বিশ্বের আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বহু ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে দুর্বল জাতি ও সম্প্রদায়গুলোর স্বাধীনতা ও মর্যাদা সংকুচিত হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর ক্ষেত্রে এই অর্থনৈতিক শোষণ অতীব সুক্ষ্ম ও দীর্ঘস্থায়ী। ঋণ ও সুদভিত্তিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপ, এবং ধর্মীয় অর্থনৈতিক কাঠামোর অবক্ষয় একদিকে যেমন মুসলিম সমাজের স্বাধীনতা হরণ করছে, অন্যদিকে তা তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গৌরবকে ক্ষুণ্ণ করছে।
আমরা বুঝার চেষ্টা করবো, কিভাবে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নীতিমালা মুসলিম উম্মাহর ওপর নির্যাতন এবং শোষণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি উম্মাহর ঐতিহ্যগত ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে দুর্বল করা হয়েছে এবং কেন আজ আমাদের জন্য অর্থনীতি পুনর্গঠনের বিকল্প পথ অবলম্বন করা জরুরি।
(১)
বিশ্বব্যাপী যে আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থা আজ প্রভাব বিস্তার করছে, তা মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও মানসিকতাকে এমনভাবে গেঁথে ফেলেছে, যা ইসলামী আদর্শের একেবারে বিপরীত। এই আর্থিক ব্যবস্থা আমাদের জীবনের এমন কোনো অংশ রাখেনি, যা তার প্রভাব থেকে মুক্ত।
প্রথমেই দেখা যাক—এই প্রভাব কোথা থেকে এসেছে।
ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো মুসলিম ভূখণ্ডে এসে শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেনি, বরং তারা ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। ওয়াক্ফ, যাকাত, বায়তুল মাল—এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম সমাজে সম্পদের স্বাভাবিক বণ্টন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা এবং দরিদ্র সুরক্ষা নিশ্চিত করত। এগুলো ছিল রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন, জনগণের কাছে জবাবদিহি, এবং সরাসরি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত।
কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে আমরা দেখি, ১৮৫০-এর দশকে ওয়াক্ফ সম্পত্তিকে "চ্যারিটেবল ট্রাস্ট" নামে রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে মুসলিমদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় আইন ও আদালতের অধীনে চলে আসে। এরপর একে একে ওয়াক্ফ প্রশাসন আইন, ম্যানেজমেন্ট বোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে এর স্বশাসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আজকের ভারত, বাংলাদেশ, মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোতে ওয়াক্ফ বোর্ডগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে—যেখানে ওয়াক্ফ সম্পত্তি লিজ দেওয়া হয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দারুল উলূম নয়।
অন্যদিকে, যাকাতের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় যাকাত ছিল একটিমাত্র কর, যা গরিবদের জন্য ফরজ ছিল ধনীদের উপর। এটি কর নয়—একটি শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র যাকাতকে ব্যক্তিক উদ্যোগে পরিণত করেছে বা সরকারী যাকাত বোর্ডের মাধ্যমে এমনভাবে চালায়, যার কোন সামাজিক প্রভাবই দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে “মুসটাহিক” নির্ধারণ করার নামে এমন এক বুরোক্র্যাটিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যেখানে কেউ যদি কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম না পূরণ করে, তবে সে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হয় না—even if he is starving on the street. অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সময়েও দেখা যায়, যাকাত সরাসরি গরিবের কাছে পৌঁছে যেত, কোনো ফর্ম ছাড়াই।
আর বায়তুল মাল? যেটি ছিল উম্মাহর সম্মিলিত সম্পদের সংরক্ষণের কেন্দ্র, আজ তা অধিকাংশ মুসলিম দেশে নেই। তার জায়গায় এসেছে “ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট”—যার প্রধান কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ গ্রহণ এবং কর আদায়ের মাধ্যমে সরকার চালানো। একবিংশ শতাব্দীর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বায়তুল মাল একটি ইতিহাসবিষয়ক পরিভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। আজ মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো সরকার রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা স্কুল বানাতে গেলে নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভর করে না—বরং আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদি থেকে সুদভিত্তিক ঋণ নেয়। একে একপ্রকার "ঋণ নির্ভর ইবাদত ব্যবস্থা" বলা যায়।
আর এখানেই আসে সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়—সুদ। ইসলাম যেখানে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে, সেখানে আমাদের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই সুদকেই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্কুল থেকে শুরু করে হজ্ব পর্যন্ত—সবকিছুতেই সুদের ছায়া।
উদাহরণ স্বরূপ, মালয়েশিয়ায় ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষ এখনো কনভেনশনাল ব্যাংকের উপর নির্ভর করে, কারণ তারা ইসলামী ব্যাংককেও "সুদকে হালাল করার কৌশল" মনে করে। অনেক সময়, ইসলামী ব্যাংকগুলোকেও তাদের প্রতিযোগিতার চাপে এমন প্রোডাক্ট চালু করতে হয়, যা মূলত কনভেনশনাল ব্যাংকের অনুকরণ।
আর মিশরের কথা ধরা যাক—এই দেশে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ‘এডুকেশন লোন’ নিতে হয় যা সুদভিত্তিক। কোনো আলিম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী অথবা গরিব মুসলিম পরিবার যদি এই ঋণ না নেয়, তবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগই পায় না।
এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে এক ‘অসুস্থ স্বাভাবিকতা’, যেখানে একজন মুসলিম ব্যবসায়ী সকালে নামাজ পড়ে দোকান খুলে ব্যাংক থেকে সুদে টাকা ধার নেয়, বিকেলে ওই সুদ থেকেই আয় করে, রাতে সেই আয়ের অংশ দিয়ে ওমরাহর টিকিট কাটে—এবং একটিবারের জন্যও প্রশ্ন করে না, “এই অর্থে কি বরকত আছে?”
