Announcement

Collapse
No announcement yet.

উম্মাহ ইনকর্পোরেটেড (৪থ পর্বের ১ম খন্ড)

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • উম্মাহ ইনকর্পোরেটেড (৪থ পর্বের ১ম খন্ড)

    কর্পোরেট ও গণতান্ত্রিক
    আঁতাতের গল্প

    গণতন্ত্রের প্রচলিত সংজ্ঞা—“জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের সরকার”—শুনতে যতই মনোহর হোক, আজকের বাস্তবতায় এটি পশ্চিমা রাজনৈতিক অলঙ্কারের সাজসজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংজ্ঞাটি মূলত পশ্চিমারা নিজেদের জন্য বানিয়েছে—তাদের সামাজিক বাস্তবতা, শ্রেণিচরিত্র ও ক্ষমতার ভারসাম্য অনুযায়ী। কিন্তু তারা এটিকে উপস্থাপন করেছে এক সর্বজনীন আদর্শ হিসেবে, যেন এটি সমগ্র মানবজাতির মুক্তির পথ। অথচ বাস্তবতা হলো, বর্তমান সময়ের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলো প্রায়শই রূপান্তরিত হয়েছে এমন এক প্রক্রিয়ায় যেখানে জনগণের সিদ্ধান্ত মুখ্য নয়, বরং পুঁজির স্রোত, কর্পোরেট স্বার্থ ও নির্বাচনী দানকারীদের হুকুমই সর্বেসর্বা। এই ব্যবস্থাকে বলা হয় "corporatocracy"—এটি গণতন্ত্রের এমন এক বিকৃত রূপ, যেখানে নির্বাচন থাকে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয় বড় কর্পোরেট সংস্থা ও ধনকুবেরেরা; যেখানে ভোটারের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে দাতারা, অর্থাৎ সেইসব কর্পোরেট লবিস্ট যারা রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন করে, প্রচারণা চালায় এবং নীতিনির্ধারণের প্রতিটি স্তরে অদৃশ্যভাবে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখে।

    এই কর্পোরেট-গণতান্ত্রিক আঁতাতের ঐতিহাসিক শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত। আধুনিক কর্পোরেট সত্ত্বার সূচনা হয় East India Company-র মাধ্যমে। ১৬০০ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেয়ে এই কোম্পানিটি শুধু একটি ব্যবসায়িক সংস্থা ছিল না, বরং একপ্রকার আধা-রাষ্ট্র। এর নিজস্ব সেনাবাহিনী ছিল, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করত, এমনকি যুদ্ধ করত, চুক্তি করত এবং কর আদায় করত। এটি ইতিহাসের প্রথম কর্পোরেট সত্তা যা রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, কর্পোরেট ক্ষমতা যখন রাষ্ট্রীয় বৈধতা পায়, তখন সেটি জনগণের সরকার নয়, বরং এক প্রকার বেসরকারি সাম্রাজ্যিকতা বা private imperialism-এ রূপ নেয়।

    এই ধারার বিস্তার ঘটে ১৮শ শতাব্দীতে, যখন ব্রিটেনে joint-stock companies গড়ে ওঠে। ব্যবসায়িক স্বার্থ এখন আর কেবল বাজারে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সংসদে, রাণীর দরবারে, এমনকি উপনিবেশগুলোর শাসনব্যবস্থাতেও প্রবেশ করে। বাণিজ্যের ছায়ায় রাজনীতি গড়ে উঠতে থাকে, এবং অর্থনৈতিক প্রভাব রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে রূপান্তরিত হয়।

    এই কর্পোরেট-রাজনৈতিক আঁতাত আমেরিকায় আরও পরিশীলিত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক রূপ পায়। ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Santa Clara County v. Southern Pacific Railroad মামলায় সুপ্রিম কোর্ট কার্যত কর্পোরেশনকে "ব্যক্তি" (legal personhood) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে, কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (freedom of speech) এবং রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ ব্যয় করার অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যেটি কর্পোরেটদের হাতে নির্বাচনী রাজনীতি এবং জনমত প্রভাবিত করার এক ধরনের বৈধ লাইসেন্স তুলে দেয়। অর্থাৎ, এখান থেকে পুঁজির রাজনীতি একটি আইনি আশ্রয় লাভ করে—এটি এখন আর ছায়া-রাজনীতি নয়, বরং প্রতিষ্ঠিত ও আদালত স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি।

    এই শক্তিকে সংগঠিত রূপ দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি Lewis Powell, যিনি ১৯৭১ সালে “Powell Memo” নামে পরিচিত একটি দলিল রচনা করেন। এই মেমোর মাধ্যমে তিনি আমেরিকার বৃহৎ ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানান—তারা যেন রাজনীতি, শিক্ষা, মিডিয়া ও আইনব্যবস্থায় সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে কর্পোরেট পুঁজির প্রভাব প্রতিষ্ঠা করে। এটি কোনো সাধারণ প্রস্তাবনা ছিল না, বরং কর্পোরেট শ্রেণির জন্য একটি রণকৌশল। এই মেমোরই ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে Chamber of Commerce-এর মতো কর্পোরেট অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, PAC ও Super PAC-এর মতো রাজনৈতিক অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান, এবং কর্পোরেট-সমর্থিত থিঙ্কট্যাংক ও মিডিয়া নেটওয়ার্ক, যারা রাষ্ট্র ও সমাজের চেতনার উপর কর্পোরেট আদর্শ চাপিয়ে দিতে থাকে।

