Announcement

Collapse
No announcement yet.

উম্মাহ ইনকর্পোরেটেড (৩য় পর্ব)

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • উম্মাহ ইনকর্পোরেটেড (৩য় পর্ব)

    নতুন ওরিয়েন্টালিজম:
    কর্পোরেট উপনিবেশে মুসলিম উম্মাহ

    এডওয়ার্ড সাঈদ (Edward Said) ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি-মার্কিন চিন্তাবিদ, সাহিত্য সমালোচক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার, যিনি আধুনিক পশ্চিমা জ্ঞানকাঠামো ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যের অন্তর্নিহিত মতাদর্শিক ভিত্তি উন্মোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ Orientalism (১৯৭৮) একটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

    Edward Said-এর Orientalism গ্রন্থে উপস্থাপিত তত্ত্ব অনুসারে, পশ্চিমা বিশ্ব “পূর্ব” বা “ওরিয়েন্ট”—বিশেষত মুসলিম সমাজ ও সভ্যতা—সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ও আদর্শায়িত জ্ঞানকাঠামো তৈরি করে যা কেবল সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে তুলে ধরতে ব্যবহৃত হয়নি, বরং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামরিক হস্তক্ষেপকে নৈতিকভাবে বৈধ করার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সাঈদ দেখান, কীভাবে পশ্চিমা সাহিত্য, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও সাংবাদিকতায় “পূর্ব” সর্বদা একটি রহস্যময়, দুর্বল, অক্ষম এবং নিজের কল্যাণ বুঝতে অক্ষম অবস্থা হিসেবে উপস্থাপিত হয়—যার ফলে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ স্বাভাবিক, এমনকি “উদ্ধারকারী” হিসেবে বৈধতা পায়।

    এই তত্ত্বকে আধুনিক কর্পোরেট–রাষ্ট্রীয় আঁতাতের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আজকের কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদও ঠিক একইরকম একটি "discursive project"—যেখানে বিশ্বব্যাংক, IMF, কর্পোরেট মিডিয়া ও বহুজাতিক কর্পোরেশনসমূহ তথাকথিত “গভর্ন্যান্স”, “উন্নয়ন”, এবং “সুশাসন”-এর নামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ নীতিতে হস্তক্ষেপ করে। Said-এর ভাষায়, এটি "knowledge in the service of power"—অর্থাৎ এক ধরনের জ্ঞান-উৎপাদন যা ক্ষমতার পক্ষেই ব্যবহৃত হয়, এবং শাসনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে।

    উদাহরণস্বরূপ, নাইজার বা ইরাকের মতো রাষ্ট্রে কর্পোরেট সম্পদদখলের বিরুদ্ধে জনসাধারণের যে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয়, তাকে যখন পশ্চিমা মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক সংস্থা “চরমপন্থা” বা “সন্ত্রাসবাদ” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে, তখন তারা আসলে একটি Said-উপস্থাপিত “orientalist binary”-কে পুনরুৎপাদন করছে: একদিকে “সভ্য”, “শৃঙ্খলাপরায়ণ” কর্পোরেট শক্তি; অপরদিকে “বন্য”, “বিক্ষিপ্ত”, “ধর্মান্ধ” স্থানীয় জনগণ। এই ফ্রেমিংয়ের মাধ্যমে পশ্চিমা কর্পোরেট হস্তক্ষেপ একটি “উন্নয়নমূলক” ও “মানবিক” কর্মকাণ্ড হিসেবে উপস্থাপিত হয়, অথচ বাস্তবে তা এক ধরনের কাঠামোগত শোষণ ও দখলদারিত্ব।

    এডওয়ার্ড সাঈদের কাজ এই আলোচনায় আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়: কর্পোরেট পুঁজিবাদ কেবল অস্ত্র বা অর্থনীতির মাধ্যমে নয়, বরং ভাষা, জ্ঞান, এবং চিত্রনির্মাণের মাধ্যমেও শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এটি “পূর্ব” জাতিগুলোর নিজস্ব রাজনৈতিক পরিপক্বতা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সাংস্কৃতিক সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, ফলে কর্পোরেট বা পশ্চিমা হস্তক্ষেপ অবধারিত মনে হয়।

    উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম উম্মাহ এই কর্পোরেট আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান ভুক্তভোগী। একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের তেল, গ্যাস, খনিজ, কৃষি ও জ্বালানিসম্পদ বহুজাতিক কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে তথাকথিত বিনিয়োগ, ঋণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে স্থানীয় সরকার ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও কর্পোরেট স্বার্থ নির্ধারক হয়ে উঠছে। ফলে সম্পদের উপর উম্মাহর সম্মিলিত অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে এবং স্থানীয় জনগণ ক্রমাগতভাবে নিজভূমে পরাধীনতার অনুরূপ এক বাস্তবতায় আটকে পড়ছে।

    এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে নীরব অথচ সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে, তা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিফলনও লক্ষণীয়। বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো যখন খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও মিডিয়া খাতে প্রবেশ করে, তখন তারা কেবল বাজার দখল করে না—তারা নীতিনির্ধারণ, জ্ঞান উৎপাদন ও মূল্যবোধের মানদণ্ডও নির্ধারণ করে ফেলে। এর ফলে মুসলিম সমাজে একপ্রকার মূল্যবোধগত অপচয় (Value Drain), আত্মপরিচয়ের সংকট এবং নৈতিক বৈপরীত্য সৃষ্টি হয়, যা ইসলামের মূল অর্থনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

    অতএব, আধুনিক কর্পোরেট ব্যবস্থা—যদিও একে ‘অগ্রগতি’ ও ‘উন্নয়ন’-এর ছদ্মবেশে উপস্থাপন করা হয়—আসলে মুসলিম উম্মাহর স্বাধিকার, সম্পদ ও নৈতিক ভিত্তির উপর এক জটিল, বহুমাত্রিক ও কাঠামোগত হুমকি হিসেবে কাজ করছে।

    (১)
    উনিশ ও বিংশ শতকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ মূলত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে সরাসরি রাজনৈতিক ও সামরিক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ এবং পর্তুগিজ উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ সময় মুসলিম বিশ্বকে মূলত একটি ‘ভৌগোলিক সম্পদভাণ্ডার’ হিসেবে বিবেচনা করে; যেখানে শাসনের উদ্দেশ্য ছিল শাসিত অঞ্চলের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদকে কেন্দ্রীভূতভাবে ইউরোপীয় পুঁজির সেবায় নিয়োজিত করা।

    ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জ—এই অঞ্চলগুলো ছিল একদিকে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরদিকে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর দৃষ্টিতে ছিল একপ্রকার “অপ্রয়োজনীয় স্বশাসন”-এর ধারক। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ভারত একসময় বৈশ্বিক উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখত; এঙ্গাস ম্যাডিসনের গবেষণা অনুযায়ী, ১৭০০ সালের দিকে ভারতের অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির প্রায় ২৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। উপনিবেশবাদী শাসন শেষ হওয়ার পর এই হার নেমে আসে মাত্র ৪ থেকে ৬ শতাংশে—যা অর্থনৈতিক নিপীড়নের একটি পরিসংখ্যানিক রূপান্তর নির্দেশ করে। এই পতনের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে ইউরোপীয় শাসকদের কাঠামোগত লুণ্ঠননীতি, যার মধ্যে ছিল কৃষিপণ্য ও শিল্পজাত সামগ্রীর একমুখী রপ্তানি, কর ও রাজস্বব্যবস্থার পুনর্গঠন, এবং স্থানীয় শিল্প ও স্বনির্ভরতার ধ্বংস।

