা, যারা তাদের জন্য বড় বড় বৃত্তি ও সম্মানজনক পদ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। ফলে মুসলিম বিশ্ব কার্যত তার নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক নেতৃত্ব ত্যাগ করে দিয়েছে—যেটি এখন পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পুনর্গঠিত বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ, নিজের করে নিয়েছে।
যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বজুড়ে আমেরিকান আধিপত্য বিস্তার করে, ফরাসি বৌদ্ধিক প্রভাবও ২০শ শতকজুড়ে বজায় ছিল। ২০শ শতকের মধ্যভাগে সাইয়্যেদ কুতুব ও অন্যান্য আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদেরা ফরাসি দার্শনিক আলেক্সি ক্যারেলের মতো চিন্তকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। তবে, এই সময়ে পশ্চিমা চিন্তা ব্যবহারে একটি মৌলিক পরিবর্তন ঘটে: এটি আর একটি সামগ্রিক দার্শনিক ব্যবস্থা হিসেবে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করার পরিবর্তে, আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদ ও কর্মীরা—যেমন মিসরের সাইয়্যেদ কুতুব (রাহি.) বা ইরানের আলী শরীয়তী (যিনি ফ্রানৎস ফ্যাননের সঙ্গে ফ্রান্সে পড়ার সময় সাক্ষাৎ করেন)—পশ্চিমা কথাবার্তাকে নিজের অস্ত্রেই আঘাত করতে শুরু করেন। এই প্রচেষ্টা ছিল একদিকে ইসলামের ভিত্তিতে একটি চিন্তা ও জীবনব্যবস্থা পুনরাবিষ্কারের, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ ও ভেঙে ফেলার একটি প্রকল্প।
এই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত অথচ ইসলাম-ভিত্তিক আন্দোলনগুলোকেই বর্তমানে আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে—সুন্নি বিশ্বে ইসলামী পুনর্জাগরণের পেছনে কুতুবের (রাহি.) ভাবনা যেমন প্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি ইরানে শিয়া দুনিয়ায় আলী শরীয়তীর চিন্তা রেখেছে গভীর ছাপ। এই ধারার চিন্তাই কিছু ক্ষেত্রে উপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙতে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করেছে; যার সবচেয়ে প্রকাশ্য উদাহরণ ইরানের ইসলামি বিপ্লব।
তবে, এখানেও একটি দ্বৈততা লক্ষণীয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ইরানের শিক্ষা ব্যবস্থা আজও মূলত সেই কাঠামোর মধ্যেই চলমান, যা পহলভি শাসনামলে গঠিত হয়েছিল—যদিও বিপ্লবের পর সেটিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ইসলামিকরণ ঘটেছে। এমনকি ইরানের সবচেয়ে স্বাধীন ও ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান—হাওযা (hawzah)—ও আধুনিকতার চাপে পড়ে এখন সমমানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সুবিধা দিচ্ছে।
এই একই গল্প আমরা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও দেখতে পাই। এবং যে উপসংহার অনিবার্যভাবে উঠে আসে তা হলো—স্কুল ও শিক্ষা এখন আধুনিক সামাজিক শৃঙ্খলার অংশে পরিণত হয়েছে। আর এই সামাজিক শৃঙ্খলা নিজেই পশ্চিমা অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত এবং ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে বিশ্বায়নের পথে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই, এই কাঠামোর মধ্যে থাকা অবস্থায় স্কুল কখনোই এর বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না; সে কেবল এই ব্যবস্থাকেই পরিবেশন করে।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরও শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ঔপনিবেশিক অবকাঠামো রয়ে গেছে। যদিও কিছু কিছু জায়গায় এটিকে কোনো না কোনো মাত্রায় ‘ইসলামায়িত’ করা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মৌলিক গঠন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়নি—যেমন সনদের প্রথা, বয়সভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস, প্রতিদিনের ও প্রতিসপ্তাহের সময়সূচি, বছরের ১০ মাস ধরে ৫ দিন করে ১২ বছর পর্যন্ত পাঠদান ইত্যাদি। এই কাঠামো অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। আজ আমরা যে শিক্ষাকে ‘ইসলামী’ আখ্যা দিচ্ছি, তার ভেতরেও মূলত সেই পুরনো, ঔপনিবেশিক ও পশ্চিমা চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোই বিদ্যমান, কেবল কিছু লোকজ আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে।
ইসলামী শিক্ষার সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিক চিন্তা-ভাবনা চলছে, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক কম। এর কারণ কোনো চিন্তার ঘাটতি নয়; বরং এটি প্রমাণ করে কতটা গভীরভাবে আধুনিক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেতনায় প্রোথিত হয়ে গেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি এক অর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন; এবং এক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে শিক্ষার লক্ষ্য হলো জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
একই সময়ে আমাদের এই কথাটাও উপলব্ধি করা জরুরি যে, পশ্চিমা ব্যবস্থাটি নিজেই এখন দারিদ্র্যপীড়িত ও অস্থির। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, পরিবেশগত বিপর্যয়, আমেরিকার নেতৃত্বে ক্রমাগত যুদ্ধকে ‘স্বাভাবিক’ করার চেষ্টা, এবং পশ্চিমা সমাজে অপরাধ ও সামাজিক অধঃপতন—সব মিলিয়ে এই ব্যবস্থা আজ নিজস্ব পতনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
মুসলমানদের জন্য—এবং অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জন্য—প্রশ্ন হলো, এই ভঙ্গুর ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে কী করা উচিত? যারা সত্যিই ভাবছেন, তাদের সামনে মূলত তিনটি পথ খোলা রয়েছে:
এক, মনে করা যে পশ্চিমা ব্যবস্থা এখনো সুস্থ ও সমৃদ্ধ, এবং তার শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত ধারণার নিচে বসবাস করে যাওয়া।
দুই,পশ্চিমা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা, তারপর অন্যদের সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে কী করতে হবে তা বের করার চেষ্টা করা
তিন, এই ব্যবস্থার পতনের আগেই তা থেকে সরে আসা, এবং এমন এক নতুন, বাস্তবসম্মত জীবনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়া যা লোভ, ভণ্ডামি ও অবিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়—এই তিনটি তো আজকের পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নতুন জীবনব্যবস্থা, যার সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু ভিন্ন রূপ অপরিহার্যভাবে জড়িত থাকবে, তা সম্ভবত গড়ে উঠবে স্থানীয় পর্যায়ে—বিভিন্ন আকারে, স্থানীয় সংস্কৃতি ও পরিবেশগত বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। এটি হবে একটি টেকসই জীবনব্যবস্থা, যা সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করবে ও মেনে চলবে; এটি হবে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্প্রদায়ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা; এবং এটি এমন একটি জীবনব্যবস্থা হবে যা বস্তুবাদী পশ্চিমা আধুনিকতার বাইরে গিয়ে অস্তিত্বকে অর্থ দান করবে।