“আরব বিশ্বে ইসরাইলের আগ্রাসী নীল নকশা
।।মাহমুদ শীছ খাত্তাব ||
এর থেকে– ১০ম পর্ব
৩. অর্থনৈতিক কারণ
যারা ইসরাঈলের ভৌগলিক অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, দেখেছেন এর কৃষির প্রয়োজনীয়তা ও য়াহূ দী উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপক উদ্যোগ, তারা অবশ্যই উপলদ্ধি করবেন যে, এ সমস্যা সমাধানের জন্য মাত্র দু'টি বিকল্প রয়েছে।
(ক) মূল বাসিন্দাদের উৎখাত করে উর্বর আরব ভূমি দখলের মাধ্যমে ইসরাঈলের সীমানা সরাসরি বিস্তৃত করা।
(খ) আরবের পানি ব্যবহারের মাধ্যমে নাজার এলাকার উন্নয়ন--যে পানির উৎস স্রোত এমনকি তার মোহনা পর্যন্ত আরবভূমিতে অবস্থিত। ইসরাঈল তার নাজাব এলাকা সেচ করবার জন্য নদীর স্রোত বিভিন্ন দিকে বিভক্ত করেছে। যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৯৬৪ সালের ১ম আরব শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিনিধিগণ জর্ডান নদীর উপনদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসরাঈল তার অধিকৃত ভূমিতে যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপসমূহ নিয়েছে তা সংক্ষেপে হলো এইঃ
১. যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা বরাবর য়াহূ দী বসতি স্থাপন। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবস্থানসমূহে ইসরাঈল ঘাঁটি গেড়েছে।
২. সমস্ত নগরী ও গ্রামসমূহ থেকে অধিবাসীদের উৎখাত করা এই খোড়া অজুহাতে যে, তারা প্যালেস্টাইন প্রতিরোধ শক্তিসমূহকে সহযোগিতা করে।
অন্যান্য কৌশলের মধ্যে এটি একটি ব্যাপক দণ্ডযোগ্য কৌশল যা সে সম্প্রতি অবলম্বন করেছে তার সম্প্রসারণবাদী উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ।
৩. জেলাসমূহের নতুন য়াহূ দী নামকরণ এবং তখনকার সমস্ত আরব নিদর্শন মুছে ফেলার মাধ্যমে অধিকৃত আরব এলাকায় য়াহূ দীবাদের ছাপ দিতে চেষ্টা করা।
৪. অধিকৃত আরবভূমি থেকে বাসিন্দাদেরকে বের করে নির্বাসন দেওয়া এবং তাদের ঘরবাড়ী ধ্বংস করে সমস্ত অঞ্চলকে খালি করে ফেলা।
(গ) ইসরাঈলের প্রতিরক্ষা। ইসরাঈলের মূল ভূখণ্ড এবং ‘৬৭-এর জুন যুদ্ধে অধিকৃত ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষার জন্য প্রবল প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন একটি উপযুক্ত সেনাবাহিনী অবশ্য প্রয়োজন।[1] সে কারণেই ইসরাঈল তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য সমস্ত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করছে এবং তার জনগণকে বস্তুগত ও নৈতিক উভয় প্রকারেই শক্তিশালী করে তুলছে।
মোশেদায়ান সেনাবাহিনী প্রধান থাকা কালে ১৯৫৫ সালের ৫ই জানুয়ারী লিখিত 'ইসরাঈলের সীমানা ও নিরাপত্তা সমস্যা' নামক এক নিবন্ধে বলেন যে, ইসরাঈল অস্বাভাবিক রকমের জটিল এক নিরাপত্তা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। দেশের আয়তন ৮১,০০০ বর্গমাইলের বেশী হবে না। তার সীমানা ৪০০ মাইল বিস্তৃত। এর তিনচতুর্থাংশ জনসংখ্যা হাইফা বন্দরের উত্তর থেকে তেল-আবিবের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল ভূমিতে বাস করে। ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান সীমান্তের মধ্যবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ এই সরু ফালিটির প্রস্থ ১২ মাইল অতিক্রম করবে না। জেরুজালেমের ইসরাঈলী পার্লামেন্টের (নেসেট) মাত্র কয়েক শত মিটার দূরেই জর্ডানী সেনাবাহিনীকে দেখতে পাওয়া যায়।
