একটি সূক্ষ্ম ধোঁকা: ফ্যাসিস্ট বিরোধী হতে গিয়ে গণতান্ত্রিক হয়ে পড়ো না
হাসিনার পতনের পর সবচেয়ে বেশি হাইলাইট হচ্ছে: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আবহটা এমন দাঁড়াচ্ছে যেন হাসিনাবিরোধী আন্দোলনটা হয়েছিলই গণতান্ত্রিক কুফরি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রচ্ছন্নভাবে আমরা ধোঁকার শিকার হচ্ছি। আমাদেরকে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে দেয়া হচ্ছে: ফ্যাসিবাদ-গণতন্ত্র। ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে এখন গণতন্ত্র ফিরে আসবে। এই দুয়ের বাইরে যাওয়ার সুযোগ আপনার নাই। এভাবেই আমরা প্রতারিত হচ্ছি।
দেশের সাধারণ জনগণ স্বৈরতন্ত্রও বুঝে না, ফ্যাসিবাদও বুঝে না। বুঝে: হাসিনা জালেম ছিল, আলেম উলামাদের হত্যা করেছে, ভারতকে খুশি করেছে, জনগণকে শোষণ করেছে। জনগণ এগুলো বুঝে আর এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই তাদের আন্দোলন। আল্লাহর শরীয়তের বিপরীতে কুফরি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তাদের মাথায় কখনও ছিল না। কিন্তু আমাদেরকে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে: দেশের আপামর জনগণ চাচ্ছে গণতন্ত্র, একটা সুষ্ঠ নির্বাচন হলেই দেশের জনগণ তথা মুসলিমদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে। সুকৌশলে এই আবহ তৈরি করা হচ্ছে। অতএব, হে মুসলিম ভাই, সতর্ক হোন, প্রতারিত হবেন না।
***
স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ জিনিসটা শরীয়তের দৃষ্টিতেও খারাপ। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা যে আঙ্গিকে করা হচ্ছে সেটাতে কৌশলে আমাদের ব্রেইনওয়াশ হচ্ছে। আমাদের মগজে এমন একটা ধারণার জন্ম দেয়া হচ্ছে যেটা মোটাদাগে ইসলামী শাসন ও শাসকদের ইতিহাসের ব্যাপারে আমাদেরকে নেতিবাচক বানিয়ে ফেলবে।
ধরুন বর্তমানে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে আন্দোলন, তাতে হাইলাইট করা হচ্ছে কোন কোন বিষয়:
ক. হাসিনা নির্বাচন তথা জনগণের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতা দখল করেছে। সাংবিধানিক বৈধ পন্থায় আসেনি।
খ. বিরোধী দলকে দমন করেছে, কোনো বিরোধী দলকে সে সহ্য করেনি।
গ. মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে, মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করেছে। … ইত্যাদি ইত্যাদি।
হাসিনার এই যে দোষগুলো, এগুলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কুফরি পর্যায়ের অপরাধ। হাসিনার বিরুদ্ধে তাই আন্দোলন করা ফরয (!!) হয়ে গিয়েছিল!!
ইসলাম বিদ্বেষ এবং আল্লাহর শরীয়তের বিপরীতে ইংরেজদের কুফরি আইন মুসলিমদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া- এই বিষয়টা মোটেই তুলে ধরা হচ্ছে না। কেন? কারণ: কুফরি আইন দিয়ে শাসন মানেই তো গণতন্ত্র। শরীয়াহ আইন তো গণতন্ত্রের দৃষ্টি কুফরের পর্যায়ে। এটা তো তাদের কাছে স্বীকৃতই যে: শাসন হবে ইংরেজদের গণতান্ত্রিক কুফরি শাসন। এ বিষয়ে কথা বলার কিছু নাই!! হাসিনার সমস্যা: সে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল, অন্যদের ভাগ দেয়নি বরং দমন করেছে। গণতান্ত্রিক সেকুলারদের মূল পয়েন্ট এগুলোই, কুফরি শাসন নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি থাকার প্রশ্ন নাই।
কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে আপনার চিন্তা কেমন হবে? শাসনব্যবস্থা যদি কুফরি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে শাসক যেই আসুক আমি তাকে মানতে পারি না। নির্বাচনের মাধ্যমে আসলেও যে কথা অস্ত্রের বলে আসলেও একই কথা। আমার দ্বন্দ্ব নিছক একটা নির্বাচনের সাথে না, শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সাথে না, আমার দ্বন্দ্ব কুফরি শাসনের সাথে। নির্বাচন হওয়া না হওয়া, সাংবিধানিকভাবে বৈধ হওয়া না হওয়ায় আমি একজন মুসলিম হিসেবে এই পয়েন্টে কোনো ব্যবধান করতে পারি না। সর্বাবস্থায়: এই শাসনকে আমি মানতে পারি না। শতভাগ ভোটে নির্বাচিত হলেও আমি একজন মুসলিমের দৃষ্টিতে এই শাসক শরয়ী শাসকের মর্যাদা পাবে না, তার আনুগত্য করার মতো কোনো ভার আমার কাঁধে নাই।
পক্ষান্তরে শাসন যদি শরীয়াহর ভিত্তিতে হয়, তাহলে শাসক যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক: জনসাধারণের সন্তুষ্টিতে আসুক বা অস্ত্রবলেই আসুক - আমি তাকে মেনে নিতে প্রস্তুত। সে কিভাবে ক্ষমতায় আসলো এটা এখানে বড় কোনো ফ্যাক্টর না, বড় বিষয় হলো: সে আল্লাহর দ্বীন দিয়ে আল্লাহর যমিন শাসন করছে কি'না। যদি তা করে তাহলে অস্ত্রবলে ক্ষমতায় আসলেও, বিরোধীদের দমন করলেও আমি তাকে মেনে নিবো (বরং ইসলামে তো বিরোধী দলের কোনো ধারণাই নাই)। এগুলো এখানে মূল বিষয় নয়, মূল বিষয়: শরীয়াহর শাসন বনাম কুফরি গণতান্ত্রিক শাসন। সেকুলাররা এটাই এড়িয়ে যায়, আশপাশের বিষয়গুলোকে মূল হিসেবে দেখিয়ে আমাকে ধোঁকা দেয়।
আপনাকে এখন ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় যে মন্ত্র শিখানো হচ্ছে সে আলোকে আপনি উমাইয়া, আব্বাসী ও উসমানী শাসনকে কি বলবেন? আপনি তো তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠাতে শুরু করবেন।
উমাইয়ারা একশো বছরের মতো শাসন করেছে। এর মধ্যে শুধু উমার বিন আব্দুল আজিজ রহ. আহলুল হল ওয়াল আকদের নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন, বাকি সকল শাসক অস্ত্রবলে ক্ষমতায় ছিলো। সাহাবা তাবিয়িন ও মুসলিম ইমামগণ কি তাদের মেনে নেননি? নিয়েছেন। কারণ? কারণ: তারা ইসলামের সেবক, আল্লাহর যমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠাকারী, কুফরের প্রতি খড়গহস্ত, কুফরের নির্মূলকারী।
এই অস্ত্রবলেই আব্বাসীরা ছয়শো বছর এবং উসমানীরা ছয়শো বছর খেলাফত পরিচালনা করেছে। তারা নিয়মতান্ত্রিক ও ইসলামের স্বাভাবিক পদ্ধতিতে জনগণের সন্তুষ্টি ও বাইয়াতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। বরং বংশ পরম্পরায় বাপের পরে ছেলে এভাবে ক্ষমতায় ছিলেন। এটি ইসলামের স্বাভাবিক রীতি নয়। কিন্তু এরপরও ইসলাম বলে: তাদেরকে মেনে চলো, তাদের প্রতি অনুগত থাকো, তাদের জন্য দোয়া করো, তাদের সাথে মিলে জিহাদ করো, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরো না। বর্তমানে আমাদের যে মন্ত্র শিখানো হচ্ছে সে অনুযায়ী ইসলামের এই সোনালী শাসনগুলোকে আপনি স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদী শাসন ভাববেন এবং প্রশ্ন উঠাবেন। আজ যদিও বুঝতে পারছি না, কিন্তু এই মন্ত্র মনে গেঁথে যাবার পর একদিন ঠিকই ইসলামের ইতিহাস ও গৌরবের উপর আপত্তি উঠানো শুরু হবে।
অতএব, হে মুসলিম ভাই, সতর্ক থাকো। কাফের ও স্যাকুলাররা যে মন্ত্র, যে পরিভাষা আমাদের শিখায় অন্ধভাবে তা গিলে নিয়ো না। তারা কখনই আমাদের কল্যাণ চায় না। তারা তাদের আকীদা বিশ্বাস অনুযায়ী কথা বলে। তাদের বিশ্বাসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ইসলামী মূল্যবোধের বিবেচনায় কথা বলে না। সাবধান হে মুসলমান! এন্টি ফ্যাসিজম হতে গিয়ে গণতান্ত্রিক হয়ে পড়ো না। চমকপ্রদ পরিভাষার বিষে আক্রান্ত হয়ো না। সব কিছু সঠিক ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে শিখো। নতুবা প্রতারিত হবে।
***
Comment