    বিশ্ব অর্থনীতিতে এই দখলদারিত্বের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব সূচিত হয় ১৯৩০-এর দশকে, যখন মধ্যপ্রাচ্য ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তেলের বিপুল মজুদ আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কার বিশ্ব অর্থনীতির নতুন শক্তির উৎস নির্ধারণ করে এবং ফলস্বরূপ সৌদি আরব, ইরাক, ইরান ও কুয়েত দ্রুত ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই কৌশলগত মূল্যায়ন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে কোনো দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থরক্ষা করেনি; বরং পশ্চিমা কর্পোরেশন ও রাষ্ট্রসমূহ সামরিক জোট, অনুগত রাজতন্ত্র, এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অঞ্চলটির সম্পদকে নিজের দখলে আনতে শুরু করে। এই পর্বটি ছিল সরাসরি সামরিক উপনিবেশ থেকে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশবাদের এক সংক্রামক উত্তরণ।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, রাজনৈতিকভাবে ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর পতনের পরও, অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব রয়ে যায় কর্পোরেট পুঁজির হাতে। এটি ছিল এক প্রকার "ডি-কলোনাইজেশন উইথআউট ডিসএনট্যাংলমেন্ট"—অর্থাৎ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও অর্থনৈতিক শৃঙ্খল অটুট থাকে। এই সময় বহুজাতিক তেল কর্পোরেশনসমূহ, যেমন Standard Oil (পরবর্তীতে ExxonMobil), British Petroleum (BP), Royal Dutch Shell এবং Total—বিশ্ব রাজনীতিতে একপ্রকার কৌশলগত অভিনেতা হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত জোটকে পরবর্তীতে “Seven Sisters” নামে অভিহিত করা হয়, যারা ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ দশকের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার ও মূলধারাকে কার্যত একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করত।

    এই কর্পোরেশনগুলোর কর্মকৌশল ছিল আপাতদৃষ্টিতে ‘আইনি’, কিন্তু কার্যত শোষণাত্মক। তারা স্থানীয় রাজপরিবার, সামরিক শাসক বা পশ্চিমাপন্থী আমলাতন্ত্রের সঙ্গে ‘কনসেশন এগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তিসমূহের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কর্পোরেশনসমূহ প্রায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র সামান্য পরিমাণ রয়্যালটি বা কর আদায় করে, যা প্রায়শই জনগণের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়নি। এই কাঠামো উপনিবেশিক দখলের চেয়েও অনেকাংশে সূক্ষ্ম, কিন্তু অধিক কার্যকরী, কারণ এখানে আধিপত্য ছিল অদৃশ্য, এবং প্রতিরোধ দুরূহ।

    উল্লেখযোগ্য যে, এই কর্পোরেট একাধিপত্য কেবল প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার বা মুনাফা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি বিশ্বব্যাপী মূল্য নির্ধারণ, প্রযুক্তিগত প্রাধান্য, রাজনীতি প্রভাবিতকরণ, এবং সামাজিক চুক্তির ধরন পুনর্গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থা ও জনমত গঠনের নেপথ্যে কর্পোরেট স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা এক প্রকার কর্পোরেট-রাজনৈতিক সম্মিলন বা “corporate-state symbiosis” এর দিকে ইঙ্গিত করে।

    (২)
    আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় কর্পোরেট পুঁজির জোয়ার যে প্রকারে প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ এবং বিতরণ কাঠামোকে প্রভাবিত করছে, তা নিছক অর্থনৈতিক একটি প্রক্রিয়া নয়; বরং এটি বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর একটি কেন্দ্রমুখী উপাদান। মুসলিম বিশ্ব—বিশেষত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো—এই প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান ভুক্তভোগী। কর্পোরেট ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের ঘনিষ্ঠ মেলবন্ধনের ফলে অঞ্চলভিত্তিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ একদিকে যেমন বহুজাতিক কর্পোরেশনের নিকট সঙ্কুচিত হচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় জনগণ সম্পদের অধিকার থেকে ক্রমেই বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। এই শোষণ আজ যুদ্ধ, বিনিয়োগ, উন্নয়ন কিংবা নিরাপত্তার নামে ন্যায্যতা পায়।

