Announcement

Collapse
No announcement yet.

শিক্ষা ব্যবস্থা (৪র্থ পর্ব): ইলম ও তারবিয়তের পথপ্রদর্শক রূপে পিতামাতার প্রস্তুতি ও ইসলামী সমাবেশের তাৎপর্য

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • শিক্ষা ব্যবস্থা (৪র্থ পর্ব): ইলম ও তারবিয়তের পথপ্রদর্শক রূপে পিতামাতার প্রস্তুতি ও ইসলামী সমাবেশের তাৎপর্য

    বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনে শিক্ষার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু এসব আলোচনার অধিকাংশই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে শিশু এবং স্কুলকে ঘিরে। ফলে, প্রাপ্তবয়স্কদের, বিশেষ করে বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শিক্ষায় ভূমিকা প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে অথবা আলোচনার মূল স্রোত থেকে বাইরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই অবহেলার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে শিক্ষার ধারণা সম্পর্কে প্রচলিত বিভ্রান্তি। অনেকেই শিক্ষা বলতে শুধু স্কুলে যাওয়া, পাঠ্যবই পড়া, কিংবা পরীক্ষায় ভালো ফল করাকেই বোঝেন। অথচ শিক্ষা একটি বিস্তৃত প্রক্রিয়া, যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির মাধ্যমে চলতে থাকে সারাজীবন।

    এই সংকীর্ণ ধারণা ভাঙার জন্য প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হলো—শিক্ষা এবং স্কুলিং বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য নির্ধারণ করা। যতক্ষণ না এই পার্থক্যটি বোঝা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণতা ও এর সামাজিক ভিত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারব না।

    (১)

    শিক্ষা মানুষের জীবনে অনেকভাবে, অনেক সময়ে ঘটে। এটা শুধু বই পড়া বা স্কুলে যাওয়া নয়—বরং একজন পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার একটি প্রক্রিয়া। এর মধ্যে জীবনের নানা রকম দক্ষতা শেখা, একটা পেশা বা কাজ শেখা, সমাজের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বোঝা, এবং নিজের ও অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ গড়ে তোলা সবই পড়ে। শিক্ষা শুধু ক্লাসরুমে নয়, পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, এমনকি একা একা চিন্তা করার মধ্যেও হয়। এটা সারা জীবন চলতে থাকে—বাচ্চা হোক বা বড়, সবাই শেখে, নিজের মতো করে।

    এই বিশাল ব্যাপারটার একটুখানি অংশ হলো স্কুলিং বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। স্কুলিং মানে হলো নির্দিষ্ট একটা জায়গায়, নির্দিষ্ট সময় ধরে, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পড়ালেখা করা। এর পেছনে কিছু নিয়ম, কাঠামো আর লক্ষ্য থাকে—যেমন ভালো চাকরি পাওয়া বা ভালো নম্বর তোলা। পরিবার বা সমাজ এখানে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারে না। স্কুলিং সাধারণত চার দেয়ালের ভেতরে ঘটে এবং অনেক সময় এর উদ্দেশ্য থাকে কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সফলতা অর্জন করা।

    মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে শিক্ষা নিচ্ছে—পরিবারের মধ্যে, অভিজ্ঞতা থেকে, ভুল করে শিখে। কিন্তু আজকে আমরা যেটাকে স্কুল বলি, সেটা আসলে গত ১৫০ বছরের মধ্যেই গড়ে উঠেছে। স্কুলিংয়ে অন্য কেউ নিয়ম বানায়, পাঠ্যসূচি ঠিক করে, এবং বলে কী শেখা উচিত। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা অনেক সময় নিজে থেকেই হয়—যেমন কারও সঙ্গে কথা বলার সময়, কোনো কাজ করতে গিয়ে, বা নিজের ভুল থেকে।

    স্কুলিং প্রায়ই মনোবিজ্ঞানের কিছু নিয়ম অনুসরণ করে, যেমন আচরণবিজ্ঞান বা কগনিটিভ থিওরি। কিন্তু শিক্ষা আরও বেশি প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিক—এতে আত্মপর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা আর ভাবনার জায়গা থাকে।

