মানব ইতিহাসে সর্বাধিক সফল দাসত্বের রূপটি হলো এমন এক ব্যবস্থা,
যেখানে মানুষ নিজেদের দাসত্বকেই স্বাধীনতা মনে করে।
যেখানে মানুষ নিজেদের দাসত্বকেই স্বাধীনতা মনে করে।
এই কাগজপত্রগুলোকে আমরা অনেক সময় কেবল প্রশাসনিক কার্যকারিতা বা নাগরিক সুবিধা পাওয়ার উপায় মনে করি, অথচ এই ধারণার গভীরে রয়েছে এক জটিল ও সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রকল্প। এসব ডকুমেন্ট মানুষের আল্লাহর খলিফা হিসেবে স্বতঃসিদ্ধ অবস্থানকে মুছে দিয়ে তাকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের আনুগত্যশীল প্রজায় পরিণত করার হাতিয়ার। এখানে মানুষ আর আল্লাহর বিধানের আওতায় বসবাসকারী কলবের অধিকারী নয়; বরং সে রাষ্ট্রের সংবিধান ও নীতিমালার দ্বারা সংজ্ঞায়িত এক প্রশাসনিক সত্তা।
জাতীয় পরিচয়, নাগরিক নম্বর, জন্মসনদ, কিংবা শিক্ষাগত সার্টিফিকেট—সবকিছু মিলিয়ে মানুষের অস্তিত্বকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেলেই কার্যকর হয়। মানুষের আত্মমর্যাদা, চলাফেরা, সম্পদ অর্জন বা সামাজিক অংশগ্রহণ—সবই এই রাষ্ট্র অনুমোদিত কাগজপত্রের মধ্যস্থতায় নির্ধারিত হয়।
আধুনিক রাষ্ট্র নাগরিকদের চিহ্নিত করে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার মাধ্যমে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি কার্ড, যার মধ্যে একজন মানুষের নাম, জন্মতারিখ, পিতার নাম, স্থায়ী ঠিকানা, ধর্ম, রক্তের গ্রুপ, এমনকি আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের স্ক্যান সংরক্ষিত থাকে—এই তথ্যমালার মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা হয়: আপনি আর আল্লাহর স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন বান্দা নন; আপনি এখন একটি রাষ্ট্র-নির্মিত ‘ডাটাবেস আইটেম’।
এই তথ্য কেবল শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না; বরং এটি নিয়ন্ত্রণের অনুষঙ্গ, নজরদারির হাতিয়ার। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন, কোন ওয়েবসাইট ভিজিট করছেন, কোন বই কিনছেন, কোথায় নামাজ পড়ছেন—এইসবই একটি কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। এটি এমন এক নজরদারি, যা দৃশ্যত নিরপেক্ষ এবং প্রযুক্তিনির্ভর বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি গভীরভাবে আদর্শিক এবং কর্তৃত্ববাদী।
এই নিয়ন্ত্রণ কেবল দৈনন্দিন জীবনের উপরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ধীরে ধীরে একজন মুসলমানের ঈমান, দ্বীনচর্চা এবং আত্মপরিচয়ের উপরও ভারী ছায়া ফেলে। একজন মুসলমান যখন বুঝতে শুরু করে যে তার প্রতিটি ধর্মীয় কার্যক্রম—মসজিদে যাওয়া, কারো সাথে দ্বীনি আলোচনা, কোনো ইসলামী বই কেনা কিংবা কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ—সবই নজরদারির আওতাভুক্ত, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক আচরণ জন্ম নেয়। সে নিজের বিশ্বাস প্রকাশে সতর্ক হয়ে পড়ে, ইসলামী ভাবাদর্শের কথা বলার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, এমনকি দ্বীনকে একটি গোপন ও নিভৃত অনুশীলনে পরিণত করে। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপে তার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে—এবং এখানেই সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক বিজয়।