উপকূলীয় সমতল ভূমিতে অবস্থিত ইসরাঈলের মিলিটারী হেড কোয়ার্টা- রগুলো জর্ডানের সীমান্তবর্তী পাহাড়গুলো থেকে খুব ভালভাবেই দেখা যায়। প্রধান সড়ক ও রেলপথগুলো খুব সহজ এবং জলদি হামলার জন্য খুলে দেওয়া যাবে। তাই বলতে গেলে শত্রুর গোলার নাগালের বাইরে ইসরাঈলের কোন স্থানই নেই নাজাব মরু এলাকা ছাড়া।[2]
ইসরাঈলী তদন্ত ব্যুরো প্রধান হেইম হার্জগ (Haim Hertzog ) মিলিটারী সেন্সরশীপের উপরে বক্তৃতা প্রবর্তন করেন। তিনি ১৯৬১-এর ৩০শে মে তেল আবিবে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে যোগদানরত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার (IPL) প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করেন যে, আপনারা এখন ইসরাঈলের সংগে যুদ্ধাবস্থায় উপনীত জর্ডানী সেনাবাহিনীর মধ্যম ধরনের বন্দুকের নাগালের মধ্যে বসে আছেন। এখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে হার্জলিয়ায় (Hertzlia) আপনারা সম্মেলন করার পরিকল্পনা করেছিলেন--যা ছিল ঐ একই সেনাবাহিনীর ভূমিবন্দুকের (Field gun ) নাগালের মধ্যে। আপনারা ইসরাঈলী পার্লামেন্ট নেসেট (Kenesset) পরি দর্শন করবেন সেটাও জর্ডানী সেনাবাহিনীর মর্টারের গোলার নাগালে, যেখানে লোকেরা ঐ সমস্ত সরকারী অফিস ভবনেই পিস্তলের গুলির দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।[3] এক্ষণে এই সমস্যার সমাধান কি?
ইসরাঈলী হেরাট (Heirut) পার্টির[4] এ্যাংলো-স্যাকসন বিষয়ক কৰ্মকর্তা আইজাক লাইবারম্যান এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ইসরাঈলকে বিদ্যুৎগতিতে একটা ত্বরিৎ হামলা চালাতে হবে এবং গাযা এলাকা সহ সীমান্তের সকল সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দখল করে নিতে হবে। অতঃপর সমস্ত জর্ডানে ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে।[5]
১৯৫৬ সালে মিসরের উপর ত্রয়ী হামলার সময় বেন গুরিয়ান ইসরাঈলের নেসেটে উক্ত হামলার পক্ষে বলেন যে, এই হামলা ইসরাঈলের নিরাপত্তাকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করবে, শত্রুর হাত থেকে তাকে রক্ষা করবে এবং তার পূর্বপুরুষদের ভূমিকে অন্যায়ভাবে দখলকারীদের কবল থেকে মুক্ত করবে।
১৯৬৭ সালে লেভি ইস্কল বেন গুরিয়ানের ন্যায় একই যুক্তি পেশ করেন এবং তা বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব মোশেদায়ান ও তার সেনাবাহিনীর উপর ছেড়ে দেন।
ইসরাঈল তার দখলকৃত আরবভূমি স্বীয় অধিকারে রাখার জন্য বার বার সীমান্ত নিরাপত্তার অজুহাত খাড়া করে থাকে। কিন্তু ইসরাঈলীরা সীমান্ত নিরাপত্তা চায় কেন? গাযা সেকটর, আল-আরিশ এবং সিনাই এলাকায় ইসরাঈলের আগ্রাসী লক্ষ্য সবারই জানা কথা। শেরম আল-শেইখ এবং আকাবা উপসাগরের পশ্চিম তীর দখলের ফলে আকাবা সাগরের নৌপথ ও ইলিয়াট প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো। সুয়েজ খালের পূর্বতীর দখলের ফলে পূর্ব ও পশ্চিমের এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রেখাটি ইসরাঈলের নৌ-চলা চলের জন্য নিরাপদ রইল। এই খাল ট্যাংকসমূহের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক- ভাবেই একটি দারুণ বাধার সৃষ্টি করেছে। খালের দখলকৃত পূর্বতীরে যখনই আরবদের দ্বারা কোন হামলা আসবে এবং উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় হবে, তখন আরব বাহিনী খোলা ময়দানে বের হ'তে বাধ্য হবে, যা তাদেরকে ব্যাপক বিমান হামলার সম্মুখীন করবে।
বিমান শক্তির আধিপত্যসহ সিনাই দখল সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র বরাবর সীমান্তকে যে কোন বড় রকমের সামরিক বিপদ থেকে ইসরাঈলকে রক্ষা করবে। জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর দখলের ফলে পূর্বতীর সুনিশ্চিতভাবে পানির বাধার কারণে প্রাকৃতিক নিয়মেই নিরাপদে থাকবে।
সিরীয় উপত্যকায় অনেকগুলো পানির উৎস রয়েছে। অধিকন্তু এর এক- দিকে পূর্বাঞ্চলীয় ইসরাঈলী কলোনী ও উত্তর দিকে সিরীয় ভূমি থাকার প্রেক্ষাপটে এটি একটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। গোলানে (Goulan ) সিরীয় আরব বাহিনীর উপস্থিতি ইসরাঈলের নিরাপত্তার জন্য একটি সরাসরি হুমকি। অতএব ইসরাঈল তার উত্তর সীমান্তের প্রতিরক্ষার জন্যও এই সামরিক কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটির উপর এবং এই উপত্যকা ও হারমন পর্বতের পানির উৎসগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এই এলাকাটিকে নিজ দখলে আনা অত্যন্ত জরুরী মনে করে। ওদিকে 'গোলানে ইসরাঈলী বাহিনী পূর্বে ডেরা (Deraa) এবং পশ্চিমে দামেশ্বক পর্যন্ত বিস্তৃত সিরীয় ভূখণ্ডের জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে।
সিরীয় উপত্যকার একটি বিশেষ সামরিক কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। যারা এই উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করবে তারাই লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও প্যালেস্টাইন নিয়ন্ত্রণ করবে।
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে ১৩ হিজরী সনের ঐতিহাসিক ইয়ারমুকের যুদ্ধ এইস্থানেই সংঘটিত হয়। এবং এ কথা সবাই জানেন যে, ইয়ারমুক ছিল একটি সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এবং এই অঞ্চলের উপর মুসলিম শক্তির নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়ার ফলে তাদের পক্ষে লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান ও প্যালেস্টাইন বিজয় অতি সহজেই সম্ভব হয়।
এ কারণেই ১৯৬৭-এর জুন যুদ্ধের পরে মোশেদায়ান ঘোষণা করেন, ইসরাঈলী সীমান্তসমূহের প্রতিরক্ষা পূর্বে যা ভাবা হতো, তার চেয়ে এখন অনেক বেশী সহজ হয়েছে।[6]
ইসরাঈলের শাসক লেবার পার্টি'র সম্মেলনে যা ১৯৬৯-এর ৫ই আগস্ট সমাপ্ত হয়--এ কথা প্রকাশ করা হয় যে, ইসরাঈল তার অধিকৃত এলাকা থেকে সরে আসবে না। মোশেদায়ান, যিনি এই পার্টির অন্যতম প্রধান নেতা—ঘোষণা করেন যে, ইসরাঈল তার অধিকৃত জেরুজালেম, গাযা, সিনাই, সিরিয়া উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরে অবস্থান করতে চায়। ইসরাঈল জর্ডান নদীকে তার নিরাপদ পূর্ব সীমান্ত বলে মনে করে।
[1]. ইসরাঈলীসেনাবাহিনীতেনিয়মিতযোদ্ধাসংখ্যাবর্তমানে (১৯৭০) ইং২৫হাজারথেকে৮০হাজারেউন্নীতহয়েছে।-লেখক
[2]. American foreign affairs magazine p. 250. Issue of January 1955.
[3]. (T.C. Hurewitz) : The role of the military and government in Israel.
[4]. Terrorist-roots for the Israili Heirut party, Bassam Abu Gazaleh, Beirut, 1966. P. 67-75.
[5]. A declaration published in the pamphlet `The Arab Palestinian refugee’ The Arab Palestinian refugees office, April 1956.
পুনরুক্তিরকারণেপরবর্তীপ্যারাটিরঅনুবাদবাদদেওয়াহলো।- অনুবাদক
[6]. এইঘোষণা১৯৬৭-এরজুলাইমাসেরপ্রথমার্ধেকরাহয়এবংঐসময়কারবিভিন্নসংবাদমাদ্যমওপত্র –পত্রিকাথেকেএতথ্যসংগ্রহকরাহয়।- লেখক
আরও পড়ুন
৯ম পর্ব ---------------------------------------------------------------------------------------------- একাদশ পর্ব
Comment