    আজকের পৃথিবীতে যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়, সেটা মূলত ইউরোপে উনিশ শতকে শুরু হয়েছিল। তখন জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠছিল, কলকারখানার যুগ শুরু হচ্ছিল, আর আধুনিক সেনাবাহিনী তৈরির দরকার পড়ছিল। এরপর আমেরিকা ও জাপান এই পদ্ধতি গ্রহণ করে, আর উপনিবেশবাদের মাধ্যমে এটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এখন পৃথিবীর যেখানেই তাকানো হোক না কেন, দেখা যাবে শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় একই রকম—কিছু জায়গায় ছোটখাটো পার্থক্য থাকলেও মূল কাঠামো একই।

    এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সরকার নিয়ন্ত্রিত এক ধরনের সমাজ তৈরি করা, যেখানে মানুষের কাজ হবে কলকারখানায় শ্রম দেওয়া আর দেশের জন্য যুদ্ধ করা। এই শিক্ষাব্যবস্থা আসলে কারখানার কাজ আর সামরিক শৃঙ্খলার মতো—সবখানেই বাইরের কোনো নিয়মে মানুষকে মাপা হয়, কর্তৃত্ব মানতে শেখানো হয়, আর ব্যক্তিকে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান—যেমন রাষ্ট্র বা কোম্পানি—এর অধীন করা হয়।

    মানে, আধুনিক স্কুলিং আসলে একধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপায় ছিল। এর মাধ্যমে ‘জাতীয় নাগরিক’ তৈরি করা হতো—যারা একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলবে, জাতীয় পতাকায় বিশ্বাস রাখবে, আর দেশের কাজে লাগবে এমন কিছু নির্ধারিত দক্ষতা শিখবে। এই ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে মা-বাবা বা স্থানীয় মানুষদের মতামত নেওয়া হয়নি; অনেক সময় তারা স্কুলে সন্তান পাঠাতে চায়নি। কিন্তু শেষমেশ স্কুল ব্যবস্থা জিতে যায়, আর এখন প্রায় সবাই তা মেনে নিয়েছে।

    (২)
    এই কথাগুলো বলার মানে এই নয় যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই—বরং ইসলামের আলোকে দেখতে গেলে স্পষ্ট হয়, শিক্ষা কেবল দুনিয়াবি দক্ষতা অর্জনের কোনো পদ্ধতির নাম নয়।

    এটা একটি আমানাহ, যার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পরিচয় অর্জন, নিজেকে সঠিক পথে পরিচালিত করা, এবং সমাজে ইনসাফ ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা।
    কিন্তু আজকের আধুনিক স্কুলব্যবস্থা, যা পাশ্চাত্য চিন্তা ও উৎপাদন-কেন্দ্রিক সমাজের ফসল, সেই উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গড়ে উঠেছে। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের কর্তব্য হলো এই ব্যবস্থাকে কেবল "ভালোভাবে সংস্কারযোগ্য" কোনো বিষয় মনে না করে, বরং তার ভিত্তি ও লক্ষ্য নিয়েই গভীর প্রশ্ন তোলা।

    আজকের বিশ্বে বিকল্প শিক্ষার কিছু ধারা গড়ে উঠেছে—যেমন হোমস্কুলিং বা আনস্কুলিং। যদিও এগুলো আধুনিক স্কুলের প্রতি একধরনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে, কিন্তু অনেক সময় তারাও মূলত সেই একই কাঠামোর মধ্যে আটকে থাকে—যেখানে মানুষকে সফল হতে হলে অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট মানদণ্ডে ‘যোগ্য’ হতে হবে। অর্থাৎ, পাঠ্যক্রম হয়তো বদলেছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি। ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো শিক্ষাব্যবস্থা এই চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করে, কারণ ইসলাম শিক্ষা বোঝে তাযকিয়া ও তাকওয়ার প্রসারণ হিসেবে, যেখানে অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, চরিত্র গঠিত হয়, এবং মানুষ আল্লাহর পথে জীবনযাপন করতে শিখে।

