““আরব বিশ্বে ইসরাইলের আগ্রাসী নীল নকশা
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ২য় পর্ব
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ২য় পর্ব
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন
'ব্যাসল নগরীতে অনুষ্ঠিত প্রথম য়াহূদী সম্মেলনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই য়াহূদীরা অনেকগুলি সংস্থা ও নিশ্চিত ফলদায়ক প্রতিষ্ঠান গঠন করে। যেমন: য়াহূদী কংগ্রেস, কার্যনির্বাহী কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি, কলোনীগুলোর জন্য য়াহূদী ব্যাংক (১৮৯৮), কলোনী সম্বন্ধীয় কমিটি (১৮৯৮) এবং জাতীয় য়াহূদী ফাণ্ড (১৯০১)। এই প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কমিটিসমূহ গঠনের পিছনে মূল কারণ ছিল ফিলিস্তিনকে কলোনী বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ফাণ্ড সংগ্রহ করা, উক্ত কার্যক্রমের সংগঠন ও সমন্বয় সাধন করা এবং ব্যাসল সম্মেলনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক য়াহূদী প্রচেষ্টাকে সুসংবদ্ধ করা।[1]
সম্ভবত প্রথম দৃষ্টিতেই সকলে লক্ষ্য করে থাকবেন যে, 'হার্জেল' (Hartzel) তাঁর সমস্ত লক্ষ্যের মধ্যে একটি স্লোগানেরই অবতারণা করেছেন, যেটি তিনি স্বীয় স্মৃতিকথায় নিশ্চিত করে বলেছেন, সেটি হলো--স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কারও কোন পন্থাই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।"[2]
য়াহূদীবাদ একটি মূল নীতিতেই বিশ্বাসী। সেটি হলো The end justifies the means —অর্থাৎ লক্ষ্যই উপায় নির্ধারণ করে থাকে। অতএব নিজেদের পরিকল্পিত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে কোন কৌশল অবলম্বন করা থেকে বিরত হওয়া চলবে না- তা যতবড় নৈতিকতা বিরোধী কৌশলই সেটা হোক না কেন।
নীলনদ থেকে ইউফ্রেটিসের কিনারা পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সীমানা বলে য়াহূদীরা মনে করে থাকে। হার্জেল বলেন, “এই পরিকল্পিত সীমানা প্রতিষ্ঠার আগে অবশ্যই একটা পট পরিবর্তনের সময়কাল অতিক্রম করতে হবে, যে সময়কালের মধ্যে ফিলিস্তিন অবশ্যই য়াহূদী গভর্নর কর্তৃক শাসিত হবে এবং যখন য়াহূদী অধিবাসীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার দুই- তৃতীয়াংশ হবে, তখন এই অঞ্চলের উপর য়াহূদী আধিপত্য চেপে বসবে।”
প্যালেস্টাইনে কলোনী স্থাপন প্রকৃত প্রস্তাবে শুরু হয় ১৯০৭-১৯০৮ সালে একটি পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী য়াহূদী উদ্বাস্তুদের আগমনের সূত্র ধরে। উক্ত নীলনকশা প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন অংশে য়াহূদী কলোনী- সমূহের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্বলিত ছিল। একেই পরবর্তীকালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক তাদের নিকট স্বেচ্ছায় প্রদত্ত 'সাইক্স প্রস্তাবসমূহ' প্রত্যাখ্যানের ছুতা হিসেবে দাঁড় করানো হয়। ১৯১৫ সালে বৃটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত 'সাইকস-পিকো' গোপন চুক্তি অনুযায়ী উক্ত প্রস্তাব পেশ করা হয়। এতে প্রস্তাবিত সীমানা অনুযায়ী আপার গ্যালিলির (Upper Galilee) কলোনীসমূহ থেকে য়াহূদীদের বঞ্চিত করা হতো এবং প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক এলাকা দ্বারা য়াহূদীদেরকে তাদের স্বদেশ ভূমি জেরুজালেম ও হাইফা বন্দরের নিকটবর্তী কলোনী- সমূহ থেকে বঞ্চিত করা হত।[3]
য়াহূদী ম্যাগাজিন 'প্যালেস্টাইন' ১৯১৮ সালের ১৯শে অক্টোবর সংখ্যায় সংক্ষেপে য়াহূদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সমূহ বর্ণনা করে নিম্নভাবে- “য়াহূদী প্যালেস্টাইন অবশ্যই সমগ্র প্যালেস্টাইন নিয়েই গঠিত হবে। তার মধ্যে কোনরূপ বিভক্তি তারা কখনোই স্বীকার করবে না। ১৯১৫ সালে সম্পাদিত 'সাইকস-পিকো' চুক্তি অবশ্য এর উত্তর সীমানাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কিন্তু অবিভক্ত প্যালেস্টাইন অবশ্যই ফ্রান্স, জর্দান, গ্যালিলী এবং ভূমধ্য সাগরীয় উপকূলকে সংযুক্ত করবে।[4]
ইসরাঈলী লক্ষ্য
জর্ডানে
ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রী মেনাহিম বেগিন প্রতিটি অনুষ্ঠানে জর্ডানকে শত্রু কবলিত এলাকা' হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। বেগিন যে কথা বলেন সে কথাই তাদের স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের শেখানো হয়।
য়াহূদীদের উচ্চাভিলাষ বিশেষভাবে প্রতিভাত হয় ১৯১৭–২০ সালের মধ্যে, যখন তারা কৃষি, সেচ ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির দাবীতে আন্দোলন কেন্দ্রীভূত করলো, যাতে প্যালেস্টাইন প্রতিরক্ষা সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের উপর ইসরাঈলের কুটনৈতিক আধিপত্য নিশ্চিত করা যায়।