    ২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন এর একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ আক্রমণকে শুরুতে অস্ত্রধারিত সন্ত্রাস ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নামে উপস্থাপন করা হলেও, বিশ্লেষকগণ একে মূলত তেলভিত্তিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী পর্যায়ে দেশটির তেল খাতের উপর মার্কিন ও ব্রিটিশ কর্পোরেশনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ExxonMobil, Shell এবং Halliburton-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ইরাকের জাতীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত মুনাফার উৎসে রূপান্তরিত করে—একটি রাষ্ট্রকে কার্যত কর্পোরেট শাসনের অধীনস্থ করে ফেলে।

    আফ্রিকার মুসলিম-প্রধান অঞ্চলগুলিও এই লুণ্ঠনমূলক কাঠামোর বাইরে নয়। নাইজার এবং মালি—যেখানে ফরাসি কর্পোরেশন Areva (বর্তমানে Orano) এবং Total দীর্ঘদিন যাবৎ ইউরেনিয়াম ও তেলের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে—সেখানে আজও বৃহৎ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করে, এবং বিদ্যুৎ সুবিধা প্রায় অনুপস্থিত। অথচ এই দেশগুলো থেকেই ইউরোপের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের জ্বালানি সরবরাহ হয়। এই বৈপরীত্য কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যের পরিচায়ক নয়, এটি একপ্রকার কাঠামোগত বৈশ্বিক বৈষম্য, যা ইতিহাসের উপনিবেশিক ধারাবাহিকতারই একটি নতুন রূপ।

    এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র খনিজ বা জ্বালানিসম্পদে সীমাবদ্ধ নেই; বরং কৃষি খাতেও কর্পোরেট আগ্রাসনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে—বিশ্ব অর্থনীতিতে যেটি land grabbing নামে পরিচিত। “Agro-Investment” বা কৃষিনিয়ন্ত্রিত বিদেশি বিনিয়োগের ছায়ায় আফ্রিকার সুদান, দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এবং পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ার বিশাল অংশজুড়ে কৃষিভূমি এখন বিদেশি কোম্পানি, সৌদি ও চীনা কনসোর্টিয়াম এবং কর্পোরেট চুক্তির আওতায় চলে গেছে। এই ভূমি হস্তান্তরের ফলে স্থানীয় কৃষক কেবল ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়নি, বরং তারা নিজেদের পূর্বপুরুষের জমিতে দিনমজুরে পরিণত হয়েছে। এর পরিণতিতে খাদ্য উৎপাদনের আত্মনির্ভরতা হ্রাস পাচ্ছে, এবং খাদ্য নিরাপত্তা আজ আন্তর্জাতিক বাজারের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

    এই শোষণ কাঠামো যদি সংখ্যায় পরিমাপ করা হয়, তবে তার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। ইরাক থেকে বার্ষিক তেল রপ্তানি থেকে কর্পোরেট নিট মুনাফার পরিমাণ $১০০ বিলিয়নেরও বেশি, অথচ দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি চিহ্নিত হয় দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উচ্চমাত্রার বেকারত্ব দ্বারা। নাইজারের ইউরেনিয়াম খাত থেকে ফরাসি কোম্পানিগুলোর বার্ষিক লাভ $১.৫ বিলিয়নের বেশি হলেও সিংহভাগ জনগণ বিদ্যুৎবিহীন জীবনযাপন করছে। সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি Aramco আংশিক বেসরকারিকরণের মাধ্যমে প্রতিবছর $১৬১ বিলিয়ন পর্যন্ত লাভ করে, কিন্তু সেই লাভের বহুমাত্রিক উপযোগ রাষ্ট্রীয় রাজতন্ত্রের বিলাস ও অস্ত্র বাণিজ্যে ব্যয় হয়, জনকল্যাণে নয়। সুদানে খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্যের বিপুল রপ্তানি আয় বিদেশি কর্পোরেট ও মুনাফাভোগী রাজনীতিকদের পকেটে ঢোকে, অথচ স্থানীয় জনগণই খাদ্য সংকটে ভোগে।

    এই বাস্তবতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, মুসলিম বিশ্ব আজ যে অর্থনৈতিক কাঠামোর অধীনে রয়েছে, তা মূলত আর্থ-রাজনৈতিক পরগত্যার এক পুনরুৎপাদন। কর্পোরেট ব্যবস্থা এখানে শুধু অর্থনৈতিক একটি শক্তি নয়, বরং একেবারে অস্তিত্বগত পর্যায়ে গিয়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বাধিকার, স্বাধীন সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে।

