(১)
জাতীয় বাজেট শুধুমাত্র একটি আর্থিক দলিল নয়, এটি রাষ্ট্রের শাসননীতি এবং শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রাষ্ট্র প্রতিটি খাতে কত টাকা খরচ করবে, তা নির্ধারণ করে—যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বা অবকাঠামো। তবে, বাজেটের এই অর্থের বণ্টন কেবল কিছু সংখ্যা নয়, এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিস্তারের একটি কৌশল। এর মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের জীবনযাত্রা, চাহিদা এবং রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মিশেল ফুকো তাঁর দার্শনিক ভাবনায় বলেছে, 'ক্ষমতা শুধু আইন বা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। বরং রাষ্ট্র সামাজিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রের মাধ্যমে জনগণের মন ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।:' অর্থাৎ, সরকার তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাজেটের মাধ্যমে জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
প্রায় একইভাবে আন্তোনিও গ্রামসি হেজেমনি (শাসনব্যবস্থার সাংস্কৃতিক আধিপত্য) ধারণা দিয়েছে। গ্রামসি দেখিয়েছে, 'যে শাসক শ্রেণি শুধুমাত্র বল প্রয়োগ করেই ক্ষমতা ধরে রাখে না; তারা মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ত্ব গড়ে দেয়'। হেজেমনির অর্থ “মানসিক ও নৈতিক নেতৃত্বের” এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শাসকশ্রেণি পুরো সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই দৃষ্টিতে বাজেট বরাদ্দও একটি আইডিয়োলজিকাল হাতিয়ার: যেখানে রাষ্ট্র বিনিয়োগ বা সহযোগিতা বাড়িয়ে ধর্মীয়, ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক শাসনমূলক আদর্শ দমনের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার করে।
যখন সরকার কোনো নির্দিষ্ট খাতে, যেমন ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মসূচি বা ধর্মভিত্তিক নৈতিকতা নির্মাণে সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রমে অধিকতর অর্থ বরাদ্দ করে, তখন সেই খাতটি কেবল উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি বৃহত্তর একটি আদর্শিক কাঠামো নির্মাণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, একটি জাতির ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দিয়ে তার চারপাশে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরি করা হলে, জনগণের মধ্যে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি গড়ে ওঠে। একইভাবে, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তারে সমাজে একটি নির্দিষ্ট নৈতিক আদর্শ বা সামাজিক আচরণ কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়, যা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।
একটি বড় উদাহরণ হিসেবে ভারতের সাম্প্রতিক বাজেট নীতিকে সামনে আনা যায়। গত এক দশকে ভারত সরকার ধারাবাহিকভাবে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভারতের প্রতিরক্ষা বরাদ্দ ছিল প্রায় ₹৬.২১ লক্ষ কোটি রুপি (প্রায় ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), যা দেশটির মোট বার্ষিক বাজেট ব্যয়ের একটি বিশাল অংশ। এই বাজেট বরাদ্দ কেবল বাহ্যিক শত্রুর মোকাবিলা বা অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার প্রয়োজনে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক কৌশল হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই ধরনের নিরাপত্তা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় একটি হেজেমনিক বার্তা বহন করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে একটি নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি করে, এবং তারপর সেই ভয় নিরসনের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে নিজেকে একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে, নাগরিকরা একটি নির্ভরশীল চেতনার মধ্যে প্রবেশ করে—"আমরা নিরাপদ, কারণ রাষ্ট্র আমাদের রক্ষা করছে"। এই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী জনমনে নিজের অবস্থানকে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় করে তোলে।
ভারতের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিরাপত্তা খাতের অতিরিক্ত বরাদ্দের পেছনে 'দেশপ্রেম', 'সীমান্তরক্ষা', 'সন্ত্রাসবাদ দমন' ইত্যাদি আবেগমূলক বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়, যা একদিকে জনমনে ভয় তৈরি করে, অন্যদিকে সরকারকে 'জাতীয় রক্ষাকর্তা' হিসেবে তুলে ধরে। এই অবস্থানটি শুধু ভারতেই নয়—বিশ্বের বহু দেশেই লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে বিপুল বাজেট বরাদ্দ একটি প্রচলিত কৌশল, যার মাধ্যমে একদিকে ক্ষমতা সংহত করা হয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধী বা বিকল্প চিন্তাধারার জায়গাগুলোতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়।
একইভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বাজেটিংয়ের মাধ্যমে একটি হেজেমনিক কাঠামো নির্মাণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা অনেক সময় অভ্যন্তরীণ নয়, বরং বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। একটি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে ভারতের বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার কৌশল। ইতিহাস, ভূগোল ও অর্থনীতির ঘনিষ্ঠতা এখানে একটি নিরবচ্ছিন্ন নির্ভরতা সৃষ্টি করেছে, যেটি কখনো কূটনৈতিক সহানুভূতির আড়ালে, আবার কখনো অর্থনৈতিক চাপে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই নির্ভরতার কাঠামো টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বোধ, প্রতিরোধ ও বিশ্লেষণক্ষমতা হ্রাস করা। আর সেটি করা সম্ভব একটি কার্যকরী শিক্ষানীতি হ্রাস বা বিকৃতির মাধ্যমে। আমরা দেখতে পাই, গত এক দশকে বাংলাদেশে একাধিক ‘মেগা প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে—যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। যদিও এই প্রকল্পগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের বাহ্যিক চিত্র তৈরি করে, একইসাথে দেখা গেছে যে শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক নিচে রয়ে গেছে।
বিশ্ব ব্যাংক ও UNESCO-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, যেখানে UNESCO-এর ন্যূনতম সুপারিশ ৪-৬ শতাংশ।
আবার দেখুন, সরকার যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে—তা-ও ব্যবহার করা হচ্ছে মূলত পাঠ্যবই ছাপানোর মতো সীমিত খাতে। এর মধ্যে অধিকাংশ অর্থ খরচ হচ্ছে সরকারি স্কুলগুলোতে ফ্রিতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যেটা শুনতে চমৎকার হলেও বাস্তবে তা শিক্ষার মৌলিক গুণগত মান উন্নয়নের সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক রাখে।
এই ফ্রিতে বই বিতরণ করার ব্যবস্থাটি একদিকে যেন শিক্ষা পাওয়ার একটি ছদ্মচিত্র তৈরি করেছে। সরকার বলছে—"দেখো, আমরা তোমাদের সন্তানদের বই ফ্রিতে দিচ্ছি, শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করছি, অর্থাৎ আমরা শিক্ষাবান্ধব।" কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার ভেতরে এক ধরনের বৈধতা অর্জনের রাজনৈতিক কৌশল লুকিয়ে আছে। সরকারি বইয়ের মধ্যে এমন পাঠ্যবস্তু ঢোকানো হচ্ছে, যেগুলোর শিক্ষাগত মান প্রশ্নবিদ্ধ, এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পক্ষপাত, অসংলগ্ন তথ্য, বা প্রশ্নবিদ্ধ আদর্শ ঠাসা। ফলে শিশুরা শেখে ঠিকই, কিন্তু কী শেখে—সেই প্রশ্নটি থেকে যায় অমীমাংসিত।
বই সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু সেই বইয়ের বিষয়বস্তু কি যুক্তিভিত্তিক চিন্তা গড়ে তোলে? না কি শুধু মুখস্থনির্ভর একটি গঠনমূলক আনুগত্য তৈরি করে? প্রশ্নটা এখানেই। বই দেওয়ার প্রক্রিয়া একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রচারণার অস্ত্র ("আমরা ফ্রিতে বই দিচ্ছি"), অন্যদিকে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত জ্ঞান বিতরণ ব্যবস্থা, যা শিশুদের মধ্যে এক ধরনের স্থিরীকৃত চিন্তাধারা গড়ে তোলে।
আরেকটি বিপজ্জনক দিক হচ্ছে—এই 'ফ্রি শিক্ষা' ও 'বাধ্যতামূলক শিক্ষা'র ধারণা দিয়ে সরকার যেমন জনতার মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা করে, তেমনই এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শিক্ষাকে "ফ্রেম" করে রাখে। এই সীমার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করা, বিকল্প চিন্তা করা, বা স্বাধীনভাবে গবেষণা করা যেন হয় বিলাসিতা—যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
অন্যদিকে, জার্মান দার্শনিক ইউর্গেন হাবারমাস তাঁর “Legitimation Crisis” তত্ত্বে বলে, আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করে—যেমন করনীতি, ভর্তুকি, বা বাজেট পুনর্বণ্টন—তখন তাকে সেই হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণের আন্তঃসাংগঠনিক সম্মতি (inter-subjective consent) অর্জন করতে হয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কেবল অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, সেই পদক্ষেপের আদর্শিক গ্রহণযোগ্যতাও নিশ্চিত করতে হয়। তবে এই তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে—এই বৈধতা কি সত্যিই জনগণের কাছ থেকে আসে?