আর এই মনোভাবই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ এটা শুধু শরিয়াহ লঙ্ঘন নয়, বরং ইসলামি চিন্তা ও চেতনার সম্পূর্ণ বিপর্যয়। আমরা ইসলামি অর্থনীতিকে এক ধরণের অবাস্তব ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখে ফেলেছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন:
“لَيَأْتِيَنَّ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ بِمَا أَخَذَ الْمَالَ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ”
(“এক সময় আসবে, যখন মানুষ এই চিন্তাও করবে না, সে অর্থ হালাল থেকে উপার্জন করেছে না হারাম থেকে।”)—সহীহ বুখারী, ২০৫৯
এই সময় আজ আমাদের মাঝেই বিরাজ করছে।
সুতরাং, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশা শুধু একটি বাজেট ঘাটতি বা দুর্নীতির প্রশ্ন নয়। বরং এটি সেই বৃহত্তর নীরব বিপর্যয়ের ফল, যেখানে ইসলামি আদর্শকে কৌশলে উপেক্ষা করে এক বিকৃত ধর্মনিরপেক্ষ অর্থব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো, এই ব্যবস্থাকে এখন মুসলিমরাই “ব্যবহারিক বাস্তবতা” হিসেবে মেনে নিয়েছে।
(২)
ফলাফল হলো—মুসলমানদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথ একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামী সমাজ এখন তাকিয়ে থাকে পশ্চিমা দুনিয়ার দিকে—ঋণ, অনুদান, কর কাঠামো এবং তথাকথিত 'আধুনিকায়ন' নামক ফাঁদে। 'সার্বভৌম অর্থনীতি' নামে তারা যা পরিচালনা করে, তা আসলে IMF, বিশ্বব্যাংক ও উপনিবেশী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বানানো ফর্মুলা। অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরির ক্ষমতা চলে গেছে 'বিদেশি বিশেষজ্ঞ' আর 'পরামর্শক'-দের হাতে।
সবচেয়ে কষ্টদায়ক হলো—মুসলিমদের ধনী শ্রেণি, যাদের সম্পদ একসময় সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হতো, তারা আজ নিজের অর্থ সুদের ব্যাংকে রেখে দেয়। সেই ব্যাংক আবার এই অর্থ নিয়ে এমন সব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যেগুলো ইসলামবিরোধী কিংবা সমাজবিরোধী। অথচ কুরআন সুদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে সরাসরি যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে:
> "يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ - فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ..."
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বাকি অংশ পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা সত্যিই ঈমানদার হও। আর যদি তা না করো, তবে জেনে রেখো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা এসেছে।” -(সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৮-২৭৯)
তবে রিবার আঘাত শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মের চিন্তা ও মানসিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছে। IMF ও বিশ্বব্যাংক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে সুদভিত্তিক ঋণ দেয়, আর সরকারের বাজেট সেই ঋণের ভিত্তিতে সাজানো হয়। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট—সব উন্নয়নের পেছনে থাকে সুদের ঋণ, যার পরিণামে দেশের সম্পদ অন্যের দখলে চলে যায়।
একইভাবে, একজন সাধারণ মুসলমানও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক সুদ-নির্ভর বাস্তবতায় জীবন কাটায়। সে সুদের ব্যাংকে টাকা রাখে, কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে, শিক্ষার জন্য ঋণ নেয়, বাসার জন্য হাউজিং লোন নেয়। অথচ সে জানে না, এগুলোই ধীরে ধীরে তাকে আল্লাহর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এই বাস্তবতায় মুসলমান কেবল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়নি, বরং আত্মিক ও মানসিক দিক থেকেও বিপর্যস্ত হয়েছে। তারা এখন আর ইসলামি ফিকহ, ইতিহাস কিংবা বিকল্প কোনো অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে ভাবে না। বরং প্রশ্ন করে:
অর্থনীতি, যা ইসলামের দৃষ্টিতে ‘ইবাদত’-এর একটি রূপ, তা এখন পুঁজিবাদের জাহান্নামী অঙ্কের কাছে বন্দি। বাজেট বানানো হয় সুদের ওপর দাঁড়িয়ে, কর আদায়ে ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রের পুলিশ ও জরিমানা ব্যবস্থা, সমাজসেবাকে নির্ভর করা হয় দাতা সংস্থার করুণার ওপর, আর ইসলামী ধারণাগুলোকে পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিয়ে ‘মিউজিয়ামে রাখার যোগ্য’ মনে করা হয়।
এই মনোভাবই কুরআন প্রশ্ন করে:
> "َفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ"
“তারা কি জাহিলিয়াতের শাসন চায়? ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর শাসনের চেয়ে উত্তম আর কারো শাসন কি হতে পারে?”
-(সূরা আল-মায়েদা, ৫:৫০)
এই আয়াত আমাদের জিজ্ঞেস করে—আমরা আসলে কোন দিকেই যাচ্ছি?