পাসপোর্ট নামক কাগজখণ্ডটিও এরই এক প্রতীকী রূপ। এটি নির্ধারণ করে আপনি কোথায় যেতে পারবেন, কোথায় যেতে পারবেন না—কার অনুমতি পেলে আপনি আল্লাহর জমিনে চলাফেরা করতে পারবেন। অথচ আল্লাহর জমিন কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর মালিকানাধীন: "লিল্লাহি মা ফি আস্-সামাওয়াতি ওয়ামা ফি আল-আর্দ।" কিন্তু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র তার সীমারেখা টেনে বলে: "এই সীমার বাইরে যেতে হলে পাসপোর্ট ও ভিসা লাগবে।" ফলে একজন মুসলমান আজ তার মুসলিম ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না, মজলুমের সহায়তায় পৌঁছাতে পারছে না, এমনকি আল্লাহর ঘর কা‘বার দিকেও যেতে পারছে না—যদি রাষ্ট্র তাকে অনুমতি না দেয়।
এই ব্যবস্থার গভীরে প্রবেশ করলে স্পষ্ট হয় যে, এটি কেবল আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নয়—বরং এর শিকড় উপনিবেশবাদী শাসনের অভ্যন্তরে প্রোথিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ভারতবর্ষে তাদের কর্তৃত্ব সুসংহত করার জন্য ‘রেজিস্ট্রেশন’, ‘সেনসাস’ এবং ‘আইডেন্টিফিকেশন’-এর ব্যবস্থা চালু করেছিল। এই পদ্ধতিগুলোর লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয় কাঠামোকে নিরীক্ষা করে দমন নীতিমালা তৈরি করা। সেই ব্যবস্থাই আজ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সঙ্গে আরও সূক্ষ্ম, আরও ব্যাপক এবং অধিক বিপজ্জনক রূপ ধারণ করেছে।
এই পুরো ব্যবস্থার সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো—এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের বিপরীতে একটি সুপরিকল্পিত সাংগঠনিক ষড়যন্ত্র। ইসলাম আমাদের পরিচয় নির্ধারণ করেছে ঈমানের ভিত্তিতে, জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তিতে নয়।
"إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ"
"নিশ্চয়ই মুসলমানগণ একে অপরের ভাই।”
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১০)।
"নিশ্চয়ই মুসলমানগণ একে অপরের ভাই।”
(সূরা হুজুরাত ৪৯:১০)।
কিন্তু আজ এই ভ্রাতৃত্ব ধ্বংস করা হয়েছে পাসপোর্ট, ভিসা এবং জাতীয়তার নামে।
একজন মিসরীয় মুসলমান, একজন তুর্কি মুসলমান কিংবা একজন ফিলিস্তিনি মুসলমান—তাদের পরিচয় এখন ইসলামের আলোকে নয়; বরং তাদের পরিচয় এখন নির্ধারিত হচ্ছে পাসপোর্টের মাধ্যমে। হজের সময়ও এই বিভাজন আমাদের চোখে পড়ে—মুসলমানরা দাঁড়ায় আলাদা লাইনে, আলাদা ভাষায় কথা বলে, আলাদা রাষ্ট্রীয় ছাউনিতে থাকে, এমনকি আলাদা ভিসার স্ট্যাটাসে ঝুঁকে পড়ে। অথচ নবিজির যুগে হিজরত করা মানে ছিল দ্বীনের জন্য আত্মত্যাগ; সেখানে কোনো রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগতো না—আল্লাহর রাসূল নিজেই স্বাগত জানাতেন। এখন, হিজরত করতে চাইলেও ‘ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স’ লাগে।
একইভাবে, সার্টিফিকেট ও লাইসেন্সের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা, পেশাগত অধিকার এবং অর্থনৈতিক অবস্থান নির্ধারিত হচ্ছে। আপনি যদি একজন হাফিজ হন, শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন, যদি আপনি একজন আলেম হন, হাদীস ও ফিকহে দক্ষ—তা সত্ত্বেও যদি আপনার হাতে কোনো স্বীকৃত সেক্যুলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকে, তবে আপনি ‘অযোগ্য’, ‘অপেশাদার’ কিংবা ‘অননুমোদিত’ ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন। আপনি হয়তো কুরআনের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন, কিন্তু রাষ্ট্র বলবে, "আপনার ‘কোয়ালিফিকেশন’ কোথায়?"
