“ইসরাইলের আগ্রাসী নীল নকশা
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ১ম পর্ব
প্রকাশকের কথা
আরব বিশ্বে ইসরাঈলী অবস্থান, আগ্রাসন, সম্প্রসারণ ও হত্যাযজ্ঞ বিভীষিকার রূপ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। মসজিদে আকসায় অগ্নিসংযোগ করে এ আগ্রাসী থাবা ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কা-মদীনার দিকে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বের দুর্বলতার সুযোগে দিনে দিনে এ অটো পাশ তার বাহু-বেষ্টনে পিষ্ট করছে শহর-বন্দর জনপদ। এর উৎসে কাজ করছে তাদের সনাতন ধর্মচেতনা এবং এ কর্মকাণ্ডে পুরো বিশ্ব- য়াহূদী সমাজ ইস্পাত- কঠিন সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত তার গতি সমস্ত অশুভ শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে প্রবল ও দুর্বার হচ্ছে।
লেখক য়াহূমূদ শীছ খাত্তাব অত্যন্ত সুন্দরভাবে য়াহূদী পরিকল্পনা, আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ, তার দার্শনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক তৎপরতার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং উম্মাহর প্রতি এ প্রেক্ষিতে তাঁর দিক নির্দেশনা এ বইয়ে তুলে ধরেছেন। সাথে সাথে তিনি মুসলমানদের তথাকথিত দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠে ঈমান, ইত্তেহাদ ও সূক্ষ্ম রণকৌশল অবলম্বন করে প্রকৃত শক্তিতে দুর্বার ও অজেয় হতে ডাক দিয়েছেন। গভীর প্রত্যয়ে দীপ্ত এই বই-এর অনুবাদ করেছেন জনাব আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব। আশা করা যায়, বাংলাভাষী পাঠক সমাজ এ থেকে পরিস্থিতি যথাযথ জানতে পারবেন এবং মিল্লাতের মজলুম অংশটির প্রতি দায়িত্ব পালনে সজাগ হতে পারবেন।
ভূমিকা
এই বইখানি মাত্র এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কায়রোতে মুদ্রিত হয়। সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের আমলে দেশের ইসলামী বিষয়ক সুপ্রিম কাউন্সিল কর্তৃক প্রথম সংস্করণে ৫,০০০ কপি মুদ্রিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণে ১১,০০০ কপি মুদ্রিত হয়, যা কায়রোর ইসলামী গবেষণা কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত হয়। দু'টি সংস্করণের সমস্ত বই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই মিসরে বিক্রি হয়ে যায়। এই অকল্পনীয় সাফল্যের জন্য আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, যাঁর অপার অনুগ্রহ ব্যতীত উহা কোন ক্রমেই হতো না।
এই বই মূলতঃ একটি গবেষণা পত্রের গ্রন্থরাপ মাত্র, যা বিগত ১৩৮৯ হিজরীর যিলহাজ মাস মুতাবিক ফেব্রুয়ারী ১৯৭০-এ কায়রোতে অনুষ্ঠিত ইসলামী গবেষণা কাউন্সিলের পঞ্চম অধিবেশনে পেশ করা হয় এবং এই গবেষণার উপর ভিত্তি করেই ইসলামী গবেষণা কাউন্সিলের উক্ত পঞ্চম অধিবেশনের প্রস্তাবসমূহ গৃহীত হয়, যে অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মুসলিম জ্ঞানী-মনীষীগণ যোগদান করেছিলেন ।
আমি এই বইয়ে আরব বিশ্বের প্রতি ইসরাঈলের সম্প্রসারণবাদী জালসার ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছি কেবল মাত্র এই ভুল ধারণা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করবার জন্য যে, ইসরাঈল অন্য আরব ভূখণ্ডে নয় বরং শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের উপরেই তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে। তাছাড়া য়াহূ দী সম্প্রসারণবাদী নীতির পশ্চাতে মতবাদগত, অর্থনৈতিক, সামরিক অথবা রাজনৈতিক দিকগুলি সম্পর্কেও আমি আলোকপাত করেছি।
উক্ত আলোচনার জন্য আমি ইসরাঈলের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া বক্তৃতা-বিবৃতি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধসমূহের অংশ বিশেষ, সরকারী প্রকাশনা ও তাদের রেডিও টেলিভিশনের প্রচারণাসমূহকে প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করেছি। উপসংহারে আমি তাদের বাস্তব কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরেছি।
এই বই পুনঃমুদ্রণের উদ্দেশ্য, যাতে এই বই শুধু আরবদের নয় বরং সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের ঘরে ঘরে পৌছে যায়।[1]
পরিশেষে আমি প্রার্থনা করি আল্লাহর নিকট যেন তিনি অধিক সংখ্যক লোককে এই বই হতে উপকার লাভের তওফিক দান করেন। আমি মহাশক্তিমান আল্লাহর নিকট সকল কৃতজ্ঞতা ও প্রণতি নিবেদন করছি এবং দরূদ পেশ করছি তাঁর শেষনবী সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবায়ে কিরামের উপর। ইতি-
কায়রো মাহমুদ শীছ খাত্তাব
৩রা জমাদিউল আউয়াল ১৩৯০ হিঃ
৬ই জুলাই ১৯৭০ ইং
কথা শুরু
যারা মনে করেন যে, ইসরাঈল একটি দুর্দৈব শক্তি। এ কেবল ফিলি- স্তিনের উপর আপতিত হয়েছে। এর লালিত আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা ফিলিস্তিনের সীমানা অতিক্রম করে অন্যের দিকে ধাবিত হবে না--তারা য়াহূদীদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। বরং বাস্তব সত্য এটাই যে, ইসরাঈলী বিষফোঁড়া আজ আরবদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও ঐতিহাসিক অস্তিত্বের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর উপর আক্রমণ ও দখল কায়েম করার জন্য ইসরাঈল বর্তমানে বস্তুগতভাবে একটি সুসজ্জিত ত্রাস ।