(৩)
"এই মুসলিম উম্মাহ এক উম্মাহ”—এই বাক্যটি অনেকের কাছে শুধু ধর্মীয় কথা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভিতরে আছে একটা বাস্তব কাঠামোর ধারণা। যেমন পরিবারের কথা ভাবুন—একটা পরিবারে ভাই-বোনেরা যদি আলাদা হয়ে গিয়ে সবাই নিজ নিজ ঘরে তালা লাগিয়ে শুধু নিজের খাবার, নিজের টাকা, নিজের সুবিধা নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে সেই পরিবারে সম্পর্ক থাকবে ঠিকই, কিন্তু কোনো সংহতি থাকবে না। তেমনি আজকের মুসলিম উম্মাহ—একই ক্বিবলার দিকে নামাজ পড়ে, একই রমজানে রোজা রাখে, একই নবীর (সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মত বলে গর্ব করে, কিন্তু তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা—সব কিছু একে অপর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন।
এই বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হচ্ছে আধুনিক ‘জাতি-রাষ্ট্র’ ব্যবস্থা। এটা এমন একটা ধারণা, যেখানে পৃথিবীর মানচিত্রে লাইন টেনে বলে দেওয়া হয়, “এই অংশটা তোমার দেশ, ওইটা আমার, তুমি ওইদিকে পা দিও না।” এই সীমানা শুধু ভৌগোলিক নয়—এটা মানুষের চিন্তা, সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক আচরণকেও আলাদা করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান—দুই দেশেই পাখতুন মুসলমানরা বাস করে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি অনেক পরিবারের আত্মীয়তাও একে অপরের সঙ্গে। কিন্তু এখন একজন আফগান পাখতুন যদি পাকিস্তানে নিজের আত্মীয়কে দেখতে আসতে চায়, তাকে ভিসা নিতে হয়, নিরাপত্তা যাচাই হয়, আর সীমানায় সামরিক পাহারা পার হয়ে আসতে হয়। অর্থাৎ, মুসলিম পরিচয় নয়, বরং পাসপোর্ট ঠিক করে দেয় তুমি কে।
অর্থনীতির দিক থেকে এই জাতি-রাষ্ট্র কাঠামো আরও গভীর বিভাজন তৈরি করেছে। সৌদি আরবে যে বিপুল তেলসম্পদ আছে, তা শুধু সেই দেশের নাগরিকদের জন্য—এমনকি পাশের ইয়েমেনে লাখ লাখ মানুষ যখন না খেয়ে দিন কাটায়, তখনও সে তেল সেই দেশেই থাকে। অথচ ইসলামের বাণী ছিল—সম্পদ যেন কেবল ধনী কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে। এমনকি খলিফা ওমরের সময় সিরিয়ার দুর্ভিক্ষে মদিনা থেকে উটের বহরে খাবার পাঠানো হয়েছিল, কারণ তখনো রাষ্ট্র মানে ছিল না সীমানা টেনে নির্দিষ্ট কিছু লোক। তখনো “আমরা” মানে ছিল পুরো উম্মাহ।
আজকের মুসলিম দেশগুলো নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে ভাবতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। তারা ভাবে, কার বাজেট ভালোভাবে গৃহীত হলো, কার দেশ বেশি বৈদেশিক ঋণ পেল, কার জিডিপি বেশি বাড়ল—এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা। যেমন মালয়েশিয়া যদি ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করে, তাহলে পাশের কোনো মুসলিম দেশ সেটা অনুসরণ করে না, বরং ভাবে—এটা বেশি ‘ধর্মীয়’, এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পাবে। এর ফলে ইসলামি অর্থনীতির কোনো সম্মিলিত কাঠামো গড়ে ওঠে না।
বাজেট তৈরির ক্ষেত্রেও এখন প্রায় সব মুসলিম দেশই ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ বা ‘বিশ্বব্যাংক’ থেকে ‘পরামর্শ’ নেয়। এসব পরামর্শে থাকে কর বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো, সরকারি খরচে কাটছাঁট করা ইত্যাদি। এর ফলে জনগণের জীবনযাত্রা কঠিন হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের কাগজে ‘উন্নয়ন’ দেখানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, মিশরে রুটি ও গ্যাসের দাম একসঙ্গে কয়েকগুণ বেড়েছে, কারণ বাজেট তৈরি হয়েছে বিদেশি ঋণদাতাদের চাহিদা মেনে। অথচ ইসলামি অর্থনীতিতে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করাই ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।
এই মানসিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেক মুসলিম দেশের অর্থমন্ত্রীদের মুখে ‘সুদ’ নিয়ে কোনো সংকোচ নেই। তারা বলেন, “ঋণ না নিলে উন্নয়ন সম্ভব নয়”—অথচ ইসলামে সুদ গ্রহণ বা প্রদান করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো অপরাধ। এটি শুধু বিশ্বাসের ব্যতিক্রম নয়, এটি একটি সভ্যতা বদলের ইঙ্গিত।
এই প্রেক্ষাপটে উম্মাহর প্রশ্ন হওয়া উচিত—আমরা যদি এক উম্মাহ হই, তাহলে আমাদের অর্থনীতি, আমাদের সম্পদ, আমাদের নীতিমালা কেন এত বিচ্ছিন্ন? কেন প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের ওপর যখন আগ্রাসন হয়, তখন পাশের ধনী দেশগুলো অর্থ না দিয়ে শুধু বিবৃতি দেয়? কেন সিরিয়া, ইয়েমেন বা সুদানের মুসলিমদের জন্য আরব লিগ বা ওআইসি কোনো কার্যকর তহবিল তৈরি করতে পারে না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ইসলামী অর্থনীতির কাঠামোয় খোঁজার আগে আমাদের একেবারে মূল জায়গায় ফিরে যেতে হবে—আমাদের আকিদার ভিতর। কারণ ‘উন্নয়ন’ বা ‘স্বাধীনতা’ কী, উম্মাহর সংহতি কিসে গঠিত—এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এসব প্রশ্নের শিকড় নিহিত আছে আমাদের ঈমান ও তাওহীদের মধ্যে।
