আপনারা যারা আমার দুটি লেখা— “শিক্ষা ব্যবস্থা” ও “বাজেটের চোরাবালি”— নিয়মিত অনুসরণ করছেন, নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি প্রায়ই একই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করছি। কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতে, কখনো একেবারে নতুন কাঠামো ও ভাষায়। বিষয়বস্তুর ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও, সব লেখায় একটি নির্দিষ্ট ফেতনা বা উপদ্রবকে সামনে আনার চেষ্টা সুস্পষ্ট।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে—এই পুনরাবৃত্তির কারণ কী? এটা কি সেই বহুল পরিচিত “খাঁজ কাটা কুমির” গল্পের মতো? যেখানে এক ছাত্র যে বিষয়েই রচনা লিখতে বসুক না কেন, শেষমেশ রচনাটা ঘুরেফিরে ‘কুমির’ নিয়েই শেষ হয়?
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, আমি কি কোনো এক বিষয়েই আটকে গেছি? না কি এটা একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলসেমি? আসলে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো।
আজকের লেখায় আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করব। কেন আমি একেই কথাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছি? কেন নতুন তথ্যের ভেতরেও বারবার একই রন্ধ্র ধরিয়ে দিচ্ছি? এটা কেবল লেখার অভ্যাস নয়; বরং এটা একটি সচেতন দাওয়াহি কৌশল—একটি চিন্তার রিপিটেটিভ স্ট্র্যাটেজি, যার লক্ষ্য হচ্ছে পাঠকের মাঝে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্ন, এক ধরনের ঝাঁকুনি, এবং একটি বিকল্প চেতনার জন্ম দেওয়া।
কারণ, একটি বড় ফেতনার বিরুদ্ধে একবার বলে থেমে গেলে কাজ হয় না। যেমন কুরআনে একই বিষয়ে বহু আয়াত বারবার এসেছে, নবীজি (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বিভিন্ন হাদীসে একই মেসেজ বারবার দিয়েছেন—ভিন্ন প্রসঙ্গে, ভিন্ন ভাষায়, কিন্তু মূল বার্তাটি ছিল এক: জাহেলিয়াত ভেঙে ঈমানি সমাজ গঠন।
১.
যদিও আমি হাফেজ নই, আলেম নই বা তাফসিরকারকও নই, তবুও কুরআন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে যা কিছু জ্ঞান ও উপলব্ধি আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে, তার আলোকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা যখন কুরআনে নবী (عليهم السلام)'দের কথা বলেছেন, তখন এক অপরিবর্তনীয় মূল বিষয় সব নবী (عليهم السلام)'দের ক্ষেত্রে সর্বদা একই রূপে উপস্থিত ছিল—সে হলো তাওহীদ, অর্থাৎ এক আল্লাহর বিশ্বাস এবং তাঁর একত্বের দাওয়াত।
তবে একই সঙ্গে প্রতিটি নবী (عليهم السلام)'র সাথে সংশ্লিষ্ট জাতি বা সমাজের বড় ফেতনাকেও আল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যেটি তাদের সময়ের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল ও গালিব ছিল। যেমন:
নবী ইব্রাহিম (عليه السلام) এর যুগে সবচেয়ে বড় ফেতনা ছিল মূর্তিপূজা। কুরআনে এসেছে,
قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَـٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِىٓ أَنتُمْ لَهَا عَـٰكِفُونَ
"তিনি যখন তাঁর পিতা ও জাতিকে বললেন, 'তোমরা কেন এই মূর্তিগুলোর উপাসনা করছ?'" (সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৫২)
নবী লূত (عليه السلام) এর যুগে সমাজে প্রচলিত ছিল সমকামিতা—একটি মারাত্মক সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, যার বিরুদ্ধে আল্লাহ স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।
أَتَأْتُونَ ٱلذُّكْرَانَ مِنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ
"তোমরা কি সৃষ্টিজগতের মধ্য থেকে পুরুষদের সঙ্গেই যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হও"
(সূরা আশ-শুআরা, ২৬:১৬৫)
আদ ও সামূদ জাতির সময় ছিল অহংকার, অবিচার ও অন্যায় প্রভাব বিস্তার, যা আল্লাহর প্রেরিত আযাবের কারণ হয়েছিল।
أَتَبْنُونَ بِكُلِّ رِيعٍ ءَايَةً تَعْبَثُونَ
"তোমরা কি প্রতিটি উঁচু জায়গায় স্মারক নির্মাণ করো আর অবৈধ উচ্চাশায় বসবাস করো?" (সূরা আশ-শুআরা, ২৬:১২৮)
এখানে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহর সুন্নাহ হলো প্রতিটি যুগের মানুষের সামনে তাদের সবচেয়ে বড় ফেতনার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং তাদের নবীদের মাধ্যমে সেই ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার দাওয়াত দেওয়া।