    কিন্তু আজ যেসব স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, সমাজের জীবন্ত বাস্তবতা থেকে আলাদা। তারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে শিক্ষার্থীকে একধরনের পণ্য বা ‘মানবসম্পদ’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। তাদের কাছে শেখার মানে—চাকরি পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি, আর সফলতার মানে—ভোগবাদী সমাজে স্থান করে নেওয়া। অথচ কুরআন বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ দুনিয়ায় এসেছে ‘খলিফা’ হিসেবে, আল্লাহর আইন ও ন্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করতে। শিক্ষা সেই বড় দায়িত্বের প্রস্তুতির মাধ্যম।

    আজকের বাবা-মা, বিশেষত মুসলিম পরিবারগুলো, অনেক সময় নিজেরাও এই দুনিয়াবি দৌড়ে ব্যস্ত। তারা হয়তো নিজের উন্নয়নের জন্য সন্তানকে দিনের একটি বড় সময় স্কুলে দিয়ে আসেন, এই ভেবে যে, তবেই সন্তান ‘মানুষ’ হবে। তারা ভাবেন না—এই ব্যবস্থাটি তাদের সন্তানকে কী ধরনের মানুষে পরিণত করছে, তার অন্তর, তার আখিরাত, তার আচার-আচরণ কেমনভাবে গড়ে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ স্কুলব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে, শিক্ষক বা সহকারী হিসেবে, সেটিকে সমর্থনও করে ফেলছেন—অবচেতনে বা প্রথাগত চিন্তার ফলেই হোক না কেন।

    এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ কেউ স্কুল ত্যাগ করছেন, বা নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করছেন—কিন্তু এসব চেষ্টার মাঝেও ইসলামী চিন্তা অনেক সময় অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। অথচ আমাদের উচিত, শিক্ষার মূল ধারণাটিকে পুনরায় আল্লাহর রিসালাহর আলোকে ভাবা।
    কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,

    ... وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ مَخۡرَجًا ۙ﴿۲﴾ وَّ یَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَكَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمۡرِهٖ ؕ ...
    “... আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। ...”
    (সূরা আত-ত্বালাক; ৬৫:২-৩)।

    তাই আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত তাদের মধ্যে এই তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল গড়ে তোলা—যা কোনো স্কুল বা পাঠ্যক্রম একাই দিতে পারে না।

    সুতরাং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু হয় পরিবারে—যেখানে বাবা-মা শুধু তত্ত্বাবধায়ক নন, বরং প্রথম শিক্ষক, মুরব্বি, এবং আদর্শ। এই দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের নিজস্ব চিন্তা, আত্মসমালোচনার ক্ষমতা ও আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা থাকতে হয়।

    আর এই চিন্তাকে বাস্তবতায় রূপ দিতে হলে, বাবা-মাকে, পরিবারকে এবং আমাদের কমিউনিটিকে কিছু গভীর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে:
    • একজন ‘শিক্ষিত’ মানুষ বলতে আমরা কী বুঝি—এই সংজ্ঞা কি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নির্ধারিত হচ্ছে, নাকি পাশ্চাত্য মূল্যবোধ দিয়ে?
    • জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত?
    • আমার সন্তান কী শিখছে, কেন শিখছে, কাদের জন্য শিখছে?
    • আমাদের সন্তানেরা কীভাবে জানবে যে তারা সফল, বা আল্লাহর পথে আছে?
    • আমার দায়িত্ব কী আমার সন্তান, আমার উম্মাহ, এবং এই জমিন ও জীবজগতের প্রতি?
    • আজকের আধুনিক স্কুলিংয়ের কাঠামো কি আমাদের ঈমান, তাকওয়া ও আখিরাতমুখী জীবনের পথে সাহায্য করছে, না বাধা দিচ্ছে?
    • যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়, তাহলে তার দিকে নিয়ে যাওয়ার শিক্ষা আমরা কোথা থেকে নিচ্ছি?

    এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করাই হতে পারে একটি নতুন ধারা, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা—যেখানে ‘স্কুল’ নয়, বরং ‘তালিম’ ও ‘তারবিয়াহ’ হবে আমাদের সন্তানদের জীবনের প্রকৃত পথপ্রদর্শক।

    যদি পরিবারগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়, নিজেদের মধ্যে একটি ‘ইলমি মিলনমেলা’ তৈরি করে, যেখানে দ্বীনি জ্ঞান, জীবনের অভিজ্ঞতা, ও সমাজ গঠনের চিন্তা শেয়ার করা হয়—তাহলে সেটিই হয়ে উঠতে পারে শিক্ষার প্রকৃত বিকল্প। এটি কেবল বিকল্প নয়, বরং একটি প্রস্তাবিত রূপান্তর, যা শিক্ষাকে ফিরিয়ে নিতে পারে তার আসল উদ্দেশ্যের দিকে।

    স্কুল হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু আমাদের সন্তানদের হৃদয় ও অন্তর—সেগুলো গড়ে উঠবে কী দিয়ে? এই প্রশ্নই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি এই প্রশ্নগুলোকে স্বাভাবিক মনে না করি, যদি এটিকে ঘরোয়া আলাপ বা মসজিদের আলোচনায় স্থান দিই, তাহলে শিক্ষা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় নয়—জীবনেরই কেন্দ্র হয়ে উঠবে।

    আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন, যেন আমরা আমাদের সন্তানদের এমন একটি শিক্ষার পথ দেখাতে পারি, যা তাদের দুনিয়ায় সম্মান ও আখিরাতে মুক্তি এনে দেয়।

    (৩)
    শুধু প্রশ্ন করা বা শিক্ষার অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করাই যথেষ্ট নয়। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা জানি—প্রকৃত শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যা মানুষকে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত করে, তার দায়িত্ব ও খিলাফতের বোঝা বুঝতে শেখায়, এবং নিজেকে ও সমাজকে সংশোধনের পথে পরিচালিত করে। সুতরাং বাবা-মায়েরা চাইলে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন—তারা সময় বের করে অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে মিলে একত্রিত হতে পারেন এক ধরনের 'শিক্ষার মিলনমেলায়'। এই উদ্যোগ হতে পারে একটি ‘ইসলামী তালীমি গ্যাদারিং’—যা কেবল জ্ঞান অর্জনের নয়, বরং তাযকিয়া, ইলম, আমল ও উম্মাহর ভবিষ্যৎ গঠনের এক প্ল্যাটফর্ম।

    এই ধরনের মিলনমেলায় পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের অভিজ্ঞতা ও জীবন-দৃষ্টিভঙ্গি ভাগাভাগি করতে পারেন—যেমন সাহাবায়ে কেরাম একে অন্যের সাথে বসে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছ থেকে শোনা হাদীস, কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ও বাস্তব জীবনে দ্বীনের প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করতেন। তারা একত্রে সময় কাটাতে পারেন এমনসব কাজে, যা জীবনের গভীর তাৎপর্য বহন করে—যেমন সীরাহ চর্চা, কুরআন তিলাওয়াত ও তার মর্ম অনুধাবন, দুআ ও যিকির, ইসলামী নীতি অনুযায়ী জীবন যাপন, মুমিনদের বৈশিষ্ট্য, বা এমন কিছু যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করা যায়।

    এই ‘ইসলামী লার্নিং গ্যাদারিং’-এ তাওহীদ, আমানাহ, ইনসাফ, শুরা ও উম্মাহভিত্তিক চিন্তা—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ হতে পারে। এগুলো পরিবার ও সমাজের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমান সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা, সরকার ও কর্পোরেট কাঠামো সাধারণত এড়িয়ে চলে। এমন এক পরিসর গড়ে ওঠে, যেখানে যারা আধুনিক জীবনব্যবস্থার অন্ধ অনুকরণে বিশ্বাসী নন, তারা একে অন্যের সঙ্গে পরামর্শ ও পরিপূরক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন। যারা তথাকথিত “উন্নয়ন” ও “সাফল্য” এর প্রচলিত ধারণার বাইরে নতুন পথ খুঁজছেন, তাদের জন্য এটি হতে পারে সাহচর্যের এক নিরাপদ ক্ষেত্র।

