জাতীয় বাজেট হলো একটি দেশের সরকারের বাৎসরিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যেখানে সরকার আয় কোথা থেকে করবে এবং তা কীভাবে ব্যয় করবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেওয়া হয়। এটি শুধুমাত্র আয়-ব্যয়ের সংক্ষিপ্ত হিসাব নয়; বরং এটি একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দর্শন, নীতি, অগ্রাধিকার ও উন্নয়ন কৌশলের প্রতিফলন। একটি দেশের বাজেটের মাধ্যমে বোঝা যায়, সরকার কোন খাতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, কোন খাতে কম, এবং কোন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির উপকারে সেই বাজেট কার্যকর হবে।
এই বাজেট প্রণয়নের ধারণাটি মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্রশাসনের বিকাশমান ধারার মধ্য থেকেই এসেছে। বিশেষত ইউরোপে, ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংসদীয় ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকেই এর সূচনা ঘটে। রাজা যখন নিজ খেয়ালে জনগণের ওপর কর চাপাতেন, তখন সংসদ এই অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বলে—রাষ্ট্রের অর্থ জনগণের, সুতরাং সেই অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতাও থাকতে হবে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাজেট অনুমোদনের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা উন্নত হয় এবং একসময় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়।
এই ধারণা শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল না। ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে পশ্চিমা প্রশাসনিক কাঠামো, বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলের রাজস্ব ও বাজেট প্রণয়নের রীতিনীতি উপমহাদেশে চালু হয়। উপনিবেশের অধীন আমাদের অঞ্চলে বাজেট মূলত ছিল উপনিবেশিক সরকারের শাসনব্যবস্থার একটি হাতিয়ার, যেখানে স্থানীয় জনগণের কল্যাণ নয়, বরং উপনিবেশিক শোষণের স্বার্থে অর্থ ব্যবস্থাপনা করা হতো। তবে স্বাধীনতার পর এই কাঠামোকে পুনর্গঠন করে নতুন রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তর ঘটায়। সেই রূপান্তরে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল—পশ্চিমা কাঠামো রেখে জাতীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, যা একসময় "সূর্য না অস্ত যাওয়া সাম্রাজ্য" হিসেবে পরিচিত ছিল, প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনৈতিকভাবে চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধগুলোর ফলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো একদিকে যেমন বিপুল ঋণের বোঝায় পড়ে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তাদের বিশ্বমঞ্চে কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য করে। এই শূন্যতার সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়—অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক—সবদিক থেকেই।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেয় Brentwood Conference (1944)-এ, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্ব ব্যাংক (World Bank)। এই দুই প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার কথা বললেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনের শক্তিশালী হাতিয়ার। আর তাদের হাত ধরেই বিভিন্ন নিয়ম-নীতির সাথে রাষ্ট্র অর্থ ব্যবস্থার মাঝে প্রবেশ করে "জাতীয় বাজেট" ব্যবস্থা।
কিন্তু, আজকের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠতে পারে—যদি আন্তর্জাতিক কোনো আইন না থাকে যা একটি দেশকে বাজেট করতে বাধ্য করে, তাহলে IMF বা বিশ্ব ব্যাংক কীভাবে কার্যত পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক নীতিকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে? প্রশ্নটি যৌক্তিক, এবং এর উত্তর সরল হলেও বাস্তবতা অনেক জটিল। আন্তর্জাতিকভাবে সত্যিই এমন কোনো আইন নেই যা সরাসরি একটি রাষ্ট্রকে বলে দেয় যে তাকে জাতীয় বাজেট করতেই হবে। জাতিসংঘ, IMF বা বিশ্ব ব্যাংকের সনদপত্রগুলোতে বাজেট প্রণয়নকে আইনগত বাধ্যবাধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এই কাঠামোর বাইরে একটি বাস্তবতাও রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের ‘নরম বাধ্যবাধকতা’ বা soft coercion-এর মধ্যে পড়ে যায়।