আমাদের আজকের জীবনে এই ফেতনার সর্ববৃহৎ রূপটি হল জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এটি একটি নতুন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো, যা মুসলমানদের ঐক্য ও উম্মাহর ধারণাকে ধ্বংস করছে। এই ব্যবস্থা থেকেই জন্ম নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, নারীবাদ, লিবারেলিজম ইত্যাদি মতবাদ, যেগুলো মূলত জাতি-রাষ্ট্রের বাই-প্রোডাক্ট বা আনুষঙ্গিক ফলাফল মাত্র।
এই সমস্ত ধারণা ও ব্যবস্থাপনা ইসলামের মূল নীতি ও শরীয়াহর বিপরীতে কাজ করে এবং মুসলিম সমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে দেয়।
সুতরাং, আমি বারবার একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি কারণ এটি আল্লাহ সুবহানাতায়ালার সুন্নাহ। নবী-রাসূল (عليهم السلام)'দের জীবনে এবং তাদের মাধ্যমে মানব জাতির প্রতি বারবার পুনরাবৃত্তি ও জোর দিয়ে একই মূল বার্তা প্রদান—এটাই হচ্ছে আল্লাহর নিয়ম ও পদ্ধতি।
২.
একইভাবে, বারবার একই সত্যের পুনরাবৃত্তি এবং নিরন্তর গুরুত্ব আরোপ করা ছিল আল্লাহর রাসূল (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)-এর সুন্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি তার জীবনে বারংবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন এবং তা নবীদের রীতি অনুসরণ করে বারবার মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যেন তারা ভুলে না যায় এবং সংশোধিত হতে পারে।
রাসূল (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতিতে একাধিকবার একই নীতিমালা বা গুরুত্বপূর্ণ কথা পুনরাবৃত্তি করেছেন। যেমন, তিনি অনেকবার জোর দিয়ে মানুষের হৃদয়ে তাওহীদ এর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। বিভিন্ন হাদিসে দেখা যায়, যখনই কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সাহাবী (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ)'কে নতুন কিছু শিক্ষা বা নির্দেশ দিতেন নবী করিম (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) তা বারংবার বলতেন এবং প্রয়োজনমতো সংযোজন করতেন। এর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হল তাঁর খুতবা (বক্তব্য) ও উপদেশ।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হযরত ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন হযরত উমর (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) কে পবিত্র শহর মক্কায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করছিলেন, তখন তিনি বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে শিরক থেকে সাবধান থাকা এবং এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা রাখা কতটা জরুরি। এর মাধ্যমে নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) তাঁর প্রধান দাওয়াহর বিষয়কে বারবার জোর দিয়ে বলেছিলেন, যেন কেউ তা ভুলে না যায়।
আরেকটি দৃষ্টান্ত, হযরত আবু হুরায়রা (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) থেকে বর্ণিত, নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) সাহাবীদের মাঝে প্রায়ই পুনরাবৃত্তি করতেন যে “ইসলাম হলো সহজ”, “অত্যধিক কঠোরতা বর্জন করো” — এই বার্তাগুলো বারবার বলার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে সুস্থ মনোভাব ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।
বিভিন্ন সীরাত ও হাদিস থেকে জানা যায় যে নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বারবার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতেন, যেন মানুষ সহজেই তা উপলব্ধি ও হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। তিনি বুঝতেন যে, বারবার শ্রবণ ও পুনরাবৃত্তি না হলে মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়।
অতএব, নবী করিম (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)-এর এই পুনরাবৃত্তির পদ্ধতি ছিল একটি দাওয়াহ ও তালিমের কৌশল, যা মানুষের মনকে প্রশিক্ষিত করত এবং তাদের জ্ঞানের ভিতকে শক্তিশালী করত। এটি ছিল আল্লাহর সুন্নাহর অংশ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা।
৩.