    এখানে মানুষ নিজেদের জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। সন্তানদের শুধু দুনিয়াবি সফলতার দিকে নয়, বরং আখিরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলার জন্য প্রয়োজনীয় জীবন্ত শিক্ষা দিতে পারে। এভাবে শিশুরাও জীবনের শুরুর দিক থেকেই বুঝতে শিখবে—শিক্ষা কেবল চাকরি পাওয়ার হাতিয়ার নয়, বরং একটি আমানত; জ্ঞান শুধু জানার জন্য নয়, বরং প্রয়োগের ও সমাজ গঠনের জন্য; এবং সফলতা শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং একটি উম্মাহর দায়িত্বে অংশগ্রহণ।
    স্কুল বা কলেজ বা বিনোদনশিল্প যেভাবে “ভোগ্য অভিজ্ঞতা” তৈরি করে দেয়, এর বাইরে এসে এমন এক ‘জীবন-ভিত্তিক’ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে মানুষ নিজের মতো করে শিক্ষা অর্জন করতে পারে, নিজের পথ নিজেই চিনে নিতে পারে। আল্লাহ কুরআনে বলেন—
    ... قُلۡ هَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ ...
    অর্থ: “... বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না, তারা কি সমান? ...”
    (সূরা যুমার; ৩৯:৯)।

    এই আয়াত থেকেই প্রতীয়মান হয়, জ্ঞান এমন একটি বস্তু, যা কেবল উপস্থাপনযোগ্য তথ্য নয়, বরং মানুষকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে সহায়তা করে।

    এই মিলনমেলায় প্রশ্ন উঠতে পারে—আমাদের কমিউনিটিতে কী কী আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা প্রদত্ত প্রতিভা ও সম্পদ আছে যা ইলম অর্জনের নতুন দরজা খুলে দিতে পারে? পরিবারগুলো কীভাবে নিজেদের সন্তানদের শেখার পথ তৈরি করছে, সেই অভিজ্ঞতা একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে? তারা কীভাবে সন্তানদের আগ্রহ, মেধা ও দ্বীনী গুণাবলি চিহ্নিত করে ও লালন করছে?

    এই 'গ্যাদারিং' প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে একটি সংলাপ গড়ে তোলে, যা আমাদের সালাফদের চর্চার অনুসরণ। তারা কখনো শিক্ষাকে আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠানে বন্দি করেননি—বরং মসজিদ, বাড়ি, সফর—যেখানেই সুযোগ হয়েছে, জ্ঞান চর্চা করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাবা-মায়েরা কেবল অভিভাবক নন, বরং হবেন ‘মুরব্বি’—যাঁদের মাধ্যমে সন্তানরা দ্বীন ও দুনিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করে।

    এমন মিলনমেলা আমাদের অন্তরের দুশ্চিন্তা, দ্বিধা, এবং সমাজবিচ্ছিন্নতার অনুভূতিরও নিরাময় দিতে পারে। বিশেষ করে যারা আধুনিক স্কুলিং-এর বাইরে বের হওয়ার সাহস করছেন, তাদের জন্য এই পরিবেশ হতে পারে উৎসাহ, দিকনির্দেশনা ও আত্মবিশ্বাস তৈরির একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।

    এই রকম শিক্ষার পরিবেশে মানুষ জীবনের গভীর অর্থ অন্বেষণ করতে পারে, আল্লাহর বান্দা হিসেবে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করতে পারে। এটি বাবা-মায়েদের জন্য কেবল একটি নতুন দায়িত্ব নয়, বরং নবী সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ অনুসরণে নিজেদের গড়ে তোলার একটি মোবারক সুযোগ। পরিবার-ভিত্তিক এই রকম শিক্ষাব্যবস্থা হতে পারে উম্মাহর পুনর্জাগরণের একটি প্রাথমিক ধাপ—যা আমাদের আবার সেই সভ্যতার দিকে ফিরিয়ে নিতে পারে, যেখানে জ্ঞান ও ইখলাস একে অন্যের পরিপূরক ছিল।

    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    উন্মুক্ত ইসলামী গ্রন্থাগার