বাস্তবে, বাংলাদেশের মতো দেশে বাজেট ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে ‘জনগণের মতামত’ যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধাভোগী জোটের ভূমিকা। এই জোটের মধ্যে থাকে—শাসক দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এবং প্রভাবশালী করপোরেট ব্যবসায়ী শ্রেণি। এরা একযোগে বাজেটের কাঠামো ও ভাষা নির্ধারণ করে এমনভাবে, যা তাদের স্বার্থকে পুষ্ট করে।
বাজেটের ভাষা হয় জটিল ও অধিবিশেষিক (technocratic), যাতে সাধারণ জনগণ বুঝতেই না পারে কোথায় কীভাবে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, কিংবা কারা আসল উপকারভোগী। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বছর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়, যদিও এগুলো হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি। অথচ, তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’—যেমন সেতু, রেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র—এসব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, যেখান থেকে ব্যাপক কমিশন, লবিং, এবং লুটপাট সম্ভব হয়।
এই বৈধতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় মিডিয়া, আমলাতন্ত্র, এবং ‘কনসালট্যান্ট অর্থনীতি’র একাংশও যুক্ত থাকে। তারা সরকারপন্থী ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝায়, "দেশ এগিয়ে যাচ্ছে", অথচ শিক্ষিত বেকার, ভাঙা হাসপাতাল, ও গরিবের মৌলিক চাহিদা—সবই অবহেলিত থাকে। ফলে, রাষ্ট্রের বাজেট বাস্তবে হয়ে ওঠে বিতরণ নয়, বরং পুনঃকেন্দ্রীকরণের একটি মাধ্যম—যা ক্ষমতা ও সম্পদকে গুটিকয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত করে।
এখানে হাবারমাসের তত্ত্ব একটি মোড় নেয়। যে সম্মতি রাষ্ট্র দাবি করে, তা আর গণতান্ত্রিক সম্মতি নয়, বরং কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত বৈধতা—যা আদতে এলিট শ্রেণির দ্বারা তৈরি, প্রয়োগ ও রক্ষা করা হয়। জনগণের অংশগ্রহণ হয় কেবলমাত্র মৌখিক বা কাগজে-কলমে, নীতিনির্ধারণে নয়।
(২)
বাংলাদেশে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন আর নিছক একটি প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। এটি সরকারের ক্ষমতা সংহত করার, নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার এবং সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে পুরস্কৃত করার একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। প্রতি অর্থবছরে আমরা বাজেট ঘোষণায় যা দেখি, তা মূলত পর্দার সামনে দেখানো একটি দৃশ্যপট; প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দৃশ্যপটের আড়ালে, যেখানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ চলে।
সরকার বাজেটের মাধ্যমে জনগণের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে কখনও শুল্ক আরোপ, কখনও আবার ভর্তুকি দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নয়, এটি আচরণগত নিয়ন্ত্রণ। একজন নাগরিক কী কিনবেন, কীভাবে জীবনযাপন করবেন, কোন পেশায় যাবেন, এমনকি কোন এলাকার মানুষ কেমন জীবনযাপন করবে—এসবই বাজেট-নির্ধারিত নীতিমালার ছায়ায় নির্ধারিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, কৃষিখাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দরকার, তা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ নগর-ভিত্তিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এর ফলে শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু গ্রামের কৃষক বঞ্চিত থাকছেন। আবার কিছু কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে কর নীতিতে, যেখানে অন্যরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে এক শ্রেণি ধনী থেকে ধনবান হচ্ছে, আর অন্য শ্রেণি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।
বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষমতা থাকার কারণে সরকার এমনভাবে অর্থ বরাদ্দ করে, যাতে পছন্দের গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া যায়, আর অপ্রিয় গোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় আমরা দেখেছি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের এলাকা বা অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমে যায়, কিংবা কোনো সরকারি সেবা বিলম্বিত হয়। আবার দলীয় ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে বড় অঙ্কের কমিশন আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ত্রাণ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বাজেট নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট। দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণে দেখা যায় দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হয়। ফলে ত্রাণ প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের হাতে না পৌঁছে রাজনৈতিক কর্মী বা সমর্থকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সরকার কখন কীভাবে খাদ্য মজুত করবে, কতটুকু আমদানি করবে, কাদের কাছে রেশন কার্ড দেবে—এসব সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়, অর্থনৈতিক প্রয়োজন বা মানবিক জরুরিতায় নয়।
এই সমগ্র কাঠামোটি একটি নিরব নিপীড়নের কৌশল। নাগরিকদের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক নিরাপত্তা—সবকিছুই এমনভাবে বাজেট দ্বারা আবদ্ধ করা হচ্ছে, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নির্ভরশীল থেকে যায়, এবং রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সুতরাং, বাজেট এখন একটি কৌশলগত অস্ত্র, যা দিয়ে সরকার তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে এবং ক্ষমতাকে সাংগঠনিকভাবে টিকিয়ে রাখছে।
* নোট: প্রযুক্তির ভোগবাদ বলতে কি বুঝানো হচ্ছে?
উত্তর: সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে, যার ফলে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস আজ সহজলভ্য। কিন্তু শিক্ষাগত মননচর্চার দুর্বলতার কারণে এই প্রযুক্তি আজ জ্ঞানের বদলে ভোগের উপকরণে পরিণত হয়েছে। তরুণ সমাজ ইউটিউব, ফেসবুক রিলস বা বিনোদনমূলক কনটেন্টে মেতে উঠেছে, অথচ একই ইন্টারনেটে রয়েছে বিশাল জ্ঞানভান্ডার—মূল্যবান বই, গবেষণা, আদর্শিক ভাবনা ও হক চিন্তার পথ। প্রযুক্তি পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তার যথাযথ ব্যবহারের দিশা না থাকায় সমাজে গড়ে উঠছে এক প্রজন্ম, যারা জানে কীভাবে স্ক্রল করতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে চিন্তা করতে হয়।
জাতীয় বাজেট শুধুমাত্র একটি আর্থিক দলিল নয়, এটি রাষ্ট্রের শাসননীতি এবং শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রাষ্ট্র প্রতিটি খাতে কত টাকা খরচ করবে, তা নির্ধারণ করে—যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, বা অবকাঠামো। তবে, বাজেটের এই অর্থের বণ্টন কেবল কিছু সংখ্যা নয়, এটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা বিস্তারের একটি কৌশল। এর মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের জীবনযাত্রা, চাহিদা এবং রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মিশেল ফুকো তাঁর দার্শনিক ভাবনায় বলেছে, 'ক্ষমতা শুধু আইন বা বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। বরং রাষ্ট্র সামাজিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রের মাধ্যমে জনগণের মন ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।:' অর্থাৎ, সরকার তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাজেটের মাধ্যমে জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