বারবার একই জিনিস উপস্থাপন করা এবং তা উম্মাহর সামনে নিয়ে আসা দাওয়াতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। ইসলামী ইতিহাসে নবী করিম صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ'র সুন্নাহ অনুসারে বারবার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও শিক্ষা পুনরায় জানানো হয়ে থাকে, যা শ্রোতাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং বার্তার গুরুত্ব রক্ষা করে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে এই কৌশলটি নতুন কিছু নয়; বরং এটি মনের ওপর বার্তা প্রতিষ্ঠার এক প্রমাণিত উপায়।
সমাজে যখন বিভিন্ন ধরনের ফেতনা ও বিভ্রান্তি বিরাজমান থাকে, তখন এই কৌশল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বারবার একাধিকবার একই বিষয় উপস্থাপন করলে মানুষের মন ও চিন্তাভাবনায় সেটি দৃঢ় হয়ে যায় এবং তারা সহজেই প্রকৃত ফেতনা এবং ফেতনা সৃষ্টিকারী শত্রুদের চিহ্নিত করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ নানা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফিতনার মুখোমুখি। এই ফেতনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বারংবার একই বার্তা পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আল-কায়েদাতুল জিহাদ একটি ঐতিহাসিক সংগঠন হিসেবে এই পদ্ধতিটি বেছে নিয়েছে। তারা তাদের মানহাজে বারংবার একই বিষয় উপস্থাপন করে, যা তাদের অনুসারীদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য, সচেতনতা এবং সংগ্রামের মনোবল তৈরি করে। তাদের বার্তাগুলো খুব স্পষ্ট: বিশ্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, শত্রুদের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা এবং জিহাদের মাধ্যমে উম্মাহর পুনরুজ্জীবন সাধন। তারা এই কৌশলকে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে, যা তাদের কার্যকরীতা বাড়িয়েছে।
কন্যা সম্মত তানজিমের মানহাজে এই পুনরাবৃত্তি কৌশলকে শুধুমাত্র ভাষণ বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং এটি একটি ব্যাপক চিন্তাধারা ও কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি দাওয়াতকে ধারাবাহিক ও সুসংগঠিত করে এবং অনুসারীদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ চেতনা তৈরি করে।
ফলে, বারবার একই জিনিস উপস্থাপন করার এই পদ্ধতি শুধু একটি ভাষাগত কৌশল নয়, বরং এটি দাওয়াত ও আন্দোলনের এক গুরুত্তপূর্ণ হাতিয়ার, যা মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক সচেতনতা ও সংহতি বৃদ্ধিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এটি ফেতনা সৃষ্টিকারী শক্তি ও শত্রুদের চিহ্নিতকরণে দাওয়াতকারীদের সক্ষম করে, যা আজকের সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে—এই পুনরাবৃত্তির কারণ কী? এটা কি সেই বহুল পরিচিত “খাঁজ কাটা কুমির” গল্পের মতো? যেখানে এক ছাত্র যে বিষয়েই রচনা লিখতে বসুক না কেন, শেষমেশ রচনাটা ঘুরেফিরে ‘কুমির’ নিয়েই শেষ হয়?
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, আমি কি কোনো এক বিষয়েই আটকে গেছি? না কি এটা একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক আলসেমি? আসলে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো।
আজকের লেখায় আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার চেষ্টা করব। কেন আমি একেই কথাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছি? কেন নতুন তথ্যের ভেতরেও বারবার একই রন্ধ্র ধরিয়ে দিচ্ছি? এটা কেবল লেখার অভ্যাস নয়; বরং এটা একটি সচেতন দাওয়াহি কৌশল—একটি চিন্তার রিপিটেটিভ স্ট্র্যাটেজি, যার লক্ষ্য হচ্ছে পাঠকের মাঝে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্ন, এক ধরনের ঝাঁকুনি, এবং একটি বিকল্প চেতনার জন্ম দেওয়া।
কারণ, একটি বড় ফেতনার বিরুদ্ধে একবার বলে থেমে গেলে কাজ হয় না। যেমন কুরআনে একই বিষয়ে বহু আয়াত বারবার এসেছে, নবীজি (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বিভিন্ন হাদীসে একই মেসেজ বারবার দিয়েছেন—ভিন্ন প্রসঙ্গে, ভিন্ন ভাষায়, কিন্তু মূল বার্তাটি ছিল এক: জাহেলিয়াত ভেঙে ঈমানি সমাজ গঠন।
১.