এই বাধ্যবাধকতা আইনি নয়, বরং আর্থিক এবং কূটনৈতিক। IMF-এর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে থাকলে সেই দেশগুলিকে নিয়মিত আর্থিক তথ্য, বিশেষ করে বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আয়, ব্যয়ের কাঠামো ইত্যাদি হালনাগাদ করে সংস্থাটিকে জানাতে হয়। ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে এই প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়—তখন তাদের ‘সংস্কারমূলক বাজেট’ বা structural adjustment পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়, যেটির উপর ঋণ অনুমোদন নির্ভর করে। অর্থাৎ, বাজেট না করলেও চলে, তবে বাজেট না করলে আপনি আর্থিকভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন না। বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চিত্র দেখা যায়। তারা প্রকল্প ভিত্তিক অনুদান বা ঋণ দেয়, যার জন্য আপনাকে মিডিয়াম টার্ম এক্সপেনডিচার ফ্রেমওয়ার্কের মতো নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করতে হয়। যদি এই কাঠামো মানা না হয়, তাহলে অনুদান বা ঋণ বন্ধ হয়ে যায়। এইরূপ আচরণ কার্যত একটি অলিখিত আইন বা ‘soft law’-এর জন্ম দেয়, যেটি আইন না হয়েও আইনের মতোই শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য যেমন SDG বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নেও বাজেট অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ কোনো রাষ্ট্রকে বাধ্য করে না বাজেট করতে, কিন্তু SDG-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অর্থায়নের যে কাঠামো প্রয়োজন, তা বাজেট ছাড়া অসম্ভব। এ কারণে UNDP, UNICEF বা WHO-এর মতো সংস্থাগুলো অনেক সময় বাজেট প্রক্রিয়ায় ‘কারিগরি সহায়তা’ দিয়ে থাকে, এবং বাজেটের ভাষা ও কাঠামো তাদের পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি হয়। ফলে সরকারগুলো নিজ দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী বাজেট করতে গিয়েও আন্তর্জাতিক কাঠামোর ছাঁচে পড়তে বাধ্য হয়।
আর বাস্তব জগতের সবচেয়ে দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ আসে ঋণের শর্ত থেকে। যখন কোনো দেশ IMF বা বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ চায়, তখন সেই ঋণ সহজ শর্তে নয়। বরং বলা হয়, বাজেটে কর সংস্কার আনতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক খাতে ব্যয় সীমিত করতে হবে—এমন নানা শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ২০২৩ সালে IMF থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, কর ব্যবস্থা সংস্কার ইত্যাদি বিষয় বাজেটে যুক্ত করে। তাই দেখা যায়, সরাসরি কোনো আইন না থাকলেও রাষ্ট্রগুলো এক প্রকার 'অদৃশ্য বাধ্যবাধকতা'র আওতায় পড়ে বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এটি একটি ‘de facto obligation’, যেখানে বাস্তবতা আইনকে ছাপিয়ে যায়। আইনের চেয়ে কখনো কখনো চাপের ভাষা বেশি কার্যকর হয়, এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সেই ভাষাটিই নিপুণভাবে ব্যবহার করে থাকে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো এখন আর স্রেফ অর্থনৈতিক সহযোগিতার মঞ্চ নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা, যার কেন্দ্রে আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনৈতিক আদর্শ। তাদের তৈরি বিশ্বব্যাংক, IMF এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান আজ এক প্রকার নীতিনির্ধারক—রাষ্ট্রীয় বাজেট, আর্থিক নীতি এবং সামাজিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এখানেই আধুনিক "আর্থিক উপনিবেশ" (financial neo-colonialism)-এর সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর উপস্থিতি।
(২)
আমরা আজ সকলেই কমবেশি জানি যে ডলার কেবল একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক আধিপত্যের যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে এই মুদ্রাকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধিকাংশ, বিশেষ করে জ্বালানি, কৃষিপণ্য ও প্রযুক্তি—এসব ক্ষেত্রেই লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশ যদি তেল কিনতে চায়, খাদ্য আমদানি করতে চায়, কিংবা প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়—তাকে আগে ডলার সংগ্রহ করতে হয়। এই বাধ্যবাধকতা যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ‘মুদ্রাসাম্রাজ্যের’ কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছে, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল।
এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু অভূতপূর্ব সুবিধা দেয়। যেমন—তারা অনায়াসে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে দিতে পারে, অথচ অন্যান্য দেশ তা করলে মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই অগাধ মুদ্রা প্রবাহকে সামরিক খাতে, প্রযুক্তি উন্নয়নে এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করে। এটি এমন এক রাজনীতি, যেখানে বুদ্ধিমত্তার চেয়ে প্রভাব বেশি কার্যকর, এবং অন্য রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই নীরবে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে ডলার ব্যবহার করে একধরনের বৈশ্বিক আর্থিক আধিপত্য তৈরি করতে পেরেছে, কিন্তু শুধুমাত্র মুদ্রানীতি বা লেনদেনের মাধ্যমে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা অর্থনীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজস্ব আদায়ের উপায়, ব্যয়ের অগ্রাধিকার এবং উৎপাদন কাঠামো আলাদা। কেউ হয়তো কৃষিনির্ভর, কেউ শিল্পনির্ভর, আবার কেউ সম্পূর্ণরূপে সেবামুখী অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল।
এই বাস্তবতা পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর কাছে একধরনের “বাধা” হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা চায় একটি কেন্দ্রীয় ছাঁচ—যার ভেতরে পৃথিবীর সকল দেশকে ফেলা যাবে। তারা চায় এমন একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে তোমার পণ্য তুমি উৎপাদন করো, শ্রম তুমি দাও, কিন্তু তার দামে, মানে, রপ্তানির গন্তব্যে এবং অর্থনৈতিক নীতিতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন Nation-State পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই প্রতিটি রাষ্ট্রের সামনে সার্বভৌমত্বের এক ঝলমলে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানো হয়—তোমরা স্বাধীন, তোমরা নিজস্ব নীতিতে চলবে, তোমাদের ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতেই। এই ব্যবস্থায় আমেরিকা নিজেও জানে—কোনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সরাসরি ভেঙে দেওয়া সম্ভব নয়।
বাজেট একটি রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া—যেখানে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রতিফলিত হয়। আর আমেরিকা এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত সহযোগী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা বিশ্বজুড়ে একটি নির্দিষ্ট বাজেট কাঠামো চাপিয়ে দিয়েছে—যেখানে করনীতি থেকে শুরু করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, বরাদ্দবিন্যাস, বিনিয়োগের ধরন ও ঋণনীতির প্রতিটি অংশই নির্মিত হয়েছে তাদের স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষার হিসাব মেনে।
রাষ্ট্রগুলো হয় এই ব্যবস্থায় স্বেচ্ছায় ঢুকেছে উন্নয়নের লোভে, নয়তো বাধ্য হয়েছে বাঁচার তাগিদে। তাদের হাতে কোনো বিকল্প রাখা হয়নি। এইভাবে ‘জাতীয় বাজেট’—যা এক রাষ্ট্রের আত্মনির্ধারণের প্রতীক হওয়ার কথা ছিল—পরিণত হয়েছে এক পরাধীন চুক্তিপত্রে, যেখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে কার স্বার্থে কার স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হবে।
এই তথাকথিত ‘জাতীয় বাজেট কাঠামো’ বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে আমেরিকার হাতে দুটি বড় ক্ষমতা এসে জড়ো হয়েছে—যা তাকে গোটা বিশ্বব্যবস্থার নেপথ্য শাসকে পরিণত করেছে।
প্রথমত,
দ্বিতীয়ত,
একটি বাস্তব উদাহরণ হলো, আমেরিকা যখন দেখে যে তার শত্রু রাষ্ট্রগুলি প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, তখন তা এক ধরনের সংকেত হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকা তার অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী সংস্থাগুলির মাধ্যমে, যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, বা জাতিসংঘ—যেগুলি মূলত আমেরিকারই তৈরি সংস্থা—এই রাষ্ট্রগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই চাপের মাধ্যমে তারা শত্রু রাষ্ট্রগুলোর কাছে দাবি তোলে, তাদের বাজেটের অন্যান্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় হ্রাস করার জন্য।