    শিক্ষার উপর গড়ে উঠে মানুষের মেধা মস্তিষ্ক। তাই শিক্ষা যাতে সঠিক শিক্ষা হয় তার প্রতি আমাদের খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আফসোস ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে — এ সমাজ ও রাষ্ট্র তার জন্ম লগ্ন থেকেই সঠিক ও আদর্শ শিক্ষা চিনতে ভুল করেছে। ফলে তারা যেমন বিভ্রান্ত হয়েছে, তেমন জনগণ তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে।

    এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আল্লাহ যাদেরকে হক চেনার তাওফীক দিয়েছেন, তাদের উদ্দেশে ব্যথাভরা হৃদয়ে দরদের সাথে আরজ করছি— আপনারা নিজেদের পাড়ায় পাড়ায় মাসজিদ ভিত্তিক উন্মুক্ত ইসলামী গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা শুরু করুন। এবং মাসজিদগুলো যেন সর্বাদা নামাযী ও আল্লাহর সালিহ বানদাদের জন্য খোলা থাকে, তার প্রতি জোরদার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মাসজিদের বিশেষ বিশেষ সামানাগুলোর জন্য আলাদা আলাদা প্রোটেকশনের ব্যবস্থা রাখুন। তবুও মাসজিদ খুলে রাখার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করুন।

    উন্মুক্ত ইসলামী গ্রন্থাগারগুলো সঠিক আকীদা মানহাজ লালনকারী ভাইদের বই, ফাতওয়া এবং গাযওয়াহ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিভিন্ন বই দিয়ে সাজান।

    নারীদের জন্য বই নিয়ে পড়ার বিশেষ ব্যবস্থা রাখুন। এবং এ সংগঠন থেকেই প্রতি মাসে বা বছরে একবার হলেও ইসলামী সাহিত্য সেমিনারের আয়োজন করুন। যেখানের মূল ফোকাস থাকবে শিশু ও তরুণদের উপর।

    এভাবে যদি উন্মুক্ত ইসলামী বই অধ্যয়নের পাঠশালা প্রতি মহল্লায় গড়ে উঠে, তাহলে আশা করা যায়, মানুষ হকের রাস্তা খুঁজে পাবে। তরুণদের অবসর সময়গুলো নষ্ট না হয়ে আল্লাহ এবং তার রসূলের মিশন জানার উপায় হবে।

    হে আল্লাহ! আপনি তাওফীক দাতা। আপনি আমাদের এ ভূমিতে তোমার হুকম বাস্তবায়ন করা শক্তি দাও। আমীন।

    Comment


    • #3
      afif amiri ভাই,

      আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ,
      মাশাল্লাহ ভাই, আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট তুলে ধরেছেন।
      ​​​​​​
      হাসিনা সরকার বুঝেছিল —ইসলামকে চাইলেই সমাজ থেকে মুছে ফেলা যাবে না। তাই তারা চেষ্টা করেছে এটিকে ভেতর থেকে পাল্টে দিতে, এমন এক ইসলামে রূপান্তর করতে যেটা “পালিশ করা”, “নিরীহ”, “রাষ্ট্র-বান্ধব”। আর এই প্রকল্পে তারা মসজিদকে বানিয়েছে “মডেল”, মাদ্রাসাকে দিয়েছে “সার্টিফিকেট” এবং সব কিছুকে এনেছে নিয়ন্ত্রণের ছাতার নিচে। যে ইসলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যে ইসলাম উম্মাহর নেতৃত্বের দাবি করে, যে ইসলাম অর্থনীতিতে সুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে—সেই ইসলাম যেন না থাকে। থাকে কেবল খুশি খুশি দোয়া, নিস্তরঙ্গ খুতবা, নিয়ন্ত্রিত ইবাদত।

      এভাবে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা আজ খাঁচাবন্দী। মডেল মসজিদের দৃষ্টান্তে দেখা গেছে, খতিবদের নিয়োগ এসেছে কেন্দ্রীয়ভাবে, খুতবার বিষয়বস্তু নির্ধারিত, সরকারের অনুমোদন ছাড়া সমাজ নিয়ে আলোচনা করা নিষিদ্ধ। এগুলো কেবল স্থাপত্যের মডেল নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট চিন্তা-প্রণালীর মডেল—যেখানে ইসলাম থাকবে, কিন্তু তার কণ্ঠ থাকবে রুদ্ধ।

      কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির ঘটনাও একই ধাঁচে—একদিকে মুসলমানদের কাছে ‘অর্জন’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল এক দীর্ঘমেয়াদী 'সহনশীলতার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ' নীতি। পাঠ্যক্রমে আসছে আধুনিকতা নামের মোড়কে পশ্চিমা ভাবাদর্শ, রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে হক্ব কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলছে বহু প্রতিষ্ঠান। ইসলামের ‘সিস্টেমিক’ দিকগুলো—রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রচিন্তা—এসব এখনো পাঠ্যক্রমের বাইরে বা শুধুই তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ।

      এমন সময়েই প্রশ্ন ওঠে: আমরা কি কেবল এই চক্রান্ত চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হব, নাকি আমরা বিকল্প গড়ার সাহস দেখাব?

      আমাদের মক্তবগুলো হতে পারত এমন এক জায়গা, যেখানে কেবল নাযেরা শেখানো হতো না—বরং ছোট ছোট হৃদয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হতো আত্মমর্যাদা, তাকওয়া, সত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং বাতিলের প্রতি ঘৃণা। আমাদের মসজিদগুলো হতে পারত এমন প্ল্যাটফর্ম, যেখান থেকে সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ উঠত, যেখানে খুতবা হতো জনতার ঈমান জাগানিয়া জ্বালাময়ী চেতনায় পূর্ণ। আমাদের মাদ্রাসাগুলো হতে পারত এমন ঘাঁটি, যেখান থেকে শুধু হাদীস বিশারদ নয়—রাষ্ট্রচিন্তায় পারদর্শী, অর্থনীতির ইসলামি বিকল্প নির্মাতা, সমাজের দিকনির্দেশক নেতারা বেরিয়ে আসত।

      বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যখন প্যালেস্টাইন থেকে কাশ্মির, সুদান থেকে আরাকান—সর্বত্র উম্মাহ জুলুমের শিকার, তখন মুসলমানদের জন্য একটি নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক জাগরণ অপরিহার্য। এবং সেই জাগরণ শুরু হতে পারে আমাদের মক্তব-মসজিদ-মাদ্রাসা থেকেই। হাসিনা সরকার যদি কোটি টাকা খরচ করে 'কন্ট্রোল্ড ইসলাম' বানাতে পারে, তবে ঈমানদাররা কেন চেষ্টা করবে না 'রিভাইভড ইসলাম' গড়ে তুলতে?

      এটা আমাদের কাছে কেবল একটা সম্ভাবনা নয়, বরং ঈমানের দাবি। ইতিহাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নির্যাতিত অবস্থায় ছিলেন, তখন তিনি দারুল আরকামে বসে নেতৃত্ব তৈরির কাজ করেছেন। আমাদেরও দরকার সেই দারুল আরকামগুলোর—যা আজ মক্তবের আকারে, মসজিদের চত্বরে, মাদ্রাসার ক্লাসরুমে ছড়িয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কি সেই জায়গাগুলোকে হক্বের ঘাঁটিতে রূপান্তর করতে প্রস্তুত?
      فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

      Comment


      • #4
        Ibnul Irfan ভাই ,

        আপনার জন্যও আল্লাহর কাছে দুআ করি। আল্লাহ আপনার লেখায় উত্তরোত্তর বারাকাহ দান করুন। সত্যি কথা বলতে, আমি ইদানিং ফোরামে আসি বিশেষত আপনার লেখা পড়ার জন্য।

        জাযাকাল্লাহ

        Comment


        • #5
          সম্মানিত afif amiri ভাই,
          সকল প্রশংসা ও সম্মাণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা জন্য। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন।
          আল্লাহর কাছে বিশেষ করে দো'আ করবেন তিনি আমাকে আমার ভাইদের ও শত্রুদের সামনে অপমানিত না করেন। আমীন।।

          فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

          Comment

          Working...
          X