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা কুরআনে স্পষ্টভাবে আমাদের আদেশ দিয়েছেন, যেন আমরা কেবল তাঁর শাসন মেনে চলি এবং মানুষের তৈরি আইন ও কাঠামোর অনুসরণ না করি। এই আকিদা যদি সত্য হয়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্রব্যবস্থা—যা আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি মানবনির্মিত শাসনব্যবস্থা—তাকে আমরা মেনে নিতে পারি না। তাওহীদের প্রকৃত অর্থই হলো আল্লাহকে একমাত্র হাকিম হিসেবে মানা, এবং তাঁর শরিয়াহকে সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করা।
যখন আমরা সত্যিকারের তাওহীদ গ্রহণ করব, তখন কেবল অর্থনীতিতে নয়, বরং সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার অনিবার্যতা উপলব্ধি করব। তখন আর জাতি-রাষ্ট্রের বিভাজনে নিজেকে আটকে রাখতে পারব না। তখন উম্মাহকে একটি দেহ হিসেবে দেখার চোখ জন্মাবে—যেখানে মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা, উন্নয়ন ও ন্যায়ের প্রশ্ন কেবল জাতীয় সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
তাই ‘বায়তুল মাল’, ‘যাকাত’, বা ‘ওয়াক্ফ’-এর মতো ইসলামী অর্থনৈতিক কাঠামোগুলোকে শুধু টেকনিক্যাল সমাধান হিসেবে নয়, বরং আকিদা-নির্ভর এক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রজ্ঞার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। এগুলো বাস্তবায়িত হবে তখনই, যখন আমরা এই উম্মাহর ভিত্তিকে আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসূলের (সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথ অনুযায়ী গঠন করতে চাইব।
(৪)
আমাদের যদি প্রশ্ন করা হয়: "আপনি কি শরিয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেও রাজি আছেন?"—তাহলে যারা শরিয়াকে হৃদয়ে ধারণ করে, তারা নিঃসংকোচে বলবে, "হ্যাঁ, আমরা রাজি আছি।" কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দৈনন্দিন আর্থিক কথোপকথনে এমন আত্মত্যাগী মানসিকতা দুর্লভ।
যখন বাজেট বা অর্থনৈতিক নীতির প্রসঙ্গ ওঠে, তখন আমাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়—দুর্নীতি, অপবিন্যাস, শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব। স্বভাবতই এই বিশ্লেষণগুলো প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবতা-নির্ভর, তবে প্রশ্ন হলো—এই আলোচনা কি আসলেই সমস্যার মূল শিকড়ে পৌঁছায়? নাকি আমরা শুধুই ফল নিয়ে ব্যস্ত, মূল গাছের শিকড়কে অন্ধকারেই রেখে দিচ্ছি?
আমরা খুব কমই প্রশ্ন তুলি—এই বাজেট ব্যবস্থা আসলে কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার? এটি কাদের আদর্শে গঠিত? কাদের চাহিদা পূরণে তা সাজানো হয়? এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি মৌলিক উপলব্ধি—জাতীয় বাজেট আসলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি মেরুদণ্ড। এটি এমন এক কাঠামো যা জনগণের সম্পদকে এমনভাবে সংহত করে, যাতে রাষ্ট্র নিজের আদর্শিক ভিত্তি—ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারনৈতিক পুঁজিবাদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা—বলিষ্ঠভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে।
ধর্মনিরপেক্ষ বাজেট একদিকে যেমন ‘উন্নয়নের’ নামে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয় বাস্তব আইডিওলজিক্যাল প্রশ্নগুলো থেকে, তেমনি অপরদিকে ইসলামি অর্থনৈতিক আদর্শকে নীরবে নির্বাসনে পাঠায়। ইসলাম যেখানে বাজেটকে দেখছে আল্লাহর মালিকানাধীন সম্পদের আমানত হিসেবে, সেখানে জাতি-রাষ্ট্র তা চালায় সামাজিক চুক্তিভিত্তিক মানবকেন্দ্রিক শাসনের অংশ হিসেবে। অতএব, এই ব্যবস্থার আলোচনাগুলোও আবর্তিত হয় ‘মানব উন্নয়ন সূচক’, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি’, অথবা ‘নিরপেক্ষ বণ্টন’-এর মতো ধারণার চারপাশে—যেগুলোর মাঝে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা শরিয়ার কোনো স্থান নেই।
এমনকি আমরা যখন বাজেটের মধ্যে দুর্নীতির সমস্যা খুঁজে পাই, তখনও আমরা সেই সমস্যা নিরসনের পথ খুঁজি ঐ ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর ভেতরেই—সংবিধান সংশোধন, নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহিতা, অথবা নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কাঠামো কি আদৌ ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি? যদি এটি শুরা-ভিত্তিক না হয়, যদি এটি খিলাফা-ভিত্তিক না হয়, তাহলে এর ভেতর থেকে ন্যায় কি আদৌ ফলিত হতে পারে?
সুতরাং, আমাদের আলোচনার রূপরেখা বদলাতে হবে। বাজেটের ত্রুটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি আদর্শিক বিচ্যুতি। আমরা যদি ইসলামি আদর্শে বিশ্বাস করি, তবে বাজেট বিশ্লেষণেও সেই বিশ্বাস প্রতিফলিত হতে হবে। আমাদের আলোচনা হতে হবে এই কাঠামোর প্রকৃত উৎস ও তার দাসত্বমূলক বৈশ্বিক সংযোগ নিয়ে—বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং দাতাগোষ্ঠীসমূহ কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী গ্লোবাল অর্ডারকে মজবুত করার জন্য আমাদের অর্থনীতিকে উপনিবেশীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে হবে।
আর তখনই আমরা হয়তো সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ফিরে যেতে পারবো—আমরা কি সত্যিই শরিয়ার পথে আর্থিক ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত? কেবল মুখে নয়, বাস্তবিক অর্থে?