এটি এমন একটি কৌশল, যা পরোক্ষভাবে শত্রু রাষ্ট্রকে নিজেদের নিরাপত্তা ও জনগণের স্বার্থ বিপর্যস্ত করতে বাধ্য করে, যেমন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের মাধ্যমে এবং আমেরিকার সরাসরি চাপের মাধ্যমে, সেই রাষ্ট্রগুলো আর্থিক সংকটে পড়ে এবং একসময় নিজস্ব জাতির জন্য অপরিহার্য খাতগুলোতেই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া, যেখানে দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তার খাত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বদলাতে বাধ্য হয়, এটি আমেরিকার 'জাতীয় বাজেট কাঠামো' নির্মাণের একটি শত্রু রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিশালী কৌশল। অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে, তারা একটি দেশের শক্তি খর্ব করতে সক্ষম হয়, যা তার রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাও হ্রাস করে।
এখানে তো আমি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতের উদাহরণ নিয়ে আসলাম, কিন্তু আমেরিকা বা পশ্চিমারা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতই নয়, বরং যে কোনো দেশের আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ—সবগুলো খাতকেই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালনা করে থাকে। তারা যে জাতীয় বাজেট কাঠামো চাপিয়ে দেয়, তা শুধু অর্থনৈতিক খাতগুলোকে নয়, একটি দেশের পুরো অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কাঠামোই আমেরিকার বা পশ্চিমাদের স্বার্থ অনুযায়ী রূপান্তরিত করে দেয়।
আরেকটি বাস্তব উদাহরণ হলো —বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশ এই খাতে বিশাল উৎপাদনক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু দাম নির্ধারণ করে ইউরোপের রিটেইলাররা। তারা বলে, “এই দামে না হলে আমরা নেব না।” এমনকি শ্রমিকদের মজুরি, কাজের পরিবেশ, কার্বন নিঃসরণ—সবকিছুতেই তারা হস্তক্ষেপ করে। অথচ লাভের বড় অংশ কেটে নেয় পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো। অর্থাৎ আপনি উৎপাদন করছেন, কিন্তু শর্ত, মানদণ্ড ও লাভের নিয়ন্ত্রণে আপনি নেই।
মোট কথা, আমি যা বলতে চাই, তা হলো—আমেরিকার এই জাতীয় বাজেট কাঠামো শুধু কোনো দেশের নীতিনির্ধারণেই সীমাবদ্ধ না, এটা ঢুকে গেছে আমাদের সবার জীবনের ভেতরে। হ্যাঁ, আপনার, আমার—আমাদের জীবনেও। আমরা নিজেরাও টের পাই না, কখন যে এই কাঠামোর শিকলে বাঁধা পড়ে গেছি।
এই বাজেট কাঠামো আমেরিকাকে শুধু অর্থনীতি নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটা দিক নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দিয়েছে। কী উৎপাদন করব, কী খাব, কোথায় বিনিয়োগ করব—সবকিছুতেই তাদের ছায়া। তারা ঠিক করে দেয়, আমরা কত টাকা বেতন পাব, বাজারে জিনিসের দাম কেমন হবে, বাসাভাড়া কেমন হবে, আমরা কোথায় থাকব, কীভাবে থাকব, একসাথে কয়জন থাকতে পারব, এমনকি আমাদের সুখে-দুঃখে হাসার সুযোগটুকুও কেমন হবে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজও মুসলিম উম্মাহ জাতীয় বাজেট কাঠামোর এই গভীর ফেতনার মাত্রা বুঝে উঠতে পারেনি। তারা এখনও ভাবছে, বাজেট মানেই শুধু সংখ্যার খেলা। অথচ পশ্চিমা আমেরিকানরাই, যারা এই কাঠামোর জন্মদাতা, তারা খুব ভালো করেই জানে—এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কতটা গভীর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিচ্ছে।
এমনকি আমেরিকার অভ্যন্তরেই এই কাঠামো নিয়ে দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। দেশটির প্রধান দুই রাজনৈতিক দল—রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিভাজনের অন্যতম বড় ইস্যু হলো করনীতি। তারা জানে, করনীতি মানেই ক্ষমতার চাবিকাঠি। আর সেই চাবি যার হাতে, তার হাতেই থাকে জনগণের ভবিষ্যৎ।
