“আরব বিশ্বে ইসরাইলের আগ্রাসী নীল নকশা
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ৩য় পর্ব
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ৩য় পর্ব
সিরিয়ায়
১৯১৭ সালের ২৩শে জুন সংখ্যা 'প্যালেস্টাইন' ম্যাগাজিন সিরিয়ার 'হুরান' সমতল ভূমি সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ শুরু করে এইভাবে 'নতুন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য হুরানের চাইতে অধিকতর প্রভাবশালী এলাকা আর নেই।'
উক্ত প্রবন্ধে হুরান সমতল ভূমির বিরাট এলাকা নির্দেশ করা হয়েছে। দক্ষিণে যারকা, যা উত্তরদিকে রাজধানী দামেশ্ক পর্যন্ত বিস্তৃত, পশ্চিমে গৌর (Gour) অথবা জর্ডান উপত্যকা, পূর্বে তা রুমে গোলান (Joulan) মালভূমি এবং উত্তরের লাজা (Laja) আগ্নেয়গিরি সমূহ ও দক্ষিণের বাল্কা- ভূমি (Balka land) পর্যন্ত বিস্তৃত।
১৯১৮ সালের জুন সংখ্যা 'প্যালেস্টাইন' সাময়িকী প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ান এবং ওয়াইজম্যানের পরবর্তী ইসরাঈলী প্রেসিডেন্ট আইজাক বেন জিডি কর্তৃক লিখিত 'প্যালেস্টাইনের সীমানা ও এর আয়তন শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। যেখানে প্যালেস্টাইনের আয়তন হিসেবে পশ্চিমে ভূমধ্য সাগর, উত্তরে লেবানন পাহাড়, পূর্বে সিরিয়ার মরুভূমি এবং দক্ষিণে সিনাই উপদ্বীপ (Peninsula) দেখানো হয় এবং বলা হয় যে, এটাই হলো প্যালেস্টাইনের প্রাকৃতিক সীমানা। [1]
দুইজন লেখক এইভাবে য়াহুদী আন্দোলনের দাবীসমূহ বর্ণনা করেন এবং পরিশেষে উপসংহার টানেন এই বলে যে, “অন্যকথায় প্যালেস্টাইন অন্তর্ভুক্ত করতে চায় সমগ্র নাজার, জুদিয়া, সামারিয়া গ্যালিলি, হুরান জেলা, মাআনও আকাবা সহ কার্ক জেলা এবং কুনেত্রা, ওয়াদী আনজার ও হাসবিয়া সহ দামেশক জেলার একাংশ। [2]
এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, কৃষি, পানি প্রবাহ, সামরিক ও রাজ- নৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিধায় য়াহূদীরা দখল করে নিতে চায় হুরান সমতল ভূমি ও হারমন পাহাড়—যা প্যালেস্টাইনে পানি সরবরাহ করে। তারা দখল করতে চায় দামেশ্ক জেলা এমন কি দামেশ্ক মহানগরী এবং দামেশ্ক ও বর্তমান লেবানন-লিবিয়া সীমান্তের মধ্যস্থিত বিস্তৃত অঞ্চল।
প্রথম মহাযুদ্ধের পরে স্বস্তি পরিষদের নিকট পেশকৃত একটি সরকারী স্মারকলিপিতে (Official memorandum) কৃষি, সেচ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই পেড়ে য়াহূদীরা সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহ দাবী করে বসে। উক্ত স্মারকলিপি থেকে কিছু উদ্ধৃতি এখানে পেশ করা হলো :
প্যালেস্টাইনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ভর করছে সিরিয়ায় অবস্থিত পানির উৎসসমূহের উপর। এবং এটা অত্যন্ত জরুরী যে, প্যালেস্টাইন তার প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহের নিশ্চয়তা লাভ করবে যা দেশকে যথারীতি পানি সিঞ্চন করবে এবং এর সংরক্ষণাগারের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। হারমন পাহাড়, যাকে এক সময় প্যালেস্টাইনে পানির পিতা বলা হতো----দেশের অর্থনৈতিক জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া ব্যতীত কোনক্রমেই এটাকে প্যালেস্টাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এটা অবশ্যই পুরোপুরিভাবে তাদের অধিকারে থাকতে হবে- যারা এ থেকে অধিকতর সুবিধা ভোগ করে থাকে।