প্রায় একইভাবে আন্তোনিও গ্রামসি হেজেমনি (শাসনব্যবস্থার সাংস্কৃতিক আধিপত্য) ধারণা দিয়েছে। গ্রামসি দেখিয়েছে, 'যে শাসক শ্রেণি শুধুমাত্র বল প্রয়োগ করেই ক্ষমতা ধরে রাখে না; তারা মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্ত্ব গড়ে দেয়'। হেজেমনির অর্থ “মানসিক ও নৈতিক নেতৃত্বের” এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শাসকশ্রেণি পুরো সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এই দৃষ্টিতে বাজেট বরাদ্দও একটি আইডিয়োলজিকাল হাতিয়ার: যেখানে রাষ্ট্র বিনিয়োগ বা সহযোগিতা বাড়িয়ে ধর্মীয়, ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক শাসনমূলক আদর্শ দমনের মাধ্যমে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার করে।
যখন সরকার কোনো নির্দিষ্ট খাতে, যেমন ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মসূচি বা ধর্মভিত্তিক নৈতিকতা নির্মাণে সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রমে অধিকতর অর্থ বরাদ্দ করে, তখন সেই খাতটি কেবল উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং এটি বৃহত্তর একটি আদর্শিক কাঠামো নির্মাণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, একটি জাতির ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাধান্য দিয়ে তার চারপাশে একটি সাংস্কৃতিক ঐক্য তৈরি করা হলে, জনগণের মধ্যে একটি অভিন্ন জাতীয় পরিচয়ের অনুভূতি গড়ে ওঠে। একইভাবে, ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তারে সমাজে একটি নির্দিষ্ট নৈতিক আদর্শ বা সামাজিক আচরণ কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়, যা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে।
কোন অতিরিক্ত বরাদ্দের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র একটি বার্তা দেয়—এই বিষয়টি জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। ফলে, নাগরিকরাও ধীরে ধীরে সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে আত্মস্থ করে ফেলে, যা এক পর্যায়ে হেজেমনির প্রতিষ্ঠা ঘটায়। তারা ভাবতে শুরু করে যে, এই কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিশ্বাস থেকেই উৎসারিত, যদিও বাস্তবে তা অনেক সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার একটি সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কৌশল।
সুতরাং,
রাষ্ট্রের বাজেট বরাদ্দ শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি একটি আদর্শিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও বটে, যার মাধ্যমে নাগরিকদের চেতনাকে কাঙ্ক্ষিত দিকনির্দেশনায় প্রভাবিত করা সম্ভব হয়।
এই ধরনের নিরাপত্তা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় একটি হেজেমনিক বার্তা বহন করে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের মধ্যে একটি নিরাপত্তাহীনতার বোধ সৃষ্টি করে, এবং তারপর সেই ভয় নিরসনের দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে নিজেকে একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে, নাগরিকরা একটি নির্ভরশীল চেতনার মধ্যে প্রবেশ করে—"আমরা নিরাপদ, কারণ রাষ্ট্র আমাদের রক্ষা করছে"। এই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী জনমনে নিজের অবস্থানকে স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় করে তোলে।
ভারতের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিরাপত্তা খাতের অতিরিক্ত বরাদ্দের পেছনে 'দেশপ্রেম', 'সীমান্তরক্ষা', 'সন্ত্রাসবাদ দমন' ইত্যাদি আবেগমূলক বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়, যা একদিকে জনমনে ভয় তৈরি করে, অন্যদিকে সরকারকে 'জাতীয় রক্ষাকর্তা' হিসেবে তুলে ধরে। এই অবস্থানটি শুধু ভারতেই নয়—বিশ্বের বহু দেশেই লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে বিপুল বাজেট বরাদ্দ একটি প্রচলিত কৌশল, যার মাধ্যমে একদিকে ক্ষমতা সংহত করা হয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধী বা বিকল্প চিন্তাধারার জায়গাগুলোতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়।
একইভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বাজেটিংয়ের মাধ্যমে একটি হেজেমনিক কাঠামো নির্মাণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা অনেক সময় অভ্যন্তরীণ নয়, বরং বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। একটি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ হচ্ছে ভারতের বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার কৌশল। ইতিহাস, ভূগোল ও অর্থনীতির ঘনিষ্ঠতা এখানে একটি নিরবচ্ছিন্ন নির্ভরতা সৃষ্টি করেছে, যেটি কখনো কূটনৈতিক সহানুভূতির আড়ালে, আবার কখনো অর্থনৈতিক চাপে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই নির্ভরতার কাঠামো টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো, বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বোধ, প্রতিরোধ ও বিশ্লেষণক্ষমতা হ্রাস করা। আর সেটি করা সম্ভব একটি কার্যকরী শিক্ষানীতি হ্রাস বা বিকৃতির মাধ্যমে। আমরা দেখতে পাই, গত এক দশকে বাংলাদেশে একাধিক ‘মেগা প্রজেক্ট’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে—যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি। যদিও এই প্রকল্পগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের বাহ্যিক চিত্র তৈরি করে, একইসাথে দেখা গেছে যে শিক্ষা খাতে বাজেটের পরিমাণ জিডিপির অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক নিচে রয়ে গেছে।
বিশ্ব ব্যাংক ও UNESCO-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, যেখানে UNESCO-এর ন্যূনতম সুপারিশ ৪-৬ শতাংশ।
আবার দেখুন, সরকার যেখানে শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে—তা-ও ব্যবহার করা হচ্ছে মূলত পাঠ্যবই ছাপানোর মতো সীমিত খাতে। এর মধ্যে অধিকাংশ অর্থ খরচ হচ্ছে সরকারি স্কুলগুলোতে ফ্রিতে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যেটা শুনতে চমৎকার হলেও বাস্তবে তা শিক্ষার মৌলিক গুণগত মান উন্নয়নের সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক রাখে।
এই ফ্রিতে বই বিতরণ করার ব্যবস্থাটি একদিকে যেন শিক্ষা পাওয়ার একটি ছদ্মচিত্র তৈরি করেছে। সরকার বলছে—"দেখো, আমরা তোমাদের সন্তানদের বই ফ্রিতে দিচ্ছি, শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করছি, অর্থাৎ আমরা শিক্ষাবান্ধব।" কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার ভেতরে এক ধরনের বৈধতা অর্জনের রাজনৈতিক কৌশল লুকিয়ে আছে। সরকারি বইয়ের মধ্যে এমন পাঠ্যবস্তু ঢোকানো হচ্ছে, যেগুলোর শিক্ষাগত মান প্রশ্নবিদ্ধ, এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পক্ষপাত, অসংলগ্ন তথ্য, বা প্রশ্নবিদ্ধ আদর্শ ঠাসা। ফলে শিশুরা শেখে ঠিকই, কিন্তু কী শেখে—সেই প্রশ্নটি থেকে যায় অমীমাংসিত।
বই সহজলভ্য হয়েছে, কিন্তু সেই বইয়ের বিষয়বস্তু কি যুক্তিভিত্তিক চিন্তা গড়ে তোলে? না কি শুধু মুখস্থনির্ভর একটি গঠনমূলক আনুগত্য তৈরি করে? প্রশ্নটা এখানেই। বই দেওয়ার প্রক্রিয়া একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রচারণার অস্ত্র ("আমরা ফ্রিতে বই দিচ্ছি"), অন্যদিকে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত জ্ঞান বিতরণ ব্যবস্থা, যা শিশুদের মধ্যে এক ধরনের স্থিরীকৃত চিন্তাধারা গড়ে তোলে।
আরেকটি বিপজ্জনক দিক হচ্ছে—এই 'ফ্রি শিক্ষা' ও 'বাধ্যতামূলক শিক্ষা'র ধারণা দিয়ে সরকার যেমন জনতার মধ্যে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠা করে, তেমনই এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত শিক্ষাকে "ফ্রেম" করে রাখে। এই সীমার বাইরে গিয়ে প্রশ্ন করা, বিকল্প চিন্তা করা, বা স্বাধীনভাবে গবেষণা করা যেন হয় বিলাসিতা—যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
ফলাফল?
এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা *প্রযুক্তির ভোগবাদের
* মধ্যে আছে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দুর্বল। তারা প্রশ্ন করতে শেখেনি, তারা প্রতিরোধ করতে জানে না—এবং এটাই হেজেমনির মূল সাফল্য।
একটি চিন্তাশূন্য প্রজন্ম শাসকের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ অস্ত্র।
অন্যদিকে, জার্মান দার্শনিক ইউর্গেন হাবারমাস তাঁর “Legitimation Crisis” তত্ত্বে বলে, আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করে—যেমন করনীতি, ভর্তুকি, বা বাজেট পুনর্বণ্টন—তখন তাকে সেই হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জনগণের আন্তঃসাংগঠনিক সম্মতি (inter-subjective consent) অর্জন করতে হয়। অর্থাৎ, রাষ্ট্র কেবল অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে না, সেই পদক্ষেপের আদর্শিক গ্রহণযোগ্যতাও নিশ্চিত করতে হয়। তবে এই তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে—এই বৈধতা কি সত্যিই জনগণের কাছ থেকে আসে?
বাস্তবে, বাংলাদেশের মতো দেশে বাজেট ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে ‘জনগণের মতামত’ যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি সুবিধাভোগী জোটের ভূমিকা। এই জোটের মধ্যে থাকে—শাসক দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, এবং প্রভাবশালী করপোরেট ব্যবসায়ী শ্রেণি। এরা একযোগে বাজেটের কাঠামো ও ভাষা নির্ধারণ করে এমনভাবে, যা তাদের স্বার্থকে পুষ্ট করে।
বাজেটের ভাষা হয় জটিল ও অধিবিশেষিক (technocratic), যাতে সাধারণ জনগণ বুঝতেই না পারে কোথায় কীভাবে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, কিংবা কারা আসল উপকারভোগী। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি বছর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়, যদিও এগুলো হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল ভিত্তি। অথচ, তথাকথিত ‘মেগা প্রকল্প’—যেমন সেতু, রেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র—এসব খাতে ব্যয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে, যেখান থেকে ব্যাপক কমিশন, লবিং, এবং লুটপাট সম্ভব হয়।
এই বৈধতা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় মিডিয়া, আমলাতন্ত্র, এবং ‘কনসালট্যান্ট অর্থনীতি’র একাংশও যুক্ত থাকে। তারা সরকারপন্থী ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝায়, "দেশ এগিয়ে যাচ্ছে", অথচ শিক্ষিত বেকার, ভাঙা হাসপাতাল, ও গরিবের মৌলিক চাহিদা—সবই অবহেলিত থাকে। ফলে, রাষ্ট্রের বাজেট বাস্তবে হয়ে ওঠে বিতরণ নয়, বরং পুনঃকেন্দ্রীকরণের একটি মাধ্যম—যা ক্ষমতা ও সম্পদকে গুটিকয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত করে।
এখানে হাবারমাসের তত্ত্ব একটি মোড় নেয়। যে সম্মতি রাষ্ট্র দাবি করে, তা আর গণতান্ত্রিক সম্মতি নয়, বরং কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত বৈধতা—যা আদতে এলিট শ্রেণির দ্বারা তৈরি, প্রয়োগ ও রক্ষা করা হয়। জনগণের অংশগ্রহণ হয় কেবলমাত্র মৌখিক বা কাগজে-কলমে, নীতিনির্ধারণে নয়।
(২)
বাংলাদেশে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন আর নিছক একটি প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। এটি সরকারের ক্ষমতা সংহত করার, নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার এবং সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে পুরস্কৃত করার একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। প্রতি অর্থবছরে আমরা বাজেট ঘোষণায় যা দেখি, তা মূলত পর্দার সামনে দেখানো একটি দৃশ্যপট; প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দৃশ্যপটের আড়ালে, যেখানে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ চলে।