এই বাজেট প্রণয়নের ধারণাটি মূলত পশ্চিমা রাষ্ট্রশাসনের বিকাশমান ধারার মধ্য থেকেই এসেছে। বিশেষত ইউরোপে, ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংসদীয় ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকেই এর সূচনা ঘটে। রাজা যখন নিজ খেয়ালে জনগণের ওপর কর চাপাতেন, তখন সংসদ এই অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বলে—রাষ্ট্রের অর্থ জনগণের, সুতরাং সেই অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয় হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতাও থাকতে হবে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাজেট অনুমোদনের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারা। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থা উন্নত হয় এবং একসময় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়।
এই ধারণা শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল না। ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে পশ্চিমা প্রশাসনিক কাঠামো, বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলের রাজস্ব ও বাজেট প্রণয়নের রীতিনীতি উপমহাদেশে চালু হয়। উপনিবেশের অধীন আমাদের অঞ্চলে বাজেট মূলত ছিল উপনিবেশিক সরকারের শাসনব্যবস্থার একটি হাতিয়ার, যেখানে স্থানীয় জনগণের কল্যাণ নয়, বরং উপনিবেশিক শোষণের স্বার্থে অর্থ ব্যবস্থাপনা করা হতো। তবে স্বাধীনতার পর এই কাঠামোকে পুনর্গঠন করে নতুন রাষ্ট্রগুলো নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী রূপান্তর ঘটায়। সেই রূপান্তরে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল—পশ্চিমা কাঠামো রেখে জাতীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, যা একসময় "সূর্য না অস্ত যাওয়া সাম্রাজ্য" হিসেবে পরিচিত ছিল, প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় অর্থনৈতিকভাবে চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধগুলোর ফলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো একদিকে যেমন বিপুল ঋণের বোঝায় পড়ে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তাদের বিশ্বমঞ্চে কর্তৃত্ব হারাতে বাধ্য করে। এই শূন্যতার সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়—অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক—সবদিক থেকেই।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেয় Brentwood Conference (1944)-এ, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্ব ব্যাংক (World Bank)। এই দুই প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের পুনর্গঠন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার কথা বললেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরা হয়ে ওঠে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনের শক্তিশালী হাতিয়ার। আর তাদের হাত ধরেই বিভিন্ন নিয়ম-নীতির সাথে রাষ্ট্র অর্থ ব্যবস্থার মাঝে প্রবেশ করে "জাতীয় বাজেট" ব্যবস্থা।
কিন্তু, আজকের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠতে পারে—যদি আন্তর্জাতিক কোনো আইন না থাকে যা একটি দেশকে বাজেট করতে বাধ্য করে, তাহলে IMF বা বিশ্ব ব্যাংক কীভাবে কার্যত পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক নীতিকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে? প্রশ্নটি যৌক্তিক, এবং এর উত্তর সরল হলেও বাস্তবতা অনেক জটিল। আন্তর্জাতিকভাবে সত্যিই এমন কোনো আইন নেই যা সরাসরি একটি রাষ্ট্রকে বলে দেয় যে তাকে জাতীয় বাজেট করতেই হবে। জাতিসংঘ, IMF বা বিশ্ব ব্যাংকের সনদপত্রগুলোতে বাজেট প্রণয়নকে আইনগত বাধ্যবাধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু এই কাঠামোর বাইরে একটি বাস্তবতাও রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রগুলো এক ধরনের ‘নরম বাধ্যবাধকতা’ বা soft coercion-এর মধ্যে পড়ে যায়।