মনে রাখবেন আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালার আদেশ এই নয় যে তোমরা সম্পদ রক্ষার জন্য যুদ্ধ করো বরং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার আদেশ হচ্ছে:
وَقٰتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّیَکُوۡنَ الدِّیۡنُ لِلّٰہِ ؕ
তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন আল্লাহর হয়ে যায়। (সূরা বাকারাহ; ২:১৯৩)
আমরা বুঝার চেষ্টা করবো, কিভাবে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নীতিমালা মুসলিম উম্মাহর ওপর নির্যাতন এবং শোষণের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি উম্মাহর ঐতিহ্যগত ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে দুর্বল করা হয়েছে এবং কেন আজ আমাদের জন্য অর্থনীতি পুনর্গঠনের বিকল্প পথ অবলম্বন করা জরুরি।
(১)
বিশ্বব্যাপী যে আধুনিক আর্থিক ব্যবস্থা আজ প্রভাব বিস্তার করছে, তা মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও মানসিকতাকে এমনভাবে গেঁথে ফেলেছে, যা ইসলামী আদর্শের একেবারে বিপরীত। এই আর্থিক ব্যবস্থা আমাদের জীবনের এমন কোনো অংশ রাখেনি, যা তার প্রভাব থেকে মুক্ত।
প্রথমেই দেখা যাক—এই প্রভাব কোথা থেকে এসেছে।
ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো মুসলিম ভূখণ্ডে এসে শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেনি, বরং তারা ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল স্তম্ভগুলোকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। ওয়াক্ফ, যাকাত, বায়তুল মাল—এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলিম সমাজে সম্পদের স্বাভাবিক বণ্টন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা এবং দরিদ্র সুরক্ষা নিশ্চিত করত। এগুলো ছিল রাষ্ট্র থেকে স্বাধীন, জনগণের কাছে জবাবদিহি, এবং সরাসরি আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত।
কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে আমরা দেখি, ১৮৫০-এর দশকে ওয়াক্ফ সম্পত্তিকে "চ্যারিটেবল ট্রাস্ট" নামে রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে মুসলিমদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় আইন ও আদালতের অধীনে চলে আসে। এরপর একে একে ওয়াক্ফ প্রশাসন আইন, ম্যানেজমেন্ট বোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে এর স্বশাসন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আজকের ভারত, বাংলাদেশ, মিসর বা তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোতে ওয়াক্ফ বোর্ডগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে—যেখানে ওয়াক্ফ সম্পত্তি লিজ দেওয়া হয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা দারুল উলূম নয়।
অন্যদিকে, যাকাতের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় যাকাত ছিল একটিমাত্র কর, যা গরিবদের জন্য ফরজ ছিল ধনীদের উপর। এটি কর নয়—একটি শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র যাকাতকে ব্যক্তিক উদ্যোগে পরিণত করেছে বা সরকারী যাকাত বোর্ডের মাধ্যমে এমনভাবে চালায়, যার কোন সামাজিক প্রভাবই দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে “মুসটাহিক” নির্ধারণ করার নামে এমন এক বুরোক্র্যাটিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, যেখানে কেউ যদি কোনো নির্দিষ্ট ফর্ম না পূরণ করে, তবে সে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত বিবেচিত হয় না—even if he is starving on the street. অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সময়েও দেখা যায়, যাকাত সরাসরি গরিবের কাছে পৌঁছে যেত, কোনো ফর্ম ছাড়াই।
আর বায়তুল মাল? যেটি ছিল উম্মাহর সম্মিলিত সম্পদের সংরক্ষণের কেন্দ্র, আজ তা অধিকাংশ মুসলিম দেশে নেই। তার জায়গায় এসেছে “ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট”—যার প্রধান কাজ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ গ্রহণ এবং কর আদায়ের মাধ্যমে সরকার চালানো। একবিংশ শতাব্দীর মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে বায়তুল মাল একটি ইতিহাসবিষয়ক পরিভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে; যার বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। আজ মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো সরকার রাস্তাঘাট, হাসপাতাল বা স্কুল বানাতে গেলে নিজস্ব সম্পদের ওপর নির্ভর করে না—বরং আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদি থেকে সুদভিত্তিক ঋণ নেয়। একে একপ্রকার "ঋণ নির্ভর ইবাদত ব্যবস্থা" বলা যায়।
আর এখানেই আসে সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়—সুদ। ইসলাম যেখানে সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে, সেখানে আমাদের গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই সুদকেই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। স্কুল থেকে শুরু করে হজ্ব পর্যন্ত—সবকিছুতেই সুদের ছায়া।
উদাহরণ স্বরূপ, মালয়েশিয়ায় ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষ এখনো কনভেনশনাল ব্যাংকের উপর নির্ভর করে, কারণ তারা ইসলামী ব্যাংককেও "সুদকে হালাল করার কৌশল" মনে করে। অনেক সময়, ইসলামী ব্যাংকগুলোকেও তাদের প্রতিযোগিতার চাপে এমন প্রোডাক্ট চালু করতে হয়, যা মূলত কনভেনশনাল ব্যাংকের অনুকরণ।
আর মিশরের কথা ধরা যাক—এই দেশে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ‘এডুকেশন লোন’ নিতে হয় যা সুদভিত্তিক। কোনো আলিম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী অথবা গরিব মুসলিম পরিবার যদি এই ঋণ না নেয়, তবে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগই পায় না।
এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে এক ‘অসুস্থ স্বাভাবিকতা’, যেখানে একজন মুসলিম ব্যবসায়ী সকালে নামাজ পড়ে দোকান খুলে ব্যাংক থেকে সুদে টাকা ধার নেয়, বিকেলে ওই সুদ থেকেই আয় করে, রাতে সেই আয়ের অংশ দিয়ে ওমরাহর টিকিট কাটে—এবং একটিবারের জন্যও প্রশ্ন করে না, “এই অর্থে কি বরকত আছে?”