    (৩)
    আধুনিক কর্পোরেট পুঁজিবাদের কার্যকর বিস্তার কেবল বাজারের সম্প্রসারণ কিংবা পণ্যের বৈশ্বিক প্রবাহের উপর নির্ভর করে না; বরং তার ভিত্তি নির্মিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতার কাঠামোর সাথে একধরনের কৌশলগত আঁতাতের মাধ্যমে। এই আঁতাতের ফলে রাষ্ট্র নিজের প্রথাগত সামাজিক দায়িত্ব ও সার্বভৌম কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয় এক অলক্ষ্য, অথচ পরাক্রমশালী কর্পোরেট এজেন্ডার হাতে।

    বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান—বিশেষত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)—এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় নিয়ামক। তারা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ওপর এমন সব অর্থনৈতিক সংস্কারের শর্ত চাপিয়ে দেয় যা "স্থিতিশীলতা", "উন্নয়ন", কিংবা "আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা"-র নামে আসলে কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। বেসরকারিকরণ (Privatization), উদারীকরণ (Liberalization) এবং অর্থনৈতিক খোলামেলা নীতি (Open Investment Climate)—এই নীতিমালার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন সম্পদ, বিশেষত খনিজ ও শক্তি খাত, বহুজাতিক কর্পোরেশনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এর ফলে মুসলিম বিশ্বে প্রাকৃতিক সম্পদ—যেমন তেল, গ্যাস, খনিজ ও কৃষি জমি—স্থানীয় জনগণের অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুঁজির বহুজাতিক মালিকানায় রূপান্তরিত হয়।

    উদাহরণস্বরূপ, তেল সমৃদ্ধ অনেক রাষ্ট্রে, বহুজাতিক কর্পোরেশনসমূহ Production Sharing Agreements (PSA) নামে পরিচিত এমনসব চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ আহরণের অধিকাংশ মুনাফা আত্মসাৎ করে। এই চুক্তিগুলোতে কর্পোরেট অংশীদাররা প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার নাম করে মূল নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, আর সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ভাগ থাকে নামমাত্র—যা প্রান্তিক জনগণের জীবনমানের কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়।

    এই কর্পোরেট আধিপত্যকে নৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করার জন্য দ্বিতীয় যে কৌশলটি ব্যবহার করা হয়, তা হলো তথাকথিত “good governance”, “transparency”, এবং “rule of law”–এর ভাষায় সাজানো আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। উন্নয়ন সহায়তার শর্ত হিসেবে আরোপিত এই ধারণাগুলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বা প্রযুক্তিগত দক্ষতার মুখোশ পরিধান করলেও বাস্তবে এগুলো স্থানীয় জনগণের উপর কর্পোরেট স্বার্থে অনুগত ও দমনমূলক রাষ্ট্রীয় নীতির প্রয়োগ ঘটায়। রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করা হয় শ্রম বাজার উদার করতে, কর হ্রাস করতে, এবং কর্পোরেট বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে—যা সরাসরি বহুজাতিক পুঁজির জন্য একটি নির্বিঘ্ন প্রবেশপথ তৈরি করে।

    আরও উদ্বেগজনক হলো, যখন এই শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদে সরব হয়, তখন তাদের আন্দোলনকে প্রায়শই “চরমপন্থা”, “উগ্রবাদ” বা “সন্ত্রাসবাদ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নাইজার, ইয়েমেন, কিংবা ইরাকে, যেখানে কর্পোরেট স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নিয়মিত ঘটনা, সেখানে জনঅসন্তোষকে দমন করতে নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে ব্যবহার করা হয় এক প্রকার “নৈতিক বৈধতা”র হাতিয়ার হিসেবে। এভাবে কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক প্রতিবাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোকে হ্রাস করে একটি ভয়ের রাজনীতির নির্মাণ ঘটানো হয়।