এই বাধ্যবাধকতা আইনি নয়, বরং আর্থিক এবং কূটনৈতিক। IMF-এর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে থাকলে সেই দেশগুলিকে নিয়মিত আর্থিক তথ্য, বিশেষ করে বাজেট ঘাটতি, রাজস্ব আয়, ব্যয়ের কাঠামো ইত্যাদি হালনাগাদ করে সংস্থাটিকে জানাতে হয়। ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে এই প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়—তখন তাদের ‘সংস্কারমূলক বাজেট’ বা structural adjustment পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়, যেটির উপর ঋণ অনুমোদন নির্ভর করে। অর্থাৎ, বাজেট না করলেও চলে, তবে বাজেট না করলে আপনি আর্থিকভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবেন না। বিশ্ব ব্যাংকের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চিত্র দেখা যায়। তারা প্রকল্প ভিত্তিক অনুদান বা ঋণ দেয়, যার জন্য আপনাকে মিডিয়াম টার্ম এক্সপেনডিচার ফ্রেমওয়ার্কের মতো নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করতে হয়। যদি এই কাঠামো মানা না হয়, তাহলে অনুদান বা ঋণ বন্ধ হয়ে যায়। এইরূপ আচরণ কার্যত একটি অলিখিত আইন বা ‘soft law’-এর জন্ম দেয়, যেটি আইন না হয়েও আইনের মতোই শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য যেমন SDG বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নেও বাজেট অপরিহার্য হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ কোনো রাষ্ট্রকে বাধ্য করে না বাজেট করতে, কিন্তু SDG-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অর্থায়নের যে কাঠামো প্রয়োজন, তা বাজেট ছাড়া অসম্ভব। এ কারণে UNDP, UNICEF বা WHO-এর মতো সংস্থাগুলো অনেক সময় বাজেট প্রক্রিয়ায় ‘কারিগরি সহায়তা’ দিয়ে থাকে, এবং বাজেটের ভাষা ও কাঠামো তাদের পরামর্শ অনুযায়ী তৈরি হয়। ফলে সরকারগুলো নিজ দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী বাজেট করতে গিয়েও আন্তর্জাতিক কাঠামোর ছাঁচে পড়তে বাধ্য হয়।
আর বাস্তব জগতের সবচেয়ে দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ আসে ঋণের শর্ত থেকে। যখন কোনো দেশ IMF বা বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ চায়, তখন সেই ঋণ সহজ শর্তে নয়। বরং বলা হয়, বাজেটে কর সংস্কার আনতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক খাতে ব্যয় সীমিত করতে হবে—এমন নানা শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ ২০২৩ সালে IMF থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য বাজেট ঘাটতি কমানো, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, কর ব্যবস্থা সংস্কার ইত্যাদি বিষয় বাজেটে যুক্ত করে। তাই দেখা যায়, সরাসরি কোনো আইন না থাকলেও রাষ্ট্রগুলো এক প্রকার 'অদৃশ্য বাধ্যবাধকতা'র আওতায় পড়ে বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। এটি একটি ‘de facto obligation’, যেখানে বাস্তবতা আইনকে ছাপিয়ে যায়। আইনের চেয়ে কখনো কখনো চাপের ভাষা বেশি কার্যকর হয়, এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সেই ভাষাটিই নিপুণভাবে ব্যবহার করে থাকে।
এই পুরো কাঠামোকে বলা যেতে পারে একটি অদৃশ্য আইনি বাস্তবতা—যেখানে আইন নেই, কিন্তু আইন থেকেও শক্তিশালী এক ধরনের বাধ্যবাধকতা বিদ্যমান।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো এখন আর স্রেফ অর্থনৈতিক সহযোগিতার মঞ্চ নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা, যার কেন্দ্রে আছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা অর্থনৈতিক আদর্শ। তাদের তৈরি বিশ্বব্যাংক, IMF এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান আজ এক প্রকার নীতিনির্ধারক—রাষ্ট্রীয় বাজেট, আর্থিক নীতি এবং সামাজিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এখানেই আধুনিক "আর্থিক উপনিবেশ" (financial neo-colonialism)-এর সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর উপস্থিতি।
এই বাস্তবতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে—
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সত্যিকারের বাজেট কতটা ‘স্বাধীন’? কতটা তা দেশীয় প্রয়োজন, সংস্কৃতি ও জনমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন?
(২)
আমরা আজ সকলেই কমবেশি জানি যে ডলার কেবল একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক আধিপত্যের যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে এই মুদ্রাকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে গোটা পৃথিবীর অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধিকাংশ, বিশেষ করে জ্বালানি, কৃষিপণ্য ও প্রযুক্তি—এসব ক্ষেত্রেই লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশ যদি তেল কিনতে চায়, খাদ্য আমদানি করতে চায়, কিংবা প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়—তাকে আগে ডলার সংগ্রহ করতে হয়। এই বাধ্যবাধকতা যুক্তরাষ্ট্রকে এমন এক ‘মুদ্রাসাম্রাজ্যের’ কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছে, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল।
এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু অভূতপূর্ব সুবিধা দেয়। যেমন—তারা অনায়াসে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাপিয়ে বাজারে ছেড়ে দিতে পারে, অথচ অন্যান্য দেশ তা করলে মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই অগাধ মুদ্রা প্রবাহকে সামরিক খাতে, প্রযুক্তি উন্নয়নে এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করে। এটি এমন এক রাজনীতি, যেখানে বুদ্ধিমত্তার চেয়ে প্রভাব বেশি কার্যকর, এবং অন্য রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই নীরবে এই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাজারে ডলার ব্যবহার করে একধরনের বৈশ্বিক আর্থিক আধিপত্য তৈরি করতে পেরেছে, কিন্তু শুধুমাত্র মুদ্রানীতি বা লেনদেনের মাধ্যমে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা অর্থনীতিকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজস্ব আদায়ের উপায়, ব্যয়ের অগ্রাধিকার এবং উৎপাদন কাঠামো আলাদা। কেউ হয়তো কৃষিনির্ভর, কেউ শিল্পনির্ভর, আবার কেউ সম্পূর্ণরূপে সেবামুখী অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল।
এই বাস্তবতা পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর কাছে একধরনের “বাধা” হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা চায় একটি কেন্দ্রীয় ছাঁচ—যার ভেতরে পৃথিবীর সকল দেশকে ফেলা যাবে। তারা চায় এমন একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে তোমার পণ্য তুমি উৎপাদন করো, শ্রম তুমি দাও, কিন্তু তার দামে, মানে, রপ্তানির গন্তব্যে এবং অর্থনৈতিক নীতিতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন Nation-State পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই প্রতিটি রাষ্ট্রের সামনে সার্বভৌমত্বের এক ঝলমলে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানো হয়—তোমরা স্বাধীন, তোমরা নিজস্ব নীতিতে চলবে, তোমাদের ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতেই। এই ব্যবস্থায় আমেরিকা নিজেও জানে—কোনো রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সরাসরি ভেঙে দেওয়া সম্ভব নয়।
আর এই জায়গাতেই আসে ‘জাতীয় বাজেট’।
বাজেট একটি রাষ্ট্রের শিরদাঁড়া—যেখানে রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রতিফলিত হয়। আর আমেরিকা এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত সহযোগী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা বিশ্বজুড়ে একটি নির্দিষ্ট বাজেট কাঠামো চাপিয়ে দিয়েছে—যেখানে করনীতি থেকে শুরু করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, বরাদ্দবিন্যাস, বিনিয়োগের ধরন ও ঋণনীতির প্রতিটি অংশই নির্মিত হয়েছে তাদের স্বার্থ ও আধিপত্য রক্ষার হিসাব মেনে।
রাষ্ট্রগুলো হয় এই ব্যবস্থায় স্বেচ্ছায় ঢুকেছে উন্নয়নের লোভে, নয়তো বাধ্য হয়েছে বাঁচার তাগিদে। তাদের হাতে কোনো বিকল্প রাখা হয়নি। এইভাবে ‘জাতীয় বাজেট’—যা এক রাষ্ট্রের আত্মনির্ধারণের প্রতীক হওয়ার কথা ছিল—পরিণত হয়েছে এক পরাধীন চুক্তিপত্রে, যেখানে প্রতিটি অনুচ্ছেদে লেখা আছে কার স্বার্থে কার স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হবে।
এই তথাকথিত ‘জাতীয় বাজেট কাঠামো’ বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে আমেরিকার হাতে দুটি বড় ক্ষমতা এসে জড়ো হয়েছে—যা তাকে গোটা বিশ্বব্যবস্থার নেপথ্য শাসকে পরিণত করেছে।
প্রথমত,
কোনো রাষ্ট্র যখনই এই বাজেট কাঠামো গ্রহণ করে, তখনই সেই রাষ্ট্র—জেনে হোক বা না জেনে—নিজের অর্থনৈতিক নীতিমালার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয় আমেরিকার হাতে। কারণ এই কাঠামো যার মাধ্যমে করনীতি থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, ব্যয়, উন্নয়ন প্রকল্প—সব কিছুতে আমেরিকা তার শর্ত ও স্বার্থ অনুসারে দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত,