আর এই মনোভাবই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ এটা শুধু শরিয়াহ লঙ্ঘন নয়, বরং ইসলামি চিন্তা ও চেতনার সম্পূর্ণ বিপর্যয়। আমরা ইসলামি অর্থনীতিকে এক ধরণের অবাস্তব ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখে ফেলেছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন:
“لَيَأْتِيَنَّ عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ لَا يُبَالِي الْمَرْءُ بِمَا أَخَذَ الْمَالَ أَمِنَ الْحَلَالِ أَمْ مِنَ الْحَرَامِ”
(“এক সময় আসবে, যখন মানুষ এই চিন্তাও করবে না, সে অর্থ হালাল থেকে উপার্জন করেছে না হারাম থেকে।”)—সহীহ বুখারী, ২০৫৯
এই সময় আজ আমাদের মাঝেই বিরাজ করছে।
সুতরাং, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক দুর্দশা শুধু একটি বাজেট ঘাটতি বা দুর্নীতির প্রশ্ন নয়। বরং এটি সেই বৃহত্তর নীরব বিপর্যয়ের ফল, যেখানে ইসলামি আদর্শকে কৌশলে উপেক্ষা করে এক বিকৃত ধর্মনিরপেক্ষ অর্থব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা হলো, এই ব্যবস্থাকে এখন মুসলিমরাই “ব্যবহারিক বাস্তবতা” হিসেবে মেনে নিয়েছে।
(২)
ফলাফল হলো—মুসলমানদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথ একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। ইসলামী সমাজ এখন তাকিয়ে থাকে পশ্চিমা দুনিয়ার দিকে—ঋণ, অনুদান, কর কাঠামো এবং তথাকথিত 'আধুনিকায়ন' নামক ফাঁদে। 'সার্বভৌম অর্থনীতি' নামে তারা যা পরিচালনা করে, তা আসলে IMF, বিশ্বব্যাংক ও উপনিবেশী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বানানো ফর্মুলা। অর্থনৈতিক নীতিমালা তৈরির ক্ষমতা চলে গেছে 'বিদেশি বিশেষজ্ঞ' আর 'পরামর্শক'-দের হাতে।
সবচেয়ে কষ্টদায়ক হলো—মুসলিমদের ধনী শ্রেণি, যাদের সম্পদ একসময় সমাজের কল্যাণে ব্যবহৃত হতো, তারা আজ নিজের অর্থ সুদের ব্যাংকে রেখে দেয়। সেই ব্যাংক আবার এই অর্থ নিয়ে এমন সব প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, যেগুলো ইসলামবিরোধী কিংবা সমাজবিরোধী। অথচ কুরআন সুদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছে সরাসরি যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়ে:
> "يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ - فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا فَأْذَنُوا بِحَرْبٍ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ..."
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের বাকি অংশ পরিত্যাগ করো, যদি তোমরা সত্যিই ঈমানদার হও। আর যদি তা না করো, তবে জেনে রেখো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা এসেছে।” -(সূরা আল-বাকারা, ২:২৭৮-২৭৯)
তবে রিবার আঘাত শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ প্রজন্মের চিন্তা ও মানসিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছে। IMF ও বিশ্বব্যাংক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে সুদভিত্তিক ঋণ দেয়, আর সরকারের বাজেট সেই ঋণের ভিত্তিতে সাজানো হয়। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট—সব উন্নয়নের পেছনে থাকে সুদের ঋণ, যার পরিণামে দেশের সম্পদ অন্যের দখলে চলে যায়।
একইভাবে, একজন সাধারণ মুসলমানও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক সুদ-নির্ভর বাস্তবতায় জীবন কাটায়। সে সুদের ব্যাংকে টাকা রাখে, কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে, শিক্ষার জন্য ঋণ নেয়, বাসার জন্য হাউজিং লোন নেয়। অথচ সে জানে না, এগুলোই ধীরে ধীরে তাকে আল্লাহর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
এই বাস্তবতায় মুসলমান কেবল অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়নি, বরং আত্মিক ও মানসিক দিক থেকেও বিপর্যস্ত হয়েছে। তারা এখন আর ইসলামি ফিকহ, ইতিহাস কিংবা বিকল্প কোনো অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে ভাবে না। বরং প্রশ্ন করে:
“এই যুগে সুদ ছাড়া কিছু চলে?”
এই প্রশ্নটাই প্রমাণ করে—আমরা আত্মিকভাবে কতটা হেরে গেছি।
এই প্রশ্নটাই প্রমাণ করে—আমরা আত্মিকভাবে কতটা হেরে গেছি।
এই মনোভাবই কুরআন প্রশ্ন করে:
> "َفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ ۚ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ يُوقِنُونَ"
“তারা কি জাহিলিয়াতের শাসন চায়? ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর শাসনের চেয়ে উত্তম আর কারো শাসন কি হতে পারে?”
-(সূরা আল-মায়েদা, ৫:৫০)
এই আয়াত আমাদের জিজ্ঞেস করে—আমরা আসলে কোন দিকেই যাচ্ছি?