    তৃতীয় স্তরে, এই আধিপত্যকে মানবিক রূপ দেওয়ার জন্য কর্পোরেট বিশ্ব Corporate Social Responsibility (CSR) নামক এক জনসংযোগ কৌশল প্রয়োগ করে। স্কুল নির্মাণ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ সচেতনতা ক্যাম্পেইন—এসব কার্যক্রমকে কর্পোরেশনগুলো তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে উপস্থাপন করলেও, প্রকৃতপক্ষে তা একধরনের “মানবিক মুখোশ” যা পুঁজিবাদী শোষণের বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে। এর মাধ্যমে কর্পোরেশনসমূহ কেবল নিজেদের ভাবমূর্তি সংরক্ষণ করে না, বরং স্থানীয় জনগণের মনে একপ্রকার কৃতজ্ঞতা বা নির্ভরতার অনুভূতি তৈরি করে—যা শোষণকে নরমভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়।

    এই পুরো কাঠামোকে সহায়ক ভূমিকা দেয় মূলধারার গণমাধ্যম। কর্পোরেট মালিকানাধীন বা কর্পোরেট বিজ্ঞাপন-নির্ভর মিডিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেক সময়ই কর্পোরেট স্বার্থের পরিপন্থী সংবাদ প্রকাশে বিরত থাকে, অথবা তা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। পুঁজির নিয়ন্ত্রিত তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে একটি মনগড়া বাস্তবতা তৈরি করা হয়, যেখানে শোষককে ‘উন্নয়নদাতা’ এবং প্রতিবাদীকে ‘অরাজক’ রূপে চিত্রিত করা হয়। এভাবে কর্পোরেট মিডিয়া পরিণত হয় এক প্রকার বিনির্মাণকৃত চেতনানির্মাণের (manufactured consent) মেশিনে।

    এই প্রক্রিয়াটি আজ একাধারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক—যার ফলে মুসলিম বিশ্ব কেবল শারীরিক সম্পদ নয়, বরং আত্মপরিচয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও হারিয়ে ফেলছে। এই শোষণের কাঠামো সরাসরি আগ্রাসী না হলেও, এটি তার চেয়েও গভীরতর, কারণ এটি রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থকে একীভূত করে একটি নতুন প্রভুত্বমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে—যা আগ্রাসনের বদলে সহযোগিতার নামে, দখলের বদলে উন্নয়নের নামে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।

    এডওয়ার্ড সাঈদ-এর দৃষ্টিতে, এই জ্ঞান-ভিত্তিক আধিপত্য শুধুমাত্র তথ্য বা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, বরং প্রয়োজন এক counter-discourse—একটি বিকল্প জ্ঞান কাঠামো, যা উম্মাহর ইতিহাস, আত্মপরিচয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবিকে ন্যায়সঙ্গতভাবে উপস্থাপন করে।

    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ

  • #2
    মুহতারাম Ibnul Irfan ভাই, সম্ভব হলে আরেকটু সহজবোধ্য করে লিখার অনুরোধ রইল, জাযাকাল্লাহ খাইরান
    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment


    • #3
      যতদিন আমরা ভোগবাদী মানসিকতা পরিহার করতে না পারবো,
      ততদিন গোলামীর জিঞ্জির আমাদের ঘাড়ে বাধাই থাকবে।


      وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِۦٓ أَزْوَٰجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِۚ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ

      তুমি পার্থিব জীবনের ওই চাকচিক্যের দিকে চোখ তুলে তাকিও না, যা আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন শ্রেণীকে মজা লোটার জন্য দিয়ে রেখেছি, তা দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। বস্তুত তোমার রব্বের রিযক সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী।
      - সূরা ত্বহা, আয়াত ১৩১


      كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ ٱلْمَوْتِۗ وَنَبْلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلْخَيْرِ فِتْنَةًۖ وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ

      প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আর ভাল ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।
      - সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৩৫

      Comment


      • #4
        মাশা আল্লাহ, অনেক সুন্দর লেখা। আল্লাহ তা’আলা আপনার লেখায় বারাকাহ দান করুন, আমীন।

        Comment

        Working...
        X