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আমেরিকার হাতে একটি দাজ্জালি শক্তি চলে আসে— শত্রু জাতি বা রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাধ্যমে শোষণ বা নিয়ন্ত্রণ। যারা আমেরিকার মতাদর্শ মেনে চলে না, যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়, তাদের জন্য এই কাঠামোকে ব্যবহার করা হয় দমন ও ধ্বংসের উপায় হিসেবে।
এটি এমন একটি কৌশল, যা পরোক্ষভাবে শত্রু রাষ্ট্রকে নিজেদের নিরাপত্তা ও জনগণের স্বার্থ বিপর্যস্ত করতে বাধ্য করে, যেমন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের মাধ্যমে এবং আমেরিকার সরাসরি চাপের মাধ্যমে, সেই রাষ্ট্রগুলো আর্থিক সংকটে পড়ে এবং একসময় নিজস্ব জাতির জন্য অপরিহার্য খাতগুলোতেই কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া, যেখানে দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতি থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তার খাত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বদলাতে বাধ্য হয়, এটি আমেরিকার 'জাতীয় বাজেট কাঠামো' নির্মাণের একটি শত্রু রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিশালী কৌশল। অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করে, তারা একটি দেশের শক্তি খর্ব করতে সক্ষম হয়, যা তার রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাও হ্রাস করে।
এখানে তো আমি শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতের উদাহরণ নিয়ে আসলাম, কিন্তু আমেরিকা বা পশ্চিমারা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা খাতই নয়, বরং যে কোনো দেশের আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ—সবগুলো খাতকেই নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিচালনা করে থাকে। তারা যে জাতীয় বাজেট কাঠামো চাপিয়ে দেয়, তা শুধু অর্থনৈতিক খাতগুলোকে নয়, একটি দেশের পুরো অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কাঠামোই আমেরিকার বা পশ্চিমাদের স্বার্থ অনুযায়ী রূপান্তরিত করে দেয়।
আরেকটি বাস্তব উদাহরণ হলো —বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশ এই খাতে বিশাল উৎপাদনক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু দাম নির্ধারণ করে ইউরোপের রিটেইলাররা। তারা বলে, “এই দামে না হলে আমরা নেব না।” এমনকি শ্রমিকদের মজুরি, কাজের পরিবেশ, কার্বন নিঃসরণ—সবকিছুতেই তারা হস্তক্ষেপ করে। অথচ লাভের বড় অংশ কেটে নেয় পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো। অর্থাৎ আপনি উৎপাদন করছেন, কিন্তু শর্ত, মানদণ্ড ও লাভের নিয়ন্ত্রণে আপনি নেই।
মোট কথা, আমি যা বলতে চাই, তা হলো—আমেরিকার এই জাতীয় বাজেট কাঠামো শুধু কোনো দেশের নীতিনির্ধারণেই সীমাবদ্ধ না, এটা ঢুকে গেছে আমাদের সবার জীবনের ভেতরে। হ্যাঁ, আপনার, আমার—আমাদের জীবনেও। আমরা নিজেরাও টের পাই না, কখন যে এই কাঠামোর শিকলে বাঁধা পড়ে গেছি।
এই বাজেট কাঠামো আমেরিকাকে শুধু অর্থনীতি নয়, বরং আমাদের জীবনের প্রতিটা দিক নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দিয়েছে। কী উৎপাদন করব, কী খাব, কোথায় বিনিয়োগ করব—সবকিছুতেই তাদের ছায়া। তারা ঠিক করে দেয়, আমরা কত টাকা বেতন পাব, বাজারে জিনিসের দাম কেমন হবে, বাসাভাড়া কেমন হবে, আমরা কোথায় থাকব, কীভাবে থাকব, একসাথে কয়জন থাকতে পারব, এমনকি আমাদের সুখে-দুঃখে হাসার সুযোগটুকুও কেমন হবে।
আমরা মনে করি, এসব আমাদের নিজের সিদ্ধান্ত—কিন্তু বাস্তবে, আমেরিকার বানানো এই কাঠামোই আমাদের জীবনের রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে বসে আছে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজও মুসলিম উম্মাহ জাতীয় বাজেট কাঠামোর এই গভীর ফেতনার মাত্রা বুঝে উঠতে পারেনি। তারা এখনও ভাবছে, বাজেট মানেই শুধু সংখ্যার খেলা। অথচ পশ্চিমা আমেরিকানরাই, যারা এই কাঠামোর জন্মদাতা, তারা খুব ভালো করেই জানে—এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কতটা গভীর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিচ্ছে।
এমনকি আমেরিকার অভ্যন্তরেই এই কাঠামো নিয়ে দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। দেশটির প্রধান দুই রাজনৈতিক দল—রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বিভাজনের অন্যতম বড় ইস্যু হলো করনীতি। তারা জানে, করনীতি মানেই ক্ষমতার চাবিকাঠি। আর সেই চাবি যার হাতে, তার হাতেই থাকে জনগণের ভবিষ্যৎ।
Comment