য়াহূদীরা ট্রান্স-জর্ডানকে তাদের স্বদেশ ভূমি প্যালেস্টাইনের সংগে সংযুক্ত করার ব্যাপারে খুব জোর দেয়। তাদের সরকারী প্রকাশনাসমূহেই একথা স্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে যখন প্যালেস্টাইনের উপর বৃটেনের সামরিক ম্যান্ডেট ঘোষিত হলো, তখন য়াহূদীদের পরিচালিত 'প্যালেস্টাইন ম্যাগাজিন, ইন্টারন্যাশনাল জিওনিস্ট রিভিউ' প্রভৃতি পত্রিকায় ট্রান্স-জর্ডানকে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরবর্তী এলাকা থেকে পৃথক করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।[5]
১৯১৯ সালের ২৮শে জুন সংখ্যা "প্যালেস্টাইন' ম্যাগাজিন ট্রান্স- জর্ডানের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করে যে, ভবিষ্যতে য়াহূদী রাষ্ট্রে প্যালেস্টাইনের জন্য অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রান্স-জর্ডানের অপরিহার্য গুরুত্ব রয়েছে। য়াহূদী প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যত সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে ট্রান্স-জর্ডানের উপর। প্যালেস্টাইন ততদিন পর্যন্ত নিরাপদ নয়, যতদিন না তা ট্রান্স-জর্ডান-এর একটি অংশে পরিণত হচ্ছে। ট্রান্স-জর্ডান হলো প্যালেস্টাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।
য়াহূদী সংস্থা কর্তৃক শান্তি সম্মেলনে (peace conference) পেশকৃত স্মারকলিপিতে জর্ডান নদীর পূর্ব তীরকে প্যালেস্টাইনের সাথে সংযুক্ত করার ব্যাপারে স্পষ্ট দাবী করা হয়। এই সংযুক্তির পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে উক্ত স্মারকলিপিতে বলা হয় যে, খৃস্টীয় প্রথম যুগে (Biblical days) জর্ডান নদীর পূর্বতীরের উর্বর ভূমি এর পশ্চিম তীরের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকদিয়ে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিল। আজকের দিনের স্বপ্ন জনসংখ্যা বিশিষ্ট ট্রান্স-জর্ডান রোমকদের শাসনামলে খুবই ঘনবসতি পূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী ছিল। অতএব বর্তমান কালের নয়া উপনিবেশ (অর্থাৎ য়াহূদী বসতি স্থাপনকারীদের) তাতে স্বাগত জানানো অধিকতর যুক্তিসংগত।
ট্রান্স-জর্ডানে কৃষি উন্নয়ন প্যালেস্টাইন ও লোহিত সাগরের মধ্যে মিলন- স্থলে পরিণত করবে এবং এর ফলে আকাবা উপসাগরে ভাল ভাল বন্দর স্থাপন করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সোলায়মানের (Days of Solomont) আমলে 'আকাবা' নগরী প্যালেস্টাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়-পথের প্রান্তসীমা ( Terminus) ছিল।
যখন রেটেন ট্রান্স জর্ডান আমীরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিল, তখন য়াহূদী আন্দোলন এর তাঁর বিরোধিতা করে এবং জর্ডানের এই নতুন অবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করে। য়াহূদী নেতাদের বিরতিতে মন্তব্য করা হয় যে, এর দ্বারা প্যালেস্টাইনকে তার দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি থেকে এক আঘাতে বঞ্চিত করা হয়েছে।
য়াহূদীরা ট্রান্স-জর্ডানে কলোনী স্থাপনে বার বার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আশা ছাড়েনি বরং উল্টা হেজাযী রেলওয়ে পর্যন্ত একটা বিরাট এলাকা প্যালেস্টাইনের সংগে জুড়ে দেওয়ার জন্য তীব্র চাপ অব্যাহত রাখে। জর্ডানের বর্তমান লোকসংখ্যার ৯৯% শতাংশ এখানেই বসবাস করে। ওয়াইজম্যান জর্ডান আমীরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে মন্তব্য করেন যে, প্যালেস্টাইনে অধিকহারে য়াহূদী বসতি স্থাপনই জর্ডানে আধিপত্য বিস্তারের উপায়।[6]
য়াহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যারা য়াহূদী নেতাদের প্রদত্ত ঘোষণাপত্র ও লিখিত স্মৃতিকথাসমূহ পড়েছেন তারা ইসরাঈলের এ বিশ্বাস অবশ্যই উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, জর্ডান নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরবর্তী এলাকা দখল করা তাদের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি নিষ্পন্ন কার্য (Fait accompli) এবং য়াহূদীরা যে কোন সুযোগে জর্ডান দখল করতে কঠিন সংকল্পবদ্ধ।[7]
[1] বিস্তারিত দেখুনঃ `Zionist-expansion aims’ : Abd –el-Wahhab el-Kayall, Beirut, 1966-24.
[2] . Hartzal’s Memoirs (1616-4)
[3] . Firscos Raanan: The Frontiers of a Nation, London 1955, p.78.
[4] . The Palestine magazine, 4th Vol. No. 11.
[5]. Palestine’ issue of 23.11.1919.
[6]. ‘Palestine’ magazine volume 5, No. 20
[7] Collected papers: The Arab. Cultural club, Beirut, p.l. See also Zionist expension aimes, p. 74-77.
আরও পড়ুন
১ম পর্ব