এমনকি ধর্মীয় জ্ঞানকেও রাষ্ট্র পরিমাপ করতে চায় নিজেদের তৈরি মাপকাঠিতে। অথচ কুরআন বলে:
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ
“আল্লাহ তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকে ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে।”
(সূরা মুজাদিলা, ৫৮:১১)
এখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদার মানদণ্ড নির্ধারিত হয়েছে: ঈমান ও জ্ঞান। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র সেই মানদণ্ডকে বাতিল করে দিয়েছে। আজ মর্যাদা নির্ধারণ করে কাগজের সার্টিফিকেট, অনুমোদনের লাইসেন্স, এবং আইনি স্বীকৃতি। আপনি তখনই ডাক্তার, শিক্ষক, বা ব্যবসায়ী হতে পারবেন—যখন আপনি রাষ্ট্র-স্বীকৃত একটি নথিপত্র অর্জন করতে পারবেন, তা আপনি সত্যিকার অর্থে দক্ষ হোন বা না হোন।(সূরা মুজাদিলা, ৫৮:১১)
এই কাঠামো একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। কারণ যদি মানুষের পরিচয় কেবল ‘মুসলমান’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতো, যদি মানুষ নিজেদের আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল উম্মাহর সদস্য হিসেবে অনুভব করত, তবে রাষ্ট্রের তৈরি আইন, সংবিধান, সীমান্ত, লাইসেন্স—এসবই এক ধাক্কায় অর্থহীন হয়ে যেত। মানুষ আর ‘সংবিধান’কে সর্বোচ্চ আইন বলে মানত না; বরং কুরআন ও সুন্নাহকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বলে গ্রহণ করত। তখন কেউ আর লাইসেন্সের জন্য দ্বীন বিক্রি করতো না; বরং দ্বীনের জন্য লাইসেন্স প্রত্যাখ্যান করত।
এমন একটি অবস্থান, যেখানে মানুষ সরাসরি আল্লাহর আইনকে জীবনের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করে, আধুনিক রাষ্ট্র কখনোই তা সহ্য করতে পারে না। কারণ এতে করে তার মূল অস্তিত্বই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তাই রাষ্ট্র পরিচয়ের পুরো কাঠামো এমনভাবে গড়ে তুলেছে, যেন একজন ব্যক্তি নিজেকে নয়, বরং তার ‘আইডি নম্বর’, ‘সার্টিফিকেট কোড’ কিংবা ‘ভোটার তালিকার নাম্বার’—এইসবকেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। মানুষ চায় রাষ্ট্রের চোখে বৈধ হতে, চায় আদালতে গ্রহণযোগ্য হতে, চায় লাইসেন্সধারী নাগরিক হতে—
Even if it means losing his identity as a Muslim.
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো—এই পরিচয় কাঠামোর অন্তর্নিহিত ফিতনা ও প্রকৃত স্বরূপকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা, এবং ইসলামী তাওহীদভিত্তিক চিন্তার আলোকে একটি বিকল্প পরিচয়বোধ, বিকল্প কর্তৃত্ববোধ এবং বিকল্প নেতৃত্বের কাঠামো গড়ে তোলা। আমাদেরকে এই রাষ্ট্রনির্ভর, কাগজনির্ভর জীবনের মোহ থেকে মুক্ত হতে হবে। এমন এক জীবনে ফিরে যেতে হবে, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে বুঝবে, এবং তার পরিচয়ের ভিত্তি হবে ঈমান, তাকওয়া ও উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন বন্ধন—
Not a Biometric ID or a QR-coded existence.
শেষ কথা, যতদিন আমরা এই পরিচয় ব্যবস্থাগুলোকে নিরপেক্ষ, প্রযুক্তিগত, অথবা ‘নাগরিক সুবিধা’র নিরীহ যন্ত্র মনে করব, ততদিন আমরা ধরতেই পারব না—আমাদের ঈমান কীভাবে ধীরে ধীরে যজ্ঞে উৎসর্গ করা হচ্ছে। যতদিন না আমরা এই শেকলের ধাতব শব্দ শুনে চমকে উঠি, ততদিন আমরা মুক্তির পথ চিনতে পারব না।
আল্লাহ আমাদের এই ফিতনাকে চিনে নেয়ার বুদ্ধি দিন, এবং তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রয়োজনীয় তাওফিক, সাহস ও হিদায়াহ দান করুন। আমীন।।