ইসরাঈলের ঐতিহাসিক উৎপত্তি সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে, যার মধ্যে য়াহূদীদের সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী লালসা ও ভবিষ্যত চক্রজাল পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে--আমাদেরকে ইসরাঈলী সম্প্রসারণবাদের মুখোস উম্মোচনে সাহায্য করবে এবং এর ফলে আরবরাও সজাগ হতে পারবে যে, কিভাবে তারা ভবিষ্যত ইসরাঈলী আগ্রাসন থেকে নিজেদের দেশগুলোকে রক্ষা করবে।
ইসরাঈলের প্রস্তুতি পর্বকে আমরা দু'টি পর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারিঃ
১. ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের পূর্বের সময়কাল : যখন য়াহূদীবাদ তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে ব্যাপৃত ছিল।
২. ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের পরবর্তীকাল য়াহূদীবাদী আন্দোলন একটি সাংগঠনিক কাঠামো লাভ করলো এবং উক্ত সালে সুইজারল্যান্ডের 'ব্যাল' নগরীতে অনুষ্ঠিত প্রথম য়াহূদী সম্মেলনে গৃহীত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে একটি নিয়মিত কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করলো।
২/ আরব বিশ্বে ইসরাঈলের আগ্রাসী নীলনকশা
ইসরায়েল কোহেন ( Israel Cohen ) তার 'য়াহূদীবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস' নামক বইয়ে লেখেন যে, য়াহূদীবাদী আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য হলো তাদের প্রাচীন স্বদেশ ভূমি ফিলিস্তিনকে পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে ফিরিয়ে আনা।[2]
খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে য়াহূদীবাদ বাইবেলের (The Bible) সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক থেকে বিচ্যুত হয়নি এবং বিভিন্ন উৎসবাদি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও ফিলিস্তিনে পুনরায় ফিরে যাওয়ার য়াহূদী আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরোপুরি ধর্মীয় বিশ্বাসের অংগীভূত বিষয়।
১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে সুইজারল্যাণ্ডের 'ব্যাসল' নগরীতে সর্বপ্রথম য়াহূদী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরে 'হার্জেল' তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন- 'আমি যদি ব্যাসল সম্মেলনের ফলাফল এক কথায় বলতে চাই- যদিও তা আমি প্রকাশ্য ভাবে বলতে চাই না, তবে তা হ'লো এই যে, য়াহূদী রাষ্ট্রের ভিত্তি উক্ত ব্যাসল সম্মেলনেই স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এটা এখন যদি আমি সে কথা বলি তবে পৃথিবীর লোকেরা আমাকে টিটকারী দেবে। এটা পাঁচ বছরেও হতে পারে, তবে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সুনিশ্চিত যে, আমার এই কথা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করবে। লোকদের মনে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অংকিত হয়েছে, তা অবশ্যই আমার উক্ত বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে।’[3]
ব্যাসল নগরীতে ঐ দিন কি ঘটেছিল ? কি কি মৌলিক নীতি ও প্রস্তাবসমূহ সেখানে গৃহীত হয়েছিল ?
য়াহূদীবাদের এই প্রথম সম্মেলন তাদের বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তসমূহকে একীভূত করে। যা তারা কূটনৈতিক ও কৌশলগত পথ-পরিকল্পনায় এবং এর মানবিক ও বস্তুগত অস্তিত্ব বাস্তবায়নের উপায় উদ্ভাবনে এক হয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ য়াহূদী জাতিতে পরিণত হতে পারে। উক্ত সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহে তাদের যে মূল উদ্দেশ্য বিধৃত হয়েছে, সেটি হলো য়াহূদীদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করা, যা সর্বসাধারণের গৃহীত আইন অনুযায়ী শাসিত হবে। সম্মেলন মনে করে যে, নিম্নোক্ত উপায়সমূহ তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেঃ
১. স্পষ্ট মূলনীতির অনুসরণে য়াহূদী কৃষি ও শিল্প কর্মীদের দ্বারা সমস্ত ফিলিস্তিনকে একটি কলোনীতে পরিণত করা।
২. প্রত্যেক দেশে প্রচলিত আইন-কানুনের সংগে সংগতি রেখে বিশ্ব য়াহূদী সংগঠন ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের মধ্যে বন্ধন প্রতিষ্ঠা করা।
৩. য়াহূদীদের জাতীয় অনুভূতি উন্নয়ন ও শক্তিশালী করা।
৪. নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সরকারী সম্মতি ও অনু-মোদন আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এইভাবে উক্ত সম্মেলন ঘোষণা করলো যে, য়াহূদীরা একটি সম্প্রদায়- গত ও ধর্মীয় সত্তা হিসেবে রূপ লাভ করেছে। তাই পরিপূর্ণ অর্থে একটি 'জাতি' হিসেবে তাদের একটি নিজস্ব আবাস ভূমি প্রয়োজন এবং সেটি অবশ্যই হতে হবে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিশ্রুত ভূমি- ফিলিস্তিনে’।
[1]. অনুবাদকের মূল উদ্দেশ্যও তাই, যাতে বাংলার প্রতিটি মুসলিমের ঘরে ঘরে য়াহূদীদের স্বরুপ উদঘাটিত হয়ে যায়। -- অনুবাদক।
[2] A short History of Zionism: Israel Cohen-New York 1951.
[3] Memoirs of Theodore Hertzel : Translated into English by Harry en, N. Y. 1960 (8511-2)
Comment