যদিও আমি হাফেজ নই, আলেম নই বা তাফসিরকারকও নই, তবুও কুরআন অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে যা কিছু জ্ঞান ও উপলব্ধি আমার মধ্যে তৈরি হয়েছে, তার আলোকে আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছি। আল্লাহ তায়ালা যখন কুরআনে নবী (عليهم السلام)'দের কথা বলেছেন, তখন এক অপরিবর্তনীয় মূল বিষয় সব নবী (عليهم السلام)'দের ক্ষেত্রে সর্বদা একই রূপে উপস্থিত ছিল—সে হলো তাওহীদ, অর্থাৎ এক আল্লাহর বিশ্বাস এবং তাঁর একত্বের দাওয়াত।
তবে একই সঙ্গে প্রতিটি নবী (عليهم السلام)'র সাথে সংশ্লিষ্ট জাতি বা সমাজের বড় ফেতনাকেও আল্লাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, যেটি তাদের সময়ের মধ্যে সর্বাধিক প্রবল ও গালিব ছিল। যেমন:
নবী ইব্রাহিম (عليه السلام) এর যুগে সবচেয়ে বড় ফেতনা ছিল মূর্তিপূজা। কুরআনে এসেছে,
قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَـٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِىٓ أَنتُمْ لَهَا عَـٰكِفُونَ
"তিনি যখন তাঁর পিতা ও জাতিকে বললেন, 'তোমরা কেন এই মূর্তিগুলোর উপাসনা করছ?'" (সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:৫২)
নবী লূত (عليه السلام) এর যুগে সমাজে প্রচলিত ছিল সমকামিতা—একটি মারাত্মক সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, যার বিরুদ্ধে আল্লাহ স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।
أَتَأْتُونَ ٱلذُّكْرَانَ مِنَ ٱلْعَـٰلَمِينَ
"তোমরা কি সৃষ্টিজগতের মধ্য থেকে পুরুষদের সঙ্গেই যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হও"
(সূরা আশ-শুআরা, ২৬:১৬৫)
আদ ও সামূদ জাতির সময় ছিল অহংকার, অবিচার ও অন্যায় প্রভাব বিস্তার, যা আল্লাহর প্রেরিত আযাবের কারণ হয়েছিল।
أَتَبْنُونَ بِكُلِّ رِيعٍ ءَايَةً تَعْبَثُونَ
"তোমরা কি প্রতিটি উঁচু জায়গায় স্মারক নির্মাণ করো আর অবৈধ উচ্চাশায় বসবাস করো?" (সূরা আশ-শুআরা, ২৬:১২৮)
এখানে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহর সুন্নাহ হলো প্রতিটি যুগের মানুষের সামনে তাদের সবচেয়ে বড় ফেতনার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং তাদের নবীদের মাধ্যমে সেই ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার দাওয়াত দেওয়া।
আমাদের আজকের জীবনে এই ফেতনার সর্ববৃহৎ রূপটি হল জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এটি একটি নতুন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো, যা মুসলমানদের ঐক্য ও উম্মাহর ধারণাকে ধ্বংস করছে। এই ব্যবস্থা থেকেই জন্ম নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, নারীবাদ, লিবারেলিজম ইত্যাদি মতবাদ, যেগুলো মূলত জাতি-রাষ্ট্রের বাই-প্রোডাক্ট বা আনুষঙ্গিক ফলাফল মাত্র।
এই সমস্ত ধারণা ও ব্যবস্থাপনা ইসলামের মূল নীতি ও শরীয়াহর বিপরীতে কাজ করে এবং মুসলিম সমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে দেয়।
সুতরাং, আমি বারবার একই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি কারণ এটি আল্লাহ সুবহানাতায়ালার সুন্নাহ। নবী-রাসূল (عليهم السلام)'দের জীবনে এবং তাদের মাধ্যমে মানব জাতির প্রতি বারবার পুনরাবৃত্তি ও জোর দিয়ে একই মূল বার্তা প্রদান—এটাই হচ্ছে আল্লাহর নিয়ম ও পদ্ধতি।
২.