(৩)
"এই মুসলিম উম্মাহ এক উম্মাহ”—এই বাক্যটি অনেকের কাছে শুধু ধর্মীয় কথা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এর ভিতরে আছে একটা বাস্তব কাঠামোর ধারণা। যেমন পরিবারের কথা ভাবুন—একটা পরিবারে ভাই-বোনেরা যদি আলাদা হয়ে গিয়ে সবাই নিজ নিজ ঘরে তালা লাগিয়ে শুধু নিজের খাবার, নিজের টাকা, নিজের সুবিধা নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে সেই পরিবারে সম্পর্ক থাকবে ঠিকই, কিন্তু কোনো সংহতি থাকবে না। তেমনি আজকের মুসলিম উম্মাহ—একই ক্বিবলার দিকে নামাজ পড়ে, একই রমজানে রোজা রাখে, একই নবীর (সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মত বলে গর্ব করে, কিন্তু তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা—সব কিছু একে অপর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বিচ্ছিন্ন।
এই বিচ্ছিন্নতার প্রধান কারণ হচ্ছে আধুনিক ‘জাতি-রাষ্ট্র’ ব্যবস্থা। এটা এমন একটা ধারণা, যেখানে পৃথিবীর মানচিত্রে লাইন টেনে বলে দেওয়া হয়, “এই অংশটা তোমার দেশ, ওইটা আমার, তুমি ওইদিকে পা দিও না।” এই সীমানা শুধু ভৌগোলিক নয়—এটা মানুষের চিন্তা, সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক আচরণকেও আলাদা করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান—দুই দেশেই পাখতুন মুসলমানরা বাস করে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি অনেক পরিবারের আত্মীয়তাও একে অপরের সঙ্গে। কিন্তু এখন একজন আফগান পাখতুন যদি পাকিস্তানে নিজের আত্মীয়কে দেখতে আসতে চায়, তাকে ভিসা নিতে হয়, নিরাপত্তা যাচাই হয়, আর সীমানায় সামরিক পাহারা পার হয়ে আসতে হয়। অর্থাৎ, মুসলিম পরিচয় নয়, বরং পাসপোর্ট ঠিক করে দেয় তুমি কে।
অর্থনীতির দিক থেকে এই জাতি-রাষ্ট্র কাঠামো আরও গভীর বিভাজন তৈরি করেছে। সৌদি আরবে যে বিপুল তেলসম্পদ আছে, তা শুধু সেই দেশের নাগরিকদের জন্য—এমনকি পাশের ইয়েমেনে লাখ লাখ মানুষ যখন না খেয়ে দিন কাটায়, তখনও সে তেল সেই দেশেই থাকে। অথচ ইসলামের বাণী ছিল—সম্পদ যেন কেবল ধনী কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ না থাকে। এমনকি খলিফা ওমরের সময় সিরিয়ার দুর্ভিক্ষে মদিনা থেকে উটের বহরে খাবার পাঠানো হয়েছিল, কারণ তখনো রাষ্ট্র মানে ছিল না সীমানা টেনে নির্দিষ্ট কিছু লোক। তখনো “আমরা” মানে ছিল পুরো উম্মাহ।
আজকের মুসলিম দেশগুলো নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে ভাবতে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। তারা ভাবে, কার বাজেট ভালোভাবে গৃহীত হলো, কার দেশ বেশি বৈদেশিক ঋণ পেল, কার জিডিপি বেশি বাড়ল—এসব নিয়ে প্রতিযোগিতা। যেমন মালয়েশিয়া যদি ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করে, তাহলে পাশের কোনো মুসলিম দেশ সেটা অনুসরণ করে না, বরং ভাবে—এটা বেশি ‘ধর্মীয়’, এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভয় পাবে। এর ফলে ইসলামি অর্থনীতির কোনো সম্মিলিত কাঠামো গড়ে ওঠে না।
বাজেট তৈরির ক্ষেত্রেও এখন প্রায় সব মুসলিম দেশই ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ বা ‘বিশ্বব্যাংক’ থেকে ‘পরামর্শ’ নেয়। এসব পরামর্শে থাকে কর বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো, সরকারি খরচে কাটছাঁট করা ইত্যাদি। এর ফলে জনগণের জীবনযাত্রা কঠিন হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের কাগজে ‘উন্নয়ন’ দেখানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, মিশরে রুটি ও গ্যাসের দাম একসঙ্গে কয়েকগুণ বেড়েছে, কারণ বাজেট তৈরি হয়েছে বিদেশি ঋণদাতাদের চাহিদা মেনে। অথচ ইসলামি অর্থনীতিতে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করাই ছিল রাজস্ব ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।
এই মানসিকতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, অনেক মুসলিম দেশের অর্থমন্ত্রীদের মুখে ‘সুদ’ নিয়ে কোনো সংকোচ নেই। তারা বলেন, “ঋণ না নিলে উন্নয়ন সম্ভব নয়”—অথচ ইসলামে সুদ গ্রহণ বা প্রদান করা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো অপরাধ। এটি শুধু বিশ্বাসের ব্যতিক্রম নয়, এটি একটি সভ্যতা বদলের ইঙ্গিত।
এই প্রেক্ষাপটে উম্মাহর প্রশ্ন হওয়া উচিত—আমরা যদি এক উম্মাহ হই, তাহলে আমাদের অর্থনীতি, আমাদের সম্পদ, আমাদের নীতিমালা কেন এত বিচ্ছিন্ন? কেন প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের ওপর যখন আগ্রাসন হয়, তখন পাশের ধনী দেশগুলো অর্থ না দিয়ে শুধু বিবৃতি দেয়? কেন সিরিয়া, ইয়েমেন বা সুদানের মুসলিমদের জন্য আরব লিগ বা ওআইসি কোনো কার্যকর তহবিল তৈরি করতে পারে না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ইসলামী অর্থনীতির কাঠামোয় খোঁজার আগে আমাদের একেবারে মূল জায়গায় ফিরে যেতে হবে—আমাদের আকিদার ভিতর। কারণ ‘উন্নয়ন’ বা ‘স্বাধীনতা’ কী, উম্মাহর সংহতি কিসে গঠিত—এসব প্রশ্নের উত্তর শুধু অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এসব প্রশ্নের শিকড় নিহিত আছে আমাদের ঈমান ও তাওহীদের মধ্যে।
আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা কুরআনে স্পষ্টভাবে আমাদের আদেশ দিয়েছেন, যেন আমরা কেবল তাঁর শাসন মেনে চলি এবং মানুষের তৈরি আইন ও কাঠামোর অনুসরণ না করি। এই আকিদা যদি সত্য হয়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্রব্যবস্থা—যা আল্লাহর বিধান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি মানবনির্মিত শাসনব্যবস্থা—তাকে আমরা মেনে নিতে পারি না। তাওহীদের প্রকৃত অর্থই হলো আল্লাহকে একমাত্র হাকিম হিসেবে মানা, এবং তাঁর শরিয়াহকে সমাজের সর্বস্তরে বাস্তবায়ন করা।