    এইভাবে কর্পোরেশন হয়ে ওঠে আধুনিক গণতন্ত্রের অদৃশ্য পরিচালক। তারা আইনের ছায়ায়, মিডিয়ার মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে এবং নির্বাচনী প্রচারণার ব্যানারে এমনভাবে নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে যে, সাধারণ জনগণও বুঝতে পারে না যে তাদেরই ভোটে নির্বাচিত সরকার এখন আর তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে না—বরং কর্পোরেট স্বার্থের বাহক হয়ে উঠেছে।

    সুতরাং, আমরা আজ যে গণতন্ত্র দেখি, তা আসলে গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার সঙ্গে প্রবলভাবে সাংঘর্ষিক। এটি এমন এক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণের মাধ্যমে অর্জিত হলেও, সেটি রূপান্তরিত হয় কর্পোরেট কৌশল, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক চাপের অধীন এক নির্বাচিত অথচ অনির্বাচিত শাসনব্যবস্থায়।

    কর্পোরেট ও গণতান্ত্রিক আঁতাতের ইতিহাস

    কর্পোরেট ও গণতান্ত্রিক আঁতাতের ইতিহাস একদিনে গড়ে ওঠেনি। এটি বহু শতকের এক অন্তঃসলিলা প্রক্রিয়া, যেখানে ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে এক অদৃশ্য কিন্তু দৃঢ় জোট গড়ে ওঠে। এর গোড়াপত্তন ঘটে ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে, ষোড়শ শতকের শেষদিকে। East India Company, যা ১৬০০ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনের চার্টারে প্রতিষ্ঠিত হয়, ছিল আধুনিক ইতিহাসের প্রথম কর্পোরেট সত্তা—কিন্তু কেবল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি ছিল কার্যত একটি “কোম্পানি-রাষ্ট্র”। তার নিজস্ব সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কূটনৈতিক প্রতিনিধি, এমনকি যুদ্ধ ঘোষণা ও চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষমতাও ছিল। এটি কর্পোরেশনের এমন এক ভয়াবহ রূপ, যেখানে পুঁজির হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কার্যত হস্তান্তরিত হয়েছিল। বাণিজ্যের আড়ালে এটি তৈরি করেছিল উপনিবেশবাদী শাসনের এক নতুন ধরণ—নির্বাচিত রাষ্ট্রনেতা নয়, বরং শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফার স্বার্থে গড়ে ওঠা শাসন।

    এই মডেল ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় এবং বিশেষ করে joint-stock companies-এর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। ১৮শ শতকে, ব্রিটেনে যখন শিল্পবিপ্লবের জোয়ার উঠছে, তখন এসব কোম্পানি শুধু বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেই ক্ষান্ত হয়নি—তারা সংসদের সিদ্ধান্ত, নীতিনির্ধারক আমলাদের নিয়োগ ও আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াকেও তাদের প্রভাবের আওতায় নিয়ে আসে। ব্যবসা ও রাজনীতির মধ্যে যে দেয়াল থাকার কথা ছিল, তা আস্তে আস্তে গলতে শুরু করে; অর্থনীতি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অস্ত্র, এবং রাজনীতি পরিণত হয় পুঁজির রক্ষাকবচে।

    এই প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপটি দৃশ্যমান হয় আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের পরিচয় দেয় গণতন্ত্রের মানচিত্র হিসেবে, কিন্তু সেই গণতন্ত্রের ভেতরেই কর্পোরেট ক্ষমতার একটি সাংবিধানিক ভিত্তি তৈরি হয় ১৮৮৬ সালের এক বিচারিক রায়ে। Santa Clara County v. Southern Pacific Railroad মামলায় মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কার্যত কর্পোরেশনকে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেয়। ফলে, কর্পোরেট সংস্থাগুলো speech ও donation-এর ক্ষেত্রে ব্যক্তি-অধিকার লাভ করে। এটা ছিল একটি যুগান্তকারী মোড়—যেখানে কর্পোরেট সংস্থাগুলো নির্বাচনী রাজনীতিতে অর্থ ঢেলে দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার পায়। নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অর্থ এখন শুধু সহায়ক নয়, বরং নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়।

    এই পরিবর্তনের কৌশলগত দিক উন্মোচিত হয় ১৯৭১ সালে, যখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি Lewis Powell গোপনে একটি স্মারকলিপি রচনা করেন, যা পরে “Powell Memo” নামে পরিচিত হয়। এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট নেতাদের উদ্দেশে বলেন—রাজনীতি, শিক্ষা, মিডিয়া এবং আইনব্যবস্থা—এই চারটি স্তম্ভকে কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গির অধীনে আনতে হবে। Powell-এর এই মেমোতে কর্পোরেট শ্রেণিকে আহ্বান জানানো হয় যেন তারা “নেতৃত্ব পুনর্দখল করে”, এবং সমাজের ভাবাদর্শগত কাঠামোকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলে। এটি একটি আদর্শিক যুদ্ধের ডাক, যেখানে কর্পোরেট পুঁজির জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে—বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ।

    এর পরের ইতিহাস মূলত এই মেমোর রূপরেখা অনুসরণ করেই এগোয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো থিঙ্ক ট্যাংক তৈরি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা তহবিল দেয়, মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন খরচের নামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্বাচনী প্রার্থীদের অর্থায়নের মাধ্যমে রাজনীতিকে কার্যত বন্দি করে রাখে। গণতন্ত্র তখন আর জনগণের সরকার নয়—বরং কর্পোরেট মুনাফার স্বার্থে পরিচালিত এক ব্যবস্থাপনা কাঠামো, যেখানে ভোট একটি ইভেন্ট মাত্র, আর সিদ্ধান্ত চলে কর্পোরেট বোর্ডরুম থেকে।​
    فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ انۡتَظِرۡ اِنَّهُمۡ مُّنۡتَظِرُوۡنَ
Working...
X