উপরের আলোচনায় এটা পরিষ্কার যে, ইসরাঈল তার মধ্যে শামিল করে নিতে চায় দামেশ্ক মরুভূমির পূর্বের প্রত্যন্ত সীমানা পর্যন্ত এবং দামেশ্কের দক্ষিণে সিরিয়া প্যালেস্টাইন ও সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তের মধ্যবর্তী বিস্তৃত অঞ্চল।
১৯৪৮ সালে ইসরাঈল রাষ্ট্রের জন্মলাভের বহু পূর্বে এগুলো ছিল সিরিয়ার উপরে য়াহূদীদের নম্র (modest) দাবী। আজকের দিনে তারা ইস্কান্দারুন জেলা পর্যন্ত সমগ্র সিরিয়াকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
লেবাননে
প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি যুগ থেকেই য়াহূদীদের লেবানন দখলের স্বপ্ন ছিল। এ ব্যাপারে দক্ষিণ লেবাননকে অধিক গুরুত্ব প্রদানের পিছনে দু'টি প্রধান কারণ সক্রিয় ছিলঃ
(ক) জর্ডান নদীর উৎস এবং লিতানী নদীর মূল স্রোত ও মোহনা এই এলাকায় অবস্থিত ।
(খ) ভবিষ্যত য়াহূদী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ব্যাপারে এই অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব।
এ কথা স্পষ্ট যে, এ দু'টি উদ্দেশ্যই ছিল ইসরাঈলের সর্বাবস্থার ও সকল সময়কার একমাত্র চিন্তা-ভাবনা।
১৯১৭ সালের মে সংখ্যা, 'প্যালেস্টাইন সাময়িকী'তে একটি নিবন্ধে মত প্রকাশ করা হয় যে, লেবাননের বেনিয়াস ( Banious) য়াহূদী গোত্রীয় অধিকারভুক্ত এলাকার একটি অংশ ছিল। এইভাবে য়াহূদীদের সকল প্রবন্ধ ও বিবৃতিতে দক্ষিণ লেবানন দখলের ও একে প্যালেস্টাইনের সংগে সংযুক্ত করার ব্যাপারে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়। স্বস্তি পরিষদের ( Peace Congress ) নিকট পেশকৃত তাদের একটি স্মারকলিপিতে অন্যান্য দাবীর মধ্যে দক্ষিণ লেবাননের উপর তাদের দাবীর কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
উক্ত স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে, 'প্যালেস্টাইনের সীমানাসমূহ নিম্নোক্ত সীমান্ত রেখা অনুযায়ী হ'তে হবে। যথা: উত্তরে সিডন বন্দরের সন্নিকটবর্তী ভূমধ্য সাগর থেকে লেবাননী পর্বতমালার নিম্নবর্তী কারওয়ান ব্রীজ অতঃপর 'আল-বিরাহ' পর্যন্ত, সেখান থেকে ওয়াদিউল কার্ণ এবং ওয়াদিউত্তীন-এর দুই অববাহিকার মধ্যবর্তী বিভক্তি রেখা বেয়ে দক্ষিণে মোড় নিয়ে হারমন পাহাড়ের পূর্ব ও পশ্চিমের চালুদ্বয়ের মধ্যবর্তী বিভক্তি রেখা বরাবর এগিয়ে যাবে। য়াহূদীরা তাদের এই সরকারী স্মারকলিপিতে জর্ডান ও লিতানী নদীর দুই পানির উৎসের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণলাভের বিষয়ে জোর দিয়েছে।'
য়াহূদীদের মুখপাত্র 'প্যালেস্টাইন' সাময়িকীতে ১৯৯৯ সালের ২রা নভেম্বর সংখ্যায় পরামর্শ দেওয়া হয় যে, উত্তর সীমানা সিডানের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং এই প্রাচীন নগরী সিডনকে প্যালেস্টাইন ভূমির সংগে সংযুক্ত করে নেওয়ার পরে তা বৈরুতের উপকন্ঠ পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে।
উক্ত সাময়িকীর ১৯১৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর সংখ্যায় য়াহূদী আন্দোলনের নেতারা লেবানন সম্পর্কে তাঁদের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করেন নিম্নোক্তভাবে :
মূল সত্য এটাই যে, প্যালেস্টাইন সীমান্ত এলাকায় সেচ ও পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পানির প্রবাহ কাব্জা করা একান্ত জরুরী বিষয়। সেকারণে লিতানী নদী ও জর্ডান নদীর উৎসসমূহ এবং হারমন পর্বত-মালার তুষার পিণ্ডসমূহ অবশ্য প্রয়োজন।[3]
উত্তর সীমান্ত ও এর পানি প্রবাহগুলোর ব্যাপারে একই ধরনের বক্তব্য আমরা দেখতে পাই হার্বার্ট স্যামুয়েলের চিঠিতে প্যারিস শান্তি আলোচনায় যিনি বৃটিশ প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন :
প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে এর সম্প্রসারণের উপর। যাতে দেশটি সমস্ত য়াহূদী উদ্বাস্তুদেরকে জায়গা দিতে সক্ষম হয়। সংগে সংগে উক্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে শিল্প ও কৃষি উন্নয়নের উপর। আর এই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন পানি ও পানি-বিদ্যুতের অবিরত যোগান, যা পাওয়া যেতে পারে উত্তর সীমান্তের দেশগুলো থেকে- য়াহূদী প্রস্তাব অনুযায়ী যা ভবিষ্যত প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের সংগে সংযুক্ত হবে। [4]
সীমান্ত এলাকার উপর বৃটেন ও ফ্রান্সের যৌথ ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠিত হলে য়াহূদীরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ ও বিরক্তি প্রকাশ করে এইজন্য যে, এতে তাদেরকে লিতানী নদী, আপার জর্ডান, হারমন পর্বতমালা এবং হুরান সমতল ভূমি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। লেবানন ও লিবিয়ায় য়াহূদী বসতি স্থাপনের মাধ্যমে তারা শান্তিপূর্ণ উপায়েসীমানা নির্ধারণে কিছুটা রদবদল করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ফ্রান্সের তীব্র বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। এইভাবে য়াহূদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে কিংবা পরে পানির উৎসসমূহ দখল করার ব্যাপারে তারা তাদের প্রচেষ্টাকে কখনোই হালকা করেনি। ১৯৫১ সালের মে মাসে ইসরাঈলী পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবা ইবান ঘোষণা করেন যে, আমরা আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো জর্ডান এবং তার পানির উৎসসমূহের ব্যাপারে। [5]
আমেরিকার একটি য়াহূ দী সাময়িকী বক্তব্য রাখে—ইসরাঈলীদের নিকট এ কথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, তাদের নাজাব (Nagab) এলাকা উন্নয়নের স্বপ্ন কখনই বাস্তবে রূপায়িত হবে না লিতানী নদীর পানি ব্যতীত।[6]
অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রয়োজনে ইসরাঈলী আগ্রাসী লক্ষ্যসমূহের মধ্যে লেবাননী ভূখণ্ডকে অত্যন্ত গুরুত্বের সংগে তারা বিবেচনা করে থাকে। এজন্য তাদের প্রধান লক্ষ্য দক্ষিণ লেবানন যা লেবাননের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে এবং অন্যতম লক্ষ্য জর্ডান ও প্রিতানী নদীর উৎসসমূহ দখল করা।[7]
লেবাননে য়াহূ দী আগ্রাসনের শেষ লক্ষ্য হলো রাজধানী বৈরুত শহর ও লেবাননের পাহাড় দখল করা। সঙ্গে সঙ্গে পানির উৎসের নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে রুমে এর উত্তর সীমানাসহ সমগ্র লেবানন কব্জা করা। লেবাননে ক্রমবর্ধমান য়াহূ দী তৎপরতা আরব দেশসমূহে তাদের সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষার কথা তাদের অজ্ঞাতেই প্রকাশ করে দিয়েছে।[8]
[1] `Palestine’ magazine Vol. 3 No. 17.
[2] Zionist expansion aims, p. 77-81.
[3] The Palestine Magazine, Volume 6, No. 17.
[4] The British Government documents, year 1919, Vol. 4. No- 197, article 3, p. 285.
[5] Zerusalem post paper, Issue of May 2, 1951.
[6] Middle Eastern Affairs Issue at the beginning of the year 1955.
[7] Zionist expansion aggressive aims. P. 71-97.
[8]বিগত৬ইজুন ’৮২-তেদক্ষিণলেবাননেরউপরইসরাঈলেরসর্বাত্মকআক্রমণএরপ্রকৃষ্টপ্রমাণ। - অনুবাদক
আরও পড়ুন