শ্রমিকের শোষণ ও উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ:
একটি কাঠামোগত বৈষম্যের উদঘাটন
একটি কাঠামোগত বৈষম্যের উদঘাটন
শ্রমিকের শোষণ এবং উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ—এই দুটি বিষয় কেবল অর্থনৈতিক অনিয়ম নয়, বরং তা আধুনিক পুঁজিবাদী কর্পোরেট কাঠামোর কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণিকে এমন এক নব্যদাসত্বের কাঠামোয় আবদ্ধ করা হয়েছে, যা শুধুমাত্র তাদের আয়কে সংকুচিত করে না, বরং তাদের চিন্তাভাবনা, নৈতিকতা এবং ভবিষ্যতের ওপরও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। বিশেষত মুসলিম উম্মাহর শ্রমিকগণ—যারা বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন—তারা এই দ্বৈত প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সুস্পষ্ট ভুক্তভোগী।
আধুনিক কর্পোরেট ব্যবস্থায় শ্রমিক কেবল একজন কর্মী নয়; বরং সে একধরনের "দেহ-পরিসেবা" বা bodily commodity, যাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া করা হয় একটি পূর্বনির্ধারিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য। তার মানবিক পরিচয়—ধর্ম, নৈতিকতা, সংস্কৃতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট—সবকিছুই গৌণ হয়ে পড়ে উৎপাদন পরিমাপক যন্ত্রের কাছে। যেমন একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শ্রমিক জানেন না তিনি কোন ব্র্যান্ডের জন্য কাজ করছেন, তৈরি করা পোশাক কোথায় যাবে, কিংবা সেটি কত দামে বিক্রি হবে। তার ভূমিকা সীমাবদ্ধ কেবল সেলাই মেশিন চালনার মধ্যেই, অথচ সেই সেলাই করা পণ্য নিউ ইয়র্কের বিলাসবহুল দোকানে হাজার ডলারে বিক্রি হয়।
এই বিচ্ছিন্নতার দৃষ্টান্ত আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায়—একই শ্রমিক নিজের তৈরি পণ্য নিজের আয় দিয়ে কিনতে সক্ষম নন। এখানে স্পষ্ট হয় উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে, এবং কাদের নয়। পুঁজির মালিক, উদ্যোক্তা ও ম্যানেজমেন্ট—সবাই সিদ্ধান্তগ্রহণের কেন্দ্রে অবস্থান করে; অথচ শ্রমিক, যিনি উৎপাদনের ভিত্তি, তিনি কেবল একটি নির্বাক হাত। এই বাস্তবতা মার্কসবাদী ভাষায় "alienation" হলেও, ইসলামি দৃষ্টিকোণে এটি একটি ফিতরাত-বিরোধী শোষণব্যবস্থা, যেখানে শ্রমিক তার কাজের মর্যাদা ও তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে।
আমরা যদি আরও কিছু উদাহরণ দেখি:
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে একজন নারী শ্রমিক প্রতিদিন ১০–১২ ঘণ্টা কাজ করেও মাসে আয় করেন মাত্র ১০০–১২০ ডলার। অথচ তার বানানো একটি পোশাক একটি পশ্চিমা বিপণিতে ৮০–২০০ ডলারে বিক্রি হয়। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য কেবল মজুরির নয়; এটি সিদ্ধান্ত, মালিকানা ও উপকারভোগিতারও।
কাতার বা সৌদি আরবে নির্মাণ শ্রমিকদের উপরও একই রকম নিয়ন্ত্রণ দেখা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকেরা দীর্ঘ সময় কাজ করেন, অমানবিক পরিবেশে জীবনযাপন করেন, অথচ তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে থাকে কর্পোরেট ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান। তাদের অভিবাসন স্ট্যাটাস, বেতন, এমনকি শ্রমিক সংগঠন গঠনের অধিকারও নিয়ন্ত্রিত।
আফ্রিকায়, বিশেষত নাইজেরিয়া বা সুদানে, বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো স্থানীয় জনগণের শ্রম ব্যবহার করে বিপুল সম্পদ আহরণ করে, কিন্তু সেসব অঞ্চলে দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামো এবং পরিবেশ বিপর্যয় অব্যাহত থাকে।
এই উদাহরণগুলো দেখায়, শ্রমিক শুধু উৎপাদনের বাহক নয়, বরং "উৎপাদন-অধিকারচ্যুত" এক সত্তা, যাকে ব্যবহৃত করা হয়, কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে উৎপাদনের চারটি উপাদান হিসেবে বলা হয়:
ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও উদ্যোক্তা।
এখানে পুঁজির মালিক পায় সুদ বা মুনাফা, ভূমির মালিক পায় ভাড়া, উদ্যোক্তা পায় নিয়ন্ত্রণ ও লভ্যাংশ—কিন্তু শ্রমিক পায় কেবলমাত্র সময়ভিত্তিক আয়, যা প্রায় সর্বনিম্ন এবং সর্বাপেক্ষা অনিশ্চিত। তার আয়ের পরিমাণ, শর্ত, সুযোগ এবং সুরক্ষা—সবকিছুই অন্যের ইচ্ছাধীন। অথচ উৎপাদনের একটি মুহূর্তও শ্রমিকের দেহ ও মন ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে: এই ব্যবস্থায় শ্রমিক যদি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে কেন সে মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণে অংশ পায় না? উত্তর খুঁজতে গেলে বোঝা যায়, কর্পোরেট পুঁজিবাদ শোষণের এক কাঠামোগত সংস্করণ—যেখানে শ্রমিকের কোনো প্রতিরক্ষা নেই, কোনো জবাবদিহিতা নেই, এবং কোনো বিকল্প নেই। এই "চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব"—আইন দ্বারা বৈধ, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মান্য, এবং সামাজিকভাবে স্বাভাবিকীকৃত। এটি একটি পরিশীলিত পরাধীনতা, যেখানে স্বাধীনতার নামে মানুষকে অধীনস্থ রাখা হয়।