সরকার বাজেটের মাধ্যমে জনগণের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিককে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ করে কখনও শুল্ক আরোপ, কখনও আবার ভর্তুকি দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নয়, এটি আচরণগত নিয়ন্ত্রণ। একজন নাগরিক কী কিনবেন, কীভাবে জীবনযাপন করবেন, কোন পেশায় যাবেন, এমনকি কোন এলাকার মানুষ কেমন জীবনযাপন করবে—এসবই বাজেট-নির্ধারিত নীতিমালার ছায়ায় নির্ধারিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, কৃষিখাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দরকার, তা দেওয়া হচ্ছে না। অথচ নগর-ভিত্তিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এর ফলে শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু গ্রামের কৃষক বঞ্চিত থাকছেন। আবার কিছু কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হচ্ছে কর নীতিতে, যেখানে অন্যরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে এক শ্রেণি ধনী থেকে ধনবান হচ্ছে, আর অন্য শ্রেণি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।
বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষমতা থাকার কারণে সরকার এমনভাবে অর্থ বরাদ্দ করে, যাতে পছন্দের গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া যায়, আর অপ্রিয় গোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় আমরা দেখেছি রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের এলাকা বা অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমে যায়, কিংবা কোনো সরকারি সেবা বিলম্বিত হয়। আবার দলীয় ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে মেগা প্রকল্পের দায়িত্ব দিয়ে বড় অঙ্কের কমিশন আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ত্রাণ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বাজেট নির্ধারিত নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট। দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণে দেখা যায় দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হয়। ফলে ত্রাণ প্রকৃত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের হাতে না পৌঁছে রাজনৈতিক কর্মী বা সমর্থকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। সরকার কখন কীভাবে খাদ্য মজুত করবে, কতটুকু আমদানি করবে, কাদের কাছে রেশন কার্ড দেবে—এসব সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়, অর্থনৈতিক প্রয়োজন বা মানবিক জরুরিতায় নয়।
এই সমগ্র কাঠামোটি একটি নিরব নিপীড়নের কৌশল। নাগরিকদের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক নিরাপত্তা—সবকিছুই এমনভাবে বাজেট দ্বারা আবদ্ধ করা হচ্ছে, যাতে তারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে নির্ভরশীল থেকে যায়, এবং রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন তোলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সুতরাং, বাজেট এখন একটি কৌশলগত অস্ত্র, যা দিয়ে সরকার তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে এবং ক্ষমতাকে সাংগঠনিকভাবে টিকিয়ে রাখছে।
-----***-----
* নোট: প্রযুক্তির ভোগবাদ বলতে কি বুঝানো হচ্ছে?
উত্তর: সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করেছে, যার ফলে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস আজ সহজলভ্য। কিন্তু শিক্ষাগত মননচর্চার দুর্বলতার কারণে এই প্রযুক্তি আজ জ্ঞানের বদলে ভোগের উপকরণে পরিণত হয়েছে। তরুণ সমাজ ইউটিউব, ফেসবুক রিলস বা বিনোদনমূলক কনটেন্টে মেতে উঠেছে, অথচ একই ইন্টারনেটে রয়েছে বিশাল জ্ঞানভান্ডার—মূল্যবান বই, গবেষণা, আদর্শিক ভাবনা ও হক চিন্তার পথ। প্রযুক্তি পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তার যথাযথ ব্যবহারের দিশা না থাকায় সমাজে গড়ে উঠছে এক প্রজন্ম, যারা জানে কীভাবে স্ক্রল করতে হয়, কিন্তু জানে না কীভাবে চিন্তা করতে হয়।
Comment