যখন আমরা সত্যিকারের তাওহীদ গ্রহণ করব, তখন কেবল অর্থনীতিতে নয়, বরং সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার অনিবার্যতা উপলব্ধি করব। তখন আর জাতি-রাষ্ট্রের বিভাজনে নিজেকে আটকে রাখতে পারব না। তখন উম্মাহকে একটি দেহ হিসেবে দেখার চোখ জন্মাবে—যেখানে মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা, উন্নয়ন ও ন্যায়ের প্রশ্ন কেবল জাতীয় সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
তাই ‘বায়তুল মাল’, ‘যাকাত’, বা ‘ওয়াক্ফ’-এর মতো ইসলামী অর্থনৈতিক কাঠামোগুলোকে শুধু টেকনিক্যাল সমাধান হিসেবে নয়, বরং আকিদা-নির্ভর এক রাজনৈতিক-সামাজিক প্রজ্ঞার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। এগুলো বাস্তবায়িত হবে তখনই, যখন আমরা এই উম্মাহর ভিত্তিকে আল্লাহর একত্ববাদ ও রাসূলের (সালাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথ অনুযায়ী গঠন করতে চাইব।
(৪)
আমাদের যদি প্রশ্ন করা হয়: "আপনি কি শরিয়ার প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেও রাজি আছেন?"—তাহলে যারা শরিয়াকে হৃদয়ে ধারণ করে, তারা নিঃসংকোচে বলবে, "হ্যাঁ, আমরা রাজি আছি।" কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের দৈনন্দিন আর্থিক কথোপকথনে এমন আত্মত্যাগী মানসিকতা দুর্লভ।
যখন বাজেট বা অর্থনৈতিক নীতির প্রসঙ্গ ওঠে, তখন আমাদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়—দুর্নীতি, অপবিন্যাস, শ্রেণিভিত্তিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব। স্বভাবতই এই বিশ্লেষণগুলো প্রয়োজনীয় এবং বাস্তবতা-নির্ভর, তবে প্রশ্ন হলো—এই আলোচনা কি আসলেই সমস্যার মূল শিকড়ে পৌঁছায়? নাকি আমরা শুধুই ফল নিয়ে ব্যস্ত, মূল গাছের শিকড়কে অন্ধকারেই রেখে দিচ্ছি?
আমরা খুব কমই প্রশ্ন তুলি—এই বাজেট ব্যবস্থা আসলে কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার? এটি কাদের আদর্শে গঠিত? কাদের চাহিদা পূরণে তা সাজানো হয়? এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি মৌলিক উপলব্ধি—জাতীয় বাজেট আসলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি মেরুদণ্ড। এটি এমন এক কাঠামো যা জনগণের সম্পদকে এমনভাবে সংহত করে, যাতে রাষ্ট্র নিজের আদর্শিক ভিত্তি—ধর্মনিরপেক্ষতা, উদারনৈতিক পুঁজিবাদ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা—বলিষ্ঠভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে।
ধর্মনিরপেক্ষ বাজেট একদিকে যেমন ‘উন্নয়নের’ নামে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয় বাস্তব আইডিওলজিক্যাল প্রশ্নগুলো থেকে, তেমনি অপরদিকে ইসলামি অর্থনৈতিক আদর্শকে নীরবে নির্বাসনে পাঠায়। ইসলাম যেখানে বাজেটকে দেখছে আল্লাহর মালিকানাধীন সম্পদের আমানত হিসেবে, সেখানে জাতি-রাষ্ট্র তা চালায় সামাজিক চুক্তিভিত্তিক মানবকেন্দ্রিক শাসনের অংশ হিসেবে। অতএব, এই ব্যবস্থার আলোচনাগুলোও আবর্তিত হয় ‘মানব উন্নয়ন সূচক’, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি’, অথবা ‘নিরপেক্ষ বণ্টন’-এর মতো ধারণার চারপাশে—যেগুলোর মাঝে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা শরিয়ার কোনো স্থান নেই।
এমনকি আমরা যখন বাজেটের মধ্যে দুর্নীতির সমস্যা খুঁজে পাই, তখনও আমরা সেই সমস্যা নিরসনের পথ খুঁজি ঐ ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর ভেতরেই—সংবিধান সংশোধন, নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহিতা, অথবা নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কাঠামো কি আদৌ ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি? যদি এটি শুরা-ভিত্তিক না হয়, যদি এটি খিলাফা-ভিত্তিক না হয়, তাহলে এর ভেতর থেকে ন্যায় কি আদৌ ফলিত হতে পারে?
সুতরাং, আমাদের আলোচনার রূপরেখা বদলাতে হবে। বাজেটের ত্রুটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি আদর্শিক বিচ্যুতি। আমরা যদি ইসলামি আদর্শে বিশ্বাস করি, তবে বাজেট বিশ্লেষণেও সেই বিশ্বাস প্রতিফলিত হতে হবে। আমাদের আলোচনা হতে হবে এই কাঠামোর প্রকৃত উৎস ও তার দাসত্বমূলক বৈশ্বিক সংযোগ নিয়ে—বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং দাতাগোষ্ঠীসমূহ কিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী গ্লোবাল অর্ডারকে মজবুত করার জন্য আমাদের অর্থনীতিকে উপনিবেশীকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে, তা বুঝতে হবে।
আর তখনই আমরা হয়তো সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ফিরে যেতে পারবো—আমরা কি সত্যিই শরিয়ার পথে আর্থিক ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত? কেবল মুখে নয়, বাস্তবিক অর্থে?
মনে রাখবেন আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালার আদেশ এই নয় যে তোমরা সম্পদ রক্ষার জন্য যুদ্ধ করো বরং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার আদেশ হচ্ছে:
وَقٰتِلُوۡہُمۡ حَتّٰی لَا تَکُوۡنَ فِتۡنَۃٌ وَّیَکُوۡنَ الدِّیۡنُ لِلّٰہِ ؕ
তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা খতম হয়ে যায় এবং দীন আল্লাহর হয়ে যায়। (সূরা বাকারাহ; ২:১৯৩)
Comment