এই শোষণ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার জন্য কর্পোরেট ব্যবস্থা কেবল প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণেই থেমে থাকে না; বরং এটি ব্যবহার করে একাধিক পরোক্ষ ও কাঠামোগত উপকরণ—বিশেষত প্রযুক্তি, তথ্য প্রবাহে বৈষম্য, এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলের জটিলতা। আধুনিক কর্পোরেশন শ্রমিককে কেবল সস্তা মজুরিতে নিয়োগ দেয় না, বরং তার চারপাশে এমন এক জ্ঞান ও তথ্যের অন্ধকার রচনা করে, যার ফলে সে নিজ পরিশ্রমের প্রকৃতি, ফলাফল এবং তা থেকে সৃষ্ট সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে।
এই তথ্যগত অসমতা—information asymmetry—শ্রমিককে একটি বিভ্রান্ত অবস্থায় স্থাপন করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গার্মেন্টস শ্রমিক হয়তো বছরে হাজার হাজার জিন্স, টি-শার্ট কিংবা জ্যাকেট তৈরি করছে, কিন্তু সে জানেই না সেই পণ্য কোন দেশে যাবে, কোন ব্র্যান্ডের ট্যাগ লাগবে, বা কী দামে বিক্রি হবে। সে জানে না তার ঘাম ঝরানো কাজটি কাদের জন্য, কিসের স্বার্থে। তার সৃষ্টি কীভাবে তার নিজের সামাজিক অবস্থাকে বদলে দিচ্ছে, তার জীবনধারার সঙ্গে কী সাংঘর্ষিক বিপরীততার জন্ম দিচ্ছে—সেসব অজানাই থেকে যায়। এই অজ্ঞানতা নিছক ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা নয়; বরং এটি কাঠামোগতভাবে উৎপাদিত ও রক্ষিত।
এর ফলস্বরূপ শ্রমিক শুধু শারীরিকভাবে নিঃস্ব হন না; তিনি বৌদ্ধিক ও আত্মপরিচয়গতভাবেও দারিদ্র্যগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি তার শ্রমকে আর কোনো নৈতিক, দার্শনিক বা রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে চিন্তায় আনতে পারেন না। ফলে গড়ে ওঠে একধরনের "পদানুবর্তী বুদ্ধিবৃত্তিক পরাধীনতা"—intellectual subalternity—যেখানে শ্রমিক কেবল নিজের পরিশ্রমই নয়, নিজের চিন্তাকেও লিজ দিয়ে দেয় কর্পোরেট ব্যবস্থার কাছে।
কর্পোরেট উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের কৃত্রিম প্রতিযোগিতার মাঝে বন্দি করে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা হয়, যা তাদের মধ্যে সামূহিকতা বা collective agency ধ্বংস করে দেয়। এখানে শ্রমিকরা একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে, যার ফলে তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব তৈরি হয়। তারা নিজেদেরকে শুধুমাত্র আলাদা আলাদা কাজের কর্মী হিসেবেই চেনে, কখনোই সমষ্টিগত শ্রমজীবী রাজনৈতিক সত্তা বা সচেতন শ্রেণি হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। কর্পোরেশন এই বিচ্ছিন্নতা দীর্ঘস্থায়ী করতে অবলম্বন করে আউটসোর্সিং, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং বিচ্ছিন্ন শ্রম পরিবেশের কৌশল, যা শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়।
ফলশ্রুতিতে, মুসলিম উম্মাহর শ্রমিকশ্রেণি আজ একেবারে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল—এমন এক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে যেখানে তারা নিজেদেরকে উম্মাহর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও ভাবতে ভুলে গেছে। বরং কর্পোরেট লোগো, শিফটের সময়সূচী, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ও নিয়ম-কানুনই হয়ে উঠেছে তাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। অর্থাৎ, শ্রমিকের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয় বিস্মৃত হয়ে একমাত্র কর্পোরেট কাঠামোর শ্রমজীবী হিসেবে তাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
আধুনিক কর্পোরেট ব্যবস্থায় শুধু শ্রমিকশ্রেণী নয়, মধ্যবিত্ত বা মেডেল ক্লাসকেও এমন এক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয় যা তাদের চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতা এবং সামাজিক ঐক্যকে সীমিত করে দেয়। এই নিয়ন্ত্রণের প্রধান মাধ্যম হলো আধুনিক প্রযুক্তি, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি এবং কম্পিউটার সিস্টেম।
প্রথমত, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও বোঝার ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক জটিলতাগুলো বোঝার ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা হয়, তথ্য প্রবাহকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে মানুষ প্রয়োজনীয় ও গভীর জ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। ফলে তারা কেবল কর্পোরেট কাঠামোর নির্ধারিত নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে, নিজের স্বার্থ ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভাবার সুযোগ পায় না।
দ্বিতীয়ত, এই ব্যবস্থা মানুষকে একক ব্যক্তি বা ইন্ডিভিজুয়ালিটি হিসেবে বিভক্ত করে — অর্থাৎ তাদেরকে সামাজিক ও ঐতিহ্যগত সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে একক অবস্থানে নিয়ে আসে। এভাবে সামাজিক সংহতি ভেঙে পড়ে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সমবেদনা ও ঐক্যহীনতা বৃদ্ধি পায়।
এই দুটি প্রক্রিয়া একসঙ্গে কাজ করে মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গভীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ইসলামী সমাজের ভিত্তি ঐক্য, সহযোগিতা এবং সমবায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে সামাজিক বন্ধন এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্বশীলতা একান্ত প্রয়োজনীয়।
Comment