একইভাবে, বারবার একই সত্যের পুনরাবৃত্তি এবং নিরন্তর গুরুত্ব আরোপ করা ছিল আল্লাহর রাসূল (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)-এর সুন্নাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি তার জীবনে বারংবার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছেন এবং তা নবীদের রীতি অনুসরণ করে বারবার মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন, যেন তারা ভুলে না যায় এবং সংশোধিত হতে পারে।
রাসূল (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতিতে একাধিকবার একই নীতিমালা বা গুরুত্বপূর্ণ কথা পুনরাবৃত্তি করেছেন। যেমন, তিনি অনেকবার জোর দিয়ে মানুষের হৃদয়ে তাওহীদ এর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং শিরক থেকে সতর্ক করেছেন। বিভিন্ন হাদিসে দেখা যায়, যখনই কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সাহাবী (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ)'কে নতুন কিছু শিক্ষা বা নির্দেশ দিতেন নবী করিম (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) তা বারংবার বলতেন এবং প্রয়োজনমতো সংযোজন করতেন। এর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হল তাঁর খুতবা (বক্তব্য) ও উপদেশ।
একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো হযরত ইবনে আব্বাস (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন হযরত উমর (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) কে পবিত্র শহর মক্কায় প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করছিলেন, তখন তিনি বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে শিরক থেকে সাবধান থাকা এবং এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা রাখা কতটা জরুরি। এর মাধ্যমে নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) তাঁর প্রধান দাওয়াহর বিষয়কে বারবার জোর দিয়ে বলেছিলেন, যেন কেউ তা ভুলে না যায়।
আরেকটি দৃষ্টান্ত, হযরত আবু হুরায়রা (رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ) থেকে বর্ণিত, নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) সাহাবীদের মাঝে প্রায়ই পুনরাবৃত্তি করতেন যে “ইসলাম হলো সহজ”, “অত্যধিক কঠোরতা বর্জন করো” — এই বার্তাগুলো বারবার বলার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের মধ্যে সুস্থ মনোভাব ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।
বিভিন্ন সীরাত ও হাদিস থেকে জানা যায় যে নবী (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) বারবার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতেন, যেন মানুষ সহজেই তা উপলব্ধি ও হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। তিনি বুঝতেন যে, বারবার শ্রবণ ও পুনরাবৃত্তি না হলে মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলা সম্ভব নয়।
অতএব, নবী করিম (صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ)-এর এই পুনরাবৃত্তির পদ্ধতি ছিল একটি দাওয়াহ ও তালিমের কৌশল, যা মানুষের মনকে প্রশিক্ষিত করত এবং তাদের জ্ঞানের ভিতকে শক্তিশালী করত। এটি ছিল আল্লাহর সুন্নাহর অংশ এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা।
৩.
বারবার একই জিনিস উপস্থাপন করা এবং তা উম্মাহর সামনে নিয়ে আসা দাওয়াতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। ইসলামী ইতিহাসে নবী করিম صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ'র সুন্নাহ অনুসারে বারবার গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও শিক্ষা পুনরায় জানানো হয়ে থাকে, যা শ্রোতাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং বার্তার গুরুত্ব রক্ষা করে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে এই কৌশলটি নতুন কিছু নয়; বরং এটি মনের ওপর বার্তা প্রতিষ্ঠার এক প্রমাণিত উপায়।
সমাজে যখন বিভিন্ন ধরনের ফেতনা ও বিভ্রান্তি বিরাজমান থাকে, তখন এই কৌশল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বারবার একাধিকবার একই বিষয় উপস্থাপন করলে মানুষের মন ও চিন্তাভাবনায় সেটি দৃঢ় হয়ে যায় এবং তারা সহজেই প্রকৃত ফেতনা এবং ফেতনা সৃষ্টিকারী শত্রুদের চিহ্নিত করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ নানা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফিতনার মুখোমুখি। এই ফেতনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বারংবার একই বার্তা পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আল-কায়েদাতুল জিহাদ একটি ঐতিহাসিক সংগঠন হিসেবে এই পদ্ধতিটি বেছে নিয়েছে। তারা তাদের মানহাজে বারংবার একই বিষয় উপস্থাপন করে, যা তাদের অনুসারীদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য, সচেতনতা এবং সংগ্রামের মনোবল তৈরি করে। তাদের বার্তাগুলো খুব স্পষ্ট: বিশ্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, শত্রুদের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা এবং জিহাদের মাধ্যমে উম্মাহর পুনরুজ্জীবন সাধন। তারা এই কৌশলকে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে, যা তাদের কার্যকরীতা বাড়িয়েছে।
কন্যা সম্মত তানজিমের মানহাজে এই পুনরাবৃত্তি কৌশলকে শুধুমাত্র ভাষণ বা বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং এটি একটি ব্যাপক চিন্তাধারা ও কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি দাওয়াতকে ধারাবাহিক ও সুসংগঠিত করে এবং অনুসারীদের মধ্যে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ চেতনা তৈরি করে।
ফলে, বারবার একই জিনিস উপস্থাপন করার এই পদ্ধতি শুধু একটি ভাষাগত কৌশল নয়, বরং এটি দাওয়াত ও আন্দোলনের এক গুরুত্তপূর্ণ হাতিয়ার, যা মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক সচেতনতা ও সংহতি বৃদ্ধিতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। এটি ফেতনা সৃষ্টিকারী শক্তি ও শত্রুদের চিহ্নিতকরণে দাওয়াতকারীদের সক্ষম করে, যা আজকের